মারী ও মেঘদূত
তার মনে হয় তার বিয়ের জন্য বাবা এই পুরুষপুরের গ্রিক পরিবারগুলোয় যত শ্বেতকায় পাত্রী দেখছেন বা মা দেখছেন সুন্দরী পার্সী মেয়েদের, তারা কেউই এই শ্যামবর্ণা নারীটির পাশে কিছু নয়। কিন্তু একে মগধের কালো মেয়ে ছিল মন্দিরের দেবদাসী আর এখন বিহারের শ্রমণা। একে নিয়ে কোথায় যাবে বা পালাবে এ্যাজেলিয়াস? মাধবীর কোমর ছাড়িয়ে হাঁটু অব্দি কালো চুল চূড়া করে বাঁধা আর গেরুয়া একটি শাড়িতে নিজেকে সে জড়িয়ে রেখেছে...
রূপদক্ষ এ্যাজেসিলাস
"মহা রূপদক্ষ এ্যাজেসিলাস!" শ্রমণা মাধবী এসে সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাত জোড়া করে নমষ্কারের ভঙ্গিতে নত হয়। মগধের মেয়ে মাধবী আগে ছিল এক শৈব মন্দিরের দেবদাসী। দেবদাসীর জীবন যেমন হয় তেমনই ছিল তার। কেন জানি একে দেখলেই এ্যাজেসিলাসের সবুজ চোখের কটায় তরঙ্গ খেলে যায়। তার মনে হয় তার বিয়ের জন্য বাবা এই পুরুষপুরের গ্রিক পরিবারগুলোয় যত শ্বেতকায় পাত্রী দেখছেন বা মা দেখছেন অগ্নি উপাসক, সুন্দরী পার্সী মেয়েদের, তারা কেউই এই শ্যামবর্ণা নারীটির পাশে কিছু নয়। কিন্তু বাসায় এ কথা কি আদৌ তোলা যাবে? একে মগধের কালো মেয়ে তাতে ছিল মন্দিরের দেবদাসী আর এখন বিহারের শ্রমণা। শৈশবে যে মেয়েকে চোররা চুরি করেছিল আর দেবদাসীর জীবন পার করে এখন যে কিনা ভিক্ষুণী, তাকে নিয়ে কোথায় যাবে বা পালাবে এ্যাজেলিয়াস? মাধবীর কোমর ছাড়িয়ে হাঁটু অব্দি কালো চুল চূড়া করে বাঁধা আর গেরুয়া একটি শাড়িতে নিজেকে সে জড়িয়ে রেখেছে। যদিও বিহারের ভিক্ষুণীদের চুল নেড়া করাই নিয়ম, তবু প্রথম সে এই বিহারে আসার পর নিজেই চুল কাটতে চাইলেও অমন অবিশ্বস্য সুন্দর কেশভার দেখে অন্য ভিক্ষু বা ভিক্ষুণীরাই তাকে বারণ করেছে। মাধবীর আয়ত কালো চোখের পাঁপড়ি দেখলে মনে হবে যেন দূর আকাশে ঘনিয়ে এসেছে মেঘ।
"বলুন শ্রমণা?''
"মহা বিপদ ঘনিয়ে এসেছে! আজ যুবরাজ তথা নতুন মহারাজ হুবিষ্ক চৈত্যের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন না।''
"কেন? কি হয়েছে? কোন বহি:শত্রু আক্রমণ করেছে নাকি সীমান্ত প্রদেশে?'
"না- মহা রূপদক্ষ! এক ভয়ানক ব্যাধি সহসাই ছড়িয়ে পড়ছে সব মহা জনপদে। তারিমের উপত্যকা থেকে কাশগড়, ইয়ারকন্দ আর খোটান অবধি দেখা দিচ্ছে এই মারণ অসুখ। কেন, আপনি কিছু শোনেননি? দেবী হারিতী তাঁর মারণ আগ্রাসী রূপে আসছেন!''
একটি নীল চীণাংশুকের বড় পুঁটুলিতে অনেকগুলো মুদ্রা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন মহারাজা হুবিষ্কের রাজসভার কোষাধ্যক্ষ স্বয়ং, "মহা রূপদক্ষ এ্যাজেলিয়াস! যুবরাজ মানে নতুন মহারাজ হুবিষ্ক আপনার অনুপম ভাস্কর্য শৈলী ও পরিশ্রমে মুগ্ধ হয়ে এই দক্ষিণা প্রদান করেছেন। তবে...চিন্তার বিষয় হলো... শ্রমণা মাধবী ঠিকই বলেছেন। মাত্র সপ্তাহ খানেকের ভেতর কুশাণ সাম্রাজ্যের সব বড় নগরী থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে এক ভয়ানক ব্যাধি। দেবী হারিতীর অভিশাপ অবশ্যই আছে। তবে, মনে হয় দা কিনে (রোমে) যে কঠিন মড়ক দেখা দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছিল, সমুদ্রে অর্ণব পোতগুলোর সাথে রেশমপথে আসা সার্থবাহদের ক্যারাভানের মাধ্যমেই এই মড়ক আমাদের জনপদেও ছড়িয়ে পড়ছে।''
এ্যাজেসিলাস মাত্র কয়েক মূহুর্তের জন্যই তাঁর হাতে পুরে দেয়া নীল চীণাংশুকের পুঁটুলি খুলে মুদ্রার গায়ে লেখা "ব্যাসিলিউস ব্যাসিলিওন কনিষ্ক, শাহী শাহেনশাহী কনিষ্ক, মহারাজা রাজাধিরাজ দেবপুত্র কনিষ্ক''- গ্রিক, পারসিক ও ব্রাম্মী লিপিতে খোদাই করা সীলমোহর দেখে আবার মুদ্রাগুলো পুঁটুলিতে ঢুকিয়ে কোষাধ্যক্ষের কথায় মনোযোগী হলেন, "এই ব্যাধিটা ঠিক কেমন, মাননীয় কোষাধ্যক্ষ?''
কোষাধ্যক্ষের মুখ অসহায় এক ধরণের উপহাসে বেঁকে গেল, "গত বছর দা কিন (রোম) থেকে দূত এলো! রেগেস ব্যাকট্রিয়ানোরাম লেগাটোস এ্যাড ইয়ুম, এ্যামিসিয়াটে পেটেন্ডে কজা, সাপ্লিসেস মিজেরান্ট বলে দূত এলো! মহারাজা কনিষ্কের হাতে বিকশিত এই রাজ্যের সাথে বন্ধুত্ব যাচনা করে দূত পাঠালেন দা কিনে-র রাজা। সাথে উপঢৌকন হিসেবে উলের গালিচা, নানা জাতের সুগন্ধী, চিনির মিছরি, কাঁচের বাসন-পত্র, আদা আর কালো লবণ। খুশি হয়ে যুবরাজ হুবিষ্কও বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দিলেন। আর বছর না গড়াতে সেদেশের ভয়ানক মড়ক ধেয়ে আসছে আমাদের এখানেও।'
টেকনাফ থেকে ফিরে
সেই গত মার্চ থেকে লক ডাউন হতে হতে আজ নভেম্বর। কাঁহা তক আর ঘরে বসে কাজ করা যায়? সামিনা বিরক্ত। বেজায় বিরক্ত। একটা আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করে বলে ঘরে বসে ই-মেইলে কাজ পাঠালেই মাস শেষে বেতনের নোটিশ মোবাইলে পাওয়া যায়, অথচ তার বড় বোনেরই সরকারী চাকরিতে অফিস করতে হচ্ছে। বড় আপার বয়স পঞ্চান্ন ছাড়িয়েছে। কবে কি হয়ে বসে আল্লাহই জানে! বড় আপার মাঝে মাঝেই মন খারাপ হয় যে ন'টা-পাঁচটা অফিস করতে করতে কবে না তার কোভিড হয়ে বসে! আপাদের অফিসে এর ভেতর দু/একজনের হয়েছে। সামিনাদের ফ্ল্যাটের পাশের ফ্ল্যাটে একজনের হয়েছে বলে শোনা গেছে। উপরের ফ্লোরেও কার নাকি হয়েছে! কখনো বের হলে সেই একই লিফট ব্যবহার করতে হয়। সাথে অবশ্য মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকেই। তবু...ভ্রমণ পাগল সামিনার...ঘুরতে ভালবাসে বলে যে কিনা সরকারী চাকরি বা শিক্ষকতা...মেয়েদের জন্য আরামের সব কাজ ছেড়ে এই প্রতি মূহুর্তের চ্যালেঞ্জিং আর কষ্টকর পেশাটাতেই এত বছর ধরে আছে...সেই সামিনা আজ আট মাস ঘরের বাইরে বের হয় না। ঈদ বিশেষত: কোরবানীর ঈদের পর থেকে তাদের অফিসে অবশ্য এখন সপ্তাহে দু'দিন যেতে হয়। আর তিন দিন ঘরে বসে কাজ। তবু সামিনা বহু দিন না ঘুরতে ঘুরতে কেমন অবসন্ন হয়ে পড়ে! অফিসের কাজই বা কি ঘোড়ার ডিম হচ্ছে? টেকনাফে তাদের বেনিফিশিয়ারীরা কেমন আছে কে জানে? শুধু কাগজ-কলম আর অন লাইনে অফিসের কাজ আসলে কোন্ ঘন্টটা হয়? রনী, তার বর, আছে রংপুরে সরকারী পোস্টিংয়ে। শেষ মিসক্যারেজটার পর রনী খুব চেয়েছিল যে সামিনা তার চাকরিটা ছেড়ে দিক। অথবা এমন কোন কাজ করুক যেখানে এত ঘোরাঘুরি থাকবে না। তাহলেই তাদের ঘরে নিরাপদে শিশু আসবে। কিন্তু এতগুলো বছর- সেই ভার্সিটি লাইফে এই সংস্থার দূর উপকূলীয় প্রজেক্টে ঢোকার পর থেকে বলতে গেলে অপত্য মমতায় উপকুলীয় জেলাগুলোয় সংগঠনের কাজ সে দাঁড় করিয়েছে- এখন ছেড়ে দেবে ভাবতে পারেনা। রনী সেই অভিমানেই গত বছর রংপুর যেচে চলে গেলো। সামিনার কাছে তার মা-বাবা এসে থাকে অবশ্য। আর সামিনার মনে হয় দু/দু'বার মিসক্যারেজের পর সে আর কোনদিনই মা হতে পারবে না। উল্টো মা হবার আশায় সারাদিন ঘরে শুয়ে-বসে থেকে বৃথা সময়ের অপচয়েরও কোন মানে হয় না। রনী যদি অন্য কোন নারীর পাণিগ্রহণ করে তবে করবে। কিন্তু রনী সেটাও করেনা। শুধু তাদের দু'জনার মাঝে সোশ্যাল আইসোলেশন না হোক...কনজ্যুগাল আইসোলেশনের কুয়াশা পুরু থেকে পুরুতর হতে থাকে। এরই ভেতর তাদের সংস্থার ঢাকায় কান্ট্রি অফিসে নতুন কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ এসে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে একটি অল-স্টাফ মিটিংয়ের পর সামিনাকে বললেন যে যেহেতু এই প্রজেক্টের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে সামিনা গত ছ/সাত মাসে একদিনও প্রজেক্ট সাইট ভিজিট করেনি, সে কি একবার কক্সবাজার-টেকনাফ-কুয়াকাটা ঘুরে আসবে কিনা? অফিসই বিমানের টিকিট, থাকা-খাওয়ার খরচ সব দেবে। শুনে পাখির পালকের মত হাল্কা হয়ে গেল সামিনা।
