রুপি-রুবল বিনিময় ব্যবস্থার সুবিধা পাবে রাশিয়া, ভারত কী ঝুঁকি নিল?
রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য সচল রাখতে অর্থ পরিশোধের জন্য রুপি-রুবল পদ্ধতি নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করছে ভারত সরকার।
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সময় ডলারের বিনিময়ে রুপি আর রুবল ব্যবহার করে দেশ দুটি তাদের মধ্যকার আমদানি-রপ্তানি চলমান রাখার পরিকল্পনা করছে। এর ফলে ভারত, রাশিয়া থেকে ছাড়কৃত সুলভ মূল্যে জ্বালানি তেলও আমদানি করতে পারবে।
প্রাথমিকভাবে চলমান বাণিজ্যিক কার্যক্রমগুলোর জন্য রুপি-রুবল ব্যবহারের চিন্তা করা হলেও; বর্তমানে দুই দেশের সরকারই এভাবে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিষয়ে আরও গভীরভাবে পর্যলোচনা শুরু করেছে।
রুপি-রুবল বিনিময় পদ্ধতিটি চালু হলে ভারতীয় আমদানিকারকেরা ভারতে অবস্থিত রাশিয়ান ব্যাংকগুলোতে রুপি ব্যবহার করে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করবে। এরপর রাশিয়ান ব্যাংকগুলো রুশ রপ্তানিকারকদের রুবলের মাধ্যমে দাম পরিশোধ করবে।
তবে সেক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যাও আছে। রাশিয়াতে রপ্তানির চেয়ে বেশি আমদানি করে ভারত। ফলে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর কাছে রুপির পরিমাণ বেড়ে যাবে। তাতে কমবে রুবলের বিপরীতে রুপির বিনিময় মূল্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সমস্যা সমাধানে ভারতকে রাশিয়ায় আরও বেশি পণ্য রপ্তানি করতে হবে। ভারতের বর্তমানে কৃষিযন্ত্র, ঔষধ, ফার্নিচার, বাথরুম ফিটিংস ইত্যাদি পণ্যের নতুন বাজার প্রয়োজন। আর রাশিয়ার বাজার হতে পারে এ পণ্যগুলোর পরবর্তী গন্তব্য।
রাশিয়ার সস্তা তেল:
ভারত তার জ্বালানি তেল চাহিদার ৮৬ শতাংশ আমদানি করে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর দেশটিতে তেলের দাম হু হু করে বেড়ে গিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে, দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে এবং রুপির মান কমের দিকে যাবে।
যদিও রাশিয়ার মোট রপ্তানিকৃত তেলের দুই শতাংশ ভারত আমদানি করে, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ হার অনেক বাড়তে পারে। বিশেষত, রাশিয়ার কম দামে তেল কেনার প্রস্তাব গ্রহণ করলে- এতে নয়াদিল্লির উপকার বৈ অপকার হবে না। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ার প্রস্তাবে ইতোমধ্যে সাড়া দিয়েছে ভারত সরকার। তবে এ প্রক্রিয়া থেকে সার্বিক লাভ পেতে হলে ভারতকে এর সফল ব্যবস্থাপনার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
আমদানিনির্ভর হওয়ায় বর্তমানে রাশিয়ার সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে ভারতের। দেশটির সরকারি তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত গেল অর্থবছরে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে প্রায় ৮.১ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয়েছে। যার মধ্যে ভারত ২.৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, আর রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে ৫.৪৮ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের পণ্য।
এ অবস্থায় ভারত যদি সস্তাদরে রাশিয়ান তেল কিনে কিন্তু রাশিয়ায় নিজেদের পণ্যের রপ্তানি না বাড়ায়, তাহলে দেশ দুইটির মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি আরও বাড়তে থাকবে।
ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশন (এফআইইও)-এর মহাপরিচালক অজয় সাহাই বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের রপ্তানিকারকেরা আসন্ন সুযোগগুলোর দিকে মুখিয়ে থাকবেন।'
এফআইইও ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সেখানে এটি রুপি-রুবল ব্যবস্থার পাশাপাশি, কেবল রুপির মাধ্যমে করা সম্ভব এমন একটি বাণিজ্যিক পদ্ধতি চালু করারও পরামর্শ দিয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রা রুপিতেই ব্যবসায়িক চুক্তিগুলো করা হবে এবং অন্যপক্ষ মুদ্রার বিনিময়ের হারের ঝুঁকি বহন করবে।
অতীত থেকে শিক্ষা:
রুপি-রুবল বাণিজ্য প্রক্রিয়া কিন্তু আনকোরা নতুন কোনো পদ্ধতি নয়। আজ থেকে তিন দশক আগেও একবার আলোচনার টেবিলে উঠেছিল এ ধারণাটি। তখন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই দেশের সম্মতিতে, দুই সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে সরকার থেকে সরকার পদ্ধতিতে স্থানীয় এ মুদ্রা দুটি ব্যবহার করে বাণিজ্যে সম্মতি দেয় নয়াদিল্লি ও মস্কো। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে মার্কিন ডলারকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্যই এ সিদ্ধান্ত নেয় উভয় দেশ। স্নায়ুযুদ্ধের পরও এ ব্যবস্থা কিছুক্ষেত্রে কার্যকর ছিল।
তবে বর্তমানে এ প্রক্রিয়াটি চালু করতে হলে বেগ পেতে হতে পারে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোকে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং-এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মেসেজিং সিস্টেম 'সুইফট' থেকে অনেক রাশিয়ান ব্যাংককে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের জন্য স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে অনেক কাঠখড় পোহাতে হতে পারে রুশ আর্থিক সংস্থাগুলোকে।
ভারত সরকারের সুইফট-এর বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করতে আপত্তি নেই বলে জানা গেছে। গত সপ্তাহে ব্লুমবার্গ-এর একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে অর্থ পরিশোধের জন্য রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত বিবেচনা করছে ভারত।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এখন আর বেঁধে দেওয়া বিনিময় হারে রুপি-রুবল নীতি কাজ করবে না, বরং বাজারই দাম ঠিক করবে। কারণ এটি উভয় সরকারের মধ্যে কোনো বাণিজ্য চুক্তি নয়, বরং দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যকার বাণিজ্য চুক্তি।
এস. পি. জেইন ইনস্টিটিউট অব ম্যনেজমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ-এর সহযোগী অধ্যাপক অনন্ত নারায়ণ বলনে, ১৯৯৩ ও ২০০৩ সালে সেটি ছিল দুই সরকারের মধ্যবর্তী বাণিজ্য চুক্তি। সেখানে সামরিক উদ্দেশ্য ও দ্বিপাক্ষিক ঋণের বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল।' সেসময় ঠিক করা মূল্যহার ভারতের পক্ষে ছিল না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তখন প্রাথমিকভাবে রুবলের একটি দাম ঠিক করা হয়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রুবলের দামও পড়ে যায়। কিন্তু ভারত সরকার পুরনো দামই মেনে নিয়েছিল। ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে কেন কোনো কৃত্রিম দাম বেঁধে দেওয়া হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনন্ত নারায়ণ।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ:
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ভারতের পক্ষে রুপি-রুবল প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা খুব একটা সহজ হবে না।
যুদ্ধের পর থেকেই অস্থিতিশীল হয়ে গিয়েছে রাশিয়ার রুবল। তাই রুবলের বিপরীতে বিনিময় হার ঠিক করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ভারতের। এ প্রক্রিয়ায় তৃতীয় কোনো মুদ্রাও ব্যবহার করার উপযোগিতাও নেই।
এ প্রসঙ্গে মাথায় রাখতে হবে ভূরাজনৈতিক কৌশলগুলোও। এখন পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থানে আছে ভারত। আবার রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে আনা নিন্দা প্রস্তাবে জাতিসংঘে ভোটদানে বিরত থেকেছে ভারত।
কিন্তু ঠিক কতদিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও রাশিয়ার এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি না জানিয়ে চুপ করে থাকবে সেটাও ভাবতে হবে নয়াদিল্লীর নীতি-নির্ধারকদের । মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যে আভাস দিয়েছেন, কোয়াডের দেশগুলোর (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ও ভারত) মধ্যে ভারতই এপর্যন্ত ইউক্রেনকে সমর্থন জানাতে কিছুটা গড়িমসি করেছে।
অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ)-এর বিশেষ ফেলো নন্দন উন্নিকৃষ্ণন বলেন, 'অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না, ভারতের এখন রাশিয়ার সাথে সব রকম সম্পর্ক ছিন্ন করে পুরোপুরি আমেরিকার পক্ষে চলে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আছে।' এ বিশ্লেষক মনে করেন, ভারত দুই পরাশক্তিকে সমানভাবে ব্যবহার করতে চাইছে।
'আমাদের ব্যবসায়ী ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো রাশিয়ার বাজারকে অবশ্যই সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখবে, কিন্তু তারা এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না যার ফলে পশ্চিমা বাজরের সাথে তাদের বিদ্যমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়,' মন্তব্য করেন উন্নিকৃষ্ণন।
এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সাথে ডলারের বিনিময়েই পণ্য আমদানি-রপ্তানি করছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। ভবিষ্যতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও তীব্র হলেই সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে রুপি-রুবল প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এ মুহূর্তে রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখালে তার নেতিবাচক ভূরাজনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে ভারতের ওপর।
- সূত্র: আল জাজিরা