রাশিয়ান গ্যাসের বদলে আফ্রিকান গ্যাস দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে ইইউ'র লাগবে ১০-১৫ বছর
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর দেশটির ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এসব নিষেধাজ্ঞার মধ্যে একটি হচ্ছে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করা। তার বদলে আফ্রিকান হাইড্রোকার্বন দিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে চাচ্ছে ইইউ।
ইউরোপের পরিকল্পনা হচ্ছে এ বছরের মধ্যে মস্কোর গ্যাসের ওপর থেকে তিন ভাগের দুই ভাগ নির্ভরশীলতা কমানো। তার জন্য পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকান দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে তারা।
আন্তর্জাতিক তেল বিশেষজ্ঞ ও ইএসসিপি ইউরোপ বিজনেস স্কুল ইন লন্ডন-এর অধ্যাপক ড. মামদুহ জি. সালামে বলেন, 'গ্যাসের চাহিদা পূরণে ভিন্ন উৎস খোঁজার ইউরোপের এ চেষ্টা সফল হতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।'
রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে আফ্রিকার দিকে নজর দেওয়াটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ আফ্রিকা-অঞ্চলে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। কিছু হিসাব অনুযায়ী, নাইজেরিয়ার কাছে প্রায় ২০৬.৫৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আছে।
আফ্রিকার দ্বিতীয় গ্যাস-মজুদ আলজেরিয়ার কাছে। দেশটির মজুদের পরিমাণ প্রায় ১৫৯.১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। সেনেগালের আছে ১২০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। তবে মজুদ থাকা এ গ্যাস উত্তোলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা আফ্রিকার অনুন্নত অবকাঠামো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য অ্যানালাইসিস অভ গ্লোবাল সিকিউরিটি'র সহপরিচালক ড. গ্যাল লুফট বলেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস তথা এলএনজির সক্ষমতা বাড়ানো একটি ব্যয়সাধ্য কাজ, এর জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থের বিনিয়োগ। একইসাথে এটি একটি সময়সাপেক্ষ কাজও।
তিনি বলেন, 'গ্যাস পরিবহনে আমার কাছে এলএনজি'র চেয়ে সিএনজি (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) বেশি বাস্তবসম্মত সমাধান মনে হয়। তবে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করার আরেকটি বাধা রয়েছে। সেটি হলো গ্যাসকে সিএনজিতে রূপান্তর করা গেলেও সেগুলো পরিবহন করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ট্যাংকার তৈরি করতে হবে। এর জন্য অনেক সময়ের দরকার। আর উত্তর আফ্রিকার পক্ষে খুব দ্রুত গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব কিনা সেটাও এখনো পরিষ্কার নয়।'
ট্রান্স-সাহারান পাইপলাইন
২০২২ সালে নাইজার, আলজেরিয়া, ও নাইজেরিয়া ট্রান্স-সাহারান গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত করতে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ প্রকল্পটি এনআইজিএএল পাইপলাইন বা ট্রান্স-আফ্রিকান গ্যাস পাইপলাইন নামেও পরিচিত।
প্রকল্প অনুযায়ী, পাইপলাইনটি প্রায় ৪১২৮ কিলোমিটার (২৫৬৫ মাইল) দীর্ঘ হবে। নাইজেরিয়ার ওয়ারি থেকে আলজেরিয়ার হাসি আর'মেল পর্যন্ত যাবে লাইনটি। আলজেরিয়ার কৌশলগত ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল দিয়ে এ পাইপলাইনের সাহায্যে বছরে ৩০ বিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরোপের বাজারে সরবরাহ করা হবে।
অন্যদিকে একই সময়ে রাশিয়ার নর্ড স্ট্রিম ও নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইন দুটি ইউরোপে ১১০ বিলিয়ন ঘন মিটার গ্যাস সরবরাহ করার সক্ষমতা রাখে।
আফ্রিকার যে দুটি দেশ মোটামুটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করে, সেগুলো হচ্ছে আলজেরিয়া ও নাইজেরিয়া। আলজেরিয়া বর্তমানে ২৯.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন ও নাইজেরিয়া ২২.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন গ্যাস রপ্তানি করে। আফ্রিকার অন্য দেশগুলোর গ্যাস উৎপাদন ও রপ্তানি ক্ষমতা সীমিত এবং এ দেশগুলোর কোনো এলএনজি প্ল্যান্ট বা পাইপলাইন নেই।