"বাট প্লিজ- স্টে কেয়ারফুল!'' বস এ্যান্ড্রু গিবসন বারবার বললেন। কি আর হবে? এখন নিউ নর্ম্যাল চলছে না? কাজেই সামিনা ঠিক একদিন বাসা থেকে বের হয়ে, অফিসের গাড়িতেই বিমান বন্দরে পৌঁছলো আর "নভো এয়ারে''-র বিমানেও চড়ে বসলো। প্রথমে কুয়াকাটা-পটুয়াখালি আর বরিশালের কয়েকটি এলাকা ঘুরে সেখান থেকেই বিমানে কক্সবাজার-টেকনাফ-সেন্ট মার্টিনে উপকূলীয় জন-গোষ্ঠির সাথে পনেরো দিন হৈ হৈ রৈ রৈ করার সময় সামিনা প্রায়ই মুখে মাস্ক রাখেনি। প্যাশনের চূড়ান্ত করতে গিয়ে বেনিফিশিয়ারী নারী-শিশুদের কাঁধে হাত রেখে, গায়ে গা হয়ে ছবি তুলেছে। সব কিছু সেরে ঢাকায় ফিরে কয়েকদিন অফিসে ইন্টার্ন মেইলে সব ছবি আর রিপোর্ট দেয়া থেকে শুরু করে ফেসবুকেও নিজের গত কয়েকদিনের কাজ-কর্মের সব ছবি দিয়েছে। সেসব দেখে রনী রংপুর থেকে ফোন করে এক প্রস্থ বকা-ঝকা করেছে।
সব কথা শেষ হয় যখন সামিনা বলে, "তুমি একটা বাচ্চা দেখে মেয়েকে বিয়ে করো যে তোমাকে একটা বাচ্চা দিতে পারবে'' আর রনী তখন ভয়ানক রেগে গিয়ে ফোন দড়াম করে রেখে দেয়ার ভেতরে। এমন ঝগড়া-ঝাটিও দু'দফা হয়ে যাবার পর যেদিন রনী জানালো যে আসছে বৃহষ্পতিবার রাতের বাসে সে ঢাকা আসছে, সেদিন দুপুরে খেতে গিয়েই...গত দু'দিন ধরেই সামিনা খাবারে গন্ধ আর স্বাদ পাচ্ছিল না। গলায় কাশি আর মাথা ব্যথা। তবে কি...যে কোভিডকে এত দিন পাত্তা দেয় নি, সেই কোভিড এসেই গেল? রক্তে একটা হিমস্রোত বয়ে যায়। আইসিসিডিআরবি-তে ফোন করে টেস্ট করানোর এ্যাপয়েন্টমেন্ট চায়। মা মাথার কাছে এসে দাঁড়ান, "জামাইয়ের সাথে রাগ করলি? একটু শান্ত হ। এখন কি হবে গো- আল্লাহ!'
হাইকোর্টের মাজারে
হাইকোর্টের মাজারেই থাকে সোলেমান। ঠিক কবে এই মাজার চত্বরে সে এসে পড়েছিল তা' নিজেরও মনে থাকে না। বয়স তখন বছর চার/পাঁচের বেশি হবে না বোধ হয়। বিএনপি আগারগাঁও বস্তিতে বাবা যখন আর এক বেটিকে এনে ঘরে তুললো আর মা তাকে নিয়ে এক কাপড়ে এই মাজারে চলে এলো, তখন থেকেই সে আর মা এখানে ছিল বেশ কয়েক বছর। দুই বছর হয় মা-ও আর এক বেটাকে নিকা করার পর থেকে সোলেমান পুরোটাই এই মাজারের বাচ্চা। এখানেই তার ঘর, কাজ করা, ভিক্ষা করা, থাকা-খাওয়া সব। কাজ বলতে কোনদিন সে হাইকোর্টের সামনে দোয়েল চত্বর থেকে কাগজ কুড়ায়, কখনো ফুটপাথের চত্বরে চায়ের টঙ দোকানগুলোয় কাজ করে আবার পুলিশ এসে সেই দোকান তুলে দিলে সোলেমানেরও কাজ থাকে না। ফকিরারপুলে বিহারীদের একটা পুরণো কার্পেট রঙ করার দোকান, ওয়েল্ডিংয়ের কারখানা থেকে শুরু করে নানা জায়গায় কাজ করেছে সে। তবে কোন কাজই স্থায়ী নয়। যখন কাজ থাকে না আর একটা পাউরুটি কেনারও পয়সা থাকে না, তখন সে "ডান্ডি" খায়। ডান্ডি খেয়ে ঝিমাতে থাকলে দু/চার দিন অনায়াসে খিদা ভুলে থাকা যায়। গত বার ঈদের সময় সে একটি জুতার দোকানে গোটা রোজার মাস কাজ করেছিল। তখন যে টাকা পেয়েছিল, সেটা দিয়ে মা'র জন্য একটা জনী প্রিন্ট শাড়ি কিনে ভারি দুরু দুরু বুকে, খুঁজে খুঁজে মীরপুর দশ নম্বর গোল চত্বরের বস্তিতে মা আর তার নতুন স্বামীর ঘরে গেছিল। মা'র ঘরে নতুন ভাই-বোন দু'টাকে একটু আদর করতে চাইলেও মা'র শয়তান দ্বিতীয় জামাইটা এমন গালাগালি শুরু করলো যে সোলেমান সেই যে ফিরে আসলো, আর তার মা'র সাথে কোন যোগাযোগ নেই। তারপর কেমন যেন মাথাটা হয়ে গেল। জুতার দোকানের কাজ সে নিজেই ছেড়ে দিল। এরপর আর কোথাও তার কাজ করতে মন চায় না। প্রায়ই "ডান্ডি-"র উপর থাকে। তবে, এর ভেতরেও যার কেউ থাকে না, তার নাকি আল্লাহ থাকে। ভাবতে ভাবতেও একটু অবাক লাগলো সোলেমানের। হ্যা- আল্লাহ- এই যে রমিজা খালাকে আল্লাহই হয়তো তার কাছে পাঠালো ছয় মাস আগে। মায়ের মত করে। নদী ভাসন্তি দেশের মানুষ রমিজা খালা। নদী ভাঙ্গনে ঘর-সংসার সব হারিয়ে এই শহরে এসে পৌঁছেছে। এক সকালে হাইকোর্টের মাজারের সামনে ঘুম থেকে উঠে দেখে এক নতুন মহিলা চুলা ধরাচ্ছে। মহিলা তাকে দেখে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে বললো, অই পোলা- তর নাম কি?
-সোলেমান! ক্যান খালা- আমার নাম জিগায় তোমার কি?
মহিলা বিড়বিড় করে, আমার কুদ্দুইস্যার মত মুখের নক্সাখান! আয় ত' দেহি কাছে!
কি কন?
কাছে আইতে কইছি নবাবের বাচ্চা!
মহিলা খেঁকিয়ে ওঠে। সেই শুরু। অবাক হয়ে মহিলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সে খানিকক্ষণ সোলেমানের নাকে-মুখে হাত বুলিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। পদ্মা যেখানে কীর্ত্তিনেশা (কীর্ত্তিনাশা), সেই ভয়ানক পদ্মা তার বাড়ি-ঘর, বর-ছেলে সব খেয়ে ফেললেও আল্লাহ কি এই ঢাকার রাস্তায় তার কাছে তার মরা ছেলেকে পাঠালো? দু'দিনের ভেতরেই মহিলা একটা কাজও যোগাড় করে ফেললো। কয়েকটি মেস বাড়িতে রান্নার কাজ। সোলেমানের দুই বেলার ভাত-তরকারি এখন নিশ্চিত।
হুবিস্কর রাজ দরবারে
"ব্যাসিলিউস ব্যাসিলিওন হুবিষ্ক, শাহী শাহেনশাহী হুবিষ্ক, মহারাজা রাজাধিরাজ দেবপুত্র হুবিষ্ক!'
কুশাণ নৃপতি হুবিস্কর দরবারে এই মধ্য দুপুরে ঢুকে, আনত কুর্ণিশ করেন রূপদক্ষ এ্যাজেসিলাস, "আপনি কি আমাকে ডেকেছিলেন, প্রভু?''
পুরো পুরুষপুর (পেশোয়ার) ইতোমধ্যেই কেমন জনশূণ্য হয়ে পড়ছে। মানুষজন বিশেষ কাজ ছাড়া ঘরের বাইরে বের হয় না। ঘরে ঘরে শিশুরা বিশেষত: বসন্ত ও জ্বরের সংক্রমণে অস্থির। বয়সীরাও আক্রান্ত হচ্ছে। কামারের কামারশালা, শস্য, বস্ত্র আর গন্ধ দ্রব্য বিক্রির যত বিপণী বিতান থেকে শুরু করে সবকিছুই বন্ধ আর স্থবির হয়ে পড়েছে। গত দু/তিন মাস ধরে গান্ধার জনপদ যেন অচল হয়ে উঠেছে।
যে জন্য ডেকেছি-'হুবিস্ক চিন্তিত গলায় বলেন, "রাজবৈদ্যরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে জনতাকে বোঝাতে যে যেন তারা বিপণী বিতানে না যায়, বিবাহ অনুষ্ঠান, ক্রিড়া-গীতি-নাট্য বা অকারণ প্রমাদ বা জনসমাগমে ব্যস্ত না হয়, তবু মানুষ কথা শুনতে চায় না। অথচ, এই রোগের সময় রোগীদের উচিত বৈদ্যদের সব আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা। নগর কোটালরা অবশ্য কঠোর দৃষ্টি রাখছে যে নগরে কারা আইন ভঙ্গ করে বাইরে বের হয় সেটা দেখার জন্য। তবে, ভাস্কর হিসেবে- রূপদক্ষ হিসেবে- আপনাকেও একটি দায়িত্ব দিতে চাই।'' এটুকু বলে মহারাজ হুবিষ্ক কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থাকেন। একটি পানপাত্র থেকে খানিকটা ফলের রসে ঠোঁট ভিজিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করেন, "হারিতী নামে এক দেবী- তিনিই মানুষকে দু:সময়ে ব্যাধি দিয়ে কঠোর পরীক্ষা করেন। তাঁর বিগ্রহ গড়ে পূজা দিতে হবে। আমার ইচ্ছা আপনিই তাঁর বিগ্রহ গড়বেন।''
"আপনার আদেশ আমার জন্য পুনরায় সৌভাগ্য ও সম্মানের বিষয়, ব্যাসিলিউস ব্যাসিলিওন! কিন্তু এই দেবী সম্পর্কে আগে যেন ততটা শুনিনি! তিনি কি নতুন কোন দেবী?
ঠিক কেমন তিনি দেখতে?''
"রাজ পুরোহিত! আপনি আমাকে এবং মহা রূপদক্ষকে দেবী হারিতি সম্পর্কে একটু অবগত করুন!''
"এ আমার পরম সৌভাগ্য, শাহী শাহেনশাহী হুবিষ্ক, মহারাজা রাজাধিরাজ দেবপুত্র হুবিষ্ক!'' রাজ পুরোহিত আসন থেকে উঠে দাঁড়ান, "হারিতীকে আমাদের মহা রূপদক্ষ যে দেশের মানুষ, সেই যবন দেশের মানুষেরা ডাকে টাইকে বলে। শিশুদের ভেতর এক হাতে একটি ছাগশৃঙ্গ, আর এক হাতে জাহাজের হাল ও সৌভাগ্যচক্র হাতে তিনি দন্ডায়মান থাকেন। শিশুদের নানা অসুখ থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি গর্ভবতী মায়েদের সুস্থ প্রসবেও এই দেবী রক্ষা করেন। তাঁর হাতের চক্র যেন ভাগ্যচক্র! আবার হে মহা নৃপতি...পূর্বে এই দেবীকেই পিন ইয়িন, গুইজিমু বা কিশিমোজিন বলে ডাকে চীন ও তার পাশ্ববর্তী দেশের মানুষেরা। আবার এই দেবী আগে নাকি দানবী ছিলেন আর বাচ্চাদের খেয়ে ফেলতেন। ঘরে ঘরে মায়ের কান্নায় বিচলিত হয়ে, মহারাজা কনিষ্কের সময়ে একদিন গৌতম বুদ্ধ নিজেই হারিতীর এক সন্তানকে লুকিয়ে ফেলেন। তখন হারিতী গিয়ে বুদ্ধের কাছে কাঁদতে থাকলে বুদ্ধ তাঁকে শান্ত ভাবে বলেন যে একটি সন্তান হারানোয় হারিতী যদি এমন কাঁদে, তবে যে শত শত মায়ের সন্তানকে সে রোজ খেয়ে ফ্যালে, সেই মায়েদের হৃদয়ের অবস্থা কেমন হবে? হারিতী তখন তাঁর কাজের জন্য অনুতাপ করলে বুদ্ধ তাঁকে বলেন এখন থেকে শিশু মাংসের বদলে ডালিম খেতে। আমার মনে হয় আপনি যবন দেশের টাইকে আর পূর্বে চীন দেশের পিন ইয়িনের বিগ্রহগুলো দেখে নতুন এই দেবীর বিগ্রহ নিজের মত করে তৈরি করুন। পারাতা (বালুচিস্থান)-র সীমান্তে কয়েকজন ভাস্কর ইতোমধ্যে এই দেবীর কয়েকটি বিগ্রহ নির্মাণ করেছেন। সেসব বিগ্রহ থেকে একটি আমার কাছে এসে পৌঁছেছে- তবে, দীর্ঘ যাত্রায় বিগ্রহটি একটু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আপনি তাই নতুন ভাবে একটি তৈরি করেন!''
"যথা আজ্ঞা- জো হুকুম!''
পুনরায় সবাইকে কূর্ণিশ করে বের হয়ে আসেন এ্যাজেসিলাস। রাজ দরবার থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা পথ গিয়েই তাঁকে থমকে যেতে হয়। ঐ যে রাজকীয় বিহার। অথচ সেখানে আজ মাধবী নেই। অথচ, দু'মাস আগেও ছিল। হারিতীকে কেউ বলে দেবী আর কেউ বলে রাক্ষসী। রাক্ষসী হারিতীর সংক্রমণে তিন দিনের ধূম জ্বর আর শ্বাস-কষ্টে মারা গেছে মাধবী। শৈশবেই পিতা-মাতার কাছ থেকে চুরি হওয়া, কৈশোরে আর প্রথম যৌবনে শৈব মন্দিরের দেবদাসী আর পরে বিহারের ভিক্ষুণীর কৃচ্ছ্রতার জীবন পার করা, গাঢ় বাদামী রঙের ও দীর্ঘ কালো চুলের সেই তরুণী আর বেঁচে নেই। এ্যাজেসিলাসের জন্য মা পারসিক এক অমাত্যের কণ্যা রোক্সানাকে ঠিক করেই ফেলেছেন। নেহাত সহসা এই মড়ক এসে বিয়েটা পিছিয়ে গেছে।
তাতিয়ানা ও একটা চড়ুই
স্কুলে সবাই যখন শোনে যে তাতিয়ানার নাম "তাতিয়ানা রায়'', সবাই তখন তাকে ক্ষেপায়। তোমার এমন বিদেশী গোছের নাম কেন? আর স্কুল! দেড় বছর হয় অন লাইনেই সারা দিন স্কুল, গানের ক্লাস, আঁকার ক্লাস সব। দেড় বছর হয় মা'কে যে মহিলা এসে ঘর ঝাড়– দিয়ে, সব্জি-মাছ কুটে সাহায্য করতো, সে নেই। মা তাই মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে যায়। বাবা মাঝে মাঝে অফিসে যায়। আবার কখনো কখনো বাসায় বসেই কাজ করে। তবে, এখন কিনা ঐ বড়রা বলে "নিউ নর্ম্যাল।'' বাবা এখন নিয়মিত অফিসে যায়।
কিন্তু দিন বিশেক আগে বাবা একদিন ফিরলো মাথা ব্যথা নিয়ে। পরের দিন বাবা অফিসে গেল না। তারপর দিনই জানা গেল বাবার কোভিড। শুধু বাবার না, মা আর তাতিয়ানার এক বছরের ছোট ভাই তাতারও কোভিড ধরা পড়েছে। অথচ, বাবা-মা দু'জনেই কয়েকদিন আগে ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজও নিয়েছে। নেহাত তাতিয়ানা এবার তেরোতে পড়বে বলে বাবা ওর খাট আলাদা করে দিয়েছে। তাতার বয়স বারো হলেও সে মাঝে মাঝেই মা-বাবার সাথে ঘুমায়। এখন আজ তেরো দিন হলো তাতিয়ানা একা তাদের এসি লাগানো লিভিং রুমে একা একটি বেডে ঘুমায়। মা, বাবা আর তাতা থাকে ড্রয়িং রুমে। গরমে সেখানেই মেঝেতে চাদর বিছিয়ে ঘুমায়। তবে ওদের হাসপাতাল যেতে হচ্ছে না। বড় পিসীর বাসা কাছেই। বড় পিসীই তিন বেলা রান্না পাঠাচ্ছে। কখনো বড় পিসীর ড্রাইভার আসে। কখনো বড় পিসী আর পিসে মশায় আসে। বড় পিসীর ছোট মেয়ে যে ভার্সিটি মাত্র শেষ করেছে আর ছোট পিসী মাঝে মাঝে ফোন করে, "তাতিয়ানা- ভয় করে?''
"না-'' শান্ত গলায় বলে বটে তাতিয়ানা তবে ভয় কি আর করে না? কেমন কান্না পায় আর অস্থির লাগে! মা এই শরীরেই উঠে বড় পিসীর পাঠানো খাবার একটা প্লেটে আর চামচে করে তাতিয়ানার রুমের সামনে রেখে দেয়। তাতিয়ানা সেই থালা-বাটি-চামচ তুলে নিয়ে খেয়ে, বাথরুমে ঢুকে লিক্যুইড ভিম দিয়ে সব মেজে-ধুয়ে আবার তার ঘরের সামনে রাখে। বাকি সময়টা অন লাইনে ক্লাস, গানের ক্লাস, আঁকার ক্লাস চলতে থাকে। পরীক্ষাও আছে সামনে। তাতাটাও অসুস্থ। এমনিতে দুষ্টু তাতা পড়ায় অত মনোযোগী নয়। খেলাতেই তার বেশি আনন্দ। আর তাতিয়ানাকে খোঁচানোয়। সেই তাতার গলার স্বর শোনা যাচ্ছে না। আজ দুপুরে অঙ্ক করতে করতে তাতিয়ানার একা ঘরে অস্থির লাগে। মা-বাবা-তাতা কি ঘুমাচ্ছে? তাতিয়ানা জানালার সামনে এসে দ্যাখে একটি চড়ুই পাখি ঘুলঘুলিতে বসে। তাতিয়ানার মনে হলো চড়ুই পাখিটি তার মতই একা। ওর মা-বাবা-ভাইয়েরও কি কোভিড হয়েছে? তাদের কে মাস্ক পরায়, কে স্যানিটাইজার দেয় আর কে অক্সিমিটারে অক্সিজেন মাপে?
সোলেমানের নিউজ কাস্টিং
"ক- দেহি- সোলেমান- আল্লার এইডা কেমন বিচার!'
কুমড়া আর চিংড়ি শুঁটকির তরকারী একটি মেলামাইনের থালায় ঢেলে দিতে দিতে রমিজা খালা বলে।
"ক্যান? কি হইছে?''
"সরকার ত' আবার লক ডাউন দিতাছে সামনে। আমার মেস বাড়ি দুইটা থেকে কইলো আর কামে যাইতে হইবে না। অখন আমি কি খাই, কি করি আর তরেই বা কি খাওয়াই?''
"হ্যারা যাবে কই? মেসের লোকরা?''
"হ্যাগো ঢাকার কাজ-কাম বন্ধ অইছে গিয়া। তারা দ্যাশে যাইব। আমার ত' বাপ দ্যাশটাই নাই। সব কীর্ত্তিনেশার গর্ভে গ্যাছে গিয়া। আমি কই যামু?''
সোলেমান বুঝলো আবার বুঝি কোথাও তার দু'দন্ড নিশ্চিত ভাতের ব্যবস্থা শেষ হয়ে গেল। তবু রমিজা খালা আর সোলেমানের আরো কয়েকদিনের ডাল-আলু ভর্তার এক বেলা ভাত অন্তত: চললো। তারপর এক সকালে রমিজা খালা মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। সোলেমান তার আরো দু/তিন জন টোকাই বন্ধুকে নিয়ে গেলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে আউটডোরেই ডাক্তার খালাকে দেখে বললো যে আর বেঁচে নেই। রমিজা খালার দাফনের কি হবে? কি আর হবে? আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি এসেই যা করার করবে। দু'দিন কেমন পাগলের মত ঘুরলো সোলেমান! দুনিয়ায় তার কেউ নাই। কেউই নাই। রমিজা খালা যদি মরলো সোমবারে ত' বুধবার ফকিরারপুলের সামনে দিয়ে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে সোলেমান দেখতে পেল একটি টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে দাঁড়ানো। কি মনে করে সোলেমান সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সাংবাদিক তাঁর কথা শেষ না করতেই, ক্যামেরা রল-অন অবস্থাতেই সোলেমান হুট করে বলে বসলো, "স্যার যে লক ডাউনের কথা কিছু বললেন না? মাননীয় মন্ত্রীকে বলবেন এই যে একটা লক ডাউন দিছে এটা ভুয়া। সামনে ঈদ- মানুষ খাবে কি? ধন্যবাদ।''
যেহেতু মেঘদূত
পৃথিবীতে সব বড় সাম্রাজ্যেরই একসময় পতন হয়। বিশাল সব যুদ্ধ, মহামারী, অগ্নিকান্ড, বন্যা বা ভ'মিধ্বস এসে মূহুর্তে লুপ্ত করে শতাব্দীকাল ধরে গড়ে তোলা সভ্যতা।
গুপ্ত সম্রাটরা কুশাণদের হঠিয়ে দিলেও কুশাণ কেতায় তারাও শিলাস্তম্ভে ও মুদ্রায় নিজেদের নামের পাশে দেবপুত্র শাহী শাহানু শাহী খোদাই করছেন। শেষ কুশাণ সম্রাট কিপুনদের মত করে মুদ্রার নক্সা বানাচ্ছেন। কুশাণ সাম্রাজ্য ধ্বংস হবার আগে দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। পশ্চিমে কুশাণ-সাসানীয় বা কুশাণ সাম্রাজ্যের ইরাণী অংশ আর পূর্বে পাঞ্জাব বা গঙ্গার উপত্যকায় যৌধেয়দের মত স্থানীয় রাজবংশগুলোর সাথে মৈত্রী। তবু চতুর্থ শতকের মাঝ বরাবর সমুদ্র গুপ্ত কুশাণদের হারিয়ে দিলেন। সমুদ্র গুপ্ত অবশ্য গ্রিক ব্যাসিলিউস ব্যাসিলিওন উপাধিটি সরিয়ে দিয়ে শুধুই "দেবপুত্র শাহী শাহানু শাহী'' অংশটুকু নিলেন। এখন সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রুগুপ্তের শাসনকাল চলছে। তাঁর দরবারী নাম বিক্রমাদিত্য। বিক্রমাদিত্যের সভার রাজকবি কালিদাস লোকটি ভারি হেঁয়ালীপূর্ণ। কেউ কেউ বলে সে আসলে এখানকার মানুষ নয়। সে এসেছে কাশ্মীর থেকে। নয়তো তাঁর কবিতায় এমন সব গাছ-পালা আর হ্রদের বর্ণনা আছে যা কেবল কাশ্মীরেই আছে। যেমন, দেবদারু গাছ কিন্তÍ উজ্জয়িনী বা কলিঙ্গতে মেলে না। দেবদারু পাওয়া যায় কাশ্মীরেই। এছাড়াও তাঁর কাব্যে ঘুরে-ফিরে যে নিকুম্ভের কথা আসে, সেটাও কাশ্মীরের নীলমাতা পুরাণে-ই কেবল মেলে। তবে, কাশ্মীরের মানুষ হলেও কালিদাস উজ্জয়িনীর বিক্রমাদিত্যের সভাতে ভালই জুড়ে বসেছেন। আর বসবেন না কেন? অসাধারণ কবিত্বশক্তি তাঁর! অথচ কালিদাস যৌবন পর্যন্ত নাকি ছিলেন এক নিরক্ষর মেষপালক। কেউ কেউ বলে যে এক বিদূষী রাজকুমারী মন্ত্রীর ছেলের পাণিপ্রার্থনা ফিরিয়ে দিলে মন্ত্রী মহাশয় সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে নিরক্ষর কালিদাসের সাথে বিয়ে দেয়। কেউ বলে মহা বিদূষী রাজকুমারীর কাছে বিয়ের শর্ত হিসেবে বিদ্যার প্রতিযোগিতায় কেউই সফল না হতে পেরে রুষ্ট সহনাগরিকেরা ক্রুদ্ধ হয়ে এক নিরক্ষরকেই পাঠায়। এবং বাসরঘরেই মূর্খ কালিদাস বিদূষী স্ত্রীর হাতে প্রচন্ড অপমানিত হয়ে এক কালী মন্দিরে গিয়ে দেবীর চরণ ছুঁয়ে জ্ঞান অর্জনের আকাঙ্খা ব্যক্ত করেন। আর আজ কালিদাস বিক্রমাদিত্যের রাজসভার প্রধান কবি। প্রচন্ড পরিশ্রমে সংস্কৃত শিখে আর অসংখ্য পুরাণ পড়ে পড়ে আজ তিনি লিখছেন "কুমারসম্ভব,''
"অভিজ্ঞান শকুন্তলম'' বা "মালবিকাগ্নিমিত্র।''
"সুহৃদ কালিদাস, আসতে পারি কি?''
অমাত্য কথামুগ্ধ এসেছেন। কালিদাসের তিনি বিশেষ বন্ধু।
"আমার হৃদয়ের সিংহদ্বার সবসময়ই তোমার জন্য খোলা। কিন্তু সহসা কি মনে করে?''
"বয়স্য- আমার স্ত্রী পিত্রালয়ে যাবার পরই তার পিত্রালয়ে মড়ক ছড়িয়ে পড়লো, আর সে ফিরতে পারছে না। নব পরিণীতার বিরহে আমি যে অস্থির হয়ে যাচ্ছি!''
স্মিত হাসলেন কালিদাস। প্রিয়জনকে কাছে না পাবার বেদনা তিনি জানেন। এই যে নিপুণিকা নামে এক দাসীর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি, কিন্ত বাস্তবে নিপুণিকার সাথে তার মত উচ্চ কোটির মানুষের প্রেম সম্ভব নয়। তখন? কবিরা যা করে! তিনি "মালবিকাগ্নিমিত্র'' নামে একটি নাটক রচনা করে বসলেন যেখানে মহারাজ অগ্নিমিত্র মালবিকা নামে এক দাসীর প্রতি প্রণয় বোধ করলে স্বভাবত:ই অগ্নিমিত্রর প্রথমা স্ত্রী বা রাণী খুব ক্রুদ্ধ হন। বহু পরে জানা যায় যে মালবিকাও এক রাজকন্যা। ভাগ্যের দোষে, নানা ঘটনার ফেরে সে আজ দাসীবৃত্তি করছে। তখন আর অগ্নিমিত্রর সাথে মালবিকার বিয়েতে কোন বাধা রইলো না। কিন্তু আসলে কি নিপুণিকাকে পেয়েছেন তিনি? না পান, তিনি কবি। নিজেকে অগ্নিমিত্র নামে এক রাজার চরিত্রে কল্পনা করা আর নিপুণিকাকে মালবিকা নামে এক ভাগ্যাহত রাজকন্যার চরিত্রে কল্পনা করে নিয়ে অন্তত: মহাকাব্যে তাদের মিলন ত' তিনি ঘটিয়েছেন।
"প্রিয়ার অভাবে তবে তুমি বেশ কাতর, বয়স্য?''
"তা আর বলতে? শুধু আমি তোমার মত কবি নই যে কবিতা লিখে হৃদয়দাহ জুড়াবো।''
"আর আমি যদি তোমার হৃদয়দাহের কথা রচনা করি?''
"সত্যিই করবে?''
কথামুগ্ধ তাঁর হাত চেপে ধরেন।
আকাশে ঘন মেঘ করছে। থেকে থেকে বজ্রের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। চিড়িক দিয়ে যাচ্ছে বিজলির রেখা। ভারত ভ্রমণে বহুবারই হিমালয় পর্বত দেখেছেন তিনি আর মোহিত হয়েছেন তার অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে। সেই হিমালয়ই আজ তবে রামগিরি পর্বত হয়ে দেখা দিক তাঁর কবিতায়। আর বন্ধু কথামুগ্ধকে এক বিরহী যক্ষ হিসেবে দেখালে কেমন হয়?
কশ্চিৎ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারাপ্রমত্তঃ
শাপেনাস্তঙ্গমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেণ ভর্তুঃ (শ্লোক ১)
জাতং বংশে ভুবনবিদিতে পুশকরাবর্তকানাং
জানামি ত্বাং প্রকৃতিপুরুষং কামরূপং মঘোনঃ (শ্লোক ৬)।
তাহাদের ঈদ যাত্রা
লক ডাউনে বড় লোকের জন্য দেশের এক মাথা থেকে আর এক মাথা যেতে বিমান আছে। অনেক বড় লোকেরই প্রাইভেট কারও আছে। শুধু গরীবের বুঝি ঈদ নাই? সরকার ত' বলছে যে ঘরে বসে ঈদ করতে, কিন্তু গরীবরা ত' এই শহরে বউ-বাচ্চা আনতে পারেনা। বছরে একটা পার্বণ, বড় ঈদটাও যদি বউ-বাচ্চার সাথে কাটানো না যায়, তাহলে কিসের কি? এদিকে বাস চলছে না, কিছু চলছে না। তবু দেশের বাড়ি যেতেই হবে।
অন্যান্যবার মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়াঘাটে পদ্মাপারে এসে সহজেই ফেরি পায় রবিউল। এবার বাস-ট্রাক কিছু চলছে না বলেই কে জানে কেন ফেরিতে যেন মানুষ শুমারের আর জায়গা নাই। শিমুলিয়ার ৩ নম্বর ঘাটে এসে রবিউল দ্যাখে হাজার হাজার মানুষ ফেরির জন্য অপেক্ষা করছে। তবু যেতে ত' হবেই। রোজা রাখা শরীর চলতে চায় না। তবু দুই হাতে দুইটা ব্যাগ নিয়ে ঠেলে ঠেলে ফেরির কাছে যেতে শুরু করে সে। দু'টো ব্যাগের একটায় বাচ্চা দু'টোর জন্য একটা নতুন জামা-কাপড়ের ব্যাগ আর একটায় নিজের পরণের পুরণো কাপড়-চোপর।
"ভাই- একটু জায়গা দেন!''
"আমারে একটু জায়গা দেন- আল্লার কিরা!''
"ঐ হারামজাদা- তুই নড়ো না ক্যান?''
হাজার হাজার মানুষ ফেরিতে উঠতে চাইছে। ধাক্কাধাক্কি, চেঁচামেচির ভেতর একটা সময় যেন বা অলৌকিকভাবেই ডাম্প ফেরি রায়পুরাতে উঠতে পারল রবিউল। এবার হাতের দু'টা ব্যাগের একটা এক কিনারে রেখে, আর একটাও রাখতে যাবার চেষ্টা না করতেই বাচ্চাদের জামার ব্যাগটাই হায় পানিতে পড়ে গেল!
"ওরে কপাল- আমি বুড়া মানুষ গামছা আর লুঙ্গি পরণে থাকলেই কি? বাচ্চাগুলার ত' ঈদের জামা লাগত!''
রবিউল কিছু আর ভাবতে না পেরে নদীতে ঝাঁপ দিতেই ঢেউ তাকে টেনে নিয়ে চললো বহু দূর। দুটো ব্যাগ হাতে নিয়ে সাঁতরে একবার তিরে পৌঁছাতে পারলে হয়! কিন্তু দম রাখা যাচ্ছে না। দমের কি দোষ? সারা সপ্তাহ ফ্যাক্টরির খাটনির পর শরীর কি আর কিছু আছে?
"আল্লারে- ঐ বেডাডা কেডা? অয় ত' ডুবব! অই সিদ্দিক্যা! ইঞ্জিন জোরে চালা!''
শ্যালো নৌকার মাঝি মাজহার দ্রুত নৌকা ছুটিয়ে দেন। শিমুলিয়া ঘাটের সামনে রবিউল ততক্ষণে ডুবতে শুরু করেছে। সিদ্দিক আর মাজহার তাকে তুললেন।
"আরে- ভাই-কান্দো ক্যান? জানে বাঁচছো তাই আল্লার কাছে শোকর করো।''
"পোলা-মাইয়াগুলার ঈদের জামা নিতে পারলাম না। এর আগে দেশে আম্মার কোভিডের টিরটমেনে টাকা পাঠাইছি।''
"আরে- জানে ত' বাঁচছো। তোমার আগে আমরা অরেও তুলছি। ও ত' নতুন বউয়ের জন্য শাড়ি আর কসমেটিকস কিনছিল। ওরও তোমার কেস হইছে।''
তরুণতর ভেজা জামা-কাপড়ের, কালো চেহারার ছেলেটি বিষণ্ন হাসে, "কাঁদবেন না ভাই। আমারও ত' বউয়ের সাথে বিয়ার পর প্রথম ঈদ। অর জন্য কেনা বিয়ার পর
প্রথম ঈদের শাড়িটাই নদীতে গেল গা! বউয়ে, শ্বশুর বাড়িতে কি ভাববে আমারে? হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না!''
আকাশে তখন জোরে মেঘ ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামছে।