রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর ইউরোপের নির্ভরশীলতা কতখানি?
সমুদ্রপথে রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানিতে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা দিতে ঐক্যমত্য হয়েছে ইউরোপিয় ইউনিয়নে।
জোটটি জানিয়েছে, এর ফলে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ৯০ শতাংশ কমবে। তবে জার্মানির মতো দেশের নির্ভরশীলতা বেশি হওয়ায় রাশিয়ার গ্যাস কেনা অব্যাহত রাখবে ইইউ।
ইইউ নিষেধাজ্ঞায় কী প্রভাব পড়বে?
ইইউ দেশগুলোর আমদানি করা তেলের এক-চতুর্থাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া। চলতি বছরের শেষ নাগাদ জাহাজে করে আনা রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধের পরিকল্পনা করেছে তারা। এতে করে, ইউরোপে রাশিয়ার মোট তেল রপ্তানির দুই-তৃতীয়াংশ কমবে।
সাময়িক ছাড় পাবে- পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল আমদানি। ইইউ সদস্য হাঙ্গেরি মোট চাহিদার ৬৫ শতাংশ তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে পায়। দেশটির আপত্তি আমলে নিয়েই এ ছাড় দেওয়া হয়েছে।
পাইপলাইনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানিকারক অপর দুটি দেশ- জার্মানি ও পোল্যান্ড- চলতি বছরের শেষ নাগাদ এটি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এর অর্থ, নিষেধাজ্ঞার আগে রাশিয়া যতখানি রপ্তানি করতো এরপর তার মাত্র ১০-১১ শতাংশ করবে- বলে জানিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন। ইউরোপের বাইরে আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানিতে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য চলতি বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়ার তেল থেকে পুরোপুরি সরে আসবে।
ইইউ কেন গ্যাস রপ্তানি নিষিদ্ধ করছে না?
বর্তমানে ইইউ এর আমদানিকৃত গ্যাসের ৪০ শতাংশের সরবরাহক রাশিয়া। ইউরোপের অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র জার্মানি নিজ চাহিদার অর্ধেকের বেশি গ্যাস মস্কোর কাছ থেকে কেনে। তাই নিজ অর্থনীতিতে চাপ না ফেলে ইইউ সদস্য দেশগুলোর পক্ষে গ্যাস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়।
গত মার্চে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি এক বছরের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয় ইইউ। তবে এটি আরও কমানোর বিষয়ে এরপর নতুন করে কোনো সমঝোতা হয়নি।
বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের উচ্চ মূল্যের সুবিধাভোগী হয়েছে মস্কো। এর আগের বছর শুধুমাত্র ইইউ সদস্য দেশে তেল ও গ্যাস বিক্রি করে ৪০ হাজার কোটি ইউরো আয় করেছে।
রাশিয়া কী পরিমাণ তেল রপ্তানি করে?
আমেরিকা ও সৌদি আরবের পর রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ জ্বালানি তেল উৎপাদক (উত্তোলন ও পরিশোধন বোঝাতে)। সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার আগে রাশিয়ার উত্তোলিত অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বা ক্রুডের প্রায় অর্ধেক রপ্তানি হতো ইউরোপে।
২০২০ সালে নেদারল্যান্ডস ও জার্মানি দৈনিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি রাশিয়ার তেল আমদানি করে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) তথ্যানুসারে, গত বছর স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি তাদের মোট আমদানির যথাক্রমে ৯৬ ও ৫৮ শতাংশ তেল রাশিয়া থেকে কিনেছে।
সে তুলনায় আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য রাশিয়ার তেলের ওপর কম নির্ভরশীল। যেমন যুক্তরাজ্য ২০২০ সালে মাত্র ৮ শতাংশ তেল কেনে রাশিয়া থেকে। আর গত বছর আমেরিকা কেনে মোট তেল আমদানির ৩ শতাংশ।
রাশিয়ার তেলের বিকল্পগুলো কী কী?
জ্বালানি বাজার বিশ্লেষক বেন ম্যাক উইলিয়ামস মনে করেন, গ্যাসের বিকল্প উৎস পাওয়া সহজ না হলেও, তেলের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। কারণ রাশিয়া বড় সরবরাহকারী হলেও, বিশ্বের আরও অনেক দেশ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় তেল রপ্তানি করে। তাই চালানও সহজলভ্য।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার সদস্য কয়েকটি দেশ সাম্প্রতিক সময়ে তাদের নিজস্ব মজুদ থেকে ১২ কোটি ব্যারেল তেল বাজারে ছেড়েছে, যা সংস্থাটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ রিলিজের ঘটনা।
গত মার্চের শেষদিকে, আমেরিকার কৌশলগত মজুদ থেকে বড় পরিসরে তেল বাজারে ছাড়ার নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মার্কিন নাগরিকদের জ্বালানির চড়া মূল্যের চাপ থেকে রেহাই দিতে বাইডেন প্রশাসন এ সিদ্ধান্ত নেয়।
সৌদি আরবের উৎপাদন বৃদ্ধিও চায় আমেরিকা, এমনকী ভেনিজুয়েলার তেল রপ্তানিতে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিষয়েও ভাবছে ওয়াশিংটন।
রাশিয়া যেভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখছে?
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরও ইউরোপের দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল রাশিয়া।
তবে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্ব অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিলে ক্ষিপ্ত হন রুশ প্রেসিডেন্ট। ভ্লাদিমির পুতিন এক ঘোষণায় জানিয়ে দেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে বৈরীভাব পোষণকারী দেশগুলোকে এখন থেকে রাশিয়ার মুদ্রায় গ্যাসের দাম দিতে হবে।
এরপর রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি কোম্পানি গ্যাজপ্রম প্রথমে পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া এবং সম্প্রতি ফিনল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে। রুবলে মূল্য না দিলে সরবরাহ পুনরায় শুরু করা হবে না বলেও জানিয়েছে।
ফিনল্যান্ড সম্প্রতি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে আবেদনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় দেশটিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়। নিজ চাহিদার বেশিরভাগ গ্যাস ফিনল্যান্ড রাশিয়া থেকেই আমদানি করে। তবে গ্যাস তাদের মোট ব্যবহৃত জ্বালানির দশ ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম।
রাশিয়ার এসব পদক্ষেপকে 'ব্লাকমেল' বলে নিন্দা করেছে ইইউ। জোটটি জানিয়েছে, রাশিয়ার দাবি মেনে নিয়ে রুবলে জ্বালানির দাম দিলে- তাতে করে রুশ মুদ্রা আরও শক্তিশালী হবে- যার সুফল পাবে দেশটির অর্থনীতি।
রুবলে যারা মূল্য দিচ্ছে?
ইইউ কমিশন প্রধান ডন ডার লেন সতর্ক করে বলেছেন, রাশিয়ার দাবি পুরোপুরি মেনে নিলে তা নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করবে।
তাছাড়া, রাশিয়ার ওপর জ্বালানি নির্ভরশীলতা কীভাবে কমানো যায় তা নিয়ে ইইউ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
ইতোমধ্যেই, জার্মানি, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়াসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের গ্যাস কোম্পানি রাশিয়ার গ্যাজপ্রমব্যাংকে বিশেষ একাউন্ট খুলে সেখানে ইউরো দিয়ে মূল্য পরিশোধে রাজি হয়েছে। তাদের দেওয়া দাম পরে রুবলে নগদায়ন করবে ব্যাংকটি।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, অস্ট্রিয়া ও ইতালির গ্যাস কোম্পানিগুলোও গ্যাজপ্রমব্যাংকে একাউন্ট খোলার কথা ভাবছে।
রাশিয়া ইউরোপে কী পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করে?
২০১৯ সালে ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির প্রায় ৪১ শতাংশ দিয়েছে রাশিয়া। দেশটি হঠাৎ সরবরাহ বন্ধ করলে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হবে- ইতালি ও জার্মানি। কারণ, তাদেরকেই সিংহভাগ গ্যাস রাশিয়া থেকে কিনতে হয়।
সে তুলনায় যুক্তরাজ্যের গ্যাস সরবরাহের মাত্র ৫ শতাংশ দেয় রাশিয়া। পক্ষান্তরে, আমেরিকা রাশিয়া থেকে কোনো গ্যাস আমদানি করে না।
বেশ কয়েকটি পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করছে রাশিয়া। পাইপে আসা গ্যাস আঞ্চলিক মজুদ কেন্দ্রে জমা হয়, এরপর সেখান থেকে মহাদেশটির বিভিন্ন দেশে বন্টন করা হয়।
রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প কী?
গ্যাস রপ্তানিতে শীর্ষস্থানীয় কাতার। আলজেরিয়া ও নাইজেরিয়াও রপ্তানি করে। বিকল্প উৎস হিসেবে তাদের প্রতিই আরও ঝুঁকতে পারে ইউরোপ। তবে এসব দেশের গ্যাস উত্তোলন সক্ষমতা বর্তমানের চেয়ে বাড়ানোর বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জিং।
এজন্য ইইউকে সরবরাহ দিয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমেরিকা। এর আওতায় চলতি বছরের শেষ নাগাদ ১৫ বিলিয়ন ঘনমিটার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ট্যাংকার জাহাজে করে দেবে।
জীবাশ্ম জ্বালানির একটি বড় অংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। তাই আরেক বিকল্প হিসেবে, সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে চায় ইউরোপ। তবে নবায়নযোগ্য উৎসের ব্যবহার দ্রুত বাড়ানো সম্ভব নয়।
- সূত্র: বিবিসি