ড. মামদুহ সালামে বলেন, ট্রান্স-সাহারান পাইপলাইন এখনো কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। তার মতে আগামী ১০ বছরেও এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে কিনা তা-তে সন্দেহ রয়েছে।
১৯৭০ সালে প্রথমবারের মতো এ পাইপলাইনটি তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়। ২০০২ সালে নাইজেরিয়ার ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (এনএনপিসি) ও আলজেরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি সোনাট্র্যাখ-এর মধ্যে এক সমঝোতা স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়।
২০১১ সালে দুই দেশ এ পাইপলাইনটি নিয়ে কাজ শুরু করতে চাইলেও ন্যাটোর লিবিয়ায় বোমা হামলা ও পরবর্তীকালে লিবিয়ার পতনের কারণে কাজ এগোয়নি। তাছাড়া পশ্চিম আফ্রিকার এ দেশগুলোতে নিরাপত্তা অনেক কম হওয়ায় সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরাও আর এ প্রকল্প নিয়ে আস্থা প্রকাশ করেননি।
নাইজেরিয়া-মরক্কো পাইপলাইন
২০১৬ সাল থেকে নাইজেরিয়া-মরক্কো পাইপলাইন নিয়ে আলোচনা চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় নাইজেরিয়া থেকে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে মরোক্কোতে ৫৬৬০ কিলোমিটার (৩৫১৭ মাইল) দীর্ঘ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অফশোর পাইপলাইন তৈরি হওয়ার কথা রয়েছে।
নাইজেরিয়ার জ্বালানিসম্পদ মন্ত্রী টিমিপ্রে সিলভা বলেছেন, রাশিয়াসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ এ প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০২৩ সালের মে মাসে প্রকল্পটি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এটি কবে শেষ হবে বা মোট কত অর্থ খরচ হতে পারে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
আফ্রিকায় এ দুটির পাশাপাশি আরও কিছু গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প রয়েছে। পূর্ব, পশ্চিম, ও দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে এসব পাইপলাইন প্রকল্প হয় পরিকল্পনা অথবা নির্মাণের পর্যায়ে রয়েছে। বিনিয়োগের অভাব, সন্ত্রাসী আক্রমণ, নিরাপত্তার সমস্যা, রাজনৈতিক বিভেদ ইত্যাদি কারণে অনেক প্রকল্পের কাজ থমকে আছে।
গ্যাসের বিকল্প উৎস হবে সময়সাপেক্ষ
রাশিয়া থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে ইইউ। নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই এ উৎসের বিকল্প খোঁজা শুরু করেছে ইইউ। তাই আফ্রিকান গ্যাস পেতে দেরি হবে জেনে বর্তমানে এ ব্লকটি চাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২০২২ সালে ১৫ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সংগ্রহের চুক্তি করতে।
একইসাথে ইইউ'র ইচ্ছা ২০৩০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও ৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সংগ্রহ করা। এদিকে ২০২২ সালে ইউরোপে এলএনজি আমদানির জন্য মিশর ও ইসরায়েলের সাথে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক চুক্তির বিবেচনা করছে ব্রাসেলসও।
এছাড়া রয়েছে আজারবাইজান থেকে গ্যাস আমদানি দ্বিগুণ করার পরিকল্পনাও। এগুলোর বাইরে কানাডা, জাপান, ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকেও এলএনজি আমদানির চিন্তা করছে ইউরোপ।
তবে ড. সালামে মনে করছেন না বিশ্বের এলএনজি উৎপাদনকারী দেশগুলো দ্রুতই ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাসের ঘাটতি পূরণ করতে পারবে। তার ভাষায়, 'এখন বা অদূর ভবিষ্যতে, ইইউ কখনোই রাশিয়ান গ্যাসের কোনো প্রতিস্থাপক খুঁজে পাবে না।'
তিনি উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, ও অস্ট্রেলিয়ার মোট এলএনজি রপ্তানি দিয়েও রাশিয়ার গ্যাসের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। তিনি ব্যখ্যা করেন, এসব দেশগুলোর এলএনজি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ক্রেতারা দীর্ঘকালীন মেয়াদে কিনে নেন। আর পর্যাপ্ত সংখ্যক টার্মিনাল ও সংরক্ষণ সক্ষমতার অভাবেও কম এলএনজি আমদানি করতে বাধ্য থাকে ইউরোপ।
সূত্র: স্পুটনিক