মৃত্যুর মিছিল
২২.
সাবআরবানের ভেতরটা ঝকঝকে পরিষ্কার, গোছানো, কেলোনের গন্ধে ভুরভুর করছে; তবে গন্ধটা ওর ড্যাডি ওয়ারবাকের সঙ্গী নাকি ড্রাইভারের শরীর থেকে আসছে মালুম করতে পারল না ও। ড্রাইভারের সিটে বসা লোকটা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে; তবে দৈহিক গঠন এবং বেশভুষা ওর পাশে বসা লোকটার মতোই। অবশ্য, ছোট করে ছাঁটা ঘন কালো চুলভরা মাথার কথা ভিন্ন। গাড়ি নিয়ে পিছু হটল সে। অল্প কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার আই-২০-তে উঠে এলো ওরা।
দরাদরিতে আগে কথা বললেই হারতে হয় বলে কথা চালু আছে। অবশ্য বলার মতো কিছু নেই তারিকের, তো স্পিকটি নট হয়ে বসে থাকল ও। বেরুনোর একটা রাস্তা না মেলা অবধি একটানা এগিয়ে চলল গাড়িটা, তারপর পেছন-রাস্তা ধরে আরও মিনিট দশেক আগে বাড়ার পর একটা চিহ্নহীন নুড়িপাথরের রাস্তা ধরে চলল। ড্রাইভার লোকটা গন্তব্য ভালো করেই জানে বলে মনে হলো তারিকের।
প্রশস্ত প্রায় হাঁটু অবধি উঁচু ঘেসো একটা জমিনে এসে শেষ হলো রাস্তাটা। মাঠের ওধারে একটা পাথুরে ক্লিফ দেখা যাচ্ছে। ওটার পেটের ভেতর পাথরের খনি ছিল সম্ভবত। ওর অবস্থান থেকে ওটার গভীরতা আন্দাজ করতে পারল না তারিক। তবে পেশীবহুল ষণ্ডা দুটোর হাবভাব থেকে ওটা যথেষ্ট গভীর হবে বলেই আঁচ করে নিল। ওরা কিছু লুকোতে চাইলে কোনও ঝামেলা হবে না।
গাড়িটাকে ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে থামাল ড্রাইভার। এঞ্জিন বন্ধ করল। ওর পাশের লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 'আমার নাম পোপ।'
'তা আছো কেমন, পোপ?' রসিকতা করে জিজ্ঞেস করল তারিক।
'বেশি ভালো না,' পোপও কম যায় না, পাল্টা জবাব দিল সে। 'আমার হাতে প্রচুর জরুরি কাজ ছিল। ওই তালিকায় তোমার আর তোমার ওই বান্ধবীটির নাম থাকার কথা ছিল না। অথচ এখন উটকো ঝামেলা হিসাবে জুটেছ তোমরা।'
'আমি সেজন্যে দুঃখ প্রকাশ করতে পারি বটে, কিন্তু তুমি জানো, সেটা করব না।'
'ঠিক,' বলল সে। সিটের উপর নড়েচড়ে বসল সে, তারপর আবার বলল, 'তোমার পিস্তলটা দাও দেখি। দয়া করে ধীরেসুস্থে স্রেফ বাম হাতের দুটো আঙুল ব্যবহার করে বের করো যেন।'
'ঠিক আছে,' বলল তারিক। কোলে রাখা জিনিসটা দিয়ে ওকে কাভার করতে ঘুরে বসেছে ড্রাইভার। ড্রাইভারের সিটের কারণে ওটা দেখতে পাচ্ছে না ও। হালকা চালে তারিক বলল, 'বেশ, বের করছি।'
সামনে ঝুঁকে কোমরের হোলস্টার থেকে সিগ সাওয়ারটা বের করল ও। কথামতো দুই আঙুলে ঝুলিয়ে রাখল।
'দয়া করে ট্রেভরের হাতে চালান করো ওটা,' বলল পোপ।
বন্দুক সামনে বাড়িয়ে দিল তারিক। ওর হাত থেকে ওটা তুলে নিল ড্রাইভার।
লম্বা একটা শ্বাস ফেলল পোপ । 'বেশ,' বলল সে। 'শুরুটা ঠিকমতোই করেছ। এটা আমার পছন্দ হয়েছে।'
'আমরা সবাই কি তা করি না।'
'তুমি আর তোমার বান্ধবী কিন্তু একটা জটিল ভারসাম্য নষ্ট করতে চাইছ,' ওকে পাত্তা না দিয়ে খেই ধরল পোপ, 'আমরা চাই সেটা বন্ধ হোক।'
'তা এই "আমরা"টা কারা?' জানতে চাইল তারিক। 'জ্যাক-ভক্ত সমিতির সদস্য? তুমি আর তোমার ড্রাইভারকে বোঝাচ্ছি না। তবে এই ধরনের গ্রুপগুলো নারী দর্শকদের দিকেই ঝুঁকে থাকে বলে আমার ধারণা ছিল।'
'কে আমাদের ভাড়া করেছে সেটা তোমার জানার কোনো দরকার দেখি না,' বলল সে। 'আপাতত আমরা চাই তুমি থামবে। আমাদের কি রফা হলো?'
'নাহ।'
'কেন নয়?'
'আমি রফা করতে রাজি নই,' ভবিতব্যের জন্যে নিজেকে তৈরি করার অবসরে বলল তারিক।
ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলল পোপ। ওর সামনের আসনে রাখা একটা জালি ব্যাগ থেকে একজোড়া কালো চামড়ার গ্লাভ বের করল সে। সামলানোর কায়দা দেখেই সমঝে গেল তারিক - ওগুলোর ভেতর চামড়ার চেয়েও বেশি কিছু আছে।
সীসার আস্তরণ দেওয়া দস্তানা জোড়া সযত্নে হাতে লাগাল সে। তারপর বলল, 'আমি এখন যা করতে যাচ্ছি সেজন্যে আমাকে ক্ষমা করবে, কিন্তু তোমার বান্ধবীকে অক্ষত দেখতে চাইলে স্রেফ হজম করো।'
পরক্ষণে দড়াম করে ওর মুখে আঘাত হানল পোপের মুঠি।
২৩.
পরের ঘটনার পুরোটাই রেস্ট এরিয়ায় সাবআরবানে ওঠার মুহূর্তেই পরিকল্পিত ছিল। নিজেকে ক্লান্ত না করে মাপা মাপা অল্প কিছু আঘাত হানছে পোপ, তাতেই যারপরনাই যন্ত্রণা হচ্ছে তারিকের। শিকারের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে ও, আত্মরক্ষার ভাঙ্গিতে দুই হাত উঁচু করে রেখেছে, মারের চোটে দুভাঁজ হয়ে গেছে; যন্ত্রণা আর অস্বস্তিতে গোঙাচ্ছে। পেশাগত কারণে প্রচ- সহ্য ক্ষমতার অধিকারী ও, কিন্তু পোপের মতো পেশাদার ষণ্ডার কাছে-ব্যাটার হাবভাব আর মুখের ভাষা থেকে বোঝ যায় রীতিমতো পেশাদার - ওদের দুজনের বেলায় কায়দাটা স্রেফ প্রলম্বিত হবে বলেই টের পাচ্ছে ও। ব্যাটা হয়তো স্রেফ দ্রুত কাজ সারার জন্যে তারিকের অতিঅভিনয়কে সন্দেহ করে বসতে পারে, অবশ্য পেশাদার হিসাবে পেশাদারী মতলব হাসিলের জন্যেই শেষপর্যন্ত মার চালিয়ে যাবে সে।
কিন্তু ওর একটা অংশ ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তি দিয়ে মারগুলো বিশ্লেষণ করলেও আসল কথা, মারগুলো রীতিমতো কষ্ট দিচ্ছে ওকে।
অনেক খানি সময় কেটে গেল। ফের শুরু করার আগে একটু থামল পোপ।
দাঁতে দাঁত কষল তারিক। মুখের ভেতর রক্তের লোনা স্বাদ পেল।
এই ধরনের মুহূর্তগুলোয় পেশাদারদের ঘৃণা করে ও।
অবশেষে থামল পোপ। সামান্য হাঁপাচ্ছে। 'আমার দানবীয় স্বভাবের জন্যে দুঃখিত,' বলল সে। 'কিন্তু এভাবেই খোলামেলা কথাবার্তা বলার মতো মেজাজ তৈরি হয় আমার।'
একটা শাদা রুমাল ওর কাছে চালান করল ড্রাইভার। সাধ্যমতো গ্লাভজোড়া মুছল পোপ, তারপর খুলে ফেলল ওগুলো। সযত্নে সমস্তকিছু ড্রাইভারের হাতে তুলে দিল সে।
'তাহলে শুরু করো,' বলল তারিক, বুঝতে পারছে, ঠোঁটজোড়া ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।
'জ্যাক মিল্টনের পিছে লেগেছ তুমি। এটা থামাও।'
'কেন?'
র্যাটল স্নেকের মতো ক্ষিপ্রতার সাথে নড়ে উঠল পোপের ডান হাত, তারিকের ক্ষতবিক্ষত মুখে প্রচণ্ড আঘাত হানল। অস্পষ্ট কণ্ঠে একটা কিছু বলে দরজার বুকে আছড়ে পড়ল ও।
'এটাই কি যথেষ্ট ভালো কারণ নয়?' জানতে চাইল সে। 'নাকি ট্রেভরকে বলব গ্লাভগুলো আবার ফিরিয়ে দিতে?'
লালা আর রক্তে ভরে গেছে তারিকের মুখের ভেতরটা। সামনে ঝুঁকে গাড়ির মেঝেতে থুতুর সাথে রক্ত বের করে দিল ও। ঠোঁট মুছে বলল, 'হয়তো। কিন্তু খোলাসা করে বলছ না কেন। খোশ মেজাজে আছ বলেই তো মনে হচ্ছে।'
এক মুহূর্ত মাথা নাড়ল পোপ। যেন বুঝতে পারছে ওর মর্জির সাথে তাল না মিলিয়ে পারা যাবে না। 'জ্যাক মিল্টন একটা নির্বোধ, নামের কাঙাল। ভালো কোনো স্কুপ, খবর, নাম ফাটার মতো কিছু হলেই হলো, আত্মা বিকিয়ে দিতে কসুর করে না - যদি সেটা থাকে আরকি। নেশাখোরের মতো ফের রাস্তায় নামার আগে আগে খানিক দম নেয়।'
'এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই।'
বিক্ষত মুখ ডলতে ডলতে ক্ষতির পরিমাণ আন্দাজ করার চেষ্টায় ধীরে ধীরে নড়ল তারিক। 'ইদানীং তুরস্কে গেছিলে?' জানতে চাইল ও।
লোকটার মুখে ফুটে ওঠা ক্ষীণ হাসি থেকেই যা জানার জেনে গেল ও। পোপ উত্তর দিল না, বরং বলল, 'তুমি পিছু হটবে কিনা?'
'এই মুহূর্তে বলা কঠিন,' বলল তারিক।
পোপ বলল, 'ওর প্রতিরক্ষার গভীরতার কথা জানলে অবাক হয়ো না। তুমি ওকে হুমকি দেবে, আমরা সেটি বরদাশত করব না।'
২৪.
আলো-ছায়ার একটা ঝিলিক দেখা দিল। আরেকটা শেভি সাবআরবান রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে। 'তোমার সঙ্গিনী কিন্তু ওই গাড়িতে নেই,' বলল পোপ। 'এই জায়গাটা যে জনবসতি থেকে কত দূরে সেটা বোধ হয় আন্দাজ করতে পারছ। তাছাড়া তুমি আর তোমার বান্ধবীর চেয়ে সংখ্যায় আমরাই বেশি।'
'বেশ, গত কয়েকটা মিনিট কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিলাম, তবে তোমার কথা বুঝতে পারছি,' বলল তারিক।
'তাই কি?'
অনেকটা জায়গা নিয়ে বাঁক নিল সদ্য আসা সাবআরবানটা, ওদের গাড়ির সাথে সমান্তরালে দাঁড়াল।
ওটার জানালাও টেইন্টেড।
একটু নড়ল পোপ, তাতেই সিটটা ককিয়ে উঠল। 'তাহলে ব্যাপারটা আমাকে খোলাসা করতে দাও। তোমার মনের কথা জানানোর এটাই শেষ সুযোগ।'
'তোমরা কি খুঁজছ, আবার বলবে?' জানতে চাইল তারিক।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল তার। 'জ্যাক মিল্টনের ব্যাপারে তোমার সব কাজকর্ম বাদ দেবে। পিছু হটবে তুমি, থামবে, ভদ্র সমাজে জ্যাকের নাম মুখে আনা থেকে বিরত থাকবে। আমি কি পরিষ্কার করে বোঝাতে পারলাম?'
'একদম জলের মতো,' বলল তারিক। 'কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বাদ দিয়ে গেছ। "নইলে" বলোনি তুমি। এটা রেয়াজের মধ্যে পড়ে না?'
'তোমার ধারণা আমি রেয়াজের ধার ধারি?'
'পোপ, তোমার কথায় যুক্তি আছে। এটা মানতেই হবে।'
'তোমার হাতে সময় ছিল। এখন আর নেই। আমি যা শুনতে চাই সেটাই বলবে, নইলে এমন অবস্থা করব সেটাকে তোমার বান্ধবীর বেলায় যা করব তার কাছে স্রেফ স্পা'র মতো ঠেকবে। তোমার সম্মতি পাচ্ছি তো?'
সাবআরবানের ড্রাইভারের দিকের দরজা খুলে গেল।
আনিকা বেরিয়ে এলো।
ওর ডান হাতে একটা নাইন এমএম পিস্তল।
'আমার ধারণা আমার বান্ধবী নতুন একটা প্রস্তাবের কথা বলতে চাইছে,' বলল তারিক।
ট্রেভরের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল পোপ। ওদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হওয়ার সুযোগের সদ্ব্যবহার করল ও, চোখের পলকে পকেটে হাত চালাল। নিউ ইয়র্কে আনিকার দেয়া কলমটা বের করেই একটানে ওটার মুখ খুলে ফেলল। কিন্তু বলপয়েন্টের শিসের বদলে কার্বন স্টিলের তৈরি একটা ধারাল স্টিলেটো বেরিয়ে এসেছে।
এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ট্রেভরের কাঁধের পেছনে গেঁথে দিল ওটা। তীক্ষ্ন আর্তচিৎকার করে উঠল সে, যেন পাথরে হোঁচট খেয়েছে কোনো বালক। একটানে স্টিলেটোটা বের করে এনেই পাঁই করে ঘুরল ও, নিমেষে পোপের গলায় সেঁধিয়ে দিল ওটা। গলা দিয়ে ঘরঘর আওয়াজ বেরিয়ে এলো তার। চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেছে। একটা আঘাতই হয়তো যথেষ্ট ছিল, তবু লোকটার উপর ভীষণ খাপ্পা হয়ে উঠেছিল ও, আবেগের কাছে হার মেনে ফের ঘাই দিল ও।
সামনের সিট থেকে সিগ সাওয়ারটা উদ্ধার করল ও। দুহাত দিয়ে ঘাড়ের পেছনটা চেপে ধরে হুহু করে কাঁদছে ট্রেভর, ধীরে ধীরে অবশেষে লুটিয়ে পড়ল সে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তারিক।
'হায় আল্লাহ, তোমাকে তো মেরে ভর্তা বানিয়ে দিয়েছে,' বলল আনিকা।
'কিন্তু আমার গোপন চিকেন রেসিপি আদায় করতে পারেনি।'
তারিককে পাশ কাটিয়ে গাড়ির ভেতরে নজর চালাল ও। 'চলো, এখান থেকে কেটে পড়ি,' বলল সে।
'রাজি।'
সাবআরবানে উঠল ওরা। প্রথমবারের মতো আনিকার হাতে শুকনো রক্ত খেয়াল করল তারিক। ওর কাঁধ আর মুখের ডানপাশেও রক্তের ছোপ লেগে আছে।
'আমি চালাব গাড়ি,' বলল ও। 'আর দয়া করে পেছনে তাকিয়ো না।'
'কেন?'
নাইন এমএম পিস্তলটা কালো ব্লেজারের নিচে ওয়েস্ট হোলস্টারে রাখল আনিকা।
'হাতে পিস্তল থাকলেও অনেক সময় কিছু লোক সশস্ত্র মেয়ের কথা শুনতে চায় না,' বলল ও। 'তো যা করার তাই করেছি।'
২৫.
গাড়ি নিয়ে ইন্টারস্টেটে উঠল আনিকা। বেশ কয়েক দফা বেআইনি ইউ-টার্ন নিয়ে আবার রেস্ট এরিয়ায় ফিরে এলো। পেছনের আসনটা যেন কেউ দেখতে না পায় সেজন্যে সাবআরবানটাকে পার্কিং লটের শেষ মাথায় সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরার আওতার বাইরে পার্ক করল ওরা। ওটাকে ওভাবেই ফেলে রেখে ভাড়া করা গাড়িতে চেপে পথে উঠে এলো।
কিছু দূর এগোনোর পর একটা গ্যাস স্টেশনে পৌঁছাল ওরা। দুজনই বেশ সময় নিয়ে সাফসুতরো হলো ওরা। আনিকার বেলায় কাজটা সহজ ছিল, কারণ ওর হাত আর মুখে নিজের রক্ত লেগে ছিল না। এদিকে নিজের ক্ষতগুলোর যতদূও সম্ভব ব্যবস্থা করার প্রয়াস পেল তারিক।
ওদের আটলান্টা-হার্টসফিল্ড ফ্লাইট ফসকে গেছে। অবশ্য মানানসই উসিলা থাকলেও সেগুলো ডেল্টার টিকেট কাউন্টারের মেয়েটি নতুন করে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় জানাতে গেল না।
এখন কনকোর্স এ-র সবচেয়ে দূর প্রান্তে বসে আছে ও। চুল আঁটোসাটো পনি টেইল করে উইমেনস রুম থেকে আনিকা বেরিয়ে এলো যখন, মৃদু স্বরে তারিফ করল তারিক, বলল, 'খোদা, ভালোই পরিষ্কার করে নিয়েছ নিজেকে।'
ধমকের সুরে কিছু বলার বদলে আনিকা ক্ষণিকের জন্যে লাল হয়ে গেছে মনে হলো।
'ঠিকাছে,' বলল সে। 'এখনও ঘণ্টা দুই সময় কাটাতে হবে আমাদের।'
'কথাটা ঠিক জুৎসই হলো না।'
'তুমি আবার ব্যাকরণ বিদ হলে কবে?' জানতে চাইল ও।
'তুমি চাইলে আমার সার্টিফিকেট দেখাতে পারি,' বলল তারিক।
তারিকের পাশে বসে পড়ল আনিকা। 'পোপ লোকটার কথা থেকে মনে হচ্ছে জ্যাক মিল্টনকে আমরা কোনোদিনই ধরতে পারব না। ব্যাটাকে পাহারা দিয়ে রাখা হচ্ছে। এমনি ঝামেলার সময় কর্পোরশেনগুলো আয়রোজগারের বিষয়গুলোকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবে।'
'শীতল পানিতে পেপার টাওয়েল ভিজিয়ে একটা দলা বানিয়ে নিলো তারিক। মুখের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতগুলোর উপর চেপে ধরতে লাগল ওটা। 'ওদের হাতও বেশ লম্বা। কিভাবে যেন আমার তুরস্কে থাকার কথা জেনে গেছে ওরা। ওদের সেরা লোককে খুঁজছি। ওরা সিরিয়ায় আমাকে অপহরণের চেষ্টাও করেছে।'
'ধূর্ত হারামি।'
'শক্তিশালীও,' বলল তারিক। 'কোম্পানি আর ওর বন্ধু বা সহকর্মী, যাই হোক, ওকে ছাড়বো না। সম্ভবত গাঢাকা দেয়ার জন্যে ব্যাটার অন্তত আধডজন কন্ডো, শ্যালে আর কেবিন আছে। টেলিভিশনে ওর হদিস জানার চেষ্টা করতে গেলে বরাবর কমসেকম একটা দিন পিছিয়ে থাকতে হবে।'
'তুমি কি পরামর্শ দাও?'
চোয়াল নাড়াল তারিক। সবকটা দাঁত এখনও বহাল তবিয়তে আছে বলেই মনে হচ্ছে। শোকর।
'যুদ্ধক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হবে,' বলল ও। 'নেটওয়ার্কের বড়কর্তা, কিংবা ওদের বিজ্ঞাপনদাতা কিংবা ম্যানহাটান অফিসে যেসব লোকজন কাজ করে তাদের কয়েকজনের পেছনের ইতহাস পরখ করতে হবে। কোথাও না কোথাও, কেউ একজন মচকাবেই কিংবা আমাদের সূত্র যোগাবে।'
ভুরু কোঁচকাল আনিকা। 'তাতে সময় লাগবে।'
'তোমার বাস ধরার তাড়া আছে নাকি?'
কোথাও থেকে একটা বিপ শব্দ উঠল। ওদের বসার জায়গায় নজর বোলাল তারিক। আনিকা বলে উঠল, 'আরে বুড়ো খোকা, পকেটে হাত চালাও। তোমার সেল ফোন তোমার সাথে কথা বলছে।'
ঠিকই বলেছে ও। পকেট থেকে সেল ফোন বের করল তারিক। পর্দার উপর দিয়ে হাত চালাল। একটা ইনকামিং টেক্সট দেখতে পেল:
যত দ্রুত পারো দেখা করো আমার সাথে।
'কি?' জানতে চাইল আনিকা।
টেক্সটটা ওকে পড়ে শোনাল তারিক।
'কোত্থেকে এসেছে?' জানতে চাইল আনিকা।
'জ্যাকের সবচেয়ে প্রিয় ক্যামেরাম্যান ওয়াল্টার কুপারের স্ত্রী লিসা,' বলল ও।
একহাতে ফোন ধরে রেখে কম্প্রেসটা আবার নাড়াল ও।
আনিকা বলল, 'কিন্তু আমাদের সাথে কথাবার্তা না বলার ব্যাপারে তো বেশ গোঁয়ার মনে হয়েছিল ওকে।'
'কিছু একটা বদলেছে।'
'তাই মনে হয়, সম্ভবত ভালোর জন্যেই,' বলল তারিক। 'মনে হচ্ছে আমরা নিউ রচেলেই ফিরছি।'
'ফাঁদ হতে পারে,' বলল আনিকা।
'এখন পর্যন্ত আমাদের ভাগ্য ভালোই গেছে।'
'না, যায়নি,' পাল্টা জবাব দিল আনিকা। 'আসলে আমরা ভালো ছিলাম।'
'কিন্তু কখনোই বেপরোয়া নই,' বলল তারিক।
'কখনোই বেপরোয়া না,' বলল আনিকা।
- (চলবে)