ওরহান পামুক ও শিল্পী আলী বানিসাদরের আলাপ
ওরহান পামুকের প্রথম যে বইটা পড়ি, তার নাম 'মাই নেম ইজ রেড'। নববর্ষের আগের সন্ধ্যায় বইটা তুলে নিয়েছিলাম। ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়েছিলাম মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সেই সন্ধ্যায় মা যাচ্ছিলেন মামার বাসায়। আমারও মায়ের সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু না গিয়ে বই নিয়ে বসে পড়ি। পামুকের নির্মাণ করা জগতে ডুবে থাকি। এরপর হাতের কাছে তার যে কটি বই পেয়েছি, সব কটি পড়েছি।
পামুক দুনিয়াকে দেখেন একজন চিত্রশিল্পীর মতো। তার এই দেখা শিল্পনির্মাণের পটভূমি তৈরিতে ভূমিকা রাখে। শিল্পীরা বিষয় অধ্যয়নের জন্য তা ভেঙে ফেলতে এবং স্তরে স্তরে পুনরায় তা একত্র করতে সময় নেন। পামুকের লেখার ধরনও আমার কাছে তেমন মনে হয় সব সময় পর্যবেক্ষণ করা, প্রশ্ন করা এবং নতুন উপায়ে অর্থপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত জিনিসগুলোকে পুনর্বিন্যাস করা। তার লেখায় চিন্তা, আবেগ এবং ইতিহাসের মিশ্রণ ঘটে। এটি আমার ভেতর ভীষণ অনুরণন ঘটায়।
২০১৪ সালে কিছুদিনের জন্য প্যারিসে ছিলাম। আমার আর্ট ডিলার থাড্ডিয়াস রোপাক নৈশভোজের নিমন্ত্রণ দিলেন। তিনি জানালেন, বন্ধুদের একটি ছোট দল থাকবে সেখানে। ঠিক কারা থাকবেন, তা পরিষ্কার করে বললেন না। পৌঁছার পর নিজেকে আনসেলম কিফার (জার্মান চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর, যার কাজের প্রশংসা আমি দিনের পর দিন করে আসছি) এবং ওরহান পামুকের মাঝে বসা আবিষ্কার করলাম।
পামুকের সঙ্গে আমার পরবর্তী অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ ঘটে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কের মরগান লাইব্রেরিতে; কোভিড-১৯-এর কারণে সারা দুনিয়ায় শাটডাউন নেমে আসার ঠিক আগে। এ আরেক অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা, দুজনই সেদিন দূরদর্শী স্থপতি জা জাঁক লেকুয়ের প্রদর্শনীতে উপস্থিত হয়েছিলাম। বলতে গেলে জাদুঘর প্রায় ফাঁকা ছিল। মনে হচ্ছিল, একান্ত ব্যক্তিগত সময় কাটাচ্ছি, শুধু আমরা দুজনই গ্যালারিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দুনিয়াজুড়ে লকডাউন নেমে আসার আগে এটিই ছিল আমার সর্বশেষ কোনো প্রদর্শনীতে যাওয়া। ফলে এ এক অদ্ভুত স্মৃতি, যা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়।
পামুকের সঙ্গে কথা বলার আবার সুযোগ সৃষ্টি হলো, এটা আমার জন্য আনন্দের। এবার কথা হয় তার নতুন বই 'মেমোরিজ অব ডিস্ট্যান্ট মাউন্টেন্স: ইলাস্ট্রেটেট নোটবুকস, ২০০৯-২০২২' প্রকাশ নিয়ে।
আলী বানিসাদর: গত সপ্তায় আপনার বইটা পেলাম। আপনার এ বই আমাকে দেলাক্রয়ের প্রিয় জার্নালগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে গেল।
ওরহান পামুক: বাহ! হ্যাঁ, আমি দেলাক্রয়কে নিয়ে লিখেছি। দেলাক্রয় বেশ পরিশ্রমী ও গুরুগম্ভীর। তার রসবোধ নেই। তিনি খুবই কর্তৃত্ববাদী।
বানিসাদর: আপনার বেশ কয়েকটা বই পড়ার মধ্য দিয়ে আপনার ভেতরের জগতে প্রবেশ করে দেখতে পারার অভিজ্ঞতাটা দারুণ। নিজের উপন্যাস, স্মৃতি, ল্যান্ডস্কেপ, স্বপ্ন, শব্দ এবং চিত্রে কীভাবে চিন্তার নোঙর ফেলেছেনÑ বইগুলো পাঠ করলে বোঝা যায়। তবে একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো সেটি, যেখানে আপনি কথা বলেছেন কখন-কীভাবে ছবিগুলো এঁকেছেন। বলেছেন, কখনো কখনো হাত নিজে থেকেই আঁকতে শুরু করে।
ওরহান পামুক: আমি এখন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একজন ঔপন্যাসিক। কিন্তু ৭ থেকে ২২ বছর বয়সকালে আমি একজন চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছি। এঁকেছিও অনেক ছবি। পরে কিছু রহস্যময় কারণে আমি যখন আঁকা ছেড়ে উপন্যাস লেখা শুরু করলাম, দেখলাম মাথার মধ্যে একটা প্যাঁচ তৈরি হচ্ছে। ১৫ বছর আমি চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছি। মাথার সমস্যাটার কারণে নিজের ভেতরের চিত্রকরকে হত্যা করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার ভেতরের চিত্রকরের মৃত্যু হয়নি। একদিন দোকানে গিয়ে আঁকাআঁকির প্রচুর উপকরণ কিনে নিয়ে আসি। তারপর আমার 'দ্য মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স' উপন্যাসটা শেষ করি। বইটাকে চিত্রকলা ও সাহিত্যকে এক করার একধরনের চেষ্টা বলা যায়।
এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম চিত্রকলার আনন্দ নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব। এর ফলেই লেখা হয় 'মাই নেম ইজ রেড'। আমি আমার কোনো উপন্যাসই একবসায় লিখি না। আমার প্রথম প্রচেষ্টা ছিল আপনার মতো একজন সমসাময়িক শিল্পীকে নিয়ে। ঘটনাস্থল ইস্তাম্বুল হলেও আমার শিল্পী পশ্চিমা রীতি দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত একজন। আমি চাইনি আমার উপন্যাসটা প্রভাবের সমস্যা তথা পূর্ব-পশ্চিমের অনুকরণের দিকে যাক। অন্তত উত্তর-উপনিবেশিক, প্রাচ্যবাদী, পশ্চিমাকরণ, আধুনিকতা এসব বিষয়ে আমি যেতেই চাইনি। এসব নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক লিখেছি।
আমি যা লিখতে চেয়েছি, তা হলো আমার আনন্দ! আঁকতে গিয়ে শিল্পীরা যে আনন্দ পান, আমি তা আবিষ্কার করেছি। আমি মেটে (শিল্প জাদুঘর) যেতাম। যে মিনিয়েচারের দিকে কেউ ভালো করে তাকায়ওনি, সেগুলো খুঁটিয়ে দেখতাম। এবং আমার 'মাই নেম ইজ রেড' কল্পনা করতাম।
বানিসাদর: আমিও এই জায়গায় যাই, তাবরিজের মিনিয়েচার দেখতে।
ওরহান পামুক: হ্যাঁ, যেগুলো অটোমানরা তাবরিজ আক্রমণের সময় লুট করেছিল।
আমি আসলে চিত্রকলার আনন্দ নিয়ে একটি 'পেইন্টারলি নভেল' লিখতে চেয়েছিলাম। যখন আমি আঁকি, তখন গোসলের সময় গান গাওয়া মানুষে পরিণত হই। যখন আমি লিখি, তখন যেন আমি এমন কেউ যে নীরব কোনো ঘরে নিবিষ্ট মনে দাবা খেলছে, অথবা মাথা খাটিয়ে কোনো হিসাবনিকাশ করছে বা চিন্তা করছে। লেখক হিসেবে নিজেকে আমি অধিক বুদ্ধি খাটানো মানুষ মনে করি। চিত্রকর হিসেবে অপেক্ষাকৃত কম। এখন আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি: যখন আমার বয়স ছিল কুড়ির কোটায় তখন কি আমার আরও বেশি বুদ্ধিমান হওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
বানিসাদর: আপনি আপনার ভেতরের চিত্রশিল্পীকে মেরে ফেলেননি। একমাত্র চিত্রশিল্পীরাই কোনো জিনিস দীর্ঘ সময় ধরে দেখে, তা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে এবং পুনরায় তা একত্র অবস্থায় ফিরিয়ে আনে, তারপর সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। আমার মনে হয়, এ কারণেই আপনি আপনার নিজস্ব পদ্ধতিতে নোটবুক তৈরি করেছেন, যেখানে ল্যান্ডস্ক্যাপ আছে, তারপর আবার আছে কথাও। একটি জিনিসকে আপনি চিত্রশিল্পী হিসেবে দেখেছেন, তারপর সেটাকে শব্দ দিয়ে এঁকেছেন।
ওরহান পামুক: হ্যাঁ, অন্যদিকে এ বইটা আসলে কী? এটা আমার নির্বাচিত ডায়েরি। পনেরো বছর ধরে প্রতিদিন এই মোলেস্কাইন ডায়েরি সংরক্ষণ করে আসছি। ডায়েরির পাতায় মাঝে মাঝে ছবি আঁকি, কখনো দুই পৃষ্ঠাজুড়ে, কখনো জলরং করি। আমার কাছে এমন ৩৫টি ছোট মোলেস্কাইন জার্নাল আছে। এর মধ্যে ৩২টি এঁকে শেষ করেছি। এতে প্রায় ছয় হাজার ডাবল পেজ রয়েছে, এর মধ্যে আট শ ছবি।
এগুলো কালানুক্রমিকভাবে সাজানো নয়; বিষয় ও আবেগ অনুসারে সাজানো। আপনি প্রথমে ২০১৪ সালের একটি পৃষ্ঠা দেখতে পাবেন, পাতা উল্টালে ২০০৮, ২০১৭ ইত্যাদি দেখতে পাবেন। এটা কী? কেন? কারণ, এগুলোর সবই ল্যান্ডস্কেপ অথবা ইন্ডিয়া অথবা যা লেখা যায় না, তা অথবা ইস্তাম্বুল বা নিউইয়র্কে নৌকার চলাচল অথবা উপন্যাসের সমস্যা অথবা কোনো অভিনব চিন্তা অথবা তলস্তয় থেকে উইলিয়াম ব্লেক এবং ভার্জিনিয়া উলফ থেকে কালভিনো পর্যন্ত আমাকে প্রভাবিত করা লেখক ও শিল্পী।
বানিসাদর: আপনার বইটা পড়ার সময় উইলিয়াম ব্লেকের কথা ভাবছিলাম। বইয়ে আপনিও তার কথা বলেছেন। ব্লেক ছাড়াও আপনি সাই টুম্বলি, রেমন্ড পেটিবনের উল্লেখ করেছেন...
ওরহান পামুক: সাই টুম্বলি, পেটিবন, অ্যানসেলফ কিফার-তারা হলেন এমন চিত্রশিল্পী, যারা চিত্রকলার ওপর লেখালেখি করেছেন। তাদের আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
বানিসাদর: নোটবুক অনেক ব্যক্তিগত হতে পারে। এটা আমি নিজেকে দিয়ে বলতে পারি। আপনার মতো আমারও অনেক নোটবুক রয়েছে। অনেক কিছু লিখে রাখি। তবে আমি লেখা এবং ভিজ্যুয়াল জিনিসকে আলাদা করে ফেলেছি। আগামী বছর ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে আমার ভিজ্যুয়াল নোটবুকের একটা নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ করতে যাচ্ছি।
ওরহান পামুক: সঙ্গে কোনো লেখা থাকবে?
বানিসাদর: অল্প।
ওরহান পামুক: বন্ধু, অল্প নয়; লেখার পরিমাণ বাড়ান।
বানিসাদর: আমার আরও একটা নোটবুক আছে। সেটা শুধু আমার বিক্ষিপ্ত চিন্তা টুকে রাখার জন্য। আমার চিন্তাগুলোকে স্থির করতে হবে। তা না হলে এগুলো আমাকে পাগল করে ছাড়বে। চিন্তাগুলোকে আরও বুঝতে এবং মুখোমুখি হতে সেগুলোকে স্থির করাটা জরুরি। আপনার তো ত্রিশটা নোটবুকের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, কাজটা কি খুব কঠিন ছিল?
ওরহান পামুক: কাজটা কঠিন ছিল। তুর্কি সম্পাদক পেলিন কিভরাক আমাকে সাহায্য করেছেন। প্রথমত আমরা শুধু ছবিযুক্ত পৃষ্ঠাগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছি, যা দশমাংশেরও কম। তারপরও কাজটা কঠিন ছিল। বইটাকে আরও পূর্ণ করে তুলতে কিছু পাতা যুক্ত করতে হয়েছে। যেমন আমার সম্পাদক বললেন, একই থিমে বেশ দারুণ লেখা আছে কিন্তু ডাবল পেজের মাঝে কোনো চিত্র নেই। ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আপনি কেন একই থিমের একটি ছবি এঁকে দিচ্ছেন না। সুতরাং, পরিমার্জনও করতে হয়েছে।
আমি অন্য অনেক লেখকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। গত শতকের ত্রিশের দশকে জার্নাল সংরক্ষণের ধারণায় পরিবর্তন আসে। এ সময় ফরাসি লেখক আদ্রে জিদ জীবিত থাকাকালে নিজের জার্নাল প্রকাশ করেন। তখন এই কাজটি কেউ করত না। হঠাৎ করে এই অত্যন্ত ব্যক্তিগত জায়গাটি জীবন্ত এবং সৃজনশীল জায়গা হয়ে ওঠে। এর আগে ডায়েরিতে মানুষ তার ব্যক্তিগত গোপন লক্ষের কথা লিখে রাখত। গোপন অর্থবিত্তের কথা, নিজের রাজা, পিতা বা অন্য কাউকে ঘৃণা করার কথা লেখা থাকত ডায়েরিতে। আরও আধুনিক লেখকেরা, যেমন অস্ট্রিয়ান লেখক পিটার হ্যান্ডকে, তুর্কি অনেক লেখক জিদের প্রভাবে ডায়েরি সংরক্ষণ এবং তা প্রকাশ করতে শুরু করেন। এরা ডায়েরিতে শুধু দৈনন্দিন জিনিসই লিখে রাখেননি বরং তারা যেসব চিন্তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, তা-ও লিখে রাখতেন। উদ্ভাবনী চিন্তার জায়গা হিসেবে সৃজনশীল এবং পরীক্ষামূলক জার্নালও তারা লিখেছেন।
'মেমোরিজ অব ডিসট্যান্ট মাউন্টেইন্স'-এর জার্নালগুলোতেও এই গুণটি রয়েছে। আমি হয়তো দশ বছর আগে লেখা ডায়েরির পাতা খুলে এখানে কয়েকটি লাইন যোগ করব, ওখানে সামান্য ল্যান্ডস্কেপ জুড়ে দেব, ডায়েরি কখনো শেষ হয় না। ছবি ও লেখা যোগ করেই যাচ্ছি। কখনো খালি পাতায় একটি নৌকার ছবি আঁকি, এরপর আর সেটি স্পর্শও করি না। কখনো কিছু লিখে ছবির জন্য একটা জায়গা ফাঁকা রাখি। কিন্তু সেখানে আর কখনো ছবি আঁকা হয় না। অথবা পাঁচ বছর পরে সেই ছবিটা আঁকি। এভাবেই 'মেমোরিজ অব ডিসট্যান্ট মাউন্টেইন্স'-এর জন্য ডাবল পেজগুলো বাছাই করা হয়েছে।
বানিসাদর: আপনি স্বপ্ন নিয়ে অনেক কথা বলেন। আপনার এই উক্তিটা আমার বেশ ভালো লেগেছে, 'স্বপ্ন একফ্রেসিস প্রসূত নয়। স্বপ্ন বর্ণনা করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। স্বপ্নের মেজাজ কাগজে তুলে আনার একমাত্র উপায় হলো জলরঙে আঁকা।' আপনি কি আপনার স্বপ্ন লেখেন?
ওরহান পামুক: না, বছরে একবার, প্রতি ১৫ মাসে একবার, আমি একটি অদ্ভুত, ভীতিকর ও মর্মস্পর্শী স্বপ্ন দেখি। এর ঠিক পরেই ১০ মিনিটের জন্য আমি স্বপ্নটা মনে রাখতে পারি। এই দশ মিনিটের ভেতর লিখতে পারলে স্বপ্নটা মনে থাকে। কিন্তু লিখে না রাখলে চিরদিনের জন্য ভুলে যাই। ঔপন্যাসিক হেনরি জেমস বলেছিলেন, 'একটি উপন্যাসে একটি স্বপ্ন বলুন এবং একজন পাঠককে হারান।' (হাসি)
বানিসাদর: তারপরও আপনি স্বপ্ন এবং স্মৃতির একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কথা বলেন।
ওরহান পামুক: আমি একমত যে স্বপ্নের শক্তি নিরানব্বই ভাগ ভিজ্যুয়াল। স্বপ্নে আক্ষরিক কিছু নেই। নিরানব্বই ভাগ কোনো ভিজ্যুয়াল জগৎকে শব্দে রূপান্তর করা অসম্ভব কাজ। কিন্তু তারপরও আমরা চেষ্টা করি, আমরা আমাদের স্বপ্নকে একফ্রেসিস করি।
আমি আমার 'দ্য নাইভ অ্যান্ড সেন্টিমেন্টাল নভেলিস্ট' বইয়ে যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছি, উপন্যাস লেখা হলো প্রথমে একটি দৃশ্যকে ছবি হিসেবে কল্পনা করা, তারপর সেই ছবিতে একটি সংকট তৈরি করা, যাতে পাঠক লেখাটি পড়ে লেখকের মনে যে ছবি আছে, তা তৈরির চেষ্টা করে। তাই ছবি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমার মনে যা আছে এবং বাস্তবে দুনিয়ায় আমি যা দেখি, দুটির সমন্বয় বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে আবার মিশেও যেতে পারে। আসলে এই মিশে যাওয়া নিজেই একটি শিল্প; শৈল্পিক কার্যকলাপ। কিন্তু দিন শেষে আমার মতে, সবার আগে ছবি। এরপর শব্দ। হতে পারে আমার এই যুক্তির পেছনে রয়েছে একসময়ে আমার চিত্রশিল্পী হওয়ার ইচ্ছা।
বানিসাদর: আমার শেষ প্রশ্ন আপনার ভবিষ্যৎ কাজ নিয়ে। আপনার নতুন শিরোনাম 'দ্য স্টোরি অব পেইন্টার'-এর নাম শুনেছি। এ ব্যাপারে আমি বিশদ জানতে ভীষণ আগ্রহী।
ওরহান পামুক: আমার কল্পনাশক্তি অনেক চিত্রশিল্পীর গল্প তৈরি করে। 'মাই নেম ইজ রেড' বইয়ে বেশ রহস্যময় করে লিখেছিও একটা। হাতে একাধিক নভেলা আছে, চিত্রশিল্পীদের নিয়ে উপন্যাস আছে। এই বিষয় সমসাময়িক চিত্রশিল্পী যারা প্রভাবিত হতে চান না, বরং খাঁটি, গভীর, সফল এবং সুখী হতে চান এবং আমার সমস্যা।
আমি যেসব কারণে চিত্রশিল্পী হতে চাইনি, তার অন্যতম একটি হলো, যখন আমার বয়স ১৮, তখন ইস্তাম্বুলে ছিল মাত্র তিনটি গ্যালারি। এর একটি সরকার পরিচালিত। আরেকটা চালাতেন আমার বাবার চেয়েও বয়স্ক এক প্রিয় নারী। দুর্ভাগ্যক্রমে আরেকটি ছিল বেশ ছোট। তুমি আঁকতে পারো, কিন্তু এরপর তোমাকে এমন লোক খুঁজে বের করতে হবে, যারা তোমার ছবি দেখবে। আমি যে চিত্রশিল্পী নই, এ কারণে আমি অনুতপ্ত, এ কথা বলতে পারি না। আবার আমি এ-ও বলতে পারি না, আমি চিত্রশিল্পী নই বলে অনুতপ্ত নই।
বানিসাদর: আপনার উপন্যাস এবং নতুন বইয়ে এই বিষয়টা আছে।
[গত নভেম্বরে ওরহান পামুকের নতুন বই 'মেমোরিজ অব ডিস্ট্যান্ট মাউন্টেনস: ইলাস্ট্রেটেড নোটবুকস, ২০০৯-২০২২' প্রকাশিত হয়েছে। শিল্পী আলী বানিসাদরের চিত্র প্রদর্শনী 'দ্য ফরচুন টেলার' পেরোটিন সাংহাইতে গত ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার একক প্রদর্শনী, 'আলী বানিসাদর: দ্য অ্যালকেমিস্ট' আগামী ১৬ মার্চ থেকে নিউইয়র্কের কাতোনাহ মিউজিয়াম অব আর্টে শুরু হবে। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে কালচারডম্যাগ.কম থেকে]