ফুটবল বিশ্বকাপের মাধ্যমে কি আয়োজক দেশের অর্থনীতি চাঙা হয়?
দর্শকসংখ্যার ভিত্তিতে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের চেয়ে সব সময়ই খানিকটা এগিয়ে থাকে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক। কিন্তু তারপরও ফুটবল বিশ্বকাপে প্রতি চার বছর অন্তর কেবল একটি খেলাকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী যে উচ্ছ্বাস-উন্মাদনার সৃষ্টি হয়, তা এককথায় অতুলনীয়।
ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য মুখিয়ে থাকে সব দেশ। শেষ পর্যন্ত যাদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে, তারা এতটাই আনন্দিত হয় যে দেখে মনে হতে পারে, তাদের হাতে বুঝি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত শিরোপাখানাই উঠে গেছে।
কেন ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনকে প্রায় সব দেশই এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, নিজেরা হতে চায় আয়োজক?
একটি কারণ তো অবশ্যই জাতীয় গৌরব। ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারলে বিশ্বের মানচিত্রে ওই দেশের একটি নতুন অবস্থান তৈরি হয়, সুযোগ আসে নিজেদের দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সবার সামনে উপস্থাপন করার। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিতে উন্নতির পথও প্রসারিত হয়।
তবে এর বাইরেও আরেকটি কারণ হলো অর্থনৈতিক লাভের সম্ভাবনা। ধারণা করা হয়ে থাকে, ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারলে আয়োজক দেশের অর্থনীতির পালে নতুন হাওয়া লাগবে, তারা পাবে দীর্ঘমেয়াদি সুফল।
যেমন সর্বশেষ ২০১৮ সালে প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করা রাশিয়া টুর্নামেন্ট শুরুর কিছুদিন আগে দাবি করেছিল, বিশ্বকাপ আয়োজনের বদৌলতে পরের ১০ বছরে তাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলার। এই সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির উৎস হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছিল পর্যটন, অবকাঠামোগত বিনিয়োগ এবং পরবর্তী সময়ে ওই সব বিনিয়োগের বিভিন্ন পরোক্ষ প্রভাবকে।
রাশিয়া আসলেই তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কি না, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ২০২৮ পর্যন্ত। অবশ্য যদি না পারে, সে ক্ষেত্রে হয়তো দায়ী করা হবে চলমান করোনা মহামারিকে, যার ফলে জোরালো ধাক্কা খেয়েছে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি।
কিন্তু রাশিয়ার ফলাফলকে মানদণ্ড ধরা সম্ভব না হলেও ইতিপূর্বের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক দেশগুলোর অবস্থা থেকে আমরা যাচাইয়ের চেষ্টা করতেই পারি যে আসলেই বিশ্বকাপ আয়োজন কোনো দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করে কি না।
এ ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ ব্রাজিলের পরিণতি আমাদের কোনো ইতিবাচক বার্তা দেয় না। ওই বছর বিশ্বকাপ শুরুর আগে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসকারীরা জানিয়েছিলেন, বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে ব্রাজিল তিন বিলিয়ন ডলারেরও বেশি লাভ করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা আসলে বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষতির শিকার হয় ১১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টেডিয়াম বানাতে ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে ব্রাজিলের খরচ হয় প্রায় চার বিলিয়ন ডলার, যা প্রাথমিক হিসাবের তিন গুণ। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরিণতি কী, জানেন? ওই বিশ্বকাপ উপলক্ষে নির্মিত এস্তাদিও ন্যাশনাল স্টেডিয়াম পরের বছরই ব্যবহৃত হতে থাকে মিউনিসিপ্যাল পার্কিং লট হিসেবে!
এদিকে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক দেশগুলো আশা করে, এত বড় একটি টুর্নামেন্ট আয়োজনের ফলে তাদের পর্যটনশিল্প প্রভূত লাভ করবে। কিন্তু এটিও নেহাতই মিছে বৈ আর কিছুই নয়।
বড় কোনো স্পোর্টস ইভেন্ট আয়োজন করলে যে একটি দেশের পর্যটনশিল্পের বিশেষ কোনো লাভ হয় না, তার জ্বলন্ত উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ে অলিম্পিক আয়োজক দেশ চীন ও যুক্তরাজ্য।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, অলিম্পিক আয়োজনের বছরে ওই দুই বছরেই বার্ষিক পর্যটকের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
এ ছাড়া যে মাসে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, সেই মে মাসে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাদুঘর ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও দর্শনার্থীর সংখ্যা ২২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
অর্থাৎ লোকে ভাবে বড় কোনো স্পোর্টস ইভেন্ট আয়োজন করলে পর্যটন খাতের উন্নয়ন ঘটবে, বাস্তবিক ঘটে তার উল্টোটা!
এর পেছনে কিছু সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, পর্যটকেরা চান নিরিবিলি পরিবেশ। তাই অলিম্পিক বা বিশ্বকাপের মতো ইভেন্ট আয়োজিত হলে তাঁরা জনাকীর্ণ শহরগুলোতে বেড়িয়ে মজা পাবে না বলে ওই সব দেশকে এড়িয়ে চলেন। দ্বিতীয়ত, অলিম্পিক বা বিশ্বকাপকে সামনে রেখে খরচের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায়ও ওই সব দেশে ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করেন অনেকে।
যদি বিশ্বকাপ চলাকালীন কোনো দেশে প্রচুর পরিমাণ পর্যটক আসে, তারপরও অবকাঠামোগত খরচ ফেরতের সম্ভাবনা থাকে খুবই ক্ষীণ। ব্রাজিল বিশ্বকাপের সময় সে দেশের সরকার হিসাব করে দেখেছিল, যদি একজন গড়পড়তা পর্যটক ১ লক্ষ ৩০ হাজার ডলার খরচ করেন, তাহলেই তারা অবকাঠামোগত খরচ তুলে আনতে পারবে। বলাই বাহুল্য, প্রতি পর্যটকের খরচ এর ধারেকাছেও ছিল না। ফলে পর্যটন খাত দেশের অর্থনীতিকে তেমন কোনো সাহায্যই করতে পারেনি।
ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের ফলে লাভের চেয়ে লোকসানের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হতে পারে সুযোগ ব্যয়ের হিসাব না করা। একজন অর্থনীতি বিশ্লেষকের উচিত সব সময় সুযোগ ব্যয়ের ব্যাপারটি মাথায় রাখা। কিন্তু ফিফার বিশ্লেষকেরা কখনোই সুযোগ ব্যয়ের চিন্তা করেন না।
এদিকে বাস্তবতা হলো, একটি দেশে যদি বিশ্বকাপ আয়োজিত না হতো, তারপরও সেখানকার মানুষ বিভিন্ন খাতে প্রায় সমপরিমাণ অর্থই ব্যয় করত। বিশ্বকাপ আয়োজিত হচ্ছে বলে হয়তো তারা বিশ্বকাপের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করছে। কিন্তু বিশ্বকাপ যদি আয়োজিত না হতো, তাহলেও তারা সিনেমা দেখা, প্রিয়জনের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় ডিনারে যাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে খরচ করত।
এর মানে হলো, কোনো দেশের বাসিন্দাদের হাতে যখন যেমন অর্থ থাকে, তারা কোনো না কোনোভাবে সেই অর্থ খরচ করেই থাকে। একভাবে না হোক আরেকভাবে। তাই আলাদা করে বিশ্বকাপের কারণে তারা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খরচ করছে, এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
তা ছাড়া ফুটবল বিশ্বকাপ থেকে ফিফাও অনেক বাড়তি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে, যেগুলো থেকে আয়োজক দেশ বঞ্চিত হয়। বিশ্বকাপের মোট লাভের একটি বড় অংশই আসে টিকিট বিক্রি ও টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রি করে। অথচ সেখান থেকে কোনো প্রাপ্তিই ঘটে না আয়োজক দেশের।
তাই ব্যাপারটি এমন দাঁড়ায় যে আয়োজক দেশ তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের খরচ আদায় করে দেশটির করদাতাদের কাছ থেকে, অথচ লাভের সিংহভাগই ফিফা পোরে নিজেদের পকেটে।
ফিফার স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে আয়োজক দেশের ছোটখাটো ব্যবসায়ীরাও বিশেষ সুবিধা করতে পারেন না। যেমন ব্রাজিল বিশ্বকাপ চলাকালীন ফিফার কর্মকর্তারা ব্রাজিল সরকারকে জানিয়েছিলেন যেন তারা স্টেডিয়ামের বাইরের স্থানীয় দোকানগুলোকে বন্ধ করে দেয়, যাতে করে সেখান থেকে কোনো পণ্য কিনতে না পারেন আগত দর্শকেরা। ফিফার এমনটি করার কারণ, তারা চায় স্টেডিয়ামের ভেতরে এবং স্টেডিয়ামের আশপাশের এলাকায় একচেটিয়া ব্যবসা যেন করতে পারে কেবল তাদের স্পনসররাই।
ফুটবল বিশ্বকাপের যে ব্যাপারটি আয়োজক দেশগুলোর কফিনে শেষ পেরেক হিসেবে আবির্ভূত হয়, সেটি হলো এই টুর্নামেন্টের ট্যাক্স-ফ্রি ধরন। একটি বিশ্বকাপ থেকে ফিফা যে পরিমাণ অর্থ আয় করে, তা পুরোপুরি ট্যাক্স-ফ্রি। তাই সমান পরিমাণ অর্থ যদি ভোক্তারা সিনেমা হল বা রেস্তোরাঁয় গিয়ে খরচ করত, সেখান থেকে সরকার প্রচুর পরিমাণ কর পেত। অথচ ফিফার ক্ষমতার একাধিপত্যের কারণে আয়োজক দেশের সাধারণ মানুষ বিশ্বকাপ উপলক্ষেও অর্থ ব্যয় করে ঠিকই, কিন্তু সেই অর্থের ভাগ পায় না সরকার।
এবার আরেকটু তলিয়ে ভাবা যাক ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের অদৃশ্য ক্ষতির ব্যাপারে।
একটি দেশে বিশ্বকাপ আয়োজিত হবে বলে মূল আয়োজনের ছয়-সাত বছর আগে থেকেই দেশটির সরকার বিশ্বকাপকেন্দ্রিক অবকাঠামো নিয়ে মেতে থাকে। এর ফলে পুরোপুরি বা সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায় ওই দেশের অনেক অবশ্যপ্রয়োজনীয় অবকাঠামোর কাজ, যেগুলোর মাধ্যমে হয়তো উপকৃত হতো দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষজন।
আবার বিশ্বকাপ উপলক্ষে সরাসরিও নিপীড়নের শিকার হয় অনেক দরিদ্র ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষ। ব্রাজিল বিশ্বকাপের আগে নিজেদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হয় কয়েক লক্ষ মানুষকে, কেননা সে দেশের সরকার চায়নি বিদেশিরা এসে ওই সব দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দেখে দেশটির ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পাক!
ঠিক এসব কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের প্রচুর মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে।
তাই দেখা যাচ্ছে, যতই মনে করা হোক না কেন যে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করে, তা আসলে সত্য নয়।
ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি দেশের সম্মান বৃদ্ধি পায়, দেশটিকে নিয়ে ব্যাপক চর্চা হয়, এগুলো হয়তো ঠিক। এ কথাও হয়তো ঠিক যে বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার লড়াইয়ে জয়ী হতে পারলে একটি দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও ফুটবল নিয়ন্ত্রক বোর্ডের কর্তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ে।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেশটির অর্থনৈতিক উন্নতি তথা সাধারণ মানুষের লাভ? কখনোই না!