জীবনানন্দ এবং জীবনানন্দ...
যে বা যারা ভাবে জীবনানন্দ দাশ আত্মহত্যা করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি, হাসপাতালের বেডে শুয়ে কবির আর্তি:
'আমি বাঁচব তো?'
বুবু আমায় বাঁচিয়ে দে ভাই।
'ডাক্তারবাবু... আমাকে আপনারা বাঁচিয়ে দিন ডাক্তারবাবু।'
মানুষটা ভেবে আকুল হন:
'আচ্ছা এত যে লিখলাম, এর একটিও কি সুপ্রীম পোয়েট্টি হয় নি? যা আমার মৃত্যুর পর বেঁচে থাকতে পারে?'
এই আকুতি যাঁর তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন!
* 'বুবু' জীবনানন্দ দাশের কাকার ছেলে অমলানন্দ দাশের ডাকনাম। পেশায় ডাক্তার ছিলেন।
২.
যেখানে যেখানে শোভনা গেছেন, পিছুপিছু জীবনানন্দ দাশও গেছেন।
শোভনা কিছুদিন শিলঙের লেডিকিন গার্লস কলেজে পড়িয়েছিলেন, জীবনানন্দ সেখানে গিয়েও হাজির। তখনও শোভনার বিয়ে হয়নি। কলেজটিও নতুন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শোভনার বাবা অতুলানন্দ দাস তখন ডিব্রুগড় থেকে শিলঙে পোস্টিং। শিলং তখনও আসামের অন্তর্গত।
জীবনানন্দের এই শিলং পর্বের কথা ডায়েরিতে বিস্তারিত আছে, গল্প ও কবিতাতেও কী আর খুঁজে পাওয়া যাবে না!
শিলং পাহাড়ে বসেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'যক্ষপুরী' তথা পরবর্তীকালের 'রক্তকরবী' নাটক রচনা করেন। এবং এই নাটকটি লেখার নেপথ্যে প্রেরণা ছিল রানু নামের একটি মেয়ে। অনেকে বলেন নন্দিনী আসলে রানু। এই নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কও অবশ্য আছে।
জীবনানন্দের অবশ্য সেই পরিসর ছিল না, ছিল না অবকাশ, সৃষ্টির জন্য ছিল না কোনও প্রেরণা। নিছক অবশেসড্ ছিলেন বলেই, প্রেম দ্বারা তড়িতাহত হয়েছিলেন বলেই পরিত্রানহীন ছুটে গেছেন। একটা আগাগোড়া 'অস্তিত্ন' ছিল শুধু মানুষটার। রক্তমাংসচামড়াহীন অস্তিত্ব শুধু। ডায়েরিতে তো তিনি সেই সঙ্কটের কথাই লিখবেন। সতত সতর্ক থেকে ভয়াবহভাবে জলে ডুবে যাওয়ার কথা লিখবেন।
২০০২- এ শোভনা তথা বেবি তথা 'Y'-এর যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তাতে তিনি পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করে বলেছিলেন:
'ঢাকার মেয়েরা জীবনানন্দ দাশকে তুলেছে'!
খুব জানতে ইচ্ছে করে ঢাকার কোন কোন মেয়ে জীবনানন্দ দাশকে তুলেছে বা জনপ্রিয় করেছে বা নিদেনপক্ষে নিবিড় পাঠ করেছে?
আমি সময়সীমাটা না হয়, ১৯৫৪ থেকে বাড়িয়ে ২০০২ করলাম।
হতে পারে ৮৭ বছরের বৃদ্ধা ভুল বলেছেন, তবু এমন একটা ভাবনা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তো!
লাবণ্য নিশ্চয় নয়।কারণ সেই সাক্ষাৎকারেই লাবণ্য সম্পর্কে অনেক বিরূপ মন্তব্য ছিল।বাংলাদেশের মেয়েরা বললে তবু বুঝতাম,একদম স্পেসিফিক 'ঢাকার মেয়ে'!
কোনও সূত্র পাচ্ছি না, কোনও তথ্য পাচ্ছি না, পাচ্ছি না সামান্যতম কোনও আলোও।
আজ সকালে সাক্ষাৎকারের খাতাটা দেখতে দেখতে এসব কথা মনে পড়ল।
একটা যোগ কোথাও ছিল।বেশ কিছু মহিলার সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের যোগাযোগ ছিল।নাটোরের রাজবাড়ির গল্পটা গল্পই, তবে 'পূর্ববঙ্গ সাহিত্য' বলে একটা বিষয় ছিল আর তার প্রতিনিধিত্ব স্থানে ছিলেন জীবনানন্দ।
আসলে এত দেরি হয়ে গেল। দেরি হয়ে যায়।নইতো ঠিক খুঁজে পাওয়া যেত অরুণিমা সান্যাল বা নীহারিকা মিত্রকে। দেখা মিলত সুরঞ্জনা বা সুচেতনার।
বলছি না এদের দেখা পাওয়া গেলেই রাতারাতি জীবনানন্দ দাশের সমস্ত কবিতার অর্থ উদ্ধার হয়ে যেত তবু তো আমরা বোদল্যেরের মতো, কাফকার মতো, মায়াকোভস্কির মতো প্রেরণাদাত্রী নেপথ্যের নারীটিকে আবিষ্কার করতে পারতাম।
আমাদের ঘোমটার নীচে খেমটা নাচ আছে, আমাদের মনোবিকার আছে অথচ প্রতিকার নেই, আমাদের সন্তানসন্ততি আছে অথচ যৌনতা নেই! হায়!
