পশ্চিমাদের চাপ অমান্য করে রাশিয়াতেই থাকছে কৃষিখাতের সুবৃহৎ কোম্পানিগুলো
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর, সব খাতের কোম্পানির ওপর রাশিয়া ছেড়ে আসার চাপ বাড়িয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। মস্কোর ওপর দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা। দেশটির বাণিজ্যিক ও আর্থিক খাতকে বাকী দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সব রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এই চাপ রয়েছে বিশ্বের বৃহৎ কৃষি সংস্থাগুলোর ওপরও। অন্যান্য খাতের পশ্চিমা কোম্পানি রাশিয়াতে তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বন্ধ করলেও—চাপের মুখে এখনও অটল জায়ান্ট কৃষি ব্যবসার প্রতিষ্ঠান।
এসব সুবৃহৎ কোম্পানির মধ্যে নাম করা যায়- কারগিল ইনকর্পোরেশন, বায়ার এজি, আর্চার ড্যানিয়েলস মিডল্যান্ড কোং- এর। তারা বলছে, রাশিয়ায় ব্যবসা বন্ধ করলে, খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেবে। তাতে রুশ নাগরিকদের সংকট তৈরি হবে, যা থেকে মুক্ত থাকবে না বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষও। মানবিক এ বিবেচনায়- তারা রাশিয়ায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যা সমর্থন করা উচিত।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া ছেড়েছে- নামিদামি পশ্চিমা তেল কোম্পানি, ফাস্টফুড চেইনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। অনেকেই দেশটিতে তাদের কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে।
রাশিয়া-বিরোধী পশ্চিমা দেশের জনগণ ও সরকার একসুরে দাবি করছে, সব কোম্পানি মস্কোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করুক। তথাকথিত অধিকার কর্মীরাও যোগ দিয়েছে এই কাতারে। কৃষি সংস্থার কর্মীরাও তাদের নির্বাহীদের প্রতি রাশিয়ায় ব্যবসা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি কিছুদিন আগে রাশিয়া থেকে সব দেশের কোম্পানিকে সরে আসার অনুরোধ করেন। গেল সপ্তাহে তিনি এই চাপ আরও বৃদ্ধির আহ্বানও জানান।
কিন্তু, এ ধরনের রাজনৈতিক আহ্বান কতোটা বিবেচনাপ্রসূত- তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাঁচামালের বিশ্বের শীর্ষ যোগানদাতাদের মধ্যে রয়েছে রাশিয়া। বেশকিছু শিল্প ও ভোক্তাপণ্যের বিশ্ববাজার স্থিতিশীল রাখতে রাশিয়ায় উৎপাদন বন্ধের পরিণতি হবে ভয়াবহ। অথচ, ইউক্রেনসহ পশ্চিমা সরকারগুলো কেবল নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিতেই ব্যস্ত।
ওষুধ ও ভোক্তাপণ্যসহ অন্য কয়েকটি শিল্পের কোম্পানিও মানবিক কারণ উল্লেখ করে, রাশিয়ায় তাদের ব্যবসার একাংশ সচল রাখার কথা বলেছে। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে, জনসন অ্যান্ড জনসন, আমেরিসোর্স বার্জেন কর্পোরেশনসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান।
তারা রাশিয়াতে বড় পরিসরে ব্যবসা বন্ধের ঘোষণা দিলেও, ক্যানসারের নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া, যেসব ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছিল, সেগুলো নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করার কথাও জানিয়েছে।
রাশিয়াতে কৃষি কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম চলমান থাকা বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহে সার্বিক প্রভাব ফেলবে। কারণ ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ—দানাদার খাদ্যশস্য রপ্তানির শীর্ষ দুই দেশ থেকে সরবরাহ ব্যাহত করেছে। অথচ, সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়ায়- খাদ্য চাহিদাও বেড়েছে রাতারাতি, তার সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কম মূল্যে খাদ্য যোগানের বিষয়টি তো রয়েছেই।
যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে ফসল সংগ্রহ করা যায়নি। আগামী মৌসুমে চাষাবাদের জমিও মারাত্মকভাবে কমে আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেক কৃষক পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। দেশটি থেকে খাদ্য রপ্তানিও বন্ধ হয়ে গেছে। এ বাস্তবতায় খাদ্যের বৈশ্বিক মজুদে টান পড়বে অচিরেই, যা বিশ্বব্যাপী অনাহারের জন্ম দিতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
নিত্যপণ্য ব্রোকারেজ ও কৃষি খাতের পরামর্শক কোম্পানি- এজিমার্কেট ডটনেটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল বাইডারম্যান বলেন, "এতে আসন্ন উৎপাদন মৌসুম ঘিরে শঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। ইউক্রেনে চাষাবাদ দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় না ফিরলে, খাদ্য সরবরাহ মহা-গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসে এমন জরুরি অবস্থা সত্যিই হবে নজিরবিহীন।"
কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের দানাদার শস্য বাজার কেন্দ্রীক গবেষণা ফার্ম সোভইকোন- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আন্দ্রে সিজভ বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর- গত এক মাসে বিশ্ববাজারে গমের মূল্য ৩০ শতাংশ বেড়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় সরাসরি রাশিয়ার খাদ্য রপ্তানিকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়নি, রপ্তানিকারক বন্দরগুলি সচল রয়েছে। তবে সেখান থেকে আমদানিতে চড়া বিমা খরচ মেটাতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। কার্গো বুকিংয়ের খরচও বেড়েছে।
তাই রাশিয়া যদি নিজে থেকে উৎপাদন কমায় বা সরবরাহক কোম্পানিগুলো দেশটি ছেড়ে চলেই যায়- তাহলে রাশিয়ার হাতে হয়তো নিজ জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর মতো শস্য থাকবে, কিন্তু মারাত্মক বিপদে পড়বে অন্যান্য স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশ।
"এতে রাশিয়ার কৃষক ও অর্থনীতি অবশ্যই ক্ষতির মুখে পড়বে; কিন্তু তার চেয়ে বেশি দুর্ভোগ হবে আমদানি-নির্ভর দেশগুলোর। কেউই এই বিপদ মোকাবিলায় প্রস্তুত নয়।"
গম উৎপাদনে এগিয়ে থাকা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও পরিস্থিতি অনুকূল নয়। যেমন দক্ষিণ আমেরিকায় ক্ষরার কারণে শস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরেক বৃহৎ উৎপাদক। গেল বছরে দেশটিতে এক শতকের মধ্যে সবচেয়ে কম জমিতে গমের আবাদ করা হয়। চলতি বছরে মার্কিন কৃষকরা আগের বছরের চেয়ে সামান্য বেশি জমিতে গমের বীজ বপন করবে বলে জানিয়েছে দেশটির কৃষি বিভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ও উত্তরের সমভূমি অঞ্চলে ক্ষরার কারণে গমের ফলন এবারও কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এতকিছুর পরও রাশিয়াকে সর্বাত্মক চাপের মুখে রাখার পক্ষপাতী গোষ্ঠীগুলো বলছে, ইউক্রেনে আগ্রাসনের জন্য রাশিয়াকে চরম শিক্ষা দিতে হবে। এই চাপ শিথিলের কোনো সুযোগ নেই। কৃষি ব্যবসায় জড়িত আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকেও তাদের ভাগের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
গত সপ্তাহে ইউক্রেনীয় ও মার্কিন পরিবেশ ও কৃষি সংস্থাগুলো এক চিঠিতে কারগিল কোম্পানিকে রাশিয়া থেকে পুরোপুরি সরে আসার আহ্বান জানায়।
চিঠিতে বলা হয়, "আপনারা সেখানে ব্যবসা করছেন, কর দিচ্ছেন। সেই টাকায় পুতিনের সরকার তার যুদ্ধযন্ত্র পরিচালনা করছে।"
চাপের মুখে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক শঙ্কার দিকে আলোকপাত করে কারগিল কোম্পানির এক মুখপাত্র বলেন, ঠিক একারণেই আমাদের কোম্পানি (রাশিয়ায়) জরুরি খাদ্যপণ্যের ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে।
ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, সংঘাতের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি চরম রূপ নেবে এবং তাতে সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোরই দুর্দশা হবে সীমাহীন।
কারগিলের মুখপাত্র জানিয়েছেন, "খাদ্য একটি মৌলিক, মানবিক অধিকার। এনিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়। তাকে অস্ত্রও বানানো আরও অমানবিক।"
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা-ভিত্তিক খাদ্য ও কৃষি শিল্পের জায়ান্ট কোম্পানিটির রাশিয়ায় মোট কর্মীর সংখ্যা আড়াই হাজার। কারগিল দেশটিতে তাদের খাদ্য ও পশুখাদ্য উৎপাদন সচল রাখার কথা জানিয়েছে। তবে একইসাথে নতুন বিনিয়োগ না করা এবং কার্যক্রমের পরিধি সীমিত করার কথাও বলেছে।
সার ও বীজ সরবরাহের বৈশ্বিক জায়ান্ট সিনজেন্টা রাশিয়া ও ইউক্রেনে মোট ১০০ কোটি ডলারের ব্যবসা করে প্রতিবছর। কোম্পানিটি রাশিয়ার কৃষকদের কাছে বীজ ও রাসায়নিক সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। বৈশ্বিক খাদ্য সংকট এড়াতেই এমনটি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে কোম্পানি সংশ্লিষ্ট সূত্র।
উৎপাদিত ফসল বা নিত্য খাদ্যপণ্য ক্রেতা কোম্পানির মধ্যে এডিএম, বাঞ্জে লিমিটেড, ভিটেররা এবং দানাদার শস্য ট্রেডিংয়ের জায়ান্ট গ্লেনকোরও রাশিয়ায় সীমিত পরিসরে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে।
তবে বহুজাতিক জার্মান কোম্পানি বায়ের বলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে থাকলে তারা আগামী বছর দেশটিতে ফসলের বীজ বিক্রি করবে না।
- সূত্র: দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল