নীল ও নীল বিদ্রোহ
ঐতিহাসিকভাবেই নীল একটি প্রাকৃতিক রঙ; একটি জটিল জৈব যৌগ রঙটাও বেশ স্পষ্ট। একালে প্রাকৃতিক নীল কম, সিনথেটিক নীল বেশি, ডেনিম কাপড় এর ব্লু জিনস নীলের চাহিদা এখনো বেশ ধরে রেখেছে। রঙ মেশানোর তারতম্য ভেদে একটি জিন্স ৩ থেকে ১২ গ্রাম নীল হরণ করে থাকে। খাদ্যরঞ্জক হিসেবেও নীলের ব্যবহার রয়েছে।
বেদনার প্রতীক হিসেবে কবিতায়ও নীলের ব্যবহার আছে অবশ্য তা বস্তুগত নীল নয়, আলঙ্কারিক। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পঙক্তি মনে আসতে পারে।
আকাশ কেন নীলবর্ণ?
সাপে কাটল কি?
অনেক ধরনের গাছ, সামুদ্রিক শামুক ইত্যাদি থেকেও নীল রঙ বের করে আনা যায়, কিন্তু ইন্ডিগোফেরা প্রজাতির গাছই সর্বাধিক নীলের যোগান দেয়। নীলের প্রথম ব্যবহারের প্রমাণ মেলে পেরুতে প্রায় ৬০০০ বছর আগে। শত শত বছর ধরে ভারত, জাপান, দক্ষিণ পূর্ব এশীয় দেশসমূহ বিশেষ করে সিল্ক নীল রঙ করতে এই গাছের প্রাকৃতিক নীল ব্যবহার করে আসছে। ভারত থেকে ইউরোপে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে নীল পাঠানোর ইতিহাস বহু পুরোনো: গ্রিক-রোমান যুগের। মেসোপটোনিয়া ও মিশরীয় সভ্যতায় এই রঙের ব্যবহার ছিল। মেসোআমেরিকা, পেরু, ইরান এবং পশ্চিম আফ্রিকায় বেশ প্রচলিত ছিল এই জৈব রঙ। তবে এর আদি উৎস ভারত।
জ্বলে উঠল নীলের আগুন
সেকালে ওয়ারলেস ছিল না, টেলিফোন ছিল না, দরিদ্র ও নিপীড়িত কৃষকের একদিকে ছিল বুক ফাটা দীর্ঘশ্বাস অন্যদিকে মরিয়া হয়ে উঠে বলিষ্ঠ একজোড়া হাত। এই দীর্ঘশ্বাসই সারা বাংলার নীল নির্যাতিত কৃষকদের একসূত্রে গেঁথে নিয়েছিল আর সে কারণে কাছাকাছি সময়ে একটার পর একটা ঘটনা ঘটতে থাকে-প্রত্যেকটির পেছনে জ্বলছিল বিদ্রোহের আগুন। সূচনা বাংলাদেশের যশোরের চৌগাছায়।
রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুপ্রকাশ রায় ও ব্লেয়ার কিং এবং প্রমোদ সেনগুপ্তর রচনা থেকে কিছু উদ্ধৃতি একটি স্পষ্ট ছবি তুলে ধরবে।
নীল বিদ্রোহ পাবনাতে সহিংসরূপ ধারণ করেছে। সেকেন্ড বেঙ্গল পুলিশ ব্যাটালিয়নের প্রধান নায়েক হাবিলদার সেভো খানকে সৈন্যদলের নেতৃত্ব দিয়ে পাবনা পাঠানো হয়েছে। সেভো খানের একটি পত্র থেকে বিদ্রোহীদের সাথে তার বাহিনীর খন্ড যুদ্ধের একটি বিবরণী :
'সকাল বেলায় আমরা প্রস্তুত হইয়া পিয়ারী নামক একটি গ্রামে মার্চ করিয়া গেলাম। সেই গ্রামে পৌঁছিবামাত্র লাঠি বল্লম ও তীর ধনুকে সজ্জিত হইয়া দুই সহস্র কৃষক আমাদিগকে চতুর্দিক হইতে ঘিরিয়া ফেলিল। তাহারা ক্রমশ আমাদের দিকে অগ্রসর হইয়া আসিল। তাহাদের বল্লমের আঘাতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অশ্ব আহত হইল। আমরা সংবাদ পাইলাম যে, পাশ্ববর্তী বায়ান্নখানি গ্রাম হইতে এই বিদ্রোহীরা সমবেত হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে এক ব্যক্তি আমাদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল এবং তাহার দিক হইতে কয়েকটি বন্দুকের গুলির শব্দও আসিয়াছিল।
এই বিবরণী কিছুটা পরিবর্তিত আকারে সি এফ বাকল্যান্ডের বেঙ্গল আন্ডার লেফটেন্যান্ট গর্ভনর প্রথম খন্ডে পাওয়া যাবে।
১৮৬০ সালের ৫ জুলাই লিখিত শিশির কুমারের পত্র যোগেশচন্দ্র বাগলের পিজেন্ট রেভ্যুলুশন ইন বেঙ্গল-এ উদ্ধৃত হয়েছে এবং সুপ্রকাশ রায়ের গ্রন্থে (ভারতের কৃষক
বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম) এবং অনূদিত একাংশ তুলে ধরছি:
'নীলকর কেনির লোকেরা একজন চাষীকে অপহরণ করিয়াছে। এই সংবাদ প্রচারিত হইবামাত্র সাতাশখানি গ্রামের কৃষক কেনির কুটির সহিত সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিল।
শিশির কুমারের ৮ আগস্টের (১৮৬০) পত্র:
'যশোহরের রায়তগণ ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। সংগ্রামের প্রধান কেন্দ্র ছালকোপা, বিজলিয়া রামনগর প্রভৃতি স্থানের কুঠিগুলি। সহস্র সহস্র কৃষক নীলকুঠির আক্রমণ প্রতিরোধ করিবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বলপূর্বক ফসল লইয়া যাইবার জন্য নীলকরগণ রিভলবার গুলিবারুদ ও লাঠিয়াল সংগ্রহ করিতেছে। গ্রামের কৃষকগণও লাঠি ও বল্লম সংগ্রহ করিতেছে। তাহাদের প্রতিজ্ঞা এই যে মূল্য না দিয়া তাহারা ফসল লইয়া যাইতে দিবে না।
সুপ্রকাশ রায় একজন ইংরেজ লেখকের 'প্ল্যান্টার্স সাম থার্টি ইয়ার্স এগো' প্রবন্ধের অনুবাদে উদ্ধৃতি দিয়েছেন :
অসংখ্য ভয়াবহ দাঙ্গা হাঙ্গামার কথা আমরা জানি। বহু ক্ষেত্রে নীলকর সাহেব কৃষক লাঠিয়ালদের দ্বারা আক্রান্ত হইয়া তাহার তেজস্বী ঘোড়ার পিঠে চাপিয়া অতি দক্ষতার সঙ্গে পলায়ন করিয়া প্রাণ বাঁচাইয়াছে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকের সশস্ত্র আক্রমণের দ্বারা নীলকুঠিগুলিকে ধূলিস্যাৎ করিয়া দিয়াছে: অনেক স্থানে এক পক্ষ বাজার লুট করিয়াছে, তাহার পরক্ষণেই অপর পক্ষ আসিয়া তাহার প্রতিশোধ লইয়াছে।
সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাস থেকে সুপ্রকাশ রায় উদ্ধৃত করেছেন, সেই বিবরণীর একাংশ মাত্র:
লড়াই হইয়াছিল কত লোক কত স্থানে হত বা আহত হইয়াছিল তাহার খবর নাই। এইটুকু খবর আছে তাহাদের যন্ত্রণা ও মৃত্যু সফল হইয়াছিল। জেদ বজায় হইয়াছিল। মোল্লাহাটির (যশোহরের একটি নীলকুটি) যে লম্বা লাঠির বলে নীলকরেরা বাঘের মত দেশ শাসন করিতেন প্রজারা চাষ বন্ধ করিলে সে লাঠির আঁটি পড়িয়া রহিল, উহা ধরিবার লোক জুটিল না, নীলকরের উৎপাত বন্ধ হইয়া আসিল।
ক্যালকাটা রিভিউ জানুয়ারি-জুন ১৮৬০-এ প্রকাশিত ইন্ডিগো ব্লু বুক এ উল্লেখ করা হয়েছে:
সমগ্র বাংলার গ্রামীণ জনগণের মধ্যে আকাঙ্খিত ও লক্ষণীয় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। সকলেই হঠাৎ তাদের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করতে শুরু করেছে।
জমিদার এবং নীলকরের অনুগত রায়ত হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠে তারা নিজেদের শেকল ঝেড়ে ফেলে। যে অস্বাভাবিক অনুভূতি নিয়ে ভাটি বাংলার কৃষক নীলচাষকে বিবেচনা করছে তার বিস্ফোরণ আগে থেকে আঁচ করা যায়নি।
১৮৫৭ ঘটনাপ্রবাহের (সিপাহি বিদ্রোহ) লক্ষণগুলোর সাথে এর যে নৈকট্য দেখা যাচ্ছে আগামী দিনের বাংলার উপর তার বিশেষ প্রভাব না পড়ার কারণ নেই।
ইন্ডিগো কমিশন: বাংলার প্রজা ক্রীতদাস নয়
নীল বিদ্রোহ প্রশমন এবং কিছু পরিমাণে হলেও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৬০ সালের ৩১ মার্চ ব্রিটিশ সরকার ইন্ডিগো কমিশন গঠন করে। কমিশনের সকল শ্বেতাঙ্গ সদস্যের মধ্যে একজন কেবল শ্যামবর্ণ ভারতীয় আর তিনিও একজন জমিদার। এই কমিশনকে লেফটেন্যান্ট গভর্নর পিটার গ্রান্ট স্পষ্ট জানিয়ে দেন: বাংলার প্রজা ক্রীতদাস নহে, উপরন্তু প্রকৃতপক্ষে জমির স্বত্বাধিকারী। তাদের পক্ষে এইরূপ ক্ষতির (নীলচাষের কারণে) বিরোধী হওয়া বিস্ময়কর নহে। যাহা ক্ষতিজনক তাহা করাইতে গেলে অত্যাচার অবশ্যম্ভাবী, এই অত্যাচারের আতিশয্যই নীল বপণে প্রজার আপত্তির মুখ্য কারণ। (সুপ্রকাশ রায়ের গ্রন্থ)
ইন্ডিগো কমিশন প্রতিবেদন
উল্লেখ্য ব্রিটিশ আইনসভায় নীল কমিশন গঠনের প্রস্তাবটির একটি অন্যতম লক্ষ ছিল নীলকরদের স্বার্থ সংরক্ষণ। কমিশনের প্রধান হয় ডব্লিউ এস সেটলকার, অন্য সদস্যরা হলেন: আর টেম্পল, রেভারেন্ড জে সেল (মিশনারি ও প্রজাস্বার্থ দেখবেন), ডব্লিউ এফ ফার্গুসন (নীলকরদের স্বার্থ) বাবু চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় (জমিদার স্বার্থ)। কমিশন ১৩৬ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাক্ষ্য গ্রহণ করে ১৮৬০ সালের ২৭ আগস্ট যে প্রতিবেদন দাখিল করে, তাকে পক্ষপাতদুষ্ট চিহ্নিত করার সুযোগ নেই। বরং নীলকরদের অপকীর্তির দীর্ঘ ফিরিস্তি তাতে উঠে এসেছে।
ইন্ডিগো কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেট ই. ডব্লিউ. এল. টাওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলেন: 'আমি সচক্ষে দেখিয়াছি কয়েকজন রায়তকে বর্ষাবিদ্ধ করা হইয়াছে। অন্য কয়েকজনকে গুলি করিয়া মারা হয়েছে। আর কয়েকজনকে প্রথমে বর্ষায় বিদ্ধ করিয়া পরে গুম করা হইয়াছে। (রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস আধুনিক যুগ)। একই গ্রন্থে হিন্দু প্যাট্রিয়টে প্রকাশিত একটি বিবরণীর অনুসৃতি:
সিরাজগঞ্জ মহকুমার এক নীলকর একশত লাঠিয়াল লইয়া গাবগাছি গ্রামে যান। সেখানকার লোকেরা নীলচাষ করিতে অস্বীকৃত হওয়ায় তাহাদের শায়েস্তা করিবার আদেশ দিয়া সাহেব চলিয়া আসেন। লাঠিয়ালরা বাড়িঘর পোড়ায়, ১০০ গরু বাছুর নিয়া যায় এবং গ্রামবাসীদিগকে নির্দয়ভাবে প্রহার করে ফলে একজন নিহত হয় ও দুইজন গুরুতর আঘাত পায়। ইহার বিরুদ্ধে অভিযোগ হইল কিন্তু সাহেবের কিছুই হইল না, কেবল তিনজন লাঠিয়ালের সামান্য দন্ড হইল। কৃষ্ণনগর হইতে ছয় মাইল দূরে এক নীলকুঠিতে রায়তদিগকে আটক করিয়া বেত্রাঘাত করা হইত... এইরূপ ছয়জন কয়েদীর মধ্যে পাঁচজনকে ত্রিশ করিয়া এবং একজনকে ষাটটি বেতাঘাত করা হইয়াছিল।
ফোরলঙ ও লারমোর
রমেশচন্দ্র মজুমদার উল্লেখ করেছেন ১৭৭২ সালে একজন ফরাসি ব্যবসায়ী বৃহৎ বাংলার চন্দন নগরের গোঁদলপাড়া গ্রামে সবার আগ নীলচাষ করেন (অন্যত্র বলা হয়েছে ফরাসি লুই বোনার ১৭৭৭ সালে প্রথম নীলচাষ করেন); কোম্পানি এবং ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা নানা স্থানে কুঠি স্থাপন করে এবং নীলচাষ বেড়ে যায়। কারণ যে দামে ব্যবসায়ীরা নীল উৎপাদন করাতেন বা ক্রয় করতেন লন্ডনের বাজারে তার চেয়ে তিন থেকে চারগুণ বেশি মূল্যে তা বিক্রি হতো। ১৮২০ এর দশকে কেবল নীল বিক্রি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বছরে দশ বারো লক্ষ টাকা লাভ করত। ব্লেয়ার কিং দেখিয়েছেন ১৮২৬ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত ৩০ বছরে রপ্তানি পণ্য হিসেবে একমাত্র আফিমই নীলের চেয়ে এগিয়ে ছিল।
১৮৫৯ সালে বাংলায় নীলকরের সংখ্যা ছিল আনুমানিক পাঁচশত। বাংলাতেই উৎপাদিত হতো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নীল, বাংলায় উৎপাদিত নীলের অর্ধেক উৎপন্ন হতো যশোর ও নদীয়া জেলায়। ঢাকা ও আশেপাশের জেলাগুলো নীলের চাষ এককভাবে জে পি ওয়াইজের (যার নামে ওয়াইজঘাট) নিয়ন্ত্রণে ছিল। রবার্ট ওয়াটসন কোম্পানির ৭টি কুঠি ছিল মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী ও পাবনায়। নীলকুঠির দু'জন ডাকসাইটে ম্যানেজারের নাম ছিল সবার মুখে মুখে, একজন বেঙ্গল ইন্ডিয়া অ্যান্ড কোম্পানির মফস্বল বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার রবার্ট লারমোর এবং অন্যজন জেমস হিল অ্যান্ড কোম্পানির জেমস ফোরলঙ।
উদারপন্থী ফোরলঙ ছিলেন মানবিক গুণসম্পন্ন্ এবং আপোষে কাজ আদায়ের পক্ষপাতি, অন্যদিকে লারমোর ছিলেন অনমনীয় এবং কৃষকের যে কোনো দাবিই তার কাছে ছিল অগ্রায্য।' ব্লেয়ার কিং উল্লেখ করছেন: জেমস ফোরলঙ এর মতো বিবেকবান নীলকর জনসাধারণের কাছে তাদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের চাইতেও আপন ছিলেন।
নীলের চাষ দু'ভাবে হতো একটিতে নীলকর নিজ জমিতে নিজ খরচে নিজ তত্ত্বাবধানে চাষ করাতেন; অন্যটি রায়তি প্রথায় নীল চাষীকে চাষের কিছু আগাম টাকা বা দাদন দিয়ে প্রতিকূল শর্তে চাষীর জমিতে চাষ করানো 'শর্তগুলো প্রজাদের বিশেষ অনিষ্টকর হলেও নীলকর সাহেবরা পাইক বরকন্দাজের সহায়তায় চাষীদিগকে জোর করিয়া এই শর্ত অনুসারে নীল চাষ করিতে বাধ্য করিতেন।'
একজন শেতাঙ্গের প্রতিবেদন ১৮৫৮-৫৯ সালে বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানির ৩৩২০০ চাষীর মধ্যে মাত্র ২৪৪৮ জন দাদন শোধ করে হাতে সামান্য কিছু পেয়েছে। আর সকলের ভীষণ ক্ষতি হয়েছে। নীল চাষ করব না সে কথা বলারও সুযোগ ছিল না। একদল লাঠিয়াল ও নিজেদের পাইক বরকন্দাজসহ গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া নীল চাষ অনিচ্ছুক চাষীদের ঘরবাড়ি জ্বালাইয়া দিত, গরুবাছুর কাড়িয়া নিত, জোয়ান পুরুষদের ধরিয়া নিয়া নীল কুঠিতে অন্ধকার কক্ষে মাসের পর মাস আটক করিয়া রাখিত ও বেত্রাঘাতে জর্জরিত করিত এবং আরও নানাপ্রকার শারীরিক দন্ড দিত। চাষী মেয়েদের উপরও অত্যাচার করিত। আমেরিকার নিগ্রো দাসদের যে লাঞ্ছনা ও উৎপীড়ন সর্বজনবিদিত, বাংলার নীলচাষীদর অদৃষ্টেও তাহাই ঘটিত। (রমেশচন্দ্র মজুমদারের গ্রন্থ)
অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাবার দুটি কারণ রমেশচন্দ্র নির্দেশ করেছেন: প্রথম কারণ : কখনও কখনও জমিদার তার জমিদারির অন্তর্গত নীলচাষীর পক্ষে দাড়িয়ে তাকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হতে। নীলকর তখন ঐ জমিদারি ক্রয় করার জন্য সব ধরনের দুষ্কর্ম করত, এবং শেষ পর্যন্ত তা ক্রয় করত। দ্বিতীয় কারণ: সরকার নীলকরদের কাউকে কাউকে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট বানাতেন, অত্যাচারী নীলকরের বিরুদ্ধে নালিশ করতে হত অপর এক অত্যাচারী নীলকরের কাছে সুতরাং অবিচার প্রাপ্তিই হয়ে উঠত তার নিয়তি।
হোলে ভক্ষকেতে রক্ষাকর্তা
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২ - ১৮৫৯) নীলের যন্ত্রণা দেখেছেন, নীল বিদ্রোহের এক দশক আগেই প্রয়াত। কুইন মা মাগো মহারানি ভিক্টোরিয়াকে শোনাতে 'নীলকর' লিখেছেন:
নীলকরের হদ্ধ নীলে, নীলে নিলে সকল নিলে
এইদেশে উঠেছে এইভাষ
যত প্রজার সর্বনাশ।
কুটিয়াল বিচারকারী লাঠিয়াল সরকারি
বানরের হাতে কালের খোন্তা
খোন্তা জলে চাষ।
হলো ডাইনের কোলে ছেলে সোপা
চীলের বাসায় মাচ।
হবে বাঘের হাতে ছাগের রক্ষে
শুনেনি কেউ শুনবে না।।
হোলে ভক্ষকেতে রক্ষাকর্তা ঘটে সর্বনাশ।
বাংলাদেশী নব্য নীলকর একবিংশ শতকে!
এই বাংলার বঞ্চিত সংগ্রামী কৃষক যেখানে বিদ্রোহ করে বুকের রক্ত ঝরিয়ে নীলকরদের দেশ ছাড়া করেছে একবিংশ শতকে সেই বাংলাদেশেই সৃষ্টি হচ্ছে নব্য নীলকর, স্থাপিত হচ্ছে নীলকুঠি। ১৭৭৭ সালে ফরাসি লুই বোনার প্রথম ইউরোপিয় প্ল্যান্টার হিসেবে বাংলায় আনুষ্ঠানিকভাবে নীল চাষ শুরু করেন, তারপর ১৭৭৯ সালে ক্যারেল ব্লুম হুগলিতে স্থাপন করে কুঠি। তারপর পুরোটাই এ দেশের কৃষকের বঞ্চনা ও নিপীড়নে ইতিহাস। আড়াই শত বছর পর সেই বাংলাদেশেই নীল চাষ শুরু হয়েছে এবং কম পরিমাণে হলেও রফতানি আরম্ভ হয়েছে। ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে লিভিং ব্লু নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে উৎপন্ন ও প্রক্রিয়াজাত করা এক মেট্রিক টন নীল যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছে। নিজেরা কটেজ অ্যান্ড ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ এবং কেয়ার এন্টারপ্রাইজ এর যৌথ মালিকানায় এই লিভিং ব্লু প্রতিষ্ঠিত। রংপুরের জমিতে উৎপাদিত নীল ২০১৪ সাল থেকেই স্বল্প পরিমাণ রফতানির সূচনা হয়েছে। এখন রংপুরে নীলচাষীর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার আর রঙ প্রক্রিয়াকরণের শ্রমিক ২ শতাধিক। রংপুরের হরিদেবপুর, মমিনপুর, রাজেন্দ্রপুর, তারাগঞ্জসহ বেশ কটি ইউনিয়নে নীল চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে নীল বিরোধী আন্দোলনের সম্ভাবনা নেই, কারণ চাষীরাই মালিক।
নীলকরের জন্য নিক্ষিপ্ত জুতো
ডাকবিভাগের ইন্সপেক্টর দীনবন্ধু মিত্র 'সব দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়া' একটি নাটক লিখলেন : নীল দর্পণ। ঢাকায় রচিত ঢাকায় প্রথম প্রকাশিত এবং ঢাকায় প্রথম মঞ্চস্থ। কোলকাতায় মঞ্চায়নের সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নাটকে একটি চরিত্রে অভিনয় করলেন। চরিত্রটি ছিল নীলকর সাহেবের। বিদ্যাসাগর যখন মঞ্চে, কুঠিয়াল নীলকরকে দেখে একজন ক্ষুব্ধ দর্শক তার দিকে চটি ছুড়ে মারলেন।
নীল দর্পণ নিয়ে অবশ্যই পৃথক প্রবন্ধ হতে হবে। সতীশচন্দ্রের লেখা থেকে যে টুকু সুপ্রকাশ রায় উদ্ধৃত করেছেণ, সে অংশটুকুর পুনঃউদ্ধৃতি এই রচনাকে ক্ষুন্ন করবে না:
এই নাটকে দীনবন্ধুর তুলিকাপাতে নীলকর পীড়িত বাংলাদেশের এক জীবন্ত চিত্র প্রকাশিত হয়। কয়েক মাসের মধ্যে যখন এই নাটক পাদরী লঙ সাহেবের তত্ত্বাবধানে কবিবর মাইকেল মধুসূদন দত্তের নিপুণ লেখনীর সাহায্যে ইংরেজীতে ভাষান্তরিত হইল তখন নীলকর মহলে হইচই পড়িয়া গেল। তখন ক্ষিপ্ত নীলকর সম্প্রদায় অচিরে লঙ সাহেবের বিরুদ্ধে ভীষণ মোকদ্দমা আনিয়াছিলেন। সুপ্রীম কোর্টের বিচারে লঙ-এর একমাস কারাদন্ড ও সহস্র টাকা অর্থদন্ড হইয়াছিল। জরিমানার টাকা স্বনামধন্য কালীপ্রসন্ন সিংহ তৎক্ষনাৎ কোর্টে দাখিল করেন। এই কারাদন্ডের জন্য লঙ সাহেব দেশ প্রসিদ্ধ হইলেন... 'নীলদর্পণ' যতই পঠিত ও প্রচারিত হইতে লাগিল, নীলকরের অত্যাচার বৃত্তান্ত ততই দেশের সকল স্তরে রাষ্ট্র হইয়া বাড়িতে লাগিল।'
কয়েকজন কুঠিয়াল ও কয়েকটি কুঠির নাম
উদাহরণ হিসেবে কয়েকজন কুঠিয়াল ও কয়েকটি কুঠির নাম উল্লেখ করা হচ্ছে:
সি ডব্লিউ শেরিফ পোড়াদহ (১৭৯৫)
সি ডব্লিউ শেরিফ ও জন রিভস সিন্দুরিয়া (১৭৯৬)
মিষ্টার টাপ্ট মহম্মদশাহী (১৭৯৬)
মিষ্টার ফার্গুসান ও মিষ্টার মে, দহকোলা ও আলমপুর (১৮০০)
মিষ্টার টেলর, মহেশপুর (১৮০১)
মিষ্টার বার্কার, চুয়াডাঙ্গার নিশ্চিন্তপুর (১৮০১)
পরবর্তী সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কজন কুঠিয়াল হচ্ছেন : মিষ্টার টেলর ও মিস্টার ন্যুডসন, মিষ্টার রিজেন্ট, মিস্টার স্টিভেনশন, মিস্টার জেঙ্কিনসন ও মিস্টার ম্যাকেঞ্জি, মিস্টার ওয়াটস, মিস্টার ডেভরেল।
কেবল চুয়াডাঙ্গা মহকুমার ৬টি কুঠি হচ্ছে: সিন্দুরিয়া সদর কুঠি, নিশ্চিন্তপুর সদর কুঠি, চন্ডীপুর সদর কুঠি, খাল বোয়ালিয়া সদর কুঠি, লোকনাথপুর সদর কুঠি এবং কাঁচিহাটা সদর কুঠি। চরসিন্দুরিয়া কুঠিতে বছরের ১০০০ মন নীল। নীল বিদ্রোহ শুরু হলে সংঘবদ্ধ ক্ষুব্ধ চাষীরা সিন্দুরিয়া কুঠির গোমস্তা শীতল বিশ্বাসকে হত্যা করে।
পাদটীকা: নীল বিদ্রোহ সফল হয়েছে, সারাবাংলা জেগে উঠেছে, নীল কমিশন বসেছে, নীল চাষে বাধ্য করতে না পারার আইন হয়েছে এর সবই সত্য, ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু নীলের চাষ বন্ধ হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। সস্তা দামের সিনথেটিক নীল বাজারে এসে যাওয়ায় বাংলার নীলের চাহিদায় ধস নামে। নীলচাষ বন্ধের এটিই মূল কারণ।