রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের অভাবে ইউরোপের রিফাইনারিগুলো উৎপাদন কমাতে বাধ্য হবে
ক্রুড বা অপরিশোধিত তেল পরিশোধনের পর- বিভিন্ন প্রকার জ্বালানি ও শিল্প খাতের তেলজাত পণ্য উৎপাদন করে রিফাইনারি বা পরিশোধনাগার। ইউরোপের রিফাইনারিগুলো ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ব্যাপকভাবে রাশিয়া থেকে আমদানি করা ক্রুড শোধন করতো। এখন তারা রুশ ক্রুডের বিকল্প উৎস খুঁজলেও, এই নির্ভরশীলতা তাদের পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব কিনা- দেখা দিয়েছে সে প্রশ্ন।
যেমন চলতি সপ্তাহে ইউরোপের সবচেয়ে বড় রিফাইনারি পরিচালক সংস্থা শেল পিএলসি জানিয়েছে, তাদের কয়েকটি প্ল্যান্টের উৎপাদন/ শোধন হার কমানো হবে। কারণ, রাশিয়ার তেলের বিকল্প চালান পেতে লেগে যেতে পারে একাধিক সপ্তাহ সময়। এমন সময়ে এ হার কমছে, যখন মহাদেশটির জ্বালানি বাজারে টান টান অবস্থা। হু হু করে বাড়ছে ডিজেলের মতো অত্যাবশ্যক তেলের দাম।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক জ্বালানি খাতের পরামর্শক সংস্থা টার্নার, ম্যাসন আন্ড কোং। সংস্থাটির তেল বাজার বিশ্লেষক জনাথন লিচ বলেন, "ইউরোপিয় রিফাইনারিগুলোর পরিচালন ক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন এখন প্রত্যাশিত। তাদের মধ্যে বিকল্প উৎস থেকে ক্রুড সংগ্রহের প্রতিযোগিতা চলছে। জাহাজে চালান আসতে দেরির ঘটনাও পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে।"
আসলে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধাভিযানের কারণে মস্কোর ওপর নজিরবিহীন মাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় পশ্চিমা দেশগুলো। সুইফটের মতো আর্থিক ব্যবস্থা থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায় আন্তর্জাতিক বাজারে দেশটির জ্বালানি রপ্তানির সুযোগ কমেছে। এসব কিছু বাজারে সরবরাহের প্রচণ্ড সংকোচন সৃষ্টি করেছে, কারণ রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ক্রুড তেল রপ্তানিকারক।
নিষেধাজ্ঞার ভয়ে ইউরোপের রিফাইনারিগুলোও রুশ ক্রুড বর্জন করে এখন বিপাকে। তেল কোম্পানিগুলোকেও তাদের শোধনাগারগুলো সচল রাখতে অন্য উৎসের সন্ধানে ছুটতে হচ্ছে। সীমিত সরবরাহের বাজারে চাহিদা বেশি থাকায় সেই চেষ্টাও সহজ হচ্ছে না।
ইউরোপে ক্রুড বহনকারী জাহাজকে দূর রপ্তানিকারক অঞ্চল থেকে আনতে হচ্ছে তাদের। এতে যাত্রাপথের পরিবহন ব্যয় বাড়ছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এখন জাহাজ ভাড়ার সে খরচের চাপ আরও বাড়ল।
সব মিলিয়ে রাশিয়ার ক্রুড সরবরাহ হারানো, ইউরোপিয় শোধনাগার কর্তৃপক্ষের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। বলকান অঞ্চলের বৃহৎ শোধনাগার পরিচালনাকারী গ্রীসের হেলেনিক পেট্রোলিয়ামের মতো কোম্পানি রাশিয়া থেকেই কিনতো জ্বালানি তেল ও ভ্যাকুয়াম গ্যাস অয়েলের মতো আংশিক শোধিত সরবরাহ। একে বলা হয়- সেকেন্ডারি ফিডস্টক, যা ক্রুড তেল শোধনের বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। রাশিয়ায় সর্বাধুনিক শোধনাগারের কমতি থাকায় ইউরোপিয় রিফাইনারি সেগুলো আরও পরিশোধন করে গ্যাসোলিন ও ডিজেলে রুপান্তরিত করে।
পর্তুগাল-ভিত্তিক বহুজাতিক জ্বালানি কর্পোরেশন গালপ এনার্জিয়া এসজিপিএস এসএ'র তথ্যমতে, বিশ্বের অর্ধেক ভ্যাকুয়াম গ্যাসঅয়েল সরবরাহকারী হলো রাশিয়া। এই ফিডস্টকটি আবার প্রায়শই ডিজেলে রুপান্তরে ব্যবহৃত হয়।
রাশিয়ার সরবরাহ এড়িয়ে চলার ফলে ইতোমধ্যেই সেকেন্ডারি বা সহযোগী কিছু প্ল্যান্টের উৎপাদন কমাতে হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন এনার্জি অ্যাসপেক্ট লিমিটেড সংস্থার গবেষণা শাখার বিশ্লেষক জর্জ ডিক্স। এ বাস্তবতায় ইউরোপিয় শোধনাগারগুলি রুশ ক্রুডের বিকল্প উৎস নিশ্চিত করতে না পারলে- তাদের পক্ষ থেকে বড় ধরনের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আসতে পারে বলেও জানান তিনি।
উৎপাদন কমছে যে সময়ে:
সমুদ্রপথে রাশিয়া থেকে জাহাজে করে আসা ক্রুড চালানের ওপর নির্ভরশীল ইউরোপের উপকূলীয় শোধনাগারগুলি। বিকল্প উৎসের যোগান নিশ্চিত করা তাদের জন্যই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, পূর্ব ইউরোপসহ জার্মানির দুটি শোধনাগার রাশিয়া থেকে পাইপলাইনে আসা উরাল গ্রেডের ক্রুড পরিশোধনের ওপর নির্ভরশীল।
ডিক্স বলেছেন, "সমুদ্রপথে যারা আগে বিপুল পরিমাণ উরাল গ্রেডের ক্রুড মূল সরবরাহ হিসেবে গ্রহণ করতো-তাদের ওপরই রুশ সরবরাহ এড়ানোর চাপ সবচেয়ে মারাত্মক হওয়ার অনুমান করছি আমরা।"
বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইউরোপের রিফাইনারিগুলোর জ্বালানি উৎপাদন অনেকটা কমে। সেই সময়ের সাথে এবার মিলে যাচ্ছে রাশিয়ার ক্রুড ব্যবহার কমানোর সময়।
এরমধ্যেই নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য শেল, বিপি পিএলসি এবং রেপসল এসএ'র মতো বড় ইউরোপিয় জ্বালানি কোম্পানি তাদের উৎপাদন হার স্তিমিত করেছে। কয়েকটি প্ল্যান্টের কাজ শেষ হওয়ায় সেগুলো অচিরেই পূর্ণদ্যমে উৎপাদনে ফিরবে; অথচ সেজন্য যে পর্যাপ্ত ক্রুড ও ফিডস্টক দরকার- দেখা দিচ্ছে তারই নজিরবিহীন ঘাটতি।
জ্বালানি কোম্পানি এবং ইউরোপিয় সরকারগুলো তাদের মজুদ থেকে ক্রুড যোগান দিয়ে হয়তো স্বল্প মেয়াদে পরিশোধনাগারগুলোকে পূর্ণশক্তিতে উৎপাদন চালিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা করা সম্ভব নয় বলে জানান ফ্যাক্টস গ্লোবাল এনার্জি সংস্থার রিফাইনারি শাখার পরিচালক স্টিভ সয়ার।
তার মতে, "প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম চড়তে থাকলেও, ইউরোপের বাজারে আসলে ডিজেলের জন্য সবচেয়ে বেশি হাহুতাশ। বাজারে ক্রুডের সাথে শোধিত পণ্যের দর ব্যবধান খুবই বেশি, বাজার পরিস্থিতিও পণ্যের উচ্চ দরকেই সমর্থন দিচ্ছে।"
একথার মাধ্যমে সয়ার ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তার সামনে আরেক গভীর সংকটের দিকেও ইঙ্গিত দেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