যে ৬ বিষয় থেকে বুঝবেন রাশিয়া-চীন জোট ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ মূলত রাশিয়া-চীন জোটের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধের সূচক।
তবে, নতুন এই স্নায়ুযুদ্ধ পুরানো যুদ্ধের চেয়ে বেশ আলাদা। অতীতের স্নায়ুযুদ্ধের মূলে ছিল কমিউনিজম বনাম গণতন্ত্র, অর্থাৎ তা ছিল আদর্শভিত্তিক যুদ্ধ। কিন্তু নতুন যুদ্ধের মূলে রয়েছে বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থাৎ স্বাধীনতা বনাম কর্তৃত্ববাদ।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভস্ম থেকেই জন্ম হয় স্নায়ুযুদ্ধের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ অংশ দখল করে নেওয়ার পাশাপাশি একটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তা হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে আমাদের বিধ্বংসী বোমা হামলার স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে।
একটি সোভিয়েত আক্রমণ এবং পারমাণবিক ধ্বংসের স্নায়ুযুদ্ধের ভয় আমাদের ঘরের ও বাইরের জগতকে বদলে দেয়। সেসময় প্রায় প্রতি বাড়িতেই পেছনের দিকের উঠোনে তৈরি করা হয় আশ্রয়কেন্দ্র।
এমনকি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে কি সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন, সেই বিষয়ক শিক্ষামূলক চলচ্চিত্রও প্রচার করে সরকার। কমিউনিস্টদের নিয়ে সরকারের কঠোর সতর্কবার্তার ফলে প্রতিবেশীদের সহানুভূতি নিয়েও সন্দেহ জেগেছিল আমাদের মনে।
১৯৬২ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠালে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা চরমে পৌঁছায়। সেসময় কিউবামুখী রুশ জাহাজ অবরোধ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি।
এমনকি অস্ত্র প্রতিযোগিতা আমাদের মহাকাশ কর্মসূচির সঙ্গেও যুক্ত ছিল। ১৯৬১ সালে সোভিয়েতরা ইউরি গ্যাগারিনকে কক্ষপথে পাঠায়। ঐতিহাসিক সেই অভিযানে পুরো বিশ্ব হতবাক হলেও মার্কিনদের উদ্বেগ ছিল অন্য জায়গায়। রাশিয়ানরা মহাকাশকে সামরিকীকরণ করবে- এমন উদ্বেগের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও মহাকাশ কর্মসূচি ত্বরান্বিত করে।
তবে সৌভাগ্যবশত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া কখনও সরাসরি একে অন্যের সাথে যুদ্ধ করেনি। কিন্তু এই পুরো সময় জুড়েই কোরিয়া, ভিয়েতনাম, অ্যাঙ্গোলা, কম্বোডিয়া এবং কঙ্গোতে তাদের প্রক্সি যুদ্ধ চলে।
অবশেষে, ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগান স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটাতে নেতৃত্ব দেওয়ার অদম্য দৃঢ়তা এবং স্পষ্টতা প্রদর্শন করেন। সবচেয়ে বড় কথা, রিগ্যান জানতেন যে মস্কোর প্রতি যে কোনো ধরনের শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতির প্রয়োগ আদতে একটি নির্মম শত্রুকে সাহায্য করার মতোই।
আজ গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের একজোট হওয়ার মাধ্যমে একটি নতুন অস্তিত্বের সংঘাত বিশ্বকে হুমকি দিচ্ছে। গত মাসে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন বেইজিংয়ে আলোচনায় বসেন। সেখানে তারা যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেন, তাকে প্রাক্তন মার্কিন সিনেটর জো লিবারম্যান 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আদর্শিক এবং ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধের ঘোষণা' হিসেবে ব্যক্ত করেছেন।
নতুন স্নায়ুযুদ্ধের অন্তত ৬টি সূচক রয়েছে, যা আমি আমার বই 'এলায়েন্স অফ ইভিল' (২০১৮) এ উল্লেখ করেছি। এই সূচকগুলোর সাথে চীন এবং রাশিয়ার সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণের বেশ মিল লক্ষ্য করা যায়।
কূটনৈতিক সূচক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়া ও চীন উভয়েরই সম্পর্ক ইতিবাচক নয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রাক্তন রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেন, ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মস্কো সব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে।
বিশ্ব শৃঙ্খলা সূচক
অনেক পশ্চিমা নেতাই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, চীন এবং রাশিয়া তাদের নিজেদের নিয়ম দিয়ে বিদ্যমান 'আন্তর্জাতিক নিয়ম প্রতিস্থাপন' করতে চাইছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পরিবর্তনের জন্য মস্কোকে একটি প্রচেষ্টা হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, "রাশিয়া এবং চীন বিদ্যমান আন্তর্জাতিক নিয়ম প্রতিস্থাপন' করতে চায়। তারা আইনের শাসনের চেয়ে শক্তির শাসনকে পছন্দ করে। আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে ভয় দেখানো বেছে নিতে চায় তারা।"
অর্থনৈতিক সূচক
রাশিয়া ও চীন উভয়ই অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্য চুক্তি অমান্যকারী দেশ।
বিশ্বে শিল্প পণ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী উৎপাদক হিসেবে স্বীকৃতি চাওয়া চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনেক নিয়মই লঙ্ঘন করে।
ব্রিটিশ এম সিক্সটিন প্রধান রিচার্ড মুরের মতে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' মূলত একটি 'ঋণের ফাঁদ'। অর্ধ-নির্মিত সেতু, অতিরিক্ত বাজেটের রেলপথ এবং ঋণের পাহাড় তৈরিকে এই ইনিশিয়েটিভের ফলাফল হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।
প্রতিরক্ষা বাজেট সূচক
রাশিয়া এবং চীন উভয়ই তাদের মোট ডমেস্টিক উৎপাদনের বেশিরভাগই ব্যয় করে প্রতিরক্ষা খাতে। পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা বিনিয়োগের অনেক হিসাবই রয়েছে বিশ্ব থেকে লুকানো।
আইএইচএস জেনসের মতে, গত তিন দশকে চীনা প্রতিরক্ষা ব্যয় নাটকীয়ভাবে প্রতি বছর ১৫.৮ শতাংশ হারে বেড়েছে; গত এক দশকে তা বেড়েছে ২৫০ শতাংশেরও বেশি। পেন্টাগনের মতে, চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট তাদের জিডিপির ২.৫ শতাংশ।
অত্যাধুনিক সামরিক সূচক
বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে রাশিয়া এবং চীন উভয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বড় এবং অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনী গড়ে তুলছে।
চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) নিয়ে পেন্টাগনের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, এটি বিশ্বের বৃহত্তম শক্তির ক্ষেত্র তৈরি করে এবং '২০৩৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ পিএলএ আধুনিকীকরণ' এর লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
"পিএলএ ডোমেইন জুড়ে যৌথ দীর্ঘ-পরিসরের নির্ভুল হামলা পরিচালনা করার ক্ষমতা, কাউন্টারস্পেস এবং সাইবার ক্ষমতা, ও তাদের পারমাণবিক শক্তির বৃহৎ-স্কেল সম্প্রসারণকে ত্বরান্বিত করছে, " বলেও উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
পারমাণবিক শক্তি সূচক
রাশিয়ার কাছে একটি বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রাগার (৬ হাজার ৮০০ ওয়ারহেড) থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে চীন একটি গুরুতর নতুন হুমকি তৈরি করছে।
পিএলএ তার পারমাণবিক বাহিনীকে আধুনিকীকরণ এবং দ্রুত সম্প্রসারণ করছে; স্থল, সমুদ্র এবং বিমান- সবধরনের সরবরাহ প্ল্যাটফর্মেই।
পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্লুটোনিয়াম-২৩৯ উৎপাদনের ক্ষমতাও বাড়িয়েছে তারা। পেন্টাগনের প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার অস্ত্র উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করে অন্তত ১ হাজার ওয়ারহেডে নিয়ে যাবে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, চীন-রাশিয়ার কর্তৃত্ববাদী জোট আসলেই বাস্তব এবং আমাদের বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। শি জিনপিং এবং ভ্লাদিমির পুতিন দুজনই আমাদের ভবিষ্যতে আধিপত্য বিস্তার করতে চান, তার জন্য যে মূল্যই দিতে হোক না কেন। সাম্প্রতিক ইউক্রেন আক্রমণ এবং তাইওয়ানের উপর সম্ভাব্য আসন্ন আক্রমণ সেই আধিপত্য বিস্তারের সূচনামাত্র।
- লেখক: রবার্ট ম্যাগিনিস একজন অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন সেনা কর্মকর্তা এবং একজন অভিজ্ঞ সামরিক বিশ্লেষক। রাশিয়া ও চীনের হুমকির বিষয়ে রচিত বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক তিনি, এরমধ্যে অন্যতম 'গিভ মি মিবার্টি, নট মার্ক্সিজম' (২০২১)।
- সূত্র- ফক্সনিউজ