খাদ্যের রেকর্ড দামকে আরো ভয়াবহ পরিণতির দিকে নেবে ইউক্রেন যুদ্ধ
হোক সে জ্বালানি, শিল্পের কাঁচামাল, সার বা অন্যান্য পণ্য—ইউক্রেন দখলে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রয়োজনীয় সব পণ্য বাজারকে জোর ঝাঁকুনি দিয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কার পর সামনে আসন্ন এক সংকটের ছায়া-যা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে অনাহারে রাখবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পৃথিবীর অন্যতম উর্বর জমি আছে কৃষ্ণসাগর সংলগ্ন অঞ্চলে- ইউক্রেন ও রাশিয়ায়। অথচ যুদ্ধের কারণে পশ্চিমারা রাশিয়াকে বিশ্ববাণিজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার সব রকম উদ্যোগ নিচ্ছে। এতে গম, ভেজিটেবল ওয়েল,ভূট্টার সরবরাহ বাণিজ্যকে টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। এমনকি শস্য উৎপাদনের জন্য সার সরবরাহও বন্ধের হুমকিতে। সরবরাহ মূল উৎসেই সংকোচনের শিকার হওয়ায় দিনে দিনে পণ্যগুলির দাম বেড়েই চলেছে।
এদিকে জাতিসংঘের তথ্যমতে, 'বিশ্বের রুটির ঝুড়ি'খ্যাত ওই অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় গত মাসেই রেকর্ড অবস্থানে পৌঁছে গেছে বৈশ্বিক খাদ্য পণ্যের দর।
খাদ্যে এই নাটকীয় মূল্য বৃদ্ধির সূচনা করে আবার জ্বালানি সংকট, পণ্য পরিবহন ও বিমার ঊর্ধ্বমুখী খরচ। যুদ্ধের কারণে ফসল সংগ্রহে বাঁধাও তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এ ঘটনাগুলি এখন সুপারমার্কেটের তাকগুলোতেও প্রভাব ফেলছে,অনেক মানুষের জন্য খাদ্যপণ্য হয়ে উঠছে আরো দুষ্প্রাপ্য, আরো দামি। যেমন গেল সপ্তাহজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় কৃষিপণ্যের স্টক লেনদেনে গমের মূল্য ৪০ শতাংশের নাটকীয় হারে বেড়েছে।
নিত্যপণ্যের বাজার তথ্য পরিবেশক-মিনটেক লিমিটেডের কমোডিটি ইন্টেলিজেন্স ম্যানেজার তোশিন জ্যাক বলেন, "গমের মতো কিছু পণ্যের যোগান সীমিত। তাছাড়া, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে- কেবল বাজারে পণ্য থাকাই যথেষ্ট নয়, ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।"
নিচের চার্টে খাদ্য বাজার কতোটা অস্থিতিশীলতা এবং আরো কতোটা মারাত্নক অবনতি হতে পারে তা তুলে ধরা হয়েছে:
কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার আগেই জাতিসংঘের খাদ্যপণ্যের সারণী ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায়। যুদ্ধ তাকে দিয়েছে শোচনীয় হাল।
ব্যাখ্যা করে বলেন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলি: "ইউক্রেনে ছোড়া প্রতিটি গুলি ও বোমা বৈশ্বিক খাদ্যাভাবের সংকটকে এমন মাত্রায় পৌঁছে দেবে যা আমরা আগে কখনো দেখিনি।"
গেল সপ্তাহে দানাদার শস্যের আন্তর্জাতিক বাজার এমন উচ্চতায় উপনীত হয়, যে দিকে তাকালে যে কারো মাথা ঘুরে যেতে বাধ্য। শুধু গমের দামই ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছেছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া বিশ্ববাজারের এক-চতুর্থাংশ গম সরবরাহক। তাদের অনুপস্থিতিতে আমদানিকারকদের অন্য উৎসের সন্ধানে দিশেহারা হয়ে ছুটতে বাধ্য করছে।
কিন্তু জ্যাক বলেছেন, "অন্য উৎসগুলো বৈশ্বিক চাহিদা মেটানোর মতো যথেষ্ট সরবরাহ করতে পারবে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যের দাম বাড়তেই থাকবে।"
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈশ্বিক দানাদার শস্য মজুদও পড়তির দিকে থাকার ঘটনা লক্ষ করা গেছে। ফলে যুদ্ধের অশুভ আঘাত সামলে নিয়ে এমন মজুদ ভোক্তাদের কতটুকু রক্ষা করতে পারবে- তা নিয়েও সন্দিহান বিশ্লেষকরা।
যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের চাষিরা চলতি বছরের বসন্তেও জমি আবাদ করতে পারবেন না। তার সঙ্গে বাণিজ্যের বিচ্ছিন্নতা আমদানিকে আরো ব্যয়বহুল করে তুলবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম ক্রেতা হলো মিশর। খাদ্যের সংকট সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে, ঠিক যেমনটা দেখা গেছে এক দশক আগের 'আরব বসন্তে'র সময়ে। এর পেছনেও প্রধান কারণ ছিল খাদ্যের মতো নিত্যপণ্যের সাধ্যাতীত বাজারমূল্য। অরাজকতা এড়াতে মিশর সরকার হয়তো এক দশক পর এবার রুটিতে ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বিশ্বব্যাপী অনেক দেশের সরকারকেই হয়তো এপথে হাঁটতে হবে। তারপরও, কোটি কোটি প্রান্তিক মানুষের দুর্দশা এবার অনাহারে রূপ নেওয়ারই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিসলি বলেন, "এই সংকট কেবল ইউক্রেনের ভেতরে নয়। এর আঘাত আসছে সরবরাহ চক্রে, আর বিশেষত খাদ্যের দামে।"
- সূত্র: ব্লুমবার্গ