মৃত্যুর মিছিল
২০
সহসা যেন ভাগ্যদেবী প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছে ওর দিকে। অপর প্রান্তে কোনো জাল নেই। কেবল পাথর আর আগাছা জমে আছে। কাদা আর বরফ শীতল পানি ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে এসে চারপাশে চোখ বোলাল ও। অয়্যারহাউস আর ম্যানশনের উল্টোপাশে এসে পড়েছে ও। ওর আনুমানিক শখানেক মিটার পেছনে রয়েছে গভীর জঙ্গলটা। একটা শেকলে জড়ানো বেড়া রয়েছে ওখানে, ওটার মাথায় ক্ষুরধার তার প্যাঁচানো, দশ গজ অন্তর স্পটলাইট দেখা যাচ্ছে।
কাদা, ডালপালা আর রাজ্যের হাজারো আবর্জনায় ঢেকে গেছে ওর শরীর। এতে সুবিধাই হয়েছে বরং। নালার শীতল জল পায়ের যন্ত্রণা কিঞ্চিত ভোঁতা করতে কাজ দিয়েছে।
ওর ডান হাতে নাইন এমএমটা রয়েছে। ফের চারপাশে নজর চালাল ও। অয়্যারহাউসটা এখনও ম্লানালোকিত। কিন্তু দার্কোর দালানের দৃশ্যটা পছন্দ হলো না ওর। গুড়ি মেরে কালভার্টে ঢোকার সময়ের চেয়ে আরো বেশি বাতি জ্বলছে এখন। পশ্চিমে, দূরে গোলাবর্ষণের গুমগুম শব্দ শোনা যাচ্ছে।
পৌছে গেছে প্রায়, কিন্তু এক সেকেন্ড।
এক সেকেন্ড দাঁড়াও।
শেষ করার জন্যে শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো, শেষ মুহূর্তের অদলবদল, পরিবর্তন উপেক্ষা করায় বহু অপারেশন কেঁচে গেছে।
এতো ভোরে নয়।
ম্যানশনের মাথার উপর একটা আলো দেখা দিল।
ঠিকাছে তাহলে।
অপারেশনের আগে পরিকল্পনা, পুনপরিকল্পনা এবং ট্রেনিংয়ের কথা ভাবল ও।
সব জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলা হয়েছে।
কেবল ও...বেশ, শুধু ও।
সমন্বিত কোনো হামলা নয়, আলো নিভিয়ে দেয়া নয়, অয়্যারহাউসে ডাইভারশনারি আক্রমণ নয়, ম্যানশনে তিনজনের সম্মিলিত প্রবল হামলা নয়।
কেবল ও।
কিচেনের একটা সাইড এন্ট্রান্স রয়েছে। আক্রমণের ওটাই মূল। ওটা গলে সোজা ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাও, দার্কোর শোবার ঘরে হামলে পড়ো।
বেশ, কেন নয়?
ঘাস আর বরফগলা কাদা ভেঙে ধীর পায়ে এগোল ও। রাস্তা দিয়ে একটা টয়োটা পিকআপ ট্রাক চলে গেল। গতি বাড়াল না ও। ওটার পেছনে জটলা বাঁধা সশস্ত্র লোকগুলো গান গাইছে, যেন সর্দারের প্রতি সম্মান জানাচ্ছে ওরা।
অয়্যারহাউসের সামনের দুই প্রহরী বেরিয়ে এসে টয়োটার উদ্দেশে হাত নাড়াল। জোরে হর্ন বাজিয়ে চলে গেল ড্রাইভার।
বাড়ির ভেতর আরেকটা বাতি জ্বলে উঠল।
ওটা কিচেন।
নিকুচি করেছে।
ক্যামো গিয়ারে সজ্জিত দুই তিনজন লোক রয়েছে ওখানে। মনে হচ্ছে ওরা...
নাশতা সারছে।
বাহ, কি ঘরোয়া পরিবেশ।
হাসছে ব্যাটারা, বিশাল কিচেনে ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলাফেরা করছে।
খানিকটা পিছু হটল ও।
ঘড়ি দেখল তারিক।
ভোর এবং উদীয়মান সূর্য ওর জন্যে অপেক্ষা করবে না।
অপারেশনটা শেষ করো, ওর স্মৃতি থেকে চ্যালেঞ্জের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। 'অপারেশনটা শেষ করো।
অয়্যারহাউসের সামনের দুই প্রহরী, যারা বেরিয়ে এসে টয়োটার উদ্দেশে হাত নেড়েছিল, এখন ওর দিকে এগিয়ে আসছে। খোশগল্প করছে, সিগারেট ফুঁকছে।
জায়গায় জমে গেল ও।
ওই দুই প্রহরীর দৃষ্টিসীমায় কোনো নড়াচড়া ধরা পড়লেই সতর্ক হয়ে যাবে ওরা। ব্যস, এই কাদামাটিতে হুমড়ি খেয়ে মরে থাকতে হবে ওকে। অপারেশন ওয়ালেবির ইতিহাস কখনো জানাজানি হবে না, কেবল অত্যন্ত গোপনীয় একটা মেমো কোথাও বার্ন ব্যাগে রেখে দেয়া হবে। কোনোদিন চোখে দেখা যাবে না।
হাঁটতে হাঁটতে কিচেনের দরজার কাছে এসে পড়ল দুই প্রহরী। ওদের একজন চেঁচিয়ে উঠতেই দরজা খুলে গেল। উঠোনে আলো এসে পড়ল। লোকটা নাশতার ফরমাশ দিচ্ছে নিশ্চয়ই।
দরজার আলোটা তারিকের থেকে এক মিটারের মতো দূরত্বে মিস করল ওকে।
হায় খোদা!
কিচেন থেকে বাইরের গার্ডের উদ্দেশে চিৎকার ছাড়ল কেউ একজন। এবার অন্য কেউও চোঁচাল। 'অ্যাই, উমুকনি, হোচেস দা সে প্রবুদিস দার্কো?'
ফের, ভাষা না জানলেও মানেটা ঠিক ধরতে পারল ও। 'বসের ঘুম ভাঙিয়ো না, বেকুফ কোথাকার।'
নিচু কণ্ঠে হাসির আওয়াজ উঠল।
কিচেন থেকে সরে গেল দুই প্রহরী। বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। সোজা ওর দিকে এগিয়ে আসছে লোকগুলো ।
এই অপারেশনটা শেষ করো, ফিসফিস কণ্ঠটা বলে উঠল।
তাই করবে ও।
২১
শেষ কাজটা সারার সময় সীমানার দুই নিরাপত্তা প্রহরীকে নিমেষে কার্যকরভাবে অকেজো করতে পেরে নিজেই অবাক মানল ও। খুব সম্ভব সারারাত ডিউটিতে থাকায় ক্লান্ত হয়ে একঘেয়েমিতে ভুগছিল ওরা। দলীয়ভাবে কাজ করে অভ্যস্ত নয় ওরা, বোঝা যায়, কারণ প্রথম জনকে ফেলে দেয়ার পর তাজ্জব বনে গেছে দুনম্বরটা, দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে পার্টনারের সাহায্যে ঝটপট এগিয়ে আসেনি।
কিছু এসে যায় না।
এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে মুখে ডাক্টটেপ ঠেসে, যিপ-টাইয়ে কব্জি আর গোড়ালি বেঁধে কাত করে শুইয়ে দেয়া হলো ওদের। ওদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলল ও। দুটোই বেঁচে আছে, দম ফেলছে নিশ্চিত হতে আরও কয়েকটা সেকেন্ড খরচ করল, তারপর নাইন এমএম হাতে পা বাড়াল দালানের দিকে।
তবে কিচেনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল না।
ভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে ওর মাথায়। চলার উপরই মাথায় এসেছে। অনেক সময় দারুণ কাজ দেয় এসব।
বিরাট বাড়িটার গ্রানিট পাথর বসানো বিরাট আকারের জানালা রয়েছে। কোনো ধরনের অ্যালার্মের ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে কিনা দেখতে পেছনের একটা জানালা পরখ
করল ও। বেশ মামুলি একটার খোঁজ মিলল। খোলা জানালা সার্কিট ব্রেক করলেই বেজে উঠবে ওটা।
সার্কিট পাশ কাটিয়ে একটা কাঠির সাহায্যে জানালাটা খুলে ফেলল ও। একটা সেলারে পা রাখল। পায়ের যন্ত্রণায় চোখমুখ কুচকে গেছে।
সেলারটা অন্ধকার, তবে বেশ গোছানো। সিঁড়ির দেখা পেয়ে ধীর পায়ে নিপুণ ভঙ্গিমায় দোতলায় উঠে এলো ও। দরজা খুলল।
ক্যাঁককোচ করে উঠল না পাল্লা। কোনো শব্দ নেই। কিচ্ছু না।
দেয়ালের সাথে শরীর মিশিয়ে দিয়ে এনভিজির আলোয় পিছলে একটা বড়সড় আরামদায়ক লিভিং রুম পাশ কাটাল। চামড়ায় বাঁধানো বইয়ে ঠাসা আলমারি চোখে পড়ল ওখানে। বিরাট বিরাট কাউচ রয়েছে ওই কামরায়। আরামদায়ক ভারী চেয়ার। কামরাটা নির্ঘাৎ ওর বাড়ির সমান হবে।
ওই যে। সামনেই রেলিংসহ চওড়া একটা সিঁড়ি।
রেইলিং থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সিঁড়ির মাঝবরাবর উঠতে শুরু করল ও। ক্ষীণ শব্দেও দোতালায় যেকেউ গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারে। তাই দেয়ালের দিকেই রইল।
দোতলায় উঠে এসেছে ও।
মনোযোগ ধরে রাখতে হবে, নিজেকে বলল ও।
এ বাড়ির উপরতলার লে-আউট ওর জানা আছে। বিরাট শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ানোর সময় মোটেও অবাক হলো না। চট করে একবার ঘড়ি দেখল। এখনও যথেষ্ট সময় আছে হাতে, তবে খুব বেশি না।
বেডরুমের দরজায় এসে গেছে ও।
বন্ধ।
লুব্রিকেন্টের ছোট একটা কন্টেইনার বের করে তিনটা কব্জার উপর স্প্রে করল ও। শব্দ করা যাবে না। এই তো বেশ।
লুব্রিকেন্টের ক্যানিস্টার তুলে রাখল ও। এখনও ঠাণ্ডা লাগছে, সারা শরীর ভেজা। যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে।
দরজার নব ঘুরিয়ে পাল্লা খুলে ফেলল ও।
কামরার ভেতরটা দেখা গেল এবার।
ঠিক মাঝখানে বিশাল চারপায়াঅলা একটা খাট। দুটো বিরাট জানালা একই রকম বিশাল পেছনের উঠোনের দিকে খুলেছে।
কার্পেট মোড়া মেঝের উপর দিয়ে সামনে বাড়ল ও।
বিছানায় ঘুমাচ্ছে এক লোক।
একা।
খাটের বাম দিকে গুটিশুটি মেরে পড়ে আছে সে। পাশ ঘুরে সামনে বাড়ল ও। এখন নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাসে লোকটার বুকের ওঠানামা দেখতে পেল। গভীর ঘুমে নিমগ্ন। সম্ভবত সুখস্বপ্ন দেখছে, নিষ্পাপ মানুষের ঘুম।
কিংবা কোনো নিরীহ সাইকোপ্যাথ, মনে যা চায় তাই করতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ বা আফসোসের বালাই নেই তার।
এখন লোকটার এত কাছে এসে পড়েছে যে, তার শরীর থেকে আসা কোলনের গন্ধ নাকে লাগছে। অগুনতি ছবি দেখার পর ঠিক যেমন আশা করেছিল, চেহারাটা ঠিক তেমনই।
সিগ সওয়ারটা লোকটার একেবারে নাকের কাছে নিয়ে গেল ও।
এই অপারেশনটা শেষ করো। পুরোপুরি।
পটাপট দুই বার ট্রিগারে টান দিয়ে শান্ত কপালে দুটো বুলেট সেঁধিয়ে দিলেই ওর কাজ শেষ হয়ে যায়।
তর্জনীর উপর চাপ বাড়াল ও।
এত কাছে।
কিন্তু চাপ শিথিল করে ফেলল ও।
এখনই নয়।
পিস্তলটা তার ঠোঁটের উপর নামিয়ে এনে মাযল চেপে ধরল এবার।
ধড়মড় করে