নিষেধাজ্ঞার পরেও কেন রাশিয়ার তেল বর্জন ইইউর জন্য কঠিন হবে?
ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার জ্বালানি সম্পদ তথা গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। পর্যায়ক্রমে তেলের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, জটিল বণ্টন প্রক্রিয়ার কারণে ইউরোপে রাশিয়ার তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করার কাজটি কঠিন হয়ে উঠবে।
নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনাটি যদি সদস্য দেশগুলো অনুমোদন দেয়, তাহলে অপরিশোধিত তেলের ক্ষেত্রে তা আগামী ৬ মাসের মধ্যে কার্যকর হবে। আর ডিজেল ও অন্যান্য তেল পণ্যের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়িত হতে সময় লাগবে ৮ মাস।
প্রস্তাবের আওতায় হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়াকে নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কিছুটা বেশি সময় দেওয়া হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হবে এই দেশ দুটিকে। এর অর্থ হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার মাধ্যমে রাশিয়ার তেল কিনতে পারবে, যদি না উভয় দেশকে তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তেল কেনা থেকে বিরত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলো পণ্যের উৎস সম্পর্কে না জেনেই তৃতীয় দেশের মাধ্যমে রাশিয়ার পণ্য কিনে ফেলতে পারে। কারণ তেলের রাসায়নিক গঠনের (যেমন, সালফার সামগ্রী কিংবা তেলের ঘনত্ব ইত্যাদি) মাধ্যমে এর উৎস শনাক্ত করা গেলেও এমন অনেক পণ্যই রয়েছে যেগুলোর উৎস শনাক্ত করা কঠিন।
আবার তেল ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তেল বা তেলজাত পণ্যের উৎস নির্ধারণও জটিল হয়ে পড়ে। অতীতে কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞাকবলিত দেশ থেকে তেল কিনতে দেখা গেছে বেশ কিছু দেশকে। ইরান ও ভেনেজুয়েলার মতো নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা দেশগুলো থেকে তেল রপ্তানি করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে, তবে জাল নথিপত্রের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন ক্রেতারা।
উৎস নির্ধারণ আরও কঠিন হয়ে পড়ে, যদি অপরিশোধিত তেলকে শোধনের জন্য অন্য অপরিশোধিত দ্রব্যের সঙ্গে মেশানো হয়। বিশেষ করে, গ্যাসোলিন, ডিজেল বা জেট ফুয়েলের মতো স্ট্যান্ডার্ড বা মানসম্মত পণ্য প্রক্রিয়াকরণের পর কাঁচামালের উৎস বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান জেপি মরগানের মতে, অন্তত ২৬টি প্রধান ইউরোপীয় শোধনাগার এবং ট্রেডিং কোম্পানি রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ক্রয় স্থগিত করেছে, যা সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন রাশিয়া থেকে আমদানির প্রায় ২.১ মিলিয়ন ব্যারেল (বিপিডি)।
এছাড়া শেল, টোটাল এনার্জি, রেপসল এবং বিপি সহ ইউরোপীয় অন্যান্য তেল কোম্পানিগুলো রাশিয়ার তেল বা সে দেশের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে এমন পণ্য কিনবে না বলে জানিয়েছে। সেইসঙ্গে প্ল্যাটস ট্রেডিং উইন্ডো জানিয়েছে, বিপি'র চুক্তি অনুযায়ী, কোনো বিক্রেতা তাদের নীতি বা চুক্তির কোনো ধারা লঙ্ঘন করে তা অবৈধ হবে।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের কাছে প্রকাশিত নথি অনুসারে, বেশ কয়েকটি শিপিং সংস্থা এমন নিশ্চয়তাও চাচ্ছে যে, মাল বোঝাই কার্গোগুলো রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো উত্স থেকে আসেনি, এমনকি এতে রাশিয়ার কোনো স্বার্থও নেই।
কিন্তু এতসব নথিপত্রের প্রমাণের পরেও পণ্যের উৎসের সঙ্গে রাশিয়ার স্বার্থ জড়িত নয়, এমন নিশ্চয়তা দিতে পারবে না কেউ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান তেল আমদানি কেন্দ্র আমস্টারডাম-রটারডাম-অ্যান্টওয়ার্প (এআরএ) কমপ্লেক্স দুই দেশে মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ৮টি বন্দর নিয়ে গঠিত। শত শত আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির মালিকানাধীন কমপক্ষে ৯৬ টি টার্মিনাল এবং ৬ হাজার ৩০০টি স্টোরেজ ট্যাংক সংযুক্ত রয়েছে এই কেন্দ্রের সঙ্গে। তাই এখানে তেলের সরবরাহ হলে তা কোন দেশ থেকে কিংবা কোন উৎস থেকে এসেছে তা আলাদা করা দুরূহ কাজে রূপান্তরিত হয়।
শেল বলছে, ইউরোপীয় শোধনাগারগুলোতে প্রক্রিয়াকৃত কিছু তেল পণ্যে থাকতে পারে রুশ তেলের মিশ্রণ। এছাড়া ডিজেলের মতো অনেক তেল পণ্যই রয়েছে, যেগুলো সাধারণত অন্য তেলের সঙ্গে মেশানো হয়; অর্থাৎ, পাইপ এবং ট্যাংকগুলোতে রাশিয়ার তেলের সংমিশ্রণ ঘটতে পারে। মিশ্রিত তেলের একটি অনুপাতের কারণে ইউরোপের সমগ্র তেল শিল্প খাতেই ঢুকে পড়তে পারে রাশিয়ার তেল।
এফজিই-এর প্রধান তেল চাহিদা বিশ্লেষক কুনিট কাজোকোগলু বলেন, এআরএ-তে মিশ্রিত রুশ তেল নেদারল্যান্ডস থেকে আগত জ্বালানি হিসেবে কাস্টমস ডেটাতে প্রদর্শিত হতে পারে।
"আমি মনে করি অনেক ইউরোপীয় দেশ রুশ পণ্যের উত্স লুকানোর জন্য 'নেদারল্যান্ডস' থেকে আমদানির তকমা ব্যবহার করবে", যোগ করেন কাজোকোগলু।
এআরএ থেকে কোথায় কোথায় তেল সরবরাহ হয়?
কার্গোতে জ্বালানি লোড হওয়ার পর তা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশে পুনরায় রপ্তানি করা হয়। একই বন্দরের মধ্যে অন্যান্য টার্মিনালগুলোতে এবং রাইন নদীর নিচ দিয়ে সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতেও রপ্তানি হয় জ্বালানি পণ্য। আর এই দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া আড়াল করে দিতে পারে জ্বালানির উত্স, এমনটিই বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
এআরএ কেন্দ্র থেকে তেল পণ্যগুলো ন্যাটোর সেন্ট্রাল ইউরোপীয় পাইপলাইন সিস্টেম (সিইপিএস) এর মাধ্যমে বণ্টন করা হয়, যা পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে অন্তত ৬টি সমুদ্রবন্দর, ১১টি শোধনাগার, ৩টি রেল ও ১৬টি ট্রাক-লোডিং স্টেশন এবং ৬টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে পণ্যের উৎস শনাক্ত করা টার্মিনালগুলোর জন্য নিতান্তই কঠিন একটি কাজ।
ইউরোপের তেল শিল্প সূত্র রয়টার্সকে জানায়, ক্রেতারা স্টোরেজ সাইটগুলোর কাছে ক্রমগত মিশ্রিত তেলের উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। ওই উৎস থেকে তারা তেল আমদানি করতে পারবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নিতেই বার বার এমন অনুরোধ জানাচ্ছে তারা। কিন্তু অনেক সময় এবং অনেক ক্ষেত্রেই চুক্তি সম্পূর্ণ সম্পাদিত হওয়ার আগে পণ্যের উৎস সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়না, বলছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
কিছু শিপিং কোম্পানি জ্বালানির উৎস ও প্রক্রিয়াকরণ কোথায় করা হয়েছে, সে সম্পর্কে সার্টিফিকেট দেয়। আমদানিকৃত পণ্যের সঙ্গে সে সকল তথ্য জানতে পারে একটি দেশের শুল্ক কর্তৃপক্ষ। তবুও এই তথ্যগুলোকে গোপনীয় বলেই মনে করা হয়।
অতীতে রাশিয়া থেকে উদ্ভূত জ্বালানি পণ্যের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি রুশ উপাদান শনাক্ত করেছে লন্ডনভিত্তিক তেল ও গ্যাস কোম্পানি শেল। সংস্থাটি সম্প্রতি রুশ জ্বালানির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কোম্পানিটি বলছে, রাশিয়া থেকে উদ্ভূত বা রুশ সামগ্রী দ্বারা মিশ্রিত কোনো পরিশোধিত জ্বালানি পণ্য আর কিনবে না তারা। ট্রেডিং চুক্তিতে এমন একটি ধারা সংযুক্ত করছে ব্রিটিশ এই জ্বলানি সংস্থা। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এই ধারাটি কেবল সেখানেই সংযুক্ত করা হয়েছে যেখানে কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ধারা সন্নিবেশ করার সুযোগ রয়েছে। মূলত আইসিই এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে গ্যাসঅয়েল চুক্তি এই ধারার অধীনে পড়বে না।
এছাড়া রয়টার্সকে তিনটি ব্যবসায়িক সূত্র জানিয়েছে, ডিজেল মিশ্রণে ৫০ শতাংশের কম (৪৯ শতাংশ পর্যন্ত) রুশ ডিজেল মেশালে তা নিষেধাজ্ঞাবিহীন বৈধ (রাশিয়া থেকে উদ্ভূত নয় এমন) পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে কি না সে বিষয়টিও মূল্যায়ন করছেন শিল্প সংশ্লষ্ট একদল ব্যবসায়ী।
- সূত্র: রয়টার্স