৩.
জীবনানন্দ দাশ নাকি হাসপাতালের শেষ শয্যা থেকে লাবণ্য দাশকে বারবার মৌখিক নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন তোরঙ্গে রক্ষিত রচনাবলী যেন বাইরের কাউকে দেখানো না হয়, প্রকাশ তো দূর অস্ত্!
এরপরও যখন কেউ কেউ অতি উৎসাহিত হয়ে 'মাল্যবান' ছাপানোর জন্য পেড়াপেড়ি করতে থাকে তখন লাবণ্য দাশ তাদের বলেছিলেন, পরলোকগত জীবনানন্দ দাশ নাকি নিয়মিত কবিজায়াকে দেখা দিচ্ছেন এবং 'মাল্যবান'-এর প্রকাশোপযোগিতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ও প্রকাশনার বিপক্ষে অগ্রিম অভিমত জ্ঞাপন করেছেন।
অথচ আমরা জানি জীবনানন্দ দাশ সাগরময় ঘোষের কাছে উপন্যাস ছাপানোর জন্য তদ্বির করছেন, প্রতিভা বসুর কাছে উপন্যাস বিক্রির বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন, সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে চিঠিতে ছদ্মনামে উপন্যাস লিখবার বাসনার কথা জানাচ্ছেন বা প্রভাকর সেনের মতো কাউকে কাউকে গল্প-উপন্যাস পড়তে দিচ্ছেন। এমনকি 'মাল্যবান'-এর চিত্রনাট্য লিখে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে জমা দেবেন বলে ভেবেছেন।
আসলে লাবণ্য দাশ মানুষ হিসেবে কেমন সে বিচারে যাচ্ছি না। তবে স্ত্রী হিসেবে স্বামীকে বুঝে ওঠার রসায়নে কিছু গণ্ডগোল ছিল। যে জীবনানন্দ দাশ আজীবন নাস্তিক ছিলেন তিনি কিনা ভূত হয়ে 'মাল্যবান' লিখতে মানা করবেন বা হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে ফেলতে নির্দেশ দেবেন। জীবনানন্দ দাশ তো সারাজীবন পাণ্ডুলিপি বরং স্ত্রীর কাছ থেকেই বেশি লুকিয়েছেন!
আসলে লাবণ্য দাশের 'মানুষ জীবনানন্দ' বইটিও আদ্যপ্রান্ত মনগড়া কথায় ভরা। আয়না নয়। ঘষা কাচ হলে প্রতিফলন তেমনই হতে বাধ্য। 'মাল্যবান' পড়েননি লাবণ্য, যদি পড়তেন কখনই প্রকাশের পথে এত বাধা সৃষ্টি করতেন না।
৪.
ঘুরে ঘুরে বনলতা সেনের কথাই ফিরে আসে। কেন আসে জানি না। হয়তো বনলতা সেন জীবনানন্দ দাশের অস্তিত্বের অস্তিত্ব তাই। জলের মতো যে একা কথা কয়।
কমপক্ষে একজন বনলতা সেন ছিলেন। বনলতা সেন নামেই। তবে তিনি নাটোরের নয়। বরিশালের বনলতা সেন। ডায়েরির সাক্ষ্যও সেকথাই বলে। গল্প উপন্যাসে তো আছেই। এবং কবিতাতে।
তো কেমন সেই বনলতা সেন?
একজনের লেখায় পাচ্ছি সেই বনলতা সেন মেধাবী ও তার্কিক।
তর্ক করতে গিয়ে তাঁর কন্ঠস্বর কখনও উত্তেজিত হত না। চুলচেরা সিদ্ধান্তে না পৌঁছানো অবধি এই বনলতা সেনের হাত থেকে নিস্তার নেই। তাঁর যেন বুঝতেই হবে, বোঝাতেই হবে কোন লেখার কোন লাইনের নেপথ্যে যুক্তি কী!
