মৃত্যুর মিছিল
১৬.
নদী তীর ধরে দশ মিনিট আগে বাড়ার পর ওর গুলি খাওয়া পা-টা নিজের উপস্থিতি জানান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে চিৎকার আর দপদপ শুরু করল। যত চেষ্টাই করুক, ল্যাঙচানোর ভাব গোপন করতে পারছে না। নদীর তীরের ঝোপের কাছে পাঁচ মিনিটের বিরতির সময় বোরোযান বলল, 'তোমার পা-টা দেখতে দাও।'
চিৎকার করে ওঠা ঠেকাতে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে দুটো পা একসাথে উঁচু করে নাচাল তারিক। ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বোরোযান বলল, 'তামাশা রাখ। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।'
'তুমি বলছ একথা।'
'ওই পা-টা খোয়াতে চাও?'
'ভোর হওয়ার আগেই টার্গেট এরিয়ায় যেতে চাও?' ঘড়ি দেখল ও। 'বিশ্রামের সময় শেষ। আমরা যাচ্ছি।'
আরও আধঘণ্টা নদীর তীর ধরে এগোল ওরা, তারপর নদীর সাথে এসে মেশা একটা ছোট জলধারা বরাবর আগে বাড়ল। কম্পাস পরখ করল ও। নদী থেকে দূরে সরে যেতে হলে পুবে ৪৫ ডিগ্রি কোণে এগোতে হবে। কম্পাস আর ম্যাপ বোরোযানের হাতে তুলে দিয়ে ও বলল, 'একেবারে কাছে এসে গেছি। এই টিলাটা বেয়ে উঠে ঢাল বেয়ে নামতে হবে। আমাদের নিচেই, এই রাস্তার ওধারে দার্কোর বাড়ি।'
ঘড়ি দেখল ও। 'ভোর হতে আর ঘণ্টাখানেক বাকি। সবকিছু মাথায় রাখলে... মন্দ না...'
'হ্যাঁ,' বলল বোরোযান। 'সবকিছু মাথায় রাখলে।'
তুষারপাত এবং বৃষ্টি, দুটোই থেমে গেছে। কিন্তু আকাশ এখনও মেঘে ঢাকা, ফলে দক্ষিণে কামানের গোলাবর্ষণ হলেই আলোর ঝলকানি চোখে পড়ছে ওদের।
'ভয়াবহ অবস্থা,' বলল বোরোযান। 'এইসব যুদ্ধ, এত এত মৃত্যু। কিসের জন্যে? এক গ্রামের লোক অন্য গ্রামের লোকদের চেয়ে অন্যভাবে প্রার্থনা করে বলে?;'
টপো ম্যাপটা প্যান্টের পকেটে চালান করল তারিক। ভুলভাল একটা কবিতা আওড়াল ও। 'কারণ জানতে চাওয়া আমাদের কাজ নয়...'
'আমাদের কাজ দায়িত্ব পালন করা নয়তো জান দেয়া। সত্যি?'
'না, সত্যি না,' বলল ও। 'আমাদের দায়িত্ব কাজ শেষ করা। চলো, আগে বাড়ি।'
পানি ভেঙে ছলাৎছলাৎ শব্দ তুলে এগোতে শুরু করল ওরা। ওদের পেছনে আরো আলোর ঝলকানি। আরো কামানের গর্জন।
ওরা প্রথম টিলা বেয়ে ওঠার সময় যে জিনিসটা সবার আগে ওর নজরে এলো সেটা হচ্ছে প্রচুর লম্বা এভারগ্রিন গাছ থাকলেও নিচের আগাছা কেটে সাফ করে ফেলা হয়েছে। এই নাংগা টিলাটা যেন কোনো পার্ক বা ফার্মল্যান্ড। দ্বিতীয় জিনিসটা হলো, গন্ধ: বর্জ্য আর লাশের গন্ধ।
ইশারায় বোরোযানকে থামতে বলল ও। তাই করল ও। চারপাশে নজর চালাল তারিক, আলুর বস্তার মতো বড় বড় দুটো ঢিবি চোখে পড়ল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ও। পাশে বোরোযান।
দুটো ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত, ফোলা লাশ। কাছে ভাঙা বাটঅলা একটা একে-৪৭ পড়ে আছে।
সামনে বাড়ার ইশারা করল ও। আরো উঁচুতে উঠে এসে আরো লড়াইয়ের চিহ্ন আর গন্ধ পেল। সম্ভবত একদিন পুরোনো। গোটা এলাকা যেন চিবিয়ে ফেলা হয়েছে। আরও লাশ, কিছু ফক্সহোল, ভাঙাচোরা সরঞ্জাম, অগুনতি তামার গুলির খোসা।
মোটেই সুবিধার ঠেকছে না। এখানে যেকোনো মুহূর্তে গুলি করে বসার মতো ভীত সন্ত্রস্ত কেউ জীবিত আছে বলে মনে হচ্ছে না, তবে হুট করে ল্যান্ডমাইনে পা দিয়ে বসার আশঙ্কা সবসময়ই থাকে। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে বিস্ফোরিত হয়ে কাছেপিঠে যেকাউকে হাওয়ায় মিশিয়ে দিতে পারে।
বোরোযানের দিকে ঝুঁকে পড়ল ও, বলল, 'দেখেশুনে পা ফেলো। খোদাই মালুম, কি ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছে এলানে।'
'বুঝেছি, বস।'
তো দার্কোর বাড়ির একেবারে কাছাকাছি এসে পড়া সত্ত্বেও খুব সাবধানে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পা ফেলে আগে বাড়তে লাগল ওরা।
ওদের মাথার উপর দিয়ে জেট বিমানগুলো গোঁ-গোঁ আর্তনাদ ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে।
চোখ তুলে তাকাচ্ছে না ওরা।
ওদের সামনেই নিচু একটা ঢিবি, বাম থেকে ডানে চলে গেছে। চলার গতি আরো কমাল ও।
মোটামুটি ফাঁকা একটা ট্রেঞ্চলাইন, শুধু কয়েকটা ফোলা লাশ আর কিছু ভাঙা মেশিনগান এমপ্লেসমেন্ট পড়ে আছে।
ট্রেঞ্চ বরাবর নজর চালাল ও।
কিছুই বেঁচে নেই। কিছু নড়ছে না।
বোরোযানের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো ওর। ট্রেঞ্চে নামল ওরা। পরক্ষণে সমান দ্রুততায় আবার উঠে এলো। ওদের সামনে এভারগ্রিন গাছ, আরো কিছু লাশ। এবং উল্টে পড়া একটা পিকআপ ট্রাক, পুড়ে কালো হয়ে গেছে, টয়োটা, নাকি শেভি নাকি ফোর্ড বলার জো নেই।
ওদের সামনে একটা টিলা দাঁড়িয়ে।
কাছাকাছি।
চূড়ায় উঠে নিচের এলাকা জরিপ করল ওরা। তারপর হাছড়েপাছড়ে আরো একটা উৎরাই বাইল। এখন দার্কোর মহল্লায় এসে গেছে ওরা।
অবশেষে।
তখনই ওর মনের ভেতর কথা বলে উঠল একটা কণ্ঠস্বর। এবার কি? ওকে পাঁচজনের দলের একজন হিসাবে রেখে এই শেষ মিশনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এখন বোরোযান এবং ও বাদে বাকি সবাই মারা গেছে। ফাঁদে ধরা পড়া বুড়ো ভালুকের মতো খোঁড়াচ্ছে ও।
ভালো প্রশ্ন।
ওখানে পৌছে কি করবে ওরা?
আরো কাছাকাছি এলো ওরা।
তারপর ও ভাবল, 'ওখানে পৌছেই স্থির করব সেটা।'
ফিসফিস করে কথা বলল বোরোযান। 'বস!' এবার তারিকও শুনতে পেল।
আগুয়ান বুলেটের শিসের শব্দ।
'মাথা নামাও!' চিৎকার করে বলে উঠল ও। নিজেদের জমিনে মিশিয়ে দিল ওরা।
নিকুচি করি ওদের। সবার নিকুচি করি। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে ১২০ এমএম মর্টারের গোলা। যেই গুলি করে থাকুক, ভালো করে জানে কি করছে। জমিনের স্তরে বিস্ফোরিত হতে নয়, গাছের মগডালে বিস্ফোরিত হওয়ার জন্যে গুলি করছে। তাতে গত যুদ্ধে কেউ বেঁচে থাকলেও তাদের উপর ধাতব শ্র্যাপনেল এবং ক্ষুরধার কাঠের কুচি ঝরে পড়বে।
এই পাহাড়ের বুকে আর কি বেঁচে থাকতে পারে, বলতে পারবে না, এই মুহূর্তে বোরোযান আর ও ছাড়া কেউ নেই। নিজেদের জমিনের সাথে মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বোরোযানকে জড়িয়ে ধরল ও। ওদের পেছনে ট্রেঞ্চলাইনটা রয়েছে, হয়তো কাঁকড়ার মতো হামাগুড়ি দিয়ে পিছু হটে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে পালাতে পারবে। কিন্তু প্রচ- বিস্ফোরণ আর আগুয়ান মর্টারের শিসের শব্দ সেই চিন্তা ঝেটিয়ে বিদায় করল। নড়াচড়া করার বদলে স্থির পড়ে থাকাই মঙ্গল।
ওর পায়ের নিচের অংশে একটা কিছু ছড়িয়ে পড়ল। ককিয়ে উঠল ও। তারপরই গোলাবর্ষণ থেমে গেল।
'ওহ, শিট। চোট লেগেছে মনে হচ্ছে,' ফিসফিস করে বলল বোরোযান।
'আমিও,' মাথা তুলে বলল তারিক। 'আমার পায়ে ধারাল খিলাল বিঁধেছে মনে হচ্ছে । তোমার কি অবস্থা?'
গড়ান দিল ও। ওর ঘাড়ে শক্ত হয়ে চেপে বসেছে একটা হাত। আঙুলের ফোকর গলে দরদর কওে রক্ত গড়িয়ে নামছে। 'ওরা আমার গলায় গুলি লাগিয়েছে, বস।'
১৭.
বোরোযানের অবিচল, অনায়াস ফিসফিস কথা শুনতে শুনতে কোনোমতে কাজটা সারল তারিক। ক্ষত পরিষ্কার করে ক্ষতস্থানে পাউডার লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধল। বেশি শক্ত হলো না সেটা। ব্যস। যথেষ্ট ভালো।
গভীরভাবে পরপর তিনবার শ্বাস নিল ও। 'ঠিক আছ?
'টিকে আছি।'
'নড়াচড়া করতে পারবে?'
এমনকি ঘাড়ে মোটা ব্যান্ডেজ সত্ত্বেও এনভিজির ওপাশ থেকে বোরোযানের অবিচল, পরিষ্কার চোখজোড়া ওর দিকে তাকিয়ে আছে। 'তোমার পায়ে গুলি লেগেছে বললে না?'
'না।'
অস্ত্র তুলে নিল ও। 'তাহলে চলো, কাজটা শেষ সেরে ফেলি...আর একটা ব্যাপারে শোকর করি।'
'কি সেটা?'
'ক্ষতচিহ্ন থাকলেও বিকিনি পরতে পারব।'
তারিকের বুক থেকে চাপ যেন কিছুটা কমে এলো।
আনুমানিক আধঘণ্টাটাক স্প্রুস ঝোপের ভেতর দিয়ে এগোনোর পর ঢালের উল্টোদিকে হাজির হতে পারল ওরা। এনিভিজি লাগানো চোখে নিচের দিকে নজর রাখছে ও, টার্গেট যাচাই করছে। লুকোনোর একটা চমৎকার জায়গায়সহ - উপড়ে পড়া গাছের গুড়ি, ঝোপঝাড় আর বোল্ডার - একটা সংকীর্ণ ইট বিছানো রাস্তার সাথে মিশেছে ঢালটা।
সামনেই একটা গেট, পাহারা রয়েছে ওখানে। ইট বিছানো একটা রাস্তা উপর দিকে উঠে বৃত্তাকারে ঘুরে একটা ম্যানশনের দিকে চলে গেছে। লঙ আইল্যান্ডের গোল্ড কোস্টে মোটেই বেমানান লাগবে না বাড়িটাকে। তিনতলা সমান উঁচু, অসংখ্য বে-উইন্ডো, খিলান আর সূচাল ছাদ। রাস্তা বরাবর কোমর সমান ঊঁচু একটা রট-আয়রনের গেট রয়েছে, কাটাতারের কু-লী দিয়ে সাজানো ওটার চূড়া। কি চমৎকার, ভাবল তারিক।
ম্যানশনের বামে দুটো রোল-আপ দরজাঅলা একটা ধাতব অয়্যারহাউস, এখন দরজাগুলো খোলা। পিকআপ ট্রাক, মিলিটারি ট্রাক রাখা হয়ছে ওখানে। এমনকি এত দূরত্ব থেকেও অস্ত্রে ভর্তি ধাতব ও কালচে ক্রেটগুলো আলাদা করতে পারছে ওÑঅটোমেটিক রাইফেল, আরপিজি এবং ভারী অ্যান্টিট্যাঙ্ক উইপন। অয়্যারহাউস ঘিরে চারপাশে চক্কর দিচ্ছে তিনজন সশস্ত্র লোক, মাঝেমাঝে কফি কিংবা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।
বাড়ি এবং অয়্যারহাউসের মাঝামাঝি কাদাভরা একটা জায়গা, সম্ভবত লন ছিল। ম্যানশনে সবকিছু সুনসান ঠেকছে। কিন্তু খুটির মাথায় জ্বলন্ত হাইপাওয়ার্ড লাইট পুরো এলাকা আলোকিত করে তুলেছে।
বাড়ি আর অয়্যারহাউসের পেছনে নিবিড় জঙ্গল।
বিনোকিউলার নামাল ও।
ওর ডান পায়ে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। দুই পায়েরই নিচের অংশ ব্যথা করছে, কয়েক ডজন কাঠের কুচি গেঁথে যাওয়া জায়গায় চুলকাচ্ছে।
ওদের আদি প্ল্যানে তিন এবং দুই জনের দলে ভাগ হয়ে এগোনোর কথা ছিল: ক্লেটন আর শেরের দায়িত্ব ছিল বাতি বিকল আর ব্যাকআপ জেনারেটর নষ্ট করে অয়্যারহাউসের পেছন থেকে একটা ডাইভারশনারি হামলা চালানো, প্রহরীরা যাতে অস্ত্রাগারই হুমকির মুখে পড়েছে ধরে নেয়।
সেই বিভ্রান্তির সুযোগে আলীয়া বোরোযান, খালিদ এবং তারিক ম্যানশনের পাশের গেট ভেঙে ঢুকে পড়তে পারত - কিচেনটা ওখানেই। সকালের এই সময় ওখানে কেউ থাকবে না বলেই ধরে নিয়েছিল ওরা। তারপর পেছনের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে দার্কোর শোবার ঘরের দিকে উঠে যেত।
ঢোকো, কাজ সারো, বেরিয়ে এসো। তারপর অয়্যারকাটার দিয়ে কাটাতারের বেড়া কেটে বনের ভেতর সটকে পড়।
আনুমানিক তিন কিলোমিটারের মতো দূরে আরেকটা শূন্য টিলার চূড়া ওদের এক্সিট পয়েন্ট হওয়ার কথা ছিল।
কঠিন, তবে সম্ভব।
এখন?
এখনই বোরোযানকে দেখার সময়।
ঢাল বেয়ে হামা দিয়ে নেমে এলো ও।
এইচকে ৪১৬টা কোলের উপর ফেলে একটা ওক গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে আলীয়া। ডান হাত দিয়ে শক্ত করে ঘাড়ের একটা পাশ চেপে ধওে রেখেছে।
ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ও। 'এই যে।'
আরো ভালো করে তাকাল ও। 'তোমার হাত ওখানে কেন, কি হয়েছে? আমি তো ঠিকমতোই ব্যান্ডেজ বেঁধেছি ভেবেছিলাম।'
'তা ঠিক, বস,' বলল ও। 'কিন্তু আমার শরীরের ইচ্ছা ভিন্নরকম।'
'বোরোযান...'
কোনোমতে দুর্বল হাসি দিল ও। 'যতটা ভেবেছি তারচেয়ে মারাত্মক চোট পেয়েছি আমি। আরো ক্লটিং পাউডার, একের পর এক কম্প্রেস লাগিয়েছি, কিন্তু সবকিছু চুইয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। আমার ব্যান্ডেজ ফুরিয়ে গেছে, বস।'
আর কথা নয়।
আরো সামনে গেল তারিক।
'আমার সাথে কথা বলো, বোরোযান। কি হচ্ছে?'
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। 'আমার ক্যারোটিড আর্টারি। ফুটো হয়ে গেছে বোধ হয়।'
'মানে?'
'মানে, আমার শরীরের রক্ত ফুরিয়ে যাচ্ছে, বস,' ফিসফিস করে বলল ও। 'কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যাচ্ছি আমি।'
১৮.
অস্ত্র নামিয়ে রাখল তারিক। 'কিছুতেই তেমন কিছু হবে না।'
'না হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না,' বলল আলীয়া।
অ্যাসল্ট প্যাকেট হাতড়াতে লাগল তারিক। 'নতুন করে কম্প্রেস লাগিয়ে দিচ্ছি। তারপর পাহাড় বেয়ে উঠে যাব...সারেন্ডার করব আমরা। তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেব।'
'তাই কি? এখানে আমার কিছুই বলার নেই?'
'দেখ...'
কেশে উঠল বোরোযান। 'উঁহু, তুমি শোনো। মিশনটা আমাদের শেষ করতেই হবে।'
'মিশনের গুষ্টি মারি।'
'এই প্যারামিলিটারিরা মেয়ে বন্দীদের নিয়ে করে জানো না? এমনকি যারা মরতে বসেছে, তাদের বেলায়ও? বিশেষ করে আমেরিকান হলে। হতে দেবে না, না?'
'কিন্তু...'
মুক্ত হাতে তারিকের হাত আঁকড়ে ধরল আলীয়া বোরোযান।
'হতচ্ছাড়া অপারেশনটা শেষ করো।'
'ধেত্তের, তোমাকে এখানে ফেলে যেতে পারব না আমি।'
ওর হাত ধরে চাপ দিল মেয়েটা। 'বস...তুমি জানো, আমি একা থাকব না। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওয়ালেবি স্ট্রাইকের বাকি সবাইকে ডেকে আনব। আমরা খেয়াল রাখব, তুমি যাতে সব ভণ্ডুল করতে না পার।'
তারিকের মুখে কথা সরছে না। মেয়েটার চোখের শান্ত দৃষ্টি, রক্তাক্ত হাত, আর তুষারে ঝরে পড়া রক্তের দিকে তাকিয়ে রইল।
গাঢ় দুষার।
'তুমি জানো, আমি এই অপারেশনে বেঈমানি করিনি।'
'ভুলেও তেমন কিছু ভাবিনি আমি।'
'মুখে হয়তো বলোনি, কিন্তু তোমার চিন্তাধারা আমি জানি। আমার একটা সার্বিয় পরিচয় আছে...নাহ, তেমন কিছু ঘটেনি। তবে...'
তারিকের এনভিজি ঝাপসা হয়ে আসতে চাইছে যেন, ওর দৃষ্টিশক্তি প্রখর নয়। 'নিশ্চয়ই ভজঘট হয়ে গেছে কোথাও, তাই না?'
'হ্যাঁ।'
আবার হাতে চাপ অনুভব করল তারিক। আগের মতো ততটা জোর নেই। 'কাজটা শেষ করো। কেমন? আমি পুরোপুরি শেষ করার কথাই বলছি। বুঝেছ?'
'হ্যাঁ।'
'ও...তারিক?'
অপারেশনে থাকার সময় কখনও পরস্পরকে নাম ধরে না ডাকা, বা কে কি করছে তার কোনো সূত্র না জানানো, চলার পথে এমনি আধাডজনের মতো নিয়ম ভাঙার ব্যাপারে একটা রফা ছিল ওদের ভেতর। সেটায় আঘাত হানা হয়েছে যেন।
'এটা...আমারও শেষ অপারেশন ছিল...,' ওর হাত থেকে বোরোযানের হাতটা পিছলে সরে গেল। 'ওই লেকের কাছে যখন যাবে তুমি...আমার কথা মনে রেখ, কেমন?'
ওর শীতল, শুষ্ক ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেল তারিক।
'তোমার কথা সবসময় মনে থাকবে, আলীয়া, সবসময়।'
'যাও এখন...কাজটা শেষ করো...'
এনভিজির নিচে হাত গলিয়ে চোখ মুছল তারিক। গিয়ার হাতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যতদূর সম্ভব দ্রুত এগোতে শুরু করল।
১৯.
ফের ঢালের চূড়ায় উঠে এলো ও। আলীয়াকে আপাতত একটা বাক্সে রেখে মনের জনাকীর্ণ তাকে তুলে রেখেছে। এখন সম্পূর্ণ মনোযোগ কেবল সামনে কি অপেক্ষা করে আছে সেদিকে, যদিও ব্যাপারটা বিলকুল ওর মনোপূতঃ হচ্ছে না।
এই অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল পাঁচ সদস্যের জন্যে।
এখন শ্রেফ ও বাকি আছে।
এবং নিজেও আহত হয়েছে ও, রক্তক্ষরণ হচ্ছে ক্ষতস্থান থেকে। অসহনীয় যন্ত্রণা সইতে হচ্ছে।
কিন্তু এখন আর ঠাণ্ডা লাগছে না। ভেজা অনুভূতি বিদায় নিয়েছে। ক্লান্তও নয়।
আবার এনভিজি চোখে লাগাল ও। কিছুই বদলায়নি, কেবল বিশাল অয়্যারহাউসের সামনের তিন প্রহরী এখন দুজনে পরিণত হয়েছে।
বেশ ভালো।
এখনও বাতি জ্বলছে। ভোর হতে আর মাত্র আধঘণ্টা বাকি।
চিন্তাভাবনা, দুঃখ বা পরিকল্পনা করার অবকাশ নেই এখন।
সময় হয়েছে কাজে নামার।
ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল ও। এগিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্যবস্তুর দিকে, ওর লক্ষ্যবস্তু।
ওদিকে কোথাও বিনোকিউলার আর নাইট ভিশন গ্লাস হাতে প্রহরীদের গা-ঢাকা দিয়ে থাকার আশঙ্কা থাকায় অত্যন্ত ধীরেসুস্থে এগোচ্ছে ও। হামাগুড়ি দিয়ে বোল্ডার কিংবা উপড়ানো গাছের কান্ডের আড়াল নিয়ে বরফ এবং পিচ্ছিল বরফগলা জলের উপর দিয়ে আগে বাড়ছে। বাড়িটার যত কাছাকাছি হচ্ছে, ততই মনোযোগ তীক্ষè হয়ে উঠছে ওর। চৌহদ্দী থেকে ভেসে আসা সিগারেটের কটু গন্ধ নাকে আসছে। প্রহরীদের কথাবার্তার আওয়াজ। ওদের কথা না বুঝলেও জোরে জোরে কথা বলায় মনে হচ্ছে ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা।
ক্রমেই এগিয়ে চলল ও।
সমবেত এঞ্জিনের গর্জন শোনা যাচ্ছেÑদুটো মার্সিডিস, একটা কমান্ড কার, আর তিনটা বিওভি এম-৮৬ আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়রের একটা কনভয় কম্পাউন্ডের পাশ দিয়ে সবেগে চলে গেল। এই সুযোগে আরও খানিকটা আগে বেড়ে মাথা গুঁজে পড়ে রইল ও।
কাছাকাছি।
কিন্তু এবার কি?
এদিক-ওদিক নজর চালাল ও। সিগারেটের গন্ধের সাথে মিশে গেছে ডিজেলের গন্ধ।
ওর ভেতর থেকে সেই বেসুরো কণ্ঠটা কথা বলে উঠল: ঠিকাছে, দোস্ত, এখন কি? রাস্তা ধরে আগে বেড়ে গার্ডদের বলবে দার্কো লিয়েসকে নিয়ে ঝটপট বাইরে নাশতা সারতে চাও, নাশতাটা আসলে তার কপালে দুটো টু-এমএম বসিয়ে দেয়া?
তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। তবে পরিকল্পনা তো।
এই মুহূর্তে হাতে অন্য কোনো পরিকল্পনা নেই।
আরও কাছে এগোলো ও। আরো একটা বরফ-ঢাকা বোল্ডার পেরুল। উঁচু রাস্তার এমাথা-ওমাথায় নজর বোলাল। এবং-
রসো।
ডান পাশে গোলাকৃতি একটা কিছু দেখা যাচ্ছে। গুড়ি মেরে আরও কাছাকাছি গেল ও।
একটা কালভার্ট। খোদা, রাস্তার নিচ নিয়ে কম্পাউন্ডের ওপাশে গিয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। ওভারহেড সার্ভেইল্যান্স বা গ্রাউন্ড ইন্টেলিজেন্সের কোনো রিপোর্টেই এই জিনিসের উল্লেখ ছিল না। তবে তাতে ওর মনে কোনো খেদ হচ্ছে না।
আরও কাছে গেল ও।
কালভার্টের ওপাশ থেকে এটা টলটলে পানির ঝর্না বেরিয়ে এসেছে।
আরও কাছে।
ধেৎ, শালা।
একটা ধাতব গ্রিল গোটা আউটলেটটা ঢেকে রেখেছে। শুকনো ডালপালা, ঝোপঝাড় আর নানান আবর্জনা ওটার নিচের এক তৃতীয়াংশ ঢেকে ফেলেছে। বেরিয়ে আসা জল গ্রিলে জট বেঁধে গেছে।
হেডলাইটের চকিত আলো ফেলে চলে গেল আরেকটা ট্রাক।
আলো দেখা দিচ্ছে।
ভোরের আলো।
দার্কো হয়তো খুব ভোরে জেগে ওঠার পাত্র নয়। কিন্তু এখনই আগে না বাড়লে আড়ালটুকু পুরোপুরি হারাতে হবে ওকে।
চোখের আন্দাজে কালভার্টের প্রস্থ বোঝার চেষ্টা করল ও। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এইচকে৪১৬ রেখে যাবে, কারণ কালভার্টের ভেতর দিয়ে এগোনোর সময় ওটা বাধা হয়ে দাঁড়ানোর সবরকম আশঙ্কাই আছে।
অবশ্য নিজে ওটা ভেতর দিয়ে যেতে পারে।
কাদ-পানি ভেঙে ধাতব গ্রিলের কাছে চলে এলো ও।
স্রেফ পরখ করার জন্যে টান দিল ওটায়।
লাভ হলো না।
ঠিক আছে। পাঁচটা মূল্যবান সেকেন্ড নষ্ট হলো।
অ্যাসল্ট প্যাকের কাছাকাছি থাকা একটা পকেট থেকে কাস্টমাইজড ডিটোনেশন রোল- ডেটকর্ড নামেও পরিচিত- বের করে গ্রিলের উপর ও নিচের সংকীর্ণ অংশের সাথে জুড়ে দিল। শেষমাথাটা ছিঁড়ে নিয়ে পুল ফিউজ লাগাল। এবার ওটায় টান মেরেই পিছন ফিরল।
বুম, বুম, বুম, বুম।
এমনিতে ডেটকর্ড প্রচ- আওয়াজ আর তীব্র আলোর ঝলক তৈরি করে।
কিন্তু এটা সাধারণ ডেটকর্ড নয়।
ধীরে আবার আগে বেড়ে গ্রিলের একটা প্রান্ত ধরে টানল ও।
ক্যাচক্যাচ, অশুভ এক ধরনের জোরালো শব্দ উঠল; যেন স্বর্গের সমন্ত দরজার ডব্লুডি-৪০ লুবিকেন্টের বড় ধরনের একটা ডোজের দরকার দেখা দিয়েছে।
জমে গেল ও।
তারচেয়ে খারাপ ব্যাপার, মাথার উপর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
স্তা জে ওভো?
সার্বিয়ান জানে না ও। তবে কথায় প্রশ্নের সুর ঠিক ধরতে পারছে। উপর থেকে কেউ এখানে কি হচ্ছে জানতে চাইছে। ক্যাচকোচ শব্দটা রাস্তার উল্টোপাশ পর্যন্ত পৌছে গেছে কিনা কে জানে!
অপেক্ষা করল ও। ছুরি বেরিয়ে এসেছে ওর হাতে। সিগ সওয়ার নাইন এমএম পিস্তলটা বের করে ডানেবামে এলোপাতাড়ি গুলি করার জো নেই এখন। অনেক বেশি কাছে রয়েছে ও।
অপেক্ষা।
উপরের রাস্তা থেকে কিছু ঝরতে শুরু করল। ওর অবস্থানের কাছেই বৃষ্টির মতো ঝরছে। জোরালো অ্যামোনিয়ার গন্ধ পাচ্ছে ও। ওর সারা শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে তরল পদার্থটুকু।
আরেকটা কণ্ঠস্বর কথা বলে উঠল।
আহ, নিস্তা।
আবার, কথাগুলো না বুঝলেও বাতিল করার সুরটা ধরতে পেরেছে।
আর কোনো গলার আওয়াজ নেই।
তবু অপেক্ষা করল ও।
আরেকটা গাড়ি এগিয়ে আসছে মনে হচ্ছে। মাথার উপর এঞ্জিনের শব্দের আড়ালে জালি ধরে টান মেরে খুলে হামা দিয়ে কালভার্টের নিচে ঢুকে পড়ল ও।
পৌঁছে গেছে।
- (চলবে)