মৃত্যুর মিছিল
১৮.
যেমন মনে হচ্ছে, সীমানা বেড়ার দিকে দৌড় লাগানোর ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই আত্মঘাতী ধরনের কিছু নয়। প্রথমত, ওই তিনজন লোকের পেছনে আলো দেখা যাচ্ছে -- ঠিক ওর মতো -- সহজ লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছে ওরা। দ্বিতীয়ত ব্যাটারা ধ্রুপদী ভুল করে বসেছে। সরল রেখায় সামনে-পেছনে পথ আটকে রাখায় অবস্থা এমন হয়েছে যে নিজের দলের লোকের গায়ে গুলি না লাগিয়ে দ্রুত গুলি করতে পারছে না ওরা।
তিনটা ছায়ামূর্তিই লুটিয়ে পড়ল। ব্যাটারা যেন ফের উঠে দাঁড়াতে না পারে, মরার ভান করতে না পারে, নিশ্চিত করার জন্যে গুলি চালিয়ে গেল তারিক। ওর পিস্তলের স্লাইড বিকট শব্দে পিছিয়ে এসে স্থির হয়ে গেল। তারমানে গুলি ফুরিয়ে গেছে। ম্যাগাজিন রিলিজে ধাক্কা মারল ও। টুপ করে জমিনে পড়ল ফাঁকা ম্যাগাজিনটা। পাশ থেকে খাবলা মেরে গুলি ভরা একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল ও। তারপর -- পরক্ষণে ফেলে দিল ওটা।
গাধা।
ঘুরে জমিনের দিকে হাত বাড়াল। রদ্দা বা গুলি খাওয়ার কিংবা আহত কি নিহত হওয়ার অপেক্ষা করছে। ম্যাগাজিনটা তুলে পিস্তলের গ্রিপে ঠেসে দিয়েই স্লাইড মুক্ত করল ও। মনে মনে ভাবছে, নেহাত কপাল গুণে বেঁচে গেছে, কারণ...
কেউ ওর পিছু নেয়নি।
কি?
সীমানা বেড়ার দিকে ফিরল ও। ওটার ফোকর দিয়ে আরও সামনে নজর চালাল। জোনাকপোকার মতো আগুনের ছোট ছোট বিন্দু দেখা যাচ্ছে। ওকে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে এক ধরনের ফিসফিস শব্দ।
জমিনে লুটিয়ে থাকা ভাঙাচোরা অবয়বগুলো পাশ কাটিয়ে এলো ও। সাবধানে সীমানা বেড়ার ফোকর গলে উল্টোদিকে চলে এলো। আবার তুরস্কে ফিরে এসেছে। পরিচিত একটা কণ্ঠ চড়া গলায় জানতে চাইল, 'কে, বদমাশটা না?'
সিগ-সওয়ারটা হোলস্টারে রাখল ও। 'ঠিক ধরেছ, পাদ্রি।'
তুরস্কের আরও ভেতরে এগিয়ে গেল ও। একটা দোমড়ানো শিপিং কন্টেইনারের পাশে কোমর সমান উঁচু আবর্জনা আর ভাঙা বাক্সের পাশ থেকে অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে এলো পিকার্ড। সেই আগের পোশাকই পরে আছে সে। এখন কেবল ওর মতো একটা কেভলার ভেস্ট পরেছে।
'তুমি ঠিক আছো?' জানতে চাইল সে।
'বহাল তবিয়তে, তবে কিনা কিছু লোক আমাকে ধাওয়া করছে।'
'এখন আর নয়,' বলল সে।
'ঠিক?'
ঘুরে দাঁড়াল ও। 'আরমান! আমরা এখানে, অল ক্লিয়ার!'
ছায়া ছেড়ে বেরিয়ে এলো আরেক লোক। ছোটখাটো, স্বাস্থ্যবান, চোখে নাইট ভিশন স্কোপ লাগানো। দীর্ঘ ব্যারেলের মাথায় সাউন্ড-সাপ্রেসরঅলা রাইফেল ধরে আছে সে। বাস্কেটবল ক্যাপ মাথায়, কিনারাটা পেছনে ঠেলে দেওয়া। গলায় জড়ানো শাদা-কালো চেক স্কার্ফ, পরনে গাঢ় প্যান্ট-শার্ট। আনুমানিক তিরিশের কোঠার শেষের দিকে বয়স হবে তার। ঠোঁটের উপর ভয়ঙ্কর দর্শন ফু মাঞ্চু গোঁফ। মাথা দোলাল সে।
অন্ধকারে ফের হারিয়ে গেল লোকটা।
তারিক বলল, 'সাহস আছে বলতে হবে, এখানে তুরস্কে সশস্ত্র কুর্দ।'
মাথা দোলাল পিটার। 'আরমানের এখানে থাকার কারণ,' বলল সে, 'বছর কয়েক আগে কুর্দিস্তানে থাকতে...বেশ, ওর বাবার একটা উপকার করেছিলাম আরকি। তো এখন আরমান আমার স্থায়ী বডিগার্ড। আরও নানাভাবে আমার দিকে খেয়াল রাখে সে। যেমন ধরো, দুষ্ট ছেলেদের ধাওয়া খেয়ে প্রাণ নিয়ে পালাতে থাকা বন্ধুকে কাভার দেয়া।'
'আমি আসা বা বিদায়ের সময় তো ওকে দেখিনি।'
'নিজের কাজে বেশ ভালো, কি বলো?'
পিটারের ট্রেইলারে ফেরার পর ও বলল, 'কিন্তু কাহিনীটা কি? ইউসুফের সাথে জুটতে গেলে কেন, নিজেকে সহজ শিকারে পরিণত করেছ। খুব বাজে হয়েছে কাজটা।'
'আমার সীমানা পেরুনোর কথা জানতে?'
'ইউসুফ কাজের লোক, কিন্তু সিরিয়ায় চোরাকারবারীর একটা সাইড ব্যবসাও আছে ওর। তোমাকে শিবির দেখাতে নিয়ে গেছে বলে মনে হয়নি।'
'তাই তুমি আর আরমান মোড়ে অপেক্ষা করছিলে, প্রয়োজনে আমাকে কাভার দেয়ার বিষয়টা নিশ্চিত করতে চেয়েছ।'
'ভাগ্যিশ করেছিলাম,' বলল পিটার। 'হয়তো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি। তাই বলে পুরোনো বন্ধুদের ঝুলতে দেখে চুপ থাকার মতো শান্তিবাদী হয়ে যাইনি। কিন্তু সীমানার ওপারে যেতে এমন ক্ষেপে উঠলে কেন শুনি?'
'ইউসুফ বলল জ্যাক মিল্টন নাকি আছে ওখানে।'
'ওর কথা বিশ্বাস করেছ?'
'ওর সাথে যাওয়ার পক্ষে যথষ্ট।'
ঘুরে সিরিয়ার অন্ধকারের দিকে তাকাল পিটার। 'ইউসুফ কই?'
'মাইন ফিল্ডের উপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে আমার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছিল। কাজ হয়নি।'
'হায় যিশু,' বলল পিটার। 'কিছুতেই ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে পারো না, অ্যাঁ?'
'তাই তো মনে হচ্ছে।'
ট্রেইলারের ভেতরটা অন্ধকার, অগুনতি বাক্স আর বেখাপ্পা চেয়ারে গাদাগাদি অবস্থা। সেগুলোর ভেতর থেকে হাতড়ে হাতড়ে দুই বোতল ইফেস পিলসেন নিয়ে ফিরে এলো পিটার। দুজনের আন্দাজ ঢেলে নিল। লম্বা চুমুক দিল তারিক। তরতাজা মনে হলো ওর নিজেকে। 'তুমি জ্যক মিল্টনকে খুঁজছ?' জানতে চাইল পিটার।
'হ্যাঁ।'
'ভালো টাকা মিলবে?'
'একটা পয়সাও না।'
'এটাই আমার চেনা তারিক,' বলল ও। 'এখন কি চাই তোমার?'
'আমার মাথাটা অটুট রেখে গাযিয়ানতেপের এয়ারপোর্টে যেতে চাই।'
হাসল পিটার। 'তোমার আব্দারের শেষ নেই, নাকি?'
'যেমন বললে, আমাকে ভালো করেই চেনো তুমি।'
১৯.
তুরস্ক এবং সিরিয়ায় পুরো একটা দিন কাটায়নি ও, আবার ফিরতি পথে নেমেছে। ওখানে কাটানো সময় এবং ঘটনাপ্রবাহ খতিয়ে দেখছে মনে মনে। কেন যেন ইউসুফ, নাজিম এবং অন্য বন্দুকবাজরা খামোকা কাজ করছিল না বলেই মনে হচ্ছে ওর, বরং ওদের পেছনে টাকা এবং ক্ষমতাধর কেউ আছে।
কিন্তু কি কারণ থাকতে পারে তার? ওকে জব্দ করতে? দুষ্টলোকেরা বহু বছর ধরেই ওকে বেকায়দায় পাওয়ার বহু সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি ওর। তাহলে এখন কেন?
জ্যাক মিল্টনকে বাঁচাতে চায়?
তাই যদি হয়, কে তাকে বাঁচাতে চাইছে? ওর নয়া তালিবান দোস্তরা? মনে হয় না। হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে আছে ওরা। তাছাড়া, নিজেদের মহল্লার বাইওেরকিছু করতে গেলেই প্যাঁচে পড়ে যায় ওরা। সেই সাধ্য নেই ওদের।
তাহলে কি জ্যাক মিল্টন স্বয়ং নিজের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করছে?
কিন্তু ইউসুফ আর নাজিমের মতো লোকজনকে দিয়ে কিভাবে তা সম্ভব? ম্যানহাটানের ডাউন টাউনের ঝা চকচকে জুতো আর চমৎকার ছাঁটের স্যুটঅলা আইনের লোকদের মদদই তো তার নেওয়ার কথা।
অনেক কিছুই ভাববার ছিল। কিন্তু আপাতত এয়ার ফ্রান্স বোয়িংয়ের ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে বসে আরাম করছে ও। আবার জেএফকে-তে ফিরে চলেছে ওটা। নিজের মর্যাদা বাড়াতে মোটমুটি ভালো টাকা খরচ করেছে ও। সিরিয়ার বেপরোয়া এবং বিচ্ছিরি ঘটনার কথা ভাবলে টাকাটা ঠিক জায়গাতেই খরচ করা হয়েছে মনে হয়। টেলিভিশন স্ক্রিনসহ প্রতিটি আসন একেকটা ছোটখাটো বিলাসবহুল স্পেস পড। আটলান্টিকের মাথায় কোথাও পরিবেশিত ডিনারে ছিল টর্নেডো আর পাঁচটা ভিন্ন ভিন্ন মদ থেকে পছন্দ করার সুযোগ।
কিছু টের পাওয়ার আগেই ঘুমে ঢলে পড়ল ও। মৃদু গুঞ্জন তুলে অবতরণ করল বিমান। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক নম্বর টার্মিনাল ধরে আগে বাড়ল। ভুয়া পরিচয়পত্র নিয়েই কাস্টমস পেরিয়ে এলো ও।
অন্যপাশেই ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল আনিকা। লক্ষণ সুবিধার নয়, নিশ্চিত হয়ে গেল ও। কালো ব্লেযারের ইউনিফর্ম, কালো স্ল্যাক, আর কালো হীলের জুতো পরেছে আনিকা। শুনতে শাদামাটা মনে হলেও দুর্দান্ত সুন্দর লাগছে ওকে।
ওর কাছে এসে আনিকা বলল, 'ঝামেলা হয়ে গেছে।'
ঠিকই ভেবেছিল ও, লক্ষণ সুবিধার না।
'কি সমস্যা?'
ইশারায় ওকে অনুসরণ করতে বলে একটা নিরিবিলি কোণে চলে এলো আনিকা। টার্মিনালের মাথার উপর বহু টিউব আর ট্রাসেস আছে। ভবিষ্যতের চেহারা ফুটিয়ে তুলতে কোনো ক্ষ্যাপা স্থপতির ভাবনা।
'আমাদের জর্জিয়ায় যেতে হবে,' বলল আনিকা।
'কিন্তু কি হয়েছে ওখানে?'
সরকারী চাকরীতে লম্বা সময় কাটানো কারো মতোই দরজাভাবে খিস্তি করল সে। 'রাখো। তোমার যা যা দরকার সব পেয়েছ?'
ক্যারি-অন ব্যাগটা উঁচু করে ধরল ও। 'এখানেই আছে।'
'তাহলে চলো আগে বাড়া যাক। আধঘণ্টার মধ্যে আটলান্টার পথে রওয়ানা দেবে একটা ফ্লাইট। কিন্তু ভুল টার্মিনালে আছি আমরা।'
দ্রুত হাঁটা দিল সে। ওর সাথে তাল মেলাল তারিক।
'সমস্যাটা কি?' জানতে চাইল ও।
'আটলান্টা থেকে বেরুনোর পথে ব্রিফ করব তোমাকে। তখন কেউ শুনতে পাবে না।' তারিকের খোঁচাখোঁচা দাড়িভরা মুখের দিকে তাকাল আনিকা। পরনের বাসি জামাকাপড় খেয়াল করল। 'তুরস্কের কি অবস্থা?'
'সিরিয়ায় সংক্ষিপ্ত তবে ভয়ঙ্কর সফরের কথা বাদ দিলে তুরস্ক ভালোই।'
'কি হয়েছে?'
ওর দিকে তাকিয়ে হাসল তারিক। 'আটলান্টা থেকে বেরুনোর পথে ব্রিফ করব তোমাকে।'
২০.
এয়ারপোর্টের একটা হোটেলে ঠাঁই নিল ওরা। পরদিন সকালে এক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে চলে এলো বার্নসে। ওয়াদা মতো দুদিকের সব ঘটনা পরস্পরকে জানাল ওরা, তারপর সুরম্য জর্জিয়া শহরের তারচেয়ে সুন্দর মহল্লা বার্নসে একটা দারুণ সুন্দও বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল। নিমেষে একটা কিছু গড়বড় হওয়ার কথা টের পেয়ে গেল তারিক।
ল্যান্ডস্কেপ, পথঘাট এবং ছেলেপিলেদের খেলা আগের মতোই আছে, কিন্তু রবিন এবং রেবেকাদেও বাড়ির বারান্দায় দুজন তরুণ কি যেন করছে।
গাড়িতেই এক মিনিট অপেক্ষা করল ওরা।
'ওখানেই ঘটেছে ব্যাপারটা?' জানতে চাইল তারিক।
'ঠিক ধরেছ,' বলল আনিকা। 'ঠিক যখন সিরিয়ায় শান্তি, ভালোবাসা আর সমঝোতার হাওয়া বিলোচ্ছিলে তুমি।'
'ইন্টরেস্টিং টাইমিং,' বলল তারিক।
'চলো এবার।'
বাইরের হাওয়া তুরস্কের চেয়ে ঢের বেশি তরতাজা। ট্রেইলার আর শাদা তাঁবুতে হাজারো মানুষের গাদাগাদি নেই এখানে।
'তুমি জানো, আমরা যারা পর্যটক তারা অনেক সময় পথে দেখা এলে একে অন্যকে জিজ্ঞেস করি, "বলো দেখি, আজ কি বার?" তুমি অবশ্য এটা কি মাস চলছে বলতে পারো আমাকে।'
'মাস যেটাই হোক, পুরো মাসটাই সমস্যায় ভরা,' বলল আনিকা।
বারান্দায় উঠে এলো ওরা। মিস্ত্রী দুজন পাত্তা দিল ওদের। কিন্তু বারান্দার রেইলিংয়ের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা জিনিসটাকে পাত্তা না দিয়ে পারল না তারিক। বাড়ির আদি দরজার পাল্লা, ওটার মাঝখানটা চুরমার হয়ে গেছে। দরজাটা যেখানে খোলে, ঠিক সেখানটা শটগানের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে গেছে। পোড়া গান পাউডারের কটু গন্ধ লাগছে নাকে।
কার্ডরোবোর্ডের বাক্স থেকে নতুন কবাট বের করছে মিস্ত্রীরা। ওদের পাশ কাটিয়ে দরজা পেরিয়ে পাল্টে ফেলা পার্লারে ঢুকল ওরা। কাস্টারে সাময়িকভাবে টাঙানো সবুজ চাদর হাসপাতালের বিছানার বেশির ভাগ অংশ আড়াল করেছে। মোটাসোটা একজন নার্স রবিনের শুশ্রূষা করছে। ওর ভালো চোখটা বুজে আছে। নগ্ন শরীর, কোঁচকানো ত্বক, পোড়া টিস্যু এবং ব্যান্ডেজে ঢাকা পায়ের কাটা অংশের দিকে দ্বিতীয় বারের মতো নজর দিল তারিক। পরমুহূর্তে চোখ সরিয়ে নিল।
কাছের দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দেয়া নতুন একটা জিনিস চোখে পড়ল ওর। একট মোসবার্গ মডেল ৫০০ ২০-গেজি পাম্প-অ্যাকশন শটগান।
অন্য কামরা থেকে হাজির হলো রেবেকা। ওর হাবভাব, চোখের দুষ্টিতে, এমনকি পরনের খাকি স্ল্যাক, লাল টার্টলনেক হাতাকাটা শার্ট থেকেও ভীষণ রোষ ঝরে পড়ছে। 'তো তোমরা দুই জোকার অবশেষে এলে!'
'যত জলদি সম্ভব এসেছি আমরা,' বলল আনিকা। 'আমাদের সব খুলে বল।'
'তোমরা বিদায় নেয়ার পর থেকেই রবিন আর আমাকে জ্বলাতন করা হচ্ছিল। গভীর রাতে কলিং বেল বাজিয়েছে, ফোন করে কিছু না বলেই রিসিভার রেখে দিযেছে, ঢিল মেরে দুটো জানালা ভেঙেছে। তারপর কেউ একজন সামনের দরজার নিচ দিয়ে এই ফ্লায়ারটা ঠেসে দিয়েছে।'
ককিয়ে উঠল রবিন। বিড়বিড় করে কি যেন বলল নার্স। কান্নার অস্ফুট আওয়াজ শোনা গেল। তারপর নীরবতা। দাঁতে দাঁত চাপল রেবেকা। বুককেসের দিকে এগিয়ে গিয়ে ভাঁজ করা এক টুকরো শাদা কাগজ তুলে নিল। অনিকার দিকে বাড়িয়ে দিলে ওটা নিয়ে ভাঁজ খুলল আনিকা।
ওর পাশে দাঁড়ানো তারিক পড়ল লেখাটা:
'পিছিয়ে যাও। এমনকি দুঃসাহসী যোদ্ধাও দুর্ঘটনায় মারা পড়ে।'
ইঙ্কজেট প্রিন্টারে কালো স্যান্স-সেরিফ ফন্টে ছাপানো। সোজা কথায় হদিস বের করা অসম্ভব।
কাগজটা আবার রেবেকাকে ফিরিয়ে দিল আনিকা। ওটা দুমড়ে মুচড়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল সে।
'তা তুমি কি করেছ?' জানতে চাইল তারিক।
'ওরা যেখানে কাগজটা রেখেছিল সেখানে একগাদা আবর্জনা ফেলে রেখেছি, যেন ইঙ্গিতটা ধরতে পারে।'
হাসার চেষ্টা করল তারিক। মহিলাকে কেমন যেন এখন কিঞ্চিৎ ভীতিকর ঠেকছে।
'তারপর?'
'গতকাল রাতে, হঠাৎ মনে হলো বারান্দায় কেউ আছে। তখন পাটিপে টিপে পাশের জানালা কাছে গিয়ে দেখি দুজন লোক। উবু হয়েছিল, ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে যেন।'
'আগে গুলি, তারপর প্রশ্ন, কথাটা সবসময় আমাকে বলে রবিন,' কঠিন কণ্ঠে বলল রেবেকা। 'আমি পেছনের ক্লোজিটের কাছ থেকে শটগান উঠিয়ে ওদের নিশানা করে ট্রিগার টিপে দিয়েছি।'
পর্দার ওপাশ থেকে আবারও মৃদু গোঙানির শব্দ ভেসে এলো। প্রথমে তারিক তারপর রেবেকার দিকে তাকাল আনিকা। 'আমরা...তুমি চাইলে বাদ দিতে পারি। সেটা কোনো সমস্যা না। তোমার আফসোস হয়ে থাকলে।'
দুহাত বুকের উপর আড়াআড়িভাবে রেখে প্রবলভাবে মাথা নাড়ল রেবেকা। 'আফসোস? দুটো জিনিসের জন্যে আফসোস হচ্ছে আমার। এক নম্বর, রবিনের ঘুম ভাঙিয়েছি...গভীর ঘুমে ছিল ও। দুই নম্বর...পরে পরখ করে বারান্দায় রক্তের দাগ পাইনি। তার মানে আমার গুলি ফস্কে গেছে।'
আবারও নার্সের কোমল ফিসফিস কথা কানে এলো তারিকের।
রেবেকা বলল, 'জ্যাক মিল্টন। লোকটাকে খতম করো তোমরা।'
২১.
আই-২০ হয়ে আটলান্টায় ফেরার সময়ও আনিকাই গাড়ি চালাচ্ছিল। তারিকের কাছে একে ভালো বুদ্ধি বলেই মনে হয়েছে, কারণ ওকে এবং ওদের দুজনকে যাচাই করার মতো প্রসঙ্গ তোলার কথা ভাবছে ও। মেয়েটা গাড়ি চালানোর দিকে মনোযোগী হয়ে থাকলে সেটা ওর পক্ষে কাজ করবে বলেই আশা করছে।
'একটু সময় হবে?' জানতে চাইল ও।
ভাড়া করা গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ঘড়ি দেখল ও। 'ট্রাফিক আরো বেড়ে না উঠলে, অনেক সময় আছে তোমার হাতে। কি ব্যাপার?'
সাইড ভিউ মিররে নজর চালাল তারিক। বেশ পেছনে একটা শেভি সাবআরবান দেখতে পাচ্ছি। ট্রাফিক ঠেলে এগিয়ে আসছে।
'তুমি এখানে কেন?' জানতে চাইল তারিক।
'সেটা তো পরিষ্কার। গাড়ি চালিয়ে এয়ারপোর্টে যাচ্ছি আমরা,' বলল আনিকা।
'তামাশা রাখো।' আবার ভিউ মিররে তাকাল তারিক। সাবআরবানটা নিশ্চিত ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।
'এতদিনে আমাকে চিনে ফেলেছ তুমি, আমি তামাশা করি না।'
'হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। কিন্তু অবসরে তুমি কি করো এখনো জানি না...যদি তেমন কিছু থেকে থাকে। কিন্তু রবিন রায়হানের মতো হাজার না হলে কয়েক শো লোক আছে দুনিয়ায়। সারা দেশে। তাহলে শুধু ওর পাশে এসে দাঁড়াচ্ছ কেন তুমি? মাত্র একজন পঙ্গু যোদ্ধার পেছনে নিজের ক্যারিয়ার বরবাদ করছ।'
তারিকের মনে হলো এখুনি ওকে সজোরে একটা চড় কষবে আনিকা। কিন্তু গাড়ির ভেতরে যতদূর সম্ভব দূরে রয়েছে ও। খেই ধরল ও। 'এখানে এটা জর্জিয়ায় রবিন রায়হান। জ্যাক মিল্টন একটা খবর তৈরির জন্যে খেপে থাকায় আহত হয়েছে, তালিবানরাই ওকে সেই সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু প্রথম দিন রেবেকা আমাদের যা বলেছিল তাতে মনে হয় সেকারণেই আহত হয়েছিল ও। রবিন এবং ওর ইউনিটের ওই রাতে বেরুনোর কথা ছিল না। কিন্তু ওদের সেই হুকুমই দেয়া হয়েছিল। তোমরাই দিয়েছিলে সেটা...ঠিক?'
এখন তারিকের মনে হলো ভাড়া করা গাড়িটা সোজা কাছের ব্রিজের খুঁটির সাথে টক্কর খাওয়াবে আনিকা।
'কাছে হাই ভ্যালু টার্গেট ছিল?' জানতে চাইল ও। 'ঝুকি নেয়ার মতো কাউকে খুন বা আটক করতে চেয়েছিলে তোমরা?'
'হ্যাঁ,' বলল ও।
'কি ধরনের হাই ভ্যালু টার্গেট?'
'যে টার্গেটের হাই ভ্যালু থাকে। কিন্তু পরে দেখা গেল নেই ওখানে,' খসখসে কণ্ঠ বলল আানিকা। 'কিন্তু এই ভেতর কয়েকজন ভালো সৈনিক খামোকা জবাই হলো, পঙ্গু হলো।'
তুরস্কে বন্ধু পিটার 'পাদ্রে' পিকার্ডের কথা ভাবল তারিক। 'তাহলে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছ।'
'আসলে রাতে ঘুমোনোর মতো শক্তির খোঁজ করছি,' বলল আনিকা।
ফের সাইড ভিউ মিরর দেখল ও। ধীর গতিতে লেইন পাল্টাল আনিকা। সাবআরবানটাও লেগে রইল ওদের সাথে।
'শক্তির কথা বলতে গেলে-'
'হ্যাঁ, সাবআরবানটা আছে পেছনে,' বলল আনিকা। 'দশ মিনিট হলো পেছনে লেগে আছে।'
'ভালো নজর,' বলল তারিক। 'মাত্র আট মিনিট আগে দেখেছি ওটা। কি করবে ভাবছ?'
'আমাদের পেছনে অজানা একটা জিনিস রয়েছে,' বলল ও। 'অচেনা কারো পিছু নেয়া আমার অপছন্দ।'
সামনে একটা সাইনবোর্ড বলছে, রেস্ট এরিয়া, এক মাইল সামনে।
'তাহলে সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় সেরে নেয়া যাক,' বলল তারিক।
ষাট সেকেন্ডেরও কম সময়ে মধ্যে হাইওয়ে ছেড়ে এলো ওরা, সবুজ ধাতব ছাদের একটা সুরম্য একতলা ভবনের সামনে হাজির হলো। অজানা কোনো ক্রিশ্চান গোষ্ঠীর বিরল চ্যাপেলের মতো লাগছে ওটাকে। গাড়ি থামাল আনিকা। দুজনই নামল ওরা। যে যার পরীক্ষার জায়গার দিকে এগোল। তারিক ওর কাজ শেষ করলেও আনিকা ছোট লবিতে রয়ে গেল। ভালোই হয়েছে।
উষ্ণ জর্জিয়ার শীতে বাইরে পা রাখল ও। ওদের ভাড়া করা গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে চেরি সাবআরবানটা।
এখনও আনিকার দেখা নেই।
অবশ্যই একটা কিছু ঠিক নেই।
সাবআরবানের পেছনের ডানদিকের দরজা খুলে গেল। ভেতরে বেঁটেখাটো, দশাশই চেহারার একলোক বসে আছে। দামী কাপড়ের চমৎকার ছাঁটের কালো ডোরাকাটা স্যুট তার পরনে, ওটার নিচে শাদা শার্ট, গাঢ় লাল টাই। চোখ পিটপিট করে লোকটা বলল, 'মিস্টার আহসান, তোমার আপত্তি না থাকলে, একটু কথা ছিল তোমার সাথে।'
'আমি বরং আমার সঙ্গী ফিরে আসার অপেক্ষা করব,' বলল তারিক।
'কিন্তু...ওকে যে আটকে রাখা হয়েছে,' বলল লোকটা।
হঠাৎ জর্জিয়ার ঝলমলে সূর্যটা বেমক্কা আঘাত হেনেছে বলে মনে হলো তারিকের। বাইরের গা কাঁপানো ঠাণ্ডাতেও ঘামতে শুরু করেছে ও। 'জানি, তুমি আমার সাথে কথা বলতে চাও। কিন্তু, আমি চাই কিনা নিশ্চিত হতে পারছি না,' বলল ও।
'তোমার মেয়ে বন্ধুর চেহারাসুরত সহিসালামতে থাকুক, চাও না?' জানতে চাইল লোকটা। 'সেটা তোমার সহযোগিতার উপর নির্ভর করছে। পাবো না?'
সাবআরবানের পেছনের সিটে উঠে বসতে গেল তারিক।
'কায়দামতোই পেয়েছ আমাকে,' বলল ও।
(চলবে)