জীবনযাত্রার ব্যয়: বিশ্বব্যাপী বাড়ছে খাদ্য রপ্তানি বন্ধের ঘটনা
দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ ঘাটতির যুক্তিতে আগামী জুনের শুরু থেকে মুরগি রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে মালয়েশিয়া। সম্প্রতি গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানিতেসাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর তা প্রত্যাহার করেছে।
এমন সময়ে সরকারগুলি এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যখন ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর থেকে বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে খাদ্য সরবরাহে তীব্র সংকট।
বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে, কৃষি বিশেষজ্ঞরা এশিয়ায় তথাকথিত 'খাদ্য জাতীয়তাবাদ'- এর উত্থানের আশঙ্কা করছেন।
এই আশঙ্কার কারণ গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিকারক দেশগুলির স্থানীয় বাজার। যেমন সাম্প্রতিক মাসগুলোয় মালয়েশিয়ায় বেড়েছে মুরগির মাংসের দাম। সরবরাহ সীমিত থাকায় কিছু কিছু খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান একজন ক্রেতা একসাথে কতটুকু মাংস কিনতে পারবেন তার সীমাও বেঁধে দেয়।
এই বাস্তবতায় গত সোমবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব প্রতি মাসে ৩৬ লাখ পিস মুরগি রপ্তানি কমানোর ঘোষণা দেন। তিনি জানান, "স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য ও উৎপাদন যতদিন স্থিতিশীল না হয়- ততদিন এ সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। সরকার জনগণের স্বার্থকে সবার আগে গুরুত্ব দিচ্ছে।"
প্রতিবেশী সিঙ্গাপুর নিজস্ব মুরগি আমদানির এক-তৃতীয়াংশ মালয়েশিয়া থেকে করে। কুয়ালালামপুরের সিদ্ধান্ত সিঙ্গাপুরের সাধারণ ক্রেতাদের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী করবে।
সিঙ্গাপুর অবশ্য মাংস আমদানি করে না। বরং জ্যান্ত মুরগি আমদানি করে তা স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। তবে মালয়েশিয়ার ঘোষণার পর পরই ভোক্তাদের ফ্রোজেন বা হিমায়িত মুরগির মাংস কিনতে উৎসাহিত করেছে সিঙ্গাপুরের খাদ্য দপ্তর। একইসাথে, সবাইকে আতঙ্কিত হয়ে বেশি বেশি না কেনারও আহ্বান জানিয়েছে।
সরকারি বিভাগটি তাদের বিবৃতিতে জানায়, "টাটকা মুরগির মাংস সরবরাহে সাময়িক ব্যাঘাত দেখা দিলেও, হিমায়িত মাংস দিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। তবে আমরা সকল ভোক্তাকে তাদের প্রয়োজন অনুসারে এটি কেনার পরামর্শ দিচ্ছি।"
খাদ্যবাজারে যুদ্ধের আঘাত:
বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের ঘটনাপ্রবাহে সাম্প্রতিকতম উদাহরণ মালয়েশিয়ার মুরগি রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত। খাদ্যের বাজার কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই অস্থির।
গত মাসে বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে জানায়, খাদ্যপণ্যে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্য ও অনাহারের মুখে ঠেলে দেবে।
যুদ্ধের আগে ইউক্রেন ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রধান গম রপ্তানিকারক। রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর দেশটি থেকে রপ্তানিতে ধস নেমেছে। এতে বিশ্ববাজারে গমের মূল্য বেড়েই চলেছে। যেসব দেশ ইউক্রেনের গম আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল এরফলে তাদের সরবরাহ সংকটে পড়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়েছে।
সোমবার ইউক্রেনের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া সেভিরিদেঙ্কো বিবিসিকে জানান, তার দেশের কাছে লাখ লাখ টন দানাদার শস্য মজুদ আছে, যা নিরাপদে পরিবহনের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিতে হবে।
দাভোসে চলমান ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক পার্শ্বঃআলোচনায় যোগ দিয়ে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলি ইউক্রেনের খাদ্য রপ্তানির ওপর আরোপিত রুশ অবরোধকে "বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল" বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা সবচেয়ে খারাপ খাদ্য সংকটের মধ্যে রয়েছি।"
"৪০ কোটি মুখে খাদ্যের যোগান দেয় ইউক্রেন। (রাশিয়া) সেই সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। তার সাথে বিশ্বব্যাপী সার সংকট তো রয়েছেই। রয়েছে ক্ষরা, জ্বালানি ও খাদ্যের চড়া মূল্য। পৃথিবীর বুকেই আমরা এবার নরককাণ্ড দেখতে চলেছি।"
'খাদ্য জাতীয়তাবাদ' কী শুরু হয়ে গেছে?
বিশ্বের একটি প্রধান শস্য গম, চলতি মাসের শুরুর দিকে গম রপ্তানিতে ভারত নিষেধাজ্ঞা দেয়। দেশটিতে তীব্র তাপপ্রবাহে ফসলের প্রচণ্ড ক্ষতি হয়, এতে স্থানীয় বাজারে মূল্যও বেড়ে যায়। বাজার স্থিতিশীল রাখতেই পরে রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় সরকার।
বন্যা ও ক্ষরায় বিশ্বের অন্যান্য প্রধান গম উৎপাদক অঞ্চলেও ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর আগে আন্তর্জাতিক কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীরা আশা করেছিলেন, ইউক্রেনের ঘাটতিকে কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারবে ভারতের রপ্তানি। এখন সে আশাও মরীচিকার মতো উবে গেছে।
প্রসাধনী থেকে ওষুধ সবকিছুতেই ব্যবহার রয়েছে পাম তেলের। এটি ভোজ্য তেলেরও বড় চাহিদা পূরণ করে। স্থানীয় বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইন্দোনেশিয়া টানা তিন সপ্তাহ পণ্যটি রপ্তানি বন্ধ করেনি।
সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির সহকারী অধ্যাপক সোনিয়া আক্তার মনে করেন, আলোচিত ঘটনাবলী 'খাদ্য জাতীয়তাবাদ'- এরই উদাহরণ। যেখানে সরকারগুলি নিজেদের জাতীয় স্বার্থে বিন্দুমাত্র ছাড় দিয়ে রাজি নয়।
"সরকারিগুলি এমন নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, কারণ তারা সর্বাগ্রে নিজ নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে চায়।"
তিনি বলেন, "২০০৭-০৮ সালের খাদ্য সংকটকালীন সময়ের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি, আরও অনেক দেশ একই রকম পদক্ষেপ নেবে। এতে খাদ্য সংকট ও মূল্যস্ফীতি দুই-ই চরম রূপ নেবে।"
সিঙ্গাপুরের নায়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক উইলিয়াম চেন অবশ্য মনে করেন, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞাগুলি সাময়িক এবং এখনই তাদের খাদ্য জাতীয়তাবাদের উদারহরণ বলাটা ঠিক নয়।
ফুড সায়েন্স ও টেকনোলজি প্রোগ্রামের পরিচালক চেন বলেন, "কয়েকটি দেশ খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পরে আবার তুলেও নিচ্ছে। এটি বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ চক্রের আন্তঃসম্পর্কের একটি ভালো দিক। কারণ এতে সম্পৃক্ত কোনো দেশই সব ধরনের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে তাদের একে-অপরের ওপর নির্ভর করতেই হয়।"
- সূত্র: বিবিসি