ঘোড়াটানা গাড়ি থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি: আগামীদিনের পরিবহন..
১৮৯০-এর দশকে পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় শহরগুলো এক বিরাট সমস্যার মুখে পড়ে। এসব শহরে হাজার হাজার বছর ধরে ঘোড়ায় টানা গাড়ি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। এগুলো বাদে তখন জীবনযাত্রা কল্পনা করা ছিল কঠিন। কিন্তু উনিশ শতকের দিকে এই ঘোড়ায় টানা বাহনের সংখ্যা বেড়ে ওঠায় ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোয় ঘোড়া ব্যবহারের সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠতে থাকে।
বিশেষত পথঘাটে ঘোড়ার নাদির স্তূপ এবং সেই সাথে দুর্গন্ধ টের না পাওয়া ছিল অসম্ভব। ১৮৯০-এর দশক নাগাদ লন্ডনের রাস্তাঘাটে আনুমানিক ৩ লক্ষ ঘোড়া কাজ করছিল, নিউইয়র্ক শহরে এই সংখ্যা ছিল ১.৫০ লক্ষেরও বেশি। একেকটা ঘোড়া দৈনিক গড়পড়তা ১০ কেজি নাদি এবং সেই সাথে আন্দাজ ১০ লিটার মূত্র তেরি করত। আস্তাবল এবং রাস্তা থেকে হাজার হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহ এবং অপসারণের কাজটি ক্রমেই বর্ধিত হারে কঠিন হয়ে ওঠে।
কয়েক দশক ধরেই এই সমস্যা দানা বাঁধছিল। ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের এক পত্রিকার সম্পাদক বলেছিলেন, 'খুব অল্প কিছু পথের কথা বাদ দিলে বাকি সব রাস্তাই দুর্গন্ধময়, বিরক্তিকর দুর্গন্ধে ভরা। কোথাও কোথাও ঘোড়ার বর্জ্য এমন উঁচু হয়ে জমে থাকছে যে গাড়ি পেরুনো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।' পরিবেশ ভীষণ দুর্গন্ধে ভরে তোলার পাশাপাশি বৃষ্টি হলেই অতিরিক্ত ঘোড়ার নাদি রাস্তাকে কাদাময় মলকুণ্ডে পরিণত করে।
১৮৯০-এর দশকের লন্ডনের জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে এই 'কাদা' (অতিশালীন ভিক্টোরিয়ানদের পছন্দের উপমা) ঘন মটরদানার স্যুপ থাকায় শহরের অন্যতম মূল রাস্তা স্ট্র্যান্ড ভাসিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে। ছুটন্ত গাড়ির 'ছিটানো এই স্যুপ-ট্রাউজার বা স্কার্টে বাধা না পেলে, সোজা পেভমেন্টের উল্টোদিকের বাড়িঘর আর দোকানের সামনের অংশে সেঁটে যেত। রাস্তা থেকে সংগৃহীত নাদি বড় বড় শহর এবং নগরের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্ত ডাম্পে স্তূপ করা হতো। আস্তাবলের আশপাশে জমানো নাদির বিরাট ঢিবি মাছিদের আকর্ষণীয় পরিবেশ জুগিয়েছে।
এসবই জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ছিল। নিউইয়র্ক শহরের স্বাস্থ্য পরিসংখ্যানবিদেরা 'প্রত্যন্ত অঞ্চলের চেয়ে আস্তাবলের ৫০ ফুট এলাকার মধ্যে অবস্থিত বাসাবাড়ি এবং স্কুলে' সংক্রামক রোগের চড়া হার লক্ষ করেন বলে ১৮৯৪ সালে নিউইয়র্ক টাইমস-এ খবর প্রকাশিত হয়। শতকের শেষ দিকের এক হিসাবে বছরে ২০ হাজার নিউইয়র্কারের 'ধূলিকণার সাথে ভাসমান রোগে' মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। ঘোড়ার ওপর নির্ভরশীল থাকার কারণে এটি স্বাস্থ্যঝুঁকির স্পষ্ট আলামত। পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলতেই যেন ঘোড়াগুলোকে প্রায়ই অতিরিক্ত খাটানোয় সেগুলো মারা পড়লে মৃতদেহগুলো প্রায়ই বেশ কয়েক দিন রাস্তায় পড়ে থেকে পচার পরই কেবল কাটাকাটি করে সরানো হতো। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেড়ে যেত। ১৮৮০-এর দশকের দিকে নিউইয়র্ক শহর থেকে প্রতিবছর ১৫ হাজার মৃত ঘোড়া সরানো হতো।