একটা প্যারা বনলতা পড়ছেন, তারপর চলছে তার ব্যাখ্যা। বনলতা একাই একশো। হিজিবিজি আবোল-তাবোল বললে চলবে না। তিনি নিজেও তা বলেন না। অন্যে বললেও রেহাই নেই। বইয়ের প্রতিটি বাক্যের যুক্তি থাকা চাই, প্রতিটি শব্দের অর্থ হওয়া চাই।
কী বই পড়ছেন বনলতা সেন? লেনিন, মার্কস, এঞ্জেলস! বনলতার চিন্তার তীক্ষ্ণ গতি ডানা মেলে অতীত বর্তমান ভবিষ্যতে। মহাবিশ্বের আদি ও অন্তকে অণুপরমাণুকে ধ'রে বনলতার ভাবনা এগোয়। গ্রহ, নক্ষত্র, নেবুলা, ম্যাটার, এনার্জি, সৃষ্টি, স্থিতি, বিলয় সব ছাই ছাই হয়ে যাচ্ছে তবু বনলতার তর্ক থামে না।
জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের এমনই তো হওয়ার কথা। বুদ্ধ তিনি। তিনি অতীশ দীপঙ্কর। তিনিই মঞ্জুশ্রী। মঞ্জুশ্রী তিনবার (অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত) এবং দশ দিক (যার অর্থ উপরে, নিচে, বিশ্বের চারটি প্রধান দিক এবং চারটি মধ্যবর্তী বিষয়) বুদ্ধের জ্ঞানকে ব্যক্ত করেছেন। তিনি ধর্ম বোঝার দক্ষতা, পাশাপাশি ভাল স্মৃতি, মানসিক পরিপূর্ণতা এবং বাগ্মিতা দ্বারা সমৃদ্ধ।
আমি শিহরিত। আমি খুব চেষ্টা করছি এই বনলতা সেনের একটি ছবি যদি উদ্ধার করা যায়। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করব। কবিতার কবিতাকে মুগ্ধতার কথা জানাব।
৫.
তখনও ল্যান্সডাউন মোড়ের ছোটো চায়ের দোকানটা উঠে যায়নি। ১৯৯৪/৯৫ হবে। আমি ঘুরঘুর করতাম দেশপ্রিয় পার্কের আশেপাশে। যদি কোনও সূত্রে জীবনানন্দ দাশের কোনও খবর সংগ্রহ করতে পারি।
ভূমেন্দ্র গুহর সঙ্গে পরিচয় হবে আরও ৫/৬ বছর পরে, জীবনানন্দ জন্মশতবার্ষিকীও ৫/৬ বছর পরে। তখন কল্যাণকুমার বসুর কাছে নিয়মিত যাই। যে কল্যাণকুমার বসু ও ক্লিন্টন সিলি একসাথে সেই ১৯৬৭ সালে, জীবনানন্দ দাশের জীবনী রচনার কাজ শুরু করেছিলেন।
তো একদিন সেই চায়ের দোকানে বসে আছি। বৃদ্ধ একজন কর্মচারী চা পরিবেশন করছিলেন। কেন জানিনা, মনে হল, এই ভদ্রলোকের কাছে জীবনানন্দ দাশের হদিশ থাকলেও থাকতে পারে।
কথায় কথায়, সব অনুষঙ্গ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করবার পর, ভদ্রলোক জানালেন, জীবনানন্দ দাশ রোজ সকালে এই দোকানটিতে চা খেতে আসতেন। সাথে দু'পিস পাউরুটিও খেতেন। নীরবে খেয়ে কারও সাথে কোনও কথা না বলে যেমন আসতেন তেমন আবার ফিরে যেতেন।
আমার প্রশ্ন গৃহস্থ বাড়িতে সকালে এক কাপ চা-ও জুটতো না কবির! সম্পর্কটা তবে এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল!এতটাই যে জীবনানন্দ মারা যাবেন রাতে আর লাবণ্য পরেরদিন সেজেগুজে সকাল ৯টা নাগাদ মৃতদেহ দেখতে রওনা হবেন!
তেমন কোনও উচ্চাশা অবশ্য কোনোদিনই ছিল না জীবনানন্দের। তিনি জানতেন লেড়ি কুত্তাও তাঁর গল্পের নায়ক হতে পারে। এতটাই হিম্মত ছিল তাঁর।
লেখক বা অথর শব্দটির গোলকধাঁধায় তিনি পা দেননি। তিনি জানতেন এই অথর-ই মধ্যযুগের 'Auctor'!
কে 'Auctor'?
যে লেখকের লেখাপত্রে মানুষের অগাধ আস্থা ও নিখাদ বিশ্বাস সে-ই 'Auctor'! কিছু করা, গড়ে তোলা বা বেড়ে ওঠা থেকে কর্তৃত্ব(authority)!
জীবনানন্দ দাশ নিজে ও তাঁর গল্প উপন্যাস ও কবিতার চরিত্ররা এই অথোরিটি থেকে সর্বদা দূরে থেকেছেন।
তিনি জানতেন ক্ষমতা বলয়ের স্বরূপ:
'আজকালকার পৃথিবীতে বোলতা পিঁপড়ে মৌমাছি সকলেই প্রমিসারি নোট খায়, চেক খায়, চিনি মিছরি খেতে চায় না'।
জীবনানন্দের তো চা জুটবেই না। তিনি তো জানেন:
'পৃথিবীকে ধাত্রীবিদ্যা শিখায়েছে যারা বহু দিন
সেই সব আদি অ্যামিবারা আজ পরিহাসে হয়েছে বিলীন'
-
লেখক: জীবনান্দ গবেষক