এই তিনজনের হাতেই রাশিয়ার পারমাণবিক বোমার চাবি, এরা কারা?
ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তীব্রতা। এরই মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের দায়িত্বে থাকা কৌশলগত বাহিনী্কে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। পুতিন সত্যিই পারমাণবিক হামলা করে বসবেন কিনা, এরপর থেকে তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। এই মুহূর্তে রাশিয়ার কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনী, উত্তরাঞ্চলীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর এবং দূরপাল্লার বিমান পরিচালনাকারী বাহিনী যুদ্ধ তৎপরতার মধ্যে রয়েছে। তাছাড়া, পশ্চিমা শক্তির প্রতি প্রেসিডেন্ট পুতিনের পুনঃপুনঃ হুমকি এখনো অব্যহত আছে।
রুশ সংবাদপত্র কমসোমোলস্কায়া প্রাভাডা'কে মেজর জেনারেল বরিস সলোভিয়োভ বলেন, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে যাওয়ার আগের দ্বিতীয় ধাপ হলো যুদ্ধ তৎপরতা বাড়িয়ে দেওয়া। এর পরবর্তী ধাপে সশস্ত্র প্রস্তুতি নেওয়া হবে। এর যেমন, ক্ষেপণাস্ত্রগুলোতে পারমাণবিক ওয়ারহেড যুক্ত করা হবে। তার মানে দাঁড়ায় এই যে, যেকোনো মুহূর্তে 'রেড বাটন' চাপ দেওয়া হতে পারে!
তবে এই রেড বাটন শুধুই রূপক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। আসলে রাশিয়ায় কোনো পারমাণবিক বাটনই নেই, বরং তিন মহাক্ষমতাধর ব্যক্তির হাতে আছে অ্যাটমিক স্যুটকেস এবং কোড। এই স্যুটকেসের মাধ্যমেই কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, দূরপাল্লার লক্ষ্যবস্তুতে বোমাবর্ষণ থেকে শুরু করে মুহূর্তের মধ্যে পারমাণবিক সাবমেরিন ব্যবহারের আদেশও দিতে পারেন তারা। গেল সপ্তাহেই নিজেদের 'বিশেষ স্যুটকেস' বুঝে নিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীফ অব স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল সের্গেই শোইগু। বলাই বাহুল্য, তিনজনের নামই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায়।
এখানে বলে রাখা ভালো, রাশিয়ার সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী বলে মনে করা হলেও, পুতিন একা কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিতে পারেন না। একই সময়ে সুটকেসধারী বাকি দুই নেতার কাছ থেকেও কোড আসতে হয়, তাই পুতিন এই দুজনের উপর নির্ভরশীল। রুশ গণমাধ্যমকে সলোভিয়োভ জানান, "পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার প্রক্রিয়ায় গুরুতর ভুল হওয়া ঠেকাতে এটা একটা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।"
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার প্রক্রিয়ায় এই ত্রয়ীর কোন জনের ঠিক কি ভূমিকা, তা কিন্তু এখনো অজানা। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক রাশিয়ার এই তিন নেতা সম্পর্কে, যাদের হাতে রয়েছে বিধ্বংসী এই অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা!
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ভ্লাদিমির পুতিনকে আর নতুন করে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার হয়তো কিছু নেই। দুনিয়া তাকে 'পাগল' বা 'ক্ষ্যাপাটে' যাই বলুক না কেন, পুতিন যেন তাতে থোড়াই কেয়ার করেন! এই যেমন, সম্প্রতি জার্মানির ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিবিদ এবং প্রতিরক্ষা কমিটির চেয়ারওম্যান মারি-অ্যাগনেস স্ট্র্যাক-জিমারমান টুইটারে রুশ প্রেসিডেন্টকে আখ্যা দিয়েছেন 'যুদ্ধাপরাধী ও পাগল' বলে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পুতিন তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর সর্বশেষ হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিবেন পারমাণবিক অস্ত্রকে। জার্মানির এডিটোরিয়াল নেটওয়ার্ককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হার্টি স্কুল অব গভরনেন্স এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মেরিনা হেনকে বলেন, "পারমাণবিক অস্ত্র পুতিনের প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় অপশন নয়। কিন্তু ছোট্ট একটা পারমাণবিক অস্ত্রের খেল দেখিয়ে তিনি স্পষ্টতই পশ্চিমাদের বুঝিয়ে দিতে পারেন যে প্রয়োজনে চরম পন্থা অবলম্বন করতেও পুতিন দ্বিধা করবেন না।"
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পরিস্থিতি যদি পুতিনের বিপক্ষেই যেতে থাকে, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে তার। তাছাড়া ইউক্রেনকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করায় পুতিন বরাবরই পশ্চিমাদের দোষারোপ করে আসছেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল সের্গেই শোইগু
১৯৯১ সাল থেকে রাশিয়ার একজন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সের্গেই শোইগু। শুরুতে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য লড়াই করে জনগণের চোখে হিরো বনে গিয়েছিলেন এই নেতা। এরপর ২০১২ সালে পুতিন তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্রেমলিনে কাজ করে যাচ্ছেন শোইগু। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা রয়েছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের এই বিশ্বস্ত সহযোগীর।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন শোইগু এবং তাকে সবসময়ই পুতিনের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে দেখা গেছে। ধারণা করা হয়, এই গ্রীষ্মে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে ক্রেমলিন-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করার জন্য বিশেষ বাহিনী পাঠিয়েছেন তিনি। তাছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে পুতিনের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক আছে শোইগুর, এমনকি পুতিনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবেও মনে করা হয় তাকে। আগেপরে প্রায়ই পুতিনের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতে দেখা গেছে তাকে। ছুটি কাটাতে গিয়ে দুজনের একসঙ্গে মাছ ধরা ও হাইকিং এর ছবিও সহজেই মিলবে ইন্টারনেট দুনিয়ায়। চাডান শহরে শোইগুর নিজ বাড়িতে ইতোমধ্যেই ঘুরে এসেছেন পুতিন। তাই পুতিনের পর প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে এখনই সের্গেই শোইগুকে এগিয়ে রাখছেন অনেকে।
চীফ অব স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ
রুশ সেনাবাহিনীর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্যালেরি গেরাসিমভ। প্রথমে ছিলেন সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে; পরে একটি ট্যাংক ব্যাটালিয়নের চীফ অব স্টাফ এবং অবশেষে ২০১২ সালে রাশিয়ান আর্মড ফোর্সেস-এর চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয় তাকে। সেক্রেটারি অব ডিফেন্সের অনুপস্থিতিতে সেনাবাহিনী পরিচালনা করার দায়িত্ব গেরাসিমভের।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পরপরই গেরাসিমভের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২০১৫ সালে সিরিয়ায় ক্যাম্পেইন চালানোর পুরস্কারস্বরূপ 'হিরো অব রাশিয়ান ফেডারেশন' অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন এই রুশ নেতা। বর্তমানে তিনি রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলেরও একজন সদস্য। এবারের গ্রীষ্মে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক মস্কো সম্মেলনে গেরাসিমভ ঘোষণা দেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার উপর হুমকি এলে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রও ব্যবহার করবে।
রাশিয়ার সংবিধান এবং সামরিক নীতিমালাও পুতিনকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু পারমাণবিক হামলার মতো মতো একটি গুরুতর সিদ্ধান্ত এলেও সশস্ত্র বাহিনীকে সেই আদেশ পালন করতে হবে। তবে তারা সেটি করবে কিনা এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র
সিপ্রি পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, সমগ্র ইউরোপে প্রায় ১৩,০০০ পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। এদের মধ্যে বারো হাজারই আছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। রাশিয়ার কাছে আছে ৬,২৫৫টি পারমাণবিক ওয়ারহেড। স্নায়ুযুদ্ধের কথা বিবেচনা করলে সংখ্যাটা খুব বড় নয়। কিন্তু বর্তমান যুগে পারমাণবিক অস্ত্রগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী এবং বৃহত্তর পরিসীমায় আঘাত হানতে সক্ষম। রাশিয়ার দূরপাল্লার বোমারুগুলো বিশ্বের যেকোনো টার্গেটে আঘাত হানার ক্ষমতা রাখে। আইসিবিএম ১০,০০০ কিলোমিটার এবং সারমাত আইসিবিএম ১৮,০০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। এই সবগুলো ক্ষেপণাস্ত্রর সাথেই পারমাণবিক ওয়ারহেড যুক্ত করা যায় এবং রাশিয়া ইতোমধ্যে সেগুলো পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারও করেছে।
পারমাণবিক যুদ্ধের সতর্কবার্তা
পারমাণবিক যুদ্ধের ব্যাপারে বিশ্বকে সতর্ক করেছেনশান্তিতে নোবেলবিজয়ী রাশিয়ান সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ। ইউরোপিয়ান সংসদে তিনি বলেন, "অবশ্যই এটা হবে একটা দুঃস্বপ্নের মতো, কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে নিউক্লিয়ার বাটনে চাপ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি যে হবে না, তা আমি বলতে পারছি না।"
কিন্তু এই সব রকম সতর্কবাণীকেই 'ভয়ভীতি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে গুজব' বলে উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, "সবাই জানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সেটা পারমাণবিক হামলার মধ্য দিয়েই হবে।" কিন্তু পারমাণবিক যুদ্ধের চিন্তা শুধু পশ্চিমা নেতাদের মাথায়, রাশিয়ার নয়!
সূত্র: বুলগেরিয়ান মিলিটারি ডটকম