পরিহাসমূলকভাবে, বাষ্পচালিত লোকোমোটিভ এবং ১৮৩০-এর দশকে সূচিত আন্তনগর রেলওয়ে সংযোগ সমস্যা আরও ভয়াবহ করে তোলে। বিভিন্ন শহরের ভেতর দ্রুত এবং আরও দক্ষ পরিবহন ব্যবস্থা মানুষ ও পণ্যের দ্রুত পরিবহন দাবি করায় আরও বেশিসংখ্যক ঘোড়ায় টানা গাড়ির প্রয়োজন দেখা দেয়। 'ঘোড়ার ওপর আমাদের নির্ভরতা বাষ্পশক্তির ওপর নির্ভরতার সাথে পাল্লা দিয়েই বেড়েছে,' ১৮৭২ সালে উল্লেখ করেছেন জনৈক পর্যবেক্ষক। ফলাফল, আরও ঘোড়া, আরও নাদি এবং অব্যাহত অবনতিশীল যানজট। ১৮৭০ সালে এক পর্যবেক্ষক লেখেন, ম্যানহাটানের ব্রডওয়ে দিনের কোনো কোনো সময় 'প্রায় দুর্গম' হয়ে পড়ে। গাড়িঘোড়া স্থবির হয়ে পড়লে এবড়োখেবড়ো পথে ঘোড়ার ধাতব খুর এবং ইস্পাতের কিনারাওয়ালা চাকার ঝনঝনানিতে কানে তালা লাগার দশা হয়।
অনেক সময় হাসপাতালের বাইরে কিছু ব্যক্তিগত ঘোড়ার সামনে খড় ছিটিয়ে দিয়ে আওয়াজ কমানোর চেষ্টা করা হতো। দূষণ, জট এবং শোরগোল আসলে আরও গভীর নির্ভতারই প্রকাশ ছিল। ১৮৭২ সালে উত্তর আমেরিকায় ঘোড়ার একধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জায় সমস্ত ঘোড়া এবং খচ্চর অচল হয়ে পড়লে সেটা পশুশক্তির ওপর সমাজের নির্ভরতারই স্পষ্ট স্মারক হয়ে ওঠে। নিউইয়র্ক টাইমস রাস্তা থেকে 'ট্রাক, ভ্যান, এক্সপ্রেস ওয়্যাগন এবং সাধারণ গাড়ি' উধাও হওয়ার কথা উল্লেখ করে। 'চলমান মহামারি অশ্ব-শ্রমের আকস্মিক বিদায় আমাদের সমাজ ও ব্যবসা বাণিজ্যকে পুরোপুরিভাবে অগোছালো করে দেওয়ার এক আশ্চর্য বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে,' উল্লেখ করে নেশন। ঘোড়া এবং আস্তাবল প্রসঙ্গে পত্রিকা উল্লেখ করে, 'আমাদের বিরাট সমাজযন্ত্রের চাকা, এর থমকে যাওয়ার মানে সকল শ্রেণির মানুষ, বাণিজ্য, কৃষি, ব্যবসা ও সামাজিক জীবনের ক্ষতি।'
তবু আতলান্তিক সাগরের দুই পারের সমাজই ঘোড়ার ওপর অব্যাহতভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠছিল। ১৮৭০-১৯০০ সালের ভেতর আমেরিকান শহরগুলোয় ঘোড়ার সংখ্যা চার গুণ বেড়ে ওঠে। অন্যদিকে জনসংখ্যা বাড়ে প্রায় দ্বিগুন। শতকের সূচনায় ব্রিটেনে প্রতি ১০ জনের জন্য ঘোড়া ছিল মাত্র একটি, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি চারজনে একটি। ঘোড়ার জন্য ওটস ও খড় জোগাতে বিশাল এলাকায় চাষাবাদ করতে হতো বলে মানুষের খাবার উৎপাদনের জমি কমে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০ মিলিয়ন ঘোড়াকে খাওয়াতে মোট এক-তৃতীয়াংশ চাষযোগ্য জমিনের প্রয়োজন ছিল, অন্যদিকে ব্রিটেনের ৩.৫ মিলিয়ন ঘোড়া অনেক আগে থেকেই আমদানি করা খড়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
ঘোড়া একাধারে অপরিহার্য ও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সদ্য-আবির্ভূত প্রযুক্তিপন্থীদের চোখে সমাধান ছিল স্পষ্ট: ঘোড়া বাদ দিয়ে ওই জায়গায় তখন ঘোড়াহীন ক্যারিজ নামে পরিচিত সেল্ফ-প্রপেলিং মোটর ভেহিকল নিয়ে আসা। আজকের দিনে আমরা এগুলোকে গাড়ি বলি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই পরিবর্তনকে উদ্ভাবনের শক্তি এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে সমাধানহীন সমস্যার সহজ প্রযুক্তিগত সমাধান বেরিয়ে আসার নজির হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। একে বরং অন্যান্য ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক কাহিনি হিসেবে দেখতে হবে: আজকের দিনে যাকে ত্বরিৎ সমাধান মনে হচ্ছে, সেটাই আগামীকাল সুদূরপ্রসারী ও অনাকাক্সিক্ষত পরিণতি বয়ে আনতে পারে। গাড়ি অপ্রত্যাশিত উপায়ে দুনিয়াকে, বিভিন্ন শহরের ভৌগোলিক অবস্থা থেকে শুরু করে তেলের ভূরাজনীতি পাল্টে দেওয়ায় এবং নিজস্ব সমস্যাও তৈরি করায় ঘোড়া থেকে গাড়িতে পরিবর্তনের ব্যাপারটিকে যেমনটা মনে হতে পারে, আসলে সে রকম নিখুঁত ও সময়ানুগ প্রযুক্তিগত সমাধান ছিল না।
শোরগোল, যানজট এবং দুর্ঘটনাসহ ঘোড়ায় টানা গাড়ির সাথে সম্পর্কিত সমস্যা মেটানোর প্রতিশ্রæতির সুবাদে অটোমোবাইল সম্পর্কে শুরুতে বেশির ভাগ উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে গাড়ির ব্যর্থতা সহ্য করার কারণ হলো দূষণÑ সবচেয়ে উল্লেখ্য ঘোড়ার নাদি, শত শত বছর ধরে শহরের রাস্তাঘাট অবরুদ্ধ করে রেখেছিল এই জিনিস। কাজেই গাড়ি এই বর্জ্য দূর করাসহ আরও অসংখ্য সুবিধা নিয়ে হাজির হয়েছিল।
কিন্তু একধরনের পরিবেশগত সমস্যা মেটাতে গিয়ে গাড়ি একগাদা নতুন ঝামেলা তৈরি করে, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। এগুলোর বিকিরিত দূষণ ঘোড়ার নাদির তুলনায় চোখে দেখা কঠিন হলেও মোটেই কম সমস্যাসংকুল নয়। এগুলোর ভেতর রয়েছে গাড়ির ধোঁয়ার সাথে বেরোনো ছাইসদৃশ বস্তু: এগুলো ফুসফুসের গভীরে ঢুকে যেতে পারে; শ্বাসতন্ত্রে সমস্যা তৈরি এবং বেশ কয়েক ধরনের ক্যানসারের সাথেও সম্পর্কিত উদ্বায়ী রাসায়নিক যৌগ; নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং জালবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা গ্রিনহাউস গ্যাস, মূলত কার্বন ডাই-অক্সাইড। গাড়ি, ট্রাক ও বাস সম্মিলিতভাবে বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ১৭% তৈরি করছে। বিশ শতকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর বিশ্ব নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় পেট্রল এবং ডিজেলের মতো ফসিল ফুয়েলের ওপর নির্ভরতারও সুদূরপ্রসারী ভূরাজনৈতিক প্রভাব তৈরি হয়েছিল।
এসবের কিছুই অটোমোবাইল যুগের সূচনায় আঁচ করা সম্ভব ছিল না। নাকি ছিল? কেউ কেউ অনবায়নযোগ্য ফসিল ফুয়েলে গাড়িতে শক্তি জোগানো এবং এই ধরনের জ্বালানির প্রাপ্যতার বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আজ নবায়নযোগ্য শক্তিচালিত বৈদ্যুতিক গাড়িকে এসব উদ্বেগ মোকাবিলায় যৌক্তিক সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু দেখা গেছে বৈদ্যুতিক গাড়ির সুবিধাসংক্রান্ত বিতর্ক খোদ অটোমোবাইলের বিতর্কের মতোই পুরোনো।
১৮৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সর্বাধিক বিক্রীত বাহন ছিল বৈদ্যুতিক বাহন: দ্য পোপ মানুফ্যাকচারিং কোম্পানির কলাম্বিয়া মটোর ক্যারিজ। বৈদ্যুতিক মডেলগুলোর বিক্রি বাষ্প এবং পেট্রলচালিত গাড়ির বিক্রিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। ১৯৯০ সাল নাগাদ বাষ্পচালিত বাহন কিছুটা এগিয়ে ছিল: সে বছর ১৬৮১টি বাষ্পচালিত বাহন, ১৫৭৫টি বৈদ্যুতিক বাহন এবং ৯৩৬টি পেট্রলচালিত বাহন বিক্রি হয়। কেবল ওল্ডস মোটর ওয়ার্কসের কার্ভড ড্যাশ অল্ডসমোবাইল চালুর পরই পেট্রলচালিত বাহন প্রথমবারের মতো সামনের কাতারে চলে আসে।
সম্ভবত আধুনিক মানুষের চোখে ১৮৯০-এর দশকে অল্প সময়ের জন্য বিকশিত বৈদ্যুতিক ট্যাক্সি ক্যাব 'ইলেকট্রব্যাটে'র কাহিনি বৈদ্যুতিক বাহনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কতটা ভিন্নভাবে কাজ করতে পারে তার একটা লক্ষণীয় নজির: ১৮৯৪ সালে ফিলাডেলফিয়ায় দুজন বিজ্ঞানী-বিনিয়োগকারী পেদ্রো সালোম ও হেনরি মরিস ইলেকট্রব্যাট তৈরি করেন। তাঁরা দুজনই বৈদ্যুতিক বাহনের উৎসাহী প্রবক্তা ছিলেন। ১৮৯৫ সালে এক ভাষণে সালোম 'গ্যাসোলিন ভেহিকলের অসংখ্য চেইন, বেল্ট, পুলি, পাইপ, ভালভ এবং স্টপকওয়ালা অসাধারণ জটিল ড্রাইভিং গিয়ারের' বিদ্রুপ করেন...'অসংখ্য জিনিস..., তো সব সময়ই একটা না একটা কিছুর বিকল হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।'
তাঁরা দুজন বারবার নকশা পাল্টে একটা ক্যারিজ ধরনের বাহন তৈরি করেন। পেছনের উঁচু আসনে বসা ড্রাইভার এটা নিয়ন্ত্রণ করবে। সামনের চওড়া আসনে বসবেন যাত্রীরা। ১৮৯৭ সালে মরিস ও সালোম ডজনখানেক বাহন নিয়ে ম্যানহাটানে ট্যাক্সি সার্ভিস চালু করে প্রথম মাসে এক হাজার যাত্রীকে সেবা দেন। কিন্তু ক্যাবগুলো ছিল স্বল্পপাল্লার, ব্যাটারি চার্জ হতে প্রচুর সময় নিত। তো মরিস ও সালোম ইলেকট্রিক ব্যাটারি কোম্পানি নামে আরেকটা প্রতিষ্ঠানের সাথে একীভূত হয়ে যান। এই কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা ১৮৮৪, ব্রডওয়ের এক ডিপোতে খালি ব্যাটারিকে কয়েক সেকেন্ডেই পুরোপুরি চার্জ করা ব্যাটারি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার একধরনের চতুর ব্যাটারি বদলের ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন। এতে ইলেকট্রব্যাট সারা দিন চলতে পারত।
১৮৯৯ সালে প্রতিশ্রুতিশীল এই ব্যবসাটি নিউইয়র্কবাসী রাজনীতিক ও অর্থজোগানদাতা উইলিয়াম হুইটনির নজর কাড়ে। ইলেকট্রিক স্ট্রিট কার বা ট্রামে বিনিয়োগ করে প্রচুর লাভবান হুইটনি শহুরে পরিবহনের ক্ষেত্রে একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখলেন। দুনিয়াব্যাপী বড় বড় শহরে বৈদ্যুতিক ক্যাবের বহর চলাচল করে ঘোড়ায় টানা গাড়ির আরও পরিচ্ছন্ন, নিরিবিলি বিকল্প জোগানোর কথা কল্পনা করলেন তিনি। তখন সাধারণ মানুষ নাগালের বাইরে থাকা গাড়ি কেনার চেয়ে শহরবাসীরা এদিক-ওদিক যেতে বৈদ্যুতিক ট্যাক্সি ব্যবহার করবেন। কিন্তু সে জন্য ইলেকট্রোব্যাটগুলোকে আরও বড় মাত্রায় নির্মাণ করতে হবে বুঝতে পেরে হুইটনি ও তাঁর বন্ধুরা সর্বোচ্চ বিক্রীত কলাম্বিয়া ইলেকট্রিক ভেহিকলের নির্মাতা পোপের সাথে দল বাঁধেন। ইলেকট্রিক ভেহিকল কোম্পানি নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গঠন করে এক উচ্চাভিলাষী সম্প্রসারণ পরিকল্পনায় হাত দেন তাঁরা। ইভিসি হাজার হাজার ইলেকট্রিক ক্যাব তৈরির লক্ষ্যে মূলধন সংগ্রহ এবং বোস্টন, শিকাগো, নিউ জার্সি এবং নিউ পোর্টে অফিস খোলে। ১৮৯৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান ছিল এটা।
কিন্তু নিউইয়র্কের বাইরে ট্যাক্সি কার্যক্রম বাজেভাবে চলায় প্রতিষ্ঠানটি অর্থ উপার্জনে ব্যর্থ হয়। বারবার পুনর্গঠন এবং নতুন করে মূলধন সংগ্রহের কারণে ইভিসির বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতারণার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। পেট্রলচালিত বাহনের শক্তিশালী সমর্থক দ্য হর্সলেস এজ নামে শিল্পসংক্রান্ত একটি সাময়িকী প্রতিষ্ঠানটিকে হবু একচেটিয়া বলে আক্রমণ করে বৈদ্যুতিক বাহন ব্যর্থ হতে বাধ্য বলে মত দেয়। ইভিসির প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার খবর বেরোলে এর শেয়ারমূল্য নিমেষে ৩০ ডলার থেকে ০.৭৫ ডলারের নেমে যায়। প্রতিষ্ঠানটি আঞ্চলিক অফিস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। দ্য হর্সলেস এজ এই পতন উপভোগ করে 'নির্বোধ দুনিয়া'র ওপর বৈদ্যুতিক গাড়ি চাপিয়ে দেওয়ার ব্যর্থতায় উল্লাস করে।
এর পরের বছরগুলোয় মানুষ বেশি হারে ব্যক্তিগত গাড়ি কেনায় বৈদ্যুতিক বাহন এক নতুন তকমা পায়: এগুলো মেয়েদের গাড়ি। এই তকমা জোটার কারণ, এগুলো স্বল্পপাল্লার, স্থানীয় যাত্রার উপযোগী, স্টার্ট নেওয়ার জন্য হাতের ক্র্যাঙ্কিং বা গিয়ার পাল্টাতে হয় না। সহজ নকশার সুবাদে এগুলো ভীষণ নির্ভরযোগ্য ছিল। ১৯১০ সাল ব্যাবকক ইলেকট্রিক ভেহিকেলসের এক বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, 'ব্যাবকক ইলেকট্রিক গাড়ি চালানো নারীর ভয় নেই।' এর মানে ছিল পেট্রলচালিত বাহনে চালানোর জটিলতার সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ নারীদের উচিত ইলেকট্রিক গাড়ি কেনা। বিপরীতে পুরুষদের দক্ষ মেকানিক ধরে নেওয়া হয়েছে, যাদের কাছে শ্রেয়তর দক্ষতা ও পাল্লার শক্তিশালী, পুরুষালী পেট্রলচালিত বাহনকে বেশি জটিলতা এবং কম নির্ভরশীলতার যুতসই বিকল্প ভাবা হয়েছে।
ডেট্রয়েট ইলেকট্রিক এবং ওয়েভারলি ইলেকট্রিক নামে দুটি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ১৯১২ সালে মহিলাদের চাহিদা মেটানোর উপযোগী নতুন নকশার মডেল বাজারে ছাড়ার দাবি করে। বৈদ্যুতিক বাহন হওয়ায় পেছনের আসন থেকে চালানো হতো এগুলো, ড্রাইভার বসতো উল্টো দিকে ফেরানো আসনে বসা যাত্রীদের মুখোমুখি, কিন্তু তাতে রাস্তা দেখা কঠিন হয়ে পড়ত। স্টিয়ারিংয়ের বেলায় চাকার বদলে ছিল একটা পুরোনো কেতার টিলার। এটার জন্যে কম শক্তির দরকার হলেও অনেক কম নিপুণ ও বিপজ্জনক ছিল।
হেনরি ফোর্ড তাঁর স্ত্রী কারাকে তাঁর নিজস্ব মডেলটির বদলে একটা ডেট্রয়েট ইলেকট্রিক কিনে দিয়েছিলেন। কোনো কোনো পুরুষের অল্পপাল্লার বৈদ্যুতিক বাহন পছন্দ করার মানে, তাদের ড্রাইভারকে দেওয়া স্বাধীনতা ভীষণভাবে সীমিত ছিল।
ড্রাইভারদের ভেতর একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু অংশ, যেমন ১৯১৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের ড্রাইভারদের ১৫% এবং টুসানের ৫% নারীদের প্রতি মনোযোগ দিয়ে বৈদ্যুতিক বাহনের উৎপাদকেরা আভাসে বৃহত্তর বাজারে পেট্রলচালিত গাড়ির সাথে পাল্লা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের অক্ষমতাই স্বীকার করে নিচ্ছিলেন।
সে বছর টমাস এডিসনের সাথে মিলে কম ব্যয়বহুল ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাণের কথা নিশ্চিত করেন হেনরি ফোর্ড। 'এখন পর্যন্ত সমস্যা ছিল রিচার্জ ছাড়াই লম্বা দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার মতো হালকা ওজনের স্টোরেজ ব্যাটারি তৈরি,' বৈদ্যুতিক গাড়ির মূল দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন তিনি। কিন্তু এডিসন ইলেকট্রিক গাড়িতে ব্যবহৃত ভারী, বিশাল আকারের লিড-এসিড ব্যাটারির বিকল্প আবিষ্কারের চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ায় বারবার সেই গাড়ির আবির্ভাব বিলম্বিত হতে থাকে। শেষমেশ গোটা প্রকল্পটিই নীরবে বাতিল হয়ে যায়।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যর্থতা এবং প্রপালশনের দাপুটে রূপ হিসেবে ইন্টারনাল কম্বাশন ইঞ্জিনের আবির্ভাবের সাথে লিড-এসিড ব্যাটারির চেয়ে প্রতি একক বস্তুর ক্ষেত্রে ঢের বেশি শক্তি জোগানো তরল জ্বালানির সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ব্যাখ্যা পুরোপুরি কারিগরি নয়। আবার এর মনস্তাত্তি¡ক দিকও আছে। ব্যক্তিগত গাড়ির ক্রেতারা এখনকার মতো তখনো বৈদ্যুতিক গাড়ির সীমিত আওতা এবং এর রিচার্জের অনিশ্চয়তায় সীমাবদ্ধতার কথা ভাবতে চাননি।
ইতিহাসবিদ গিস মোমের ভাষায়, এই সময়ের ব্যক্তিগত গাড়িগুলোকে মূলত সেগুলোর মালিককে স্বাধীনতা জোগানো 'অ্যাডভেঞ্চার মেশিন' ভাবা হতো এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি পেট্রলচালিত বিকল্পের তুলনায় কম স্বাধীনতা দিত। 'গাড়ির মালিক হওয়ার মানে ছিল দূরদূরান্তে পাড়ি দেওয়ার একধরনের ইচ্ছায় আচ্ছন্ন হওয়া,' ১৯০৩ সালে লিখেছেন জনৈক উৎসাহী শহরবাসী। ১৯১০-এর দশকে বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রি সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেছিল। ইন্টারনাল কম্বাশন ইঞ্জিনের ওপর ঢের বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠার সাথে সাথে বৈদ্যুতিক গাড়ি ধুলোয় গড়াগড়ি যেতে বাধ্য হয়।
কিন্তু বিশ শতকে গাড়ির মালিকানা নাটকীয়ভাবে বেড়ে ওঠায় তেলের ওপর নির্ভরতার অন্য খরচ থাকার কথাও প্রমাণিত হয়। ১৯৬০-এর দশক নাগাদ গড়পড়তা আমেরিকান গাড়িগুলো ইউরোপ ও জাপানে নির্মিত গাড়ির তুলনায় পৌনে এক টন ভারী ছিল। এগুলোর ভি-৮ ইঞ্জিনের অন্যান্য জায়গার চার সিলিন্ডার ইঞ্জিনের চেয়ে দ্বিগুণ ইঞ্জিনশক্তি ছিল। ফলে অনেক বেশি তেল খেত এগুলো। এই জ্বালানির একটা ক্রমবর্ধমান অংশ আসত আমদানি করা তেল থেকে। ১৯৭৩ সাল নাগাদ মোট মার্কিন জোগানের ২৭% ছিল মূলত মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা তেল।
ওই বছর ডিসেম্বরে ওপেক (অর্গানাইজেশন অব পেট্রলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ) ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন করার প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে এবং জোগানের আকস্মিক ভাটার কারণে পেট্রলের দাম বেড়ে যাওয়ায় শুরু হয় রেশনিং। বিভিন্ন গ্যাসস্টেশনে লম্বা লাইন দেখা দেয়। প্রথমবারের মতো আমেরিকান ড্রাইভাররা বুঝতে পারেন, পেট্রলের জোগান নিশ্চিত ধরে নিতে পারবেন না তাঁরা। তেলের এই ধাক্কা সরকারকে সারা দেশে গতিসীমা ঘণ্টায় ৫৫ মাইল বেঁধে দিতে বাধ্য করে। এ ছাড়া জ্বালানিসাশ্রয়ী অর্থনীতিতে মার্কিন উৎপাদকের তাদের সামগ্রিক পণ্যের ক্ষেত্রে গড়পড়তা ১৯৭৮ সালে ঘণ্টায় ১৮ মাইল এবং ১৯৮৫ সালে ২৭.৫ মাইল জ্বালানির সাশ্রয় নিশ্চিত করতে হয়।
কিন্তু আমেরিকান গাড়ি প্রস্তুতকারীরা তাদের পণ্য বদলাননি। ৭০-এর দশকের শেষ দিকে আমেরিকায় তৈরি ৭০% গাড়িরই ভি-৮ ইঞ্জিন ছিল। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় দফা তেলের ধাক্কায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেলের জোগান আরও একবার বিঘিœত হয়। এবার ইরানে ইসলামি বিপ্লব এবং পরের বছর ইরান-ইরাক যুদ্ধ বাধার কারণে। তেলের প্রকৃত উৎপাদন তেমন না কমলেও দাম চড়ে ওঠে, দেখা দেয় ত্রাস। এই দ্বিতীয় তেলের ধাক্কা ছোট গাড়ির চাহিদা উসকে দেয়।
বৈদ্যুতিক গাড়ি জ্বালানিভোগী গাড়ির স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ থেকে ফায়দা লুটতে পারে বলে হয়তো আশা করা হয়েছিল। কিন্তু বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রযুক্তি ১৯২০-এর দশকের পর থেকে খুব একটা এগোতে পারেনি। ব্যাটারি সবচেয়ে বড় সমস্যা রয়ে গেছে: লিড-এসিড ব্যাটারি তখনো ভারী এবং বিরাট ছিল, প্রতি ইউনিট ওজনের তুলনায় বেশি শক্তি ধারণ করতে পারত না। ১৯৭০-এর দশকের সবচেয়ে বিখ্যাত বৈদ্যুতিক গাড়ি চাঁদের বুকে আমেরিকান নভোচারীদের চালানো ফোরহুইল্ড লুনার রোভারগুলোকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য কাজ করতে হয়েছিল বলে নন-রিচার্জেবল ব্যাটারি চালিত ছিল।
৯০-এর দশকে রিচার্জেবল লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির আবির্ভাবের আগপর্যন্ত পৃথিবীর বুকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসাবে বৈদ্যুতিক গাড়িকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস হালে পানি পায়নি। ২০০৩ সাল নাগাদ অ্যালান কোকোনি এবং টম গেজ নামের দুই বৈদ্যুতিক গাড়িপ্রেমী চার সেকেন্ডেরও কম সময়ের ভেতর শূন্য থেকে ঘণ্টায় ৬০ মাইল গতিতে পৌঁছানোর ক্ষমতাধর ৬৮০০ ক্যামকর্ডার বাটারিচালিত ২৫০ মাইল পাল্লার ঃুবৎড় নামের একটি গাড়ি নির্মাণ করেন। এই প্রযুক্তির বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে টেসলা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি বৈদ্যুতিক গাড়িতে পরিবর্তন সম্ভব করে তোলে, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবিলায় কম্বাশন পাওয়ার্ড বাহনের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে এই পরিবর্তন এখন অনিবার্য বলেই মনে হচ্ছে।
অংশত একটি দূষণ মোকাবিলার লক্ষ্যে সূচিত অটোমোবাইল অন্য ধরনের দূষণের কারণ হয়েছে: জ্বলন্ত ফসিল জ্বালানি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ।
রাস্তার বাহনের বিদ্যুতায়ন কোন মাত্রায় জলবায়ু ইস্যুর সমাধান দেবে? ফসিল জ্বালানি পোড়ানোর কারণে বৈশ্বিকভাবে পরিবহন (ভূমি, সমুদ্র এবং আকাশপথসহ) ২৪% কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের জন্যে দায়ী। বৈশ্বিক মোট দূষণের জন্য রাস্তার বাহনের নিঃসরণের দায় ১৭%। এসব নিঃসরণের ভেতর আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশ তৈরি হয় মূলত হেভি ডিউটি ডিজেলচালিত বাহন (যেমন ট্রাক ও বাস) থেকে এবং দুই-তৃতীয়াংশ হালকা, মূলত পেট্রলচালিত বাহন (যেমন গাড়ি ও ভ্যান) থেকে।
এভাবে বৈদ্যুতিক গাড়িতে পরিবর্তন বৈশ্বিক নিঃসরণের ক্ষেত্রে বিরাট ছেদ ঘটাবে, যদিও বিরাট আকারের ট্রাক, জাহাজ এবং প্লেনের ফসিল জ্বালানি থেকে পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ রয়েই যাবে। কিন্তু এটা গাড়ির সাথে সংশ্লিষ্ট যানজট, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, কিংবা মাত্র একজন মানুষকে দোকানে পৌঁছে দিতে এক টন ওজনের বাহন ব্যবহারের সমস্যা দূর করবে না। অটোমোবাইলের উত্থান যেভাবে স্থিতিশীলতা এবং তেলের ওপর নির্ভরশীলতার ভূরাজনৈতিক পরিণাম নিয়ে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিল, সেভাবেই বৈদ্যুতিক গাড়িও সমান উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ব্যাটারি তৈরির জন্যে লিথিয়াম ও কোবাল্টের সরবরাহ দরকার এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় 'রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস' ইতিমধ্যেই পরিবেশগত ও ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।
লিথিয়ামের অগাধ সরবরাহ থাকলেও কোবাল্টের নেই। কংগো প্রজাতন্ত্র এর প্রধান উৎস। সেখানে মোট উৎপাদনের চার ভাগের এক ভাগই বেলচা আর মশাল ব্যবহার করে সারা হয়। খনিশ্রমিকদের অবস্থা শোচনীয়। এই শিল্পটি দুর্নীতি ও শিশুশ্রম ব্যবহারের অভিযোগে কাহিল। খনি থেকে তোলার পর কোবাল্ট মূলত চীনে পরিশোধিত হয়ে থাকে। চীন আবার বৈশ্বিক লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি উৎপাদনের সিংহভাগের মালিকানা ভোগ করার পাশাপাশি 'রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস'র উৎপাদনও নিয়ন্ত্রণ করছে।
ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ইতিমধ্যেই কম্পিউটার চিপস এবং সম্পর্কিত উৎপাদন সরঞ্জামের সরবরাহ নিয়ে চীন ও পাশ্চাত্য দেশগুলোর ভেতর বিরোধ জন্ম দিয়েছে। সুতরাং বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণের জন্যে প্রয়োজনীয় খনিজ ও যন্ত্রাংশ নিয়েও মতদ্বৈততা কল্পনা করা কঠিন নয়। (এখানেই কোবাল্টের জোগান চালু রাখতে এবং চীনের ভেতর-বাইরে নিজস্ব ব্যাটারি কারাখানা সচল রাখতে টেসলার বিশাল খনি প্রতিষ্ঠান গেøনকোরের সাথে চুক্তিতে যাওয়ার ব্যাখ্যা মেলে। এখানে বিভিন্ন কোম্পানির কোবাল্টের বিকল্প হিসেবে গভীর সমুদ্রে খননের প্রয়াসেরও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।)
তাছাড়া ইতিহাস বলে, প্রপালশনের একটা ধরন থেকে আরেক ধরনের পরিবর্তন সত্তে¡ও অন্য সবকিছু আগের মতোই থাকবে ধরে নেওয়া আনাড়িপনা হবে। ঘোড়ায় টানা গাড়িকে যখন গাড়ি প্রতিস্থাপন করে, তখন সেটা হয়নি। কেউ কেউ বলেন, কেবল গাড়িকে শক্তি জোগানো প্রপালশন নয়, বরং গাড়ির মালিকানার ধারণাও নতুন করে ভাববার এখনই সময়।
শহুরে পরিবহনব্যবস্থার ভবিষ্যৎ বিশেষ কোনো প্রযুক্তির ওপর নয়, বরং স্মার্টফোন প্রযুক্তিতে নিবিড়ভাবে বোনা বৈচিত্র্যময় পরিবহনব্যবস্থার মিশেলের ওপর নির্ভর করবে। সমগ্রিকভাবে, যাত্রার একটা ক্রমবর্ধমান অংশের বেলায় মালিক না হয়েও ব্যক্তিগত গাড়ির সুবিধা পেতে সাহায্য করার মতো রাইড-হেইলিং, মাইক্রোমোবিলিটি এবং অন-ডিমান্ড-কার রেন্টাল পরিবহনের নতুন ধারণার জন্ম দিচ্ছে।
প্রযুক্তি বিশ্লেষক হোরেস দিদিউ 'গাড়ি মুক্ত করা'কে সস্তা, দ্রুততর এবং ঢের বেশি সুবিধাজনক বিকল্প হিসেবে উল্লেখ করছেন, এটা ধীরে ধীরে বিপুল গাড়ির মালিকানার পক্ষে যুক্তিকে ক্রমে দুর্বল করছে।
এক ধরনের 'ইন্টারনেট মোশন' তৈরির লক্ষ্যে পরিবহনের এসব বিভিন্ন ধরনকে একীভূত করার ক্ষমতা বোঝায় যে পরিবহনের নির্দিষ্ট একটি উপায়ের বদলে স্মার্টফোনই গাড়ির সত্যিকারের উত্তরসূরি। গতির ইন্টারনেট গাড়িভিত্তিক বিভিন্ন শহরে অস্তিত্ববান মনোকালচার থেকে পালানোর পথ বাতলে দিচ্ছে। বিশ শতকের অভিজ্ঞতা থেকে একটি পরিবহন মনোকালচারকে অন্য একটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা ভুল হবে জানা থাকায় একে স্বাগত জানানো উচিত। একক পরিবহন মনোকালচার কম শিথিল, এর অনাকাক্সিক্ষত পরিণাম সহজেই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে সমাধান কঠিন করে ফেলে।
কম্বাশন ইঞ্জিনের বিদায়ের সাথে সাথে গাড়ি, ট্রেন এবং অন্যান্য স্থল পরিবহনের উপায় বৈদ্যুতিক হয়ে গেলে নিঃসরণ আর সমস্যা থাকবে না। (শূন্য কার্বন গ্রিড থেকে নবায়নযোগ্য শক্তিতে চালিত হলে বৈদ্যুতিক পরিবহন সত্যিকার অর্থেই নিঃসরণমুক্ত হয়ে উঠবে।) কিন্তু পরিবহনব্যবস্থা অন্য ধরনের সম্ভাবনাময় সমস্যাসংকুল পরিণাম নিয়ে আসবে: ডেটা। বিশেষত কে কোথায় গেছেন, কখন গেছেন, কীভাবে গেছেন, কার সাথে গেছেন, সে সম্পর্কিত অগুনতি ডেটার জন্ম দেবে। ইতিমধ্যেই সেটা ঘটতে শুর করেছে।
রাইডস অব গ্লোরি নামের ২০১২ সালের একটি কুখ্যাত (এবং সেকারণে মুছে ফেলা) ব্লগ পোস্টে উবার, ধরা যাক, এক রাতের অবস্থানের ক্ষেত্রে শহর আর দিন নির্ধারণের লক্ষ্যে যাত্রীদের আচরণ বিশ্লেষণ করে। পোস্টটি ভীষণ শোরগোলের জন্ম দেয়। তখন একে উবারে অস্তিত্ববান বল্গাহীন 'টেক-ব্রো' সংস্কৃতির লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়েছে। তবে অন্য একটা বড় ব্যাপার তুলে ধরছে এটা। শেয়ার্ড বাইক এবং ই-স্কুটারও বিল করার স্বার্থে কে কোথায় এবং কখন গেছেন ট্র্যাক করে।
মোবিলিটি সার্ভিস পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো তাদের ডেটা নিজেদের কাছে রাখার ব্যাপারে উৎসাহী: এটা তাদের আগামী চাহিদা অনুমানে সাহায্য করে, নতুন সেবা চালুর ক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে এবং যাত্রীদের প্রোফাইল তৈরি এবং বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য স্থির করতে কাজে লাগতে পারে। বাইক লেনের সংস্থান সমন্বয়, নিম্ন আয় ও উচ্চ আয় মহল্লায় ব্যবহারের হার, গাড়িগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেই খোঁজ রাখতে বিভিন্ন শহর শেয়ার্ড বাইসাইকেল এবং ই-স্কুটারের অবস্থান ও ব্যবহার ট্র্র্যাক করতে চায়। দুনিয়াজুড়ে তাই কয়েক ডজন শহর মোবিলিটি ডেটা স্পেসিফিকেশন (এমডিএস) নামের একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এখন এমডিএস শুধু বাইসাইকেল এবং ই-স্কুটারই কাভার করছে, যদিও একে আগামীতে রাইড-হেইলিং, কার শেয়ারিং এবং স্বায়ত্তশাসিত ট্যাক্সি সার্ভিস কাভারের কাজে সম্প্রসারিত করা যেতে পারে।
কিন্তু এমডিএস বিভিন্ন শহরকে ব্যক্তির ওপর নজরদারি করার সুযোগ দিচ্ছে বলে মোবিলিটি সার্ভিস এবং প্রাইভেসি গ্রæপগুলো উদ্বিগ্ন। উদাহরণস্বরূপ এটা বিভিন্ন বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বা বিশেষ কোথাও যাওয়া ব্যক্তিকে শনাক্তকরণে পুলিশকে সুযোগ করে দিতে পারে। এমডিএসের তত্ত¡াবধায়ক ফাউন্ডেশন নিরাপদভাবে ডেটা সংরক্ষণ করবে না বলেও তারা উদ্বিগ্ন। কোনো কর্র্তৃত্বপরায়ণ শাসক এই ধরনের ডেটা নিয়ে কী করতে পারে, কল্পনা করা কঠিন নয়।
এসবই ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত মোবিলিটি ডেটার একধরনের ফ্ল্যাশপয়েন্ট হয়ে ওঠার কথা জানাচ্ছে। একে নিগূঢ় সমস্যা মনে হতে পারে, কিন্তু অটোমোবাইল যুগের সূচনায় একই রকম অলক্ষে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। এবং সে কালের মানুষের মতোই যাঁরা আজ নতুন মোবিলিটি সার্ভিস ব্যবহার করছেন, দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই তাদের বেলায় এই ধরনের উদ্বেগের সমাধানের সুযোগ রয়েছে।