বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : বীজের জীবন
'মানুষ বেঁচে থাকে, মানুষ মরে যায়/ কাহার তাতে ক্ষতি কিইবা ক্ষতি হয়/ আমার শুধু বুকে গোপনে জ্বর বাড়ে/ মানুষ বেঁচে থাকে, মানুষ মরে যায়...'-শুভ আচার্যের এই লাইন কয়েকটি কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন কবি, চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক ও সঙ্গীতবোদ্ধা সম্প্রতি প্রয়াত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাঁর হয়ে ওঠাটুকু নিয়ে লিখতে বসেছি। এমনকি যে ফুল ফুটে ওঠে তার পেছনে থাকে আবহের পরিচর্যা, প্রায় অদৃশ্য মাকড়সাছানার পরবর্তীকালের শ্বাসরুদ্ধ সুষম জ্যামিতিক সৌন্দর্যের পেছনে থাকে মাতৃদেহের শ্বাসজলমাংস। ফলে, ঐ যে লাইন কয়েকটির কথা বললাম একটু আগে, কারো কোনো ক্ষতি হয় না ভাবাটা হয়তো ভুল কেন না সাফল্যের ধারণার মতোই ক্ষতির ধারণাও ব্যক্তিবিশেষে আলাদা। একজন সৃজনশীলের প্রয়াণে মূল ক্ষতি হয় সংস্কৃতির, তাঁর কাজ থেকে যদি আমরা কিছু ইশারা নিতে পারি, তাঁর হয়ে ওঠাটুকু যদি আমাদের প্রাণিত করে তবে সেইটুকু বড়ো রকমের উদ্ধার, শোক তখন শক্তিতে রূপান্তরিত। নশ্বর এই মানবজীবন তখন অমৃতের স্পর্শ পায়।
২
দেশ ভাগ মতান্তরে ভারতের স্বাধীনতা লাভকালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বয়স তিন বছর। নয় ভাইবোনের তৃতীয় জন জন্মেছিলেন পুরুলিয়ার আনারে (পরবর্তীকালে আমরা দেখব পুরুলিয়ার নানা অনুষঙ্গ নির্মাণে ঘুরে ফিরে আসছে)। বাবা তারাকান্ত ছিলেন রেলওয়ের ডাক্তার। সেইজন্যে দাশগুপ্ত পরিবার তিন চার বছরের বেশি কোথাও থাকতে পারতেন না। বারো বছর বয়সে হাওড়ার দীনবন্ধু স্কুলে পড়তে এসে খানিকটা থিতু হলেন। সমাজের তথাকথিত নিচুতলার মানুষেরা ছিলেন বাবার রোগী। তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে খেলতে বালক বুদ্ধদেবের বারণ ছিলো না। কেন না বাবা ছিলেন গান্ধীর অনুসারী। ফলে, সামাজিক ন্যায়, সামাজিক দায়িত্ব ও সাম্যের অধিকারে আস্থাশীল ছিলেন। ছেলের সবচেয়ে আদি স্মৃতি হলো চার বছর বয়সে, হাসপাতাল থেকে ফিরে বাবা খুব মন খারাপ করে আততায়ীর হাতে গান্ধীর খুন হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। দক্ষিণ বাংলার রেলওয়ে জংশন খড়গপুরে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আসা তেলেঙ্গী শরণার্থীরা ছিলো সংখ্যায় বেশি। হতদরিদ্র তাদের ডাক্তারবাবু নিজের পকেট থেকে ঔষধ কিনে দিতেন। মা ছেলের খেলার সাথীদের বার্লি গুলে খাওয়াতেন। মধ্যপ্রদেশের মণীন্দ্রনগরে বদলি হয়ে তারাকান্ত একা পড়ে গেলেন- তিনিই একমাত্র ডাক্তার, খড়গপুরে তা-ও চার পাঁচজন ছিলেন। এমন এমন সব পরিস্থিতিতে তাঁকে পড়তে হলো যার পর্যাপ্ত ট্রেনিং ছিলো না। কষ্ট হচ্ছিলো খুব। সন্তানদের কাছে বাবা মা আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্কুলে মাস্টারমশাইরা সিলেবাস শেষ করতে পারতেন না কারণ তাঁরা শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের আত্মত্যাগের গল্প শোনাতেন। স্কুলছাত্র বুদ্ধদেব শিক্ষকদের সাথে বস্তিতে গিয়ে কিছুদিন নিরন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
সাত বছর বয়সে তারাকান্তের বাবা মারা যান। তখন তাঁকে আর তাঁর বোনকে যিনি মানুষ করেন তাঁর নিজেরই ছিলো তেরোটি ছেলেমেয়ে। নিজের বড়ো ছেলের মর্যাদায় তিনি তারাকান্তকে বড়ো করে তুলেছিলেন। ফলে যৌথ পরিবারের গুরুত্ব দাশগুপ্ত পরিবারে অপরিসীম। প্রতি ভোরে তারাকান্ত ব্রাহ্ম সঙ্গীত গাইতেন। তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েদের পুরাণ উপনিষদের গল্প পড়ে শোনাতেন। প্রথাগত হিন্দু পরিবার ছিলেন না তাঁরা। জাতপাত নিয়ে মাথাব্যথা ছিলো না।
৩
দেশ স্বাধীনের পর অনেক স্বপ্ন নিয়েই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রজন্ম বেড়ে ওঠে। ষাটের দশকেই তাঁর মনে হলো সব ঠিক চলছে না। মা পিয়ানো বাজাতেন। সব ভাইবোনেরাই অল্পবিস্তর বাজাতে পারতেন। ভাইদের মধ্যে বিশ্বদেব সঙ্গীতের সমঝদার হয়ে ওঠেন কালে কালে। তিনি বুদ্ধদেবের দুটি সিনেমার মিউজিক করেন পরবর্তী কালে। বুদ্ধদেব এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ' জীবনে যদি সঙ্গীত থাকে, এটা অনেক বড়ো আশ্রয় হতে পারে। অনেক কিছু থেকে গান মানুষকে রক্ষা করে। সুর অনেক বেদনার উপশম ঘটাতে, অন্যকে আরো ভালোভাবে বুঝতে, অন্যের সাথে অনুভূতি ভাগ করে নিতে সাহায্য করে। মা প্রায়ই বলতেন, ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার একটা পথ সুরের মধ্যে দিয়ে।' রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ, বক্তৃতা তিনি এড়িয়ে যেতেন প্রথম তারুণ্যে। কবিতা আর গল্প পড়তেন বেশি। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, উপেন্দ্রকিশোর, ত্রৈলোক্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার রায় – এঁরা তাঁর প্রিয় হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে আসতে গিয়ে জীবনানন্দের প্রেমে মজলেন তিনি, পরবর্তীকালে আমরা দেখবো তাঁর বেশিরভাগ চলচ্চিত্র জীবনানন্দের কবিতার মতো পরাবাস্তব। বিভূতিভূষণ, মানিক আর তারাশংকর – তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশেষত নারী পুরুষের চরিত্রচিত্রণের দিকটাতে তাঁকে টানছিলেন। তিনি পড়তে পড়তে খেয়াল করলেন, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ট্রিটমেন্ট।
বুদ্ধদেবের ছেলেবেলা জুড়ে ছিলো সাহিত্য আর গান। কিছুদিন পর চিত্রকলার প্রেমে পড়লেন। অবন ঠাকুর, গগন ঠাকুর, নন্দলাল বসু আর যামিনী রায়দের ছবি তাঁকে টানতো কিন্তু যে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ আর বক্তৃতা বুদ্ধি বিকাশের শুরুর যুগে তিনি এড়াতেন, খানিক বয়স হবার পরে সেই রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলাই তাঁকে গভীর মায়ায় জড়িয়ে রাখলো। আমরা জানি, জীবনের শেষ দশ বছর রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন জুড়ে চেপে রাখা ব্যথা, অবদমনের অন্ধকার আর প্রেম চিত্রকলায় উজাড় করে দিয়েছিলেন। আটখানা আত্মপ্রতিকৃতিতে যে ভাঙচুর তাঁর মুখের, সেই বিবর্তনের দিকে তাকালে কিংবা অসংখ্য খোলা চুলের নারী প্রতিকৃতির দিকে হৃদয়সংবেদী দৃষ্টিপাত করলে আমার কথার সত্যতা পাওয়া যেতে পারে। নিজের মনোমত আঁকতে না পারার দুঃখ পুরো ষাট আর সত্তরের দশক জুড়ে গ্যালারিতে গ্যালারিতে ঘুরে প্রদর্শনী দেখে, তরুণ চিত্রকরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে মিটিয়েছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, চিত্রকলা তাঁর সিনেমার একটি জরুরি অনুষঙ্গ। খড়গপুরে বালক বয়সে যে বাঘ নৃত্য দেখেন সেটিই পরের জীবনে বাঘবাহাদুর (১৯৮৯) চলচ্চিত্রের অনুপ্রেরণা হয়।
৪
লোকনৃত্যের ধরণটা মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক। ধর্মীয় অনুষঙ্গে পূর্ণ ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যপরম্পরা তাঁকে খুব একটা আকর্ষণ করেনি। বরং লোকনৃত্যের নানা ধরণ তাঁর কাজের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন কিন্তু মধ্য সত্তর থেকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসেন। এইসব রাজনীতির সাথে অপরিহার্যভাবে যে ভায়োলেন্স যুক্ত থাকে তার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি। দূরত্ব ( ১৯৭৮) আর গৃহযুদ্ধ (১৯৮২) – এই দুই চলচ্চিত্রে হয়তো নিজের কথা-ই বলেছিলেন। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত নকশাল আন্দোলন বাহ্যিকভাবে তাঁর কাছে আদরণীয় মনে হয়েছিলো কেন না তাঁরা উদ্দেশ্যের জায়গায় খুব সৎ ছিলেন। নকশাল কর্মীরা প্রচলিত বামদলের অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে কথা বলছিলেন। পরে তাঁর মনে হলো, তাঁরা সেতু গড়ার চেয়ে ভাঙায় বেশি তন্নিষ্ঠ। 'অন্ধগলি'-র সেই ক্রস ফায়ার আমাদের কার না মনে নেই অন্তত আমরা যারা দেখেছি!
পনেরো বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। পরের বছর ছাপা শুরু হতেই নতুন চিন্তা আসে মাথায়। কবিতার মধ্যেই তিনি সিনেমার নানা ইমেজ দেখা শুরু করেন। হাইস্কুলের উপরের দিকে তাঁর কাকা তাঁকে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটিতে নিয়ে যান। তিনি তখন ব্যারিমানের পূর্বাপর প্রদর্শনী দেখেন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে নিজেই সোসাইটির মেম্বার হয়ে চ্যাপলিনের পূর্বাপর প্রদর্শনী দেখেন। পরের জীবনে এই দুই অভিজ্ঞতা তাঁর কাজে এসেছিলো। মিজোগুচি, কু্রোশাওয়া তাঁর চেতনায় নবতরঙ্গ তোলে। ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটির চিত্রনাট্য রচনা প্রতিযোগিতায় তাঁর 'সময়ের কাছে' চিত্রনাট্য প্রথম হয়। বিচারক ছিলেন দুই দিকপাল পরিচালক , সত্যজিৎ রায় আর মৃণাল সেন। পুরস্কারের অংশ হিসেবে ছবিটি তোলার কথা থাকলেও পয়সার অভাবে সেটি দৃশ্যধারণের দুদিন বাদেই অপ্রকাশিত থাকার যোগ্যতা অর্জন করে। এসব ১৯৬৭ সালের ঘটনা। তখন তেইশের উজ্জ্বল তরুণ, থেমে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অর্থনীতির অধ্যাপক হলেন পরের বছর। স্বল্প দৈর্ঘ্য আর তথ্যচিত্র নির্মাণ করার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নেন। তাঁর নিজের কথাতেই পড়ি এবার –'তখন আমি হাওড়ায় থাকি। সিনেমা করব বলে কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। মাঝে মাঝে ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাই, তার অনেকটাই সরকারি। সেটা সিদ্ধার্থশংকর রায় – এর সময়। সরকারি টাকা পেতে অনেক সময় লাগত। তাগাদা না দিলে টাকা পেতে জান কয়লা হয়ে যাওয়ার হাল হতো। অ্যাকাউন্টস বিভাগে বড়োসড়ো কাজ করতেন প্রণব দা। আমি লঞ্চে নদী পেরিয়ে রাইটার্স- এ চলে যেতাম সোজা প্রণবদার অফিসে। তারপর যা করার প্রণবদাই করতেন, টাকাটাও পেয়ে যেতাম যথাসময়ে।' ষাটের শেষে টলিগঞ্জের স্টুডিওতে গিয়ে তখনকার প্রতিষ্ঠিত পরিচালকদের কাজ কাছ থেকে দেখে শেখার চেষ্টা করতেন। ছিলেন লাজুক ও ইন্ট্রোভার্ট ধরণের। পরের জীবনে অবশ্যি এটি কাটিয়ে উঠেছিলেন। একজন ক্যামেরাম্যান, দেওজী ভাই , নিজের ক্যামেরা ও লেন্স দিয়ে কাজ শিখতে সাহায্য করেছিলো। বুদ্ধদেব নিজেই বলেছেন পরে – 'লেন্স আর ফিল্টারকে নিজের আঙুলের মত চিনে নিয়েছিলাম।'
৫
মানুষ কতরকমভাবেই না প্রেরণা পায় নিজের কাজের জন্যে! নাগিমা অসিমা যেমন 'দ্য বয়' চিত্রনাট্যের অনুপ্রেরণা পান সকালের খাবারের টেবিলে পাওয়া খবরের কাগজের টুকরো সংবাদ থেকে ৎ। কুরোশাওয়া 'Dreams'-ফিল্মের উৎস খুঁজে পান জীবন জুড়ে দেখা অসংখ্য স্বপ্নের মনে দাগ কেটে যাওয়া স্বপ্নদের মাঝে। ব্যারিম্যান কবুল করেছিলেন, ট্রেনভ্রমণের সময় ছোট এক স্টেশনে বসে থাকতে দেখেছিলেন দুই বিপন্ন বৃদ্ধাকে, এই চকিত দেখাই তাঁর 'দ্য সাইলেন্স' ছবির উৎস। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলছেন, বড়ে গুলাম আলী কিংবা বাখের সুর শুনতে শুনতেও কেউ ছবির বিষয় খুঁজে পেতে পারেন। তিনি নিজেই এক গাড়ির চালককে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। পরে সেই কবিতা থেকে উঠে আসে 'লাল দরজা' ছবির স্ক্রিপ্ট। এক লেখায় বাংলা চলচ্চিত্রের সাহিত্যিক অবদান সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় আর প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর কথা লেখেন। প্রেমেন্দ্র ছিলেন অসামান্য স্টোরিটেলার। তাঁর গল্প নিয়ে দেবকী বসু, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন আর পূর্ণেন্দু পত্রী-চারজনই মিত্রবাবুর গল্প নিয়ে স্মরণীয় ছবি করেছেন কিন্তু গল্পকার নিজে পরিচালক হিসেবে খুব একটা সুবিধের ছিলেন না। এসব তথ্য বুদ্ধদেব আমাদের যোগান। তিনি চান, তাঁর পাঠক কিংবা দর্শক আরেকটু শিক্ষিত হয়ে উঠুক।
কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের একটি কবিতা পড়া যাক এইবার :
'একদিন নিশ্চয়ই মনে পড়বে আমাদের
একদিন আমাদের কথা ভেবে
একশো বছর
ভাতের থালার কাছে হা-করে বসে থাকবে
ছোট্ট- ছোট্ট মানুষ,
তাঁদের ছোট্ট- ছোট্ট দুঃখ, ছোট্ট – ছোট্ট লাফ
ছোট্ট- ছোট্ট লেখা চিঠি থ হয়ে পড়বে
আরও একশো বছর পরের
আরও ছোট্ট মানুষ যারা
ভাতের থালার ভেতর ভাত হয়ে
অপেক্ষা করবে বিশাল একটা হাঁ-এর জন্য-
ফিরে আসব আবার, সবসময় হাঁ– করে থাকা
আজকের আমরা,
কালো, বস্তাপচা এই পৃথিবী
তখনও সেই মহাকাশের ভেতর;
শুধু আরও অনেক পৃথিবীর ভেতর জেগে উঠছে প্রাণ
যারা আমাদেরই মতো নোংরা, ঠান্ডা, যারা স্বপ্ন দেখে
ব্যাঙের জীবন
লাফ দিয়ে- দিয়ে চলেছে হাজার- হাজার মহাকাশের দিকে।'
ক্ষুধা আর ভাতের আকাঙ্ক্ষার পারস্পরিক সম্পর্ককে তিনি মহাবিশ্বের বিস্তারে ধরেছেন যেখানে পরের মানুষের কাছে আগের ক্ষুধার্ত, ভাতের জন্য অপেক্ষমান মানুষ রেখে যায় হাতে লেখা চিঠি। অক্ষরে আমাদের প্রাণের চিহ্ণ থাকে, তাই না?
৬
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সত্যজিৎ রায়ের মতো সংলাপ প্রধান কিংবা সাধারণত অন্য সাহিত্যিকের কাহিনি থেকে নিয়ে সিনেমা করতেন না, ঋত্বিক ঘটকের মতো মেলোড্রামা কিংবা মৃণাল সেনের আক্রমণোদ্যত চরিত্রের মতো সরাসরি রাজনৈতিক ট্রিটমেন্টে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর সিনেমা প্রায়শই সংলাপবিরল, কবিতাধর্মী। প্রথম তিন পূর্ণ দৈর্ঘ্য দূরত্ব, গৃহযুদ্ধ আর অন্ধগলি- তে তিনি বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা চিত্রায়িত করতে চেয়েছিলেন। দূরত্ব যেমন বিয়ে, বিচ্ছেদ আর পরে একটা মিলন সম্ভাবনার আশার গল্প। গৃহযুদ্ধ খানিকটা গোয়েন্দা গল্পের ধরণে নির্মিত। অন্ধগলির উপজীব্য এক বৈবাহিক ট্রাজেডি। শুরুর তিন ছবিতে শিল্পীর সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে অত্যন্ত সচেতন হিসেবে দেখা যায়। চরাচর – চলচ্চিত্রে তিনি এমন এক মানুষ অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন যে প্রকৃতির ভাষা বোঝার জন্যে আত্মা পর্যন্ত বিলীন করে দেয়। মানুষের মুক্তির, জাগতিক ব্যথা থেকে উপশমের এই বৈশ্বিক স্বপ্ন আমরা দেখি, তাঁর একদম শেষ দিকের কাজ 'উড়োজাহাজ' চলচ্চিত্রে। এখানে বাচ্চু মন্ডল, দরিদ্র এক মোটর মেকানিক, চেয়েছিলো উড়তে। আমাদের ধরিত্রী এখন অতিমারী ও পরিবেশ বিপর্যয়ে অসুস্থ। পরিবেশ, প্রতিবেশসচেতন এই নির্মাতার চলচ্চিত্র আর সেই সিনেমার নির্যাসে মুক্তির যে স্বপ্ন, রবীন্দ্রনাথ যে মুক্তির কথা বলেছিলেন গানে – 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়' –যতদিন যাবে সংবেদনসম্পন্ন মানুষের মধ্যে তা সঞ্চারিত হবে। মুক্তির এই বোধ আরেকটু ভালো, আরেকটু শান্ত, আরেকটু ক্ষুধাহীন পৃথিবীর দিকে নিয়ে আমাদের প্রাণিত করবে। তাঁর চারটে উপন্যাস, প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা, নিবন্ধ আর সিনেমায় তিনি আমাদের স্মরণের অন্তর্গত থেকে যাবেন। পরের প্রজন্ম স্বপ্ন দেখতে দেখতে ব্যাঙ লাফ দিয়ে মহাকাশের দিয়ে এগিয়ে যাবে, যেতে থাকবে।
(জন ডব্লিউ হুড প্রণীত 'টাইম এন্ড ড্রিমস দ্য ফিল্মস অফ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ' বইটির প্রথম অধ্যায়ের কাছে রচনাটি বিপুলভাবে ঋণী। বিশিষ্ট নির্মাতা, সিনেমাচিন্তক রফিকুল আনোয়ার রাসেল ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বইটি ধার দেয়ায় কৃতজ্ঞ হয়েছি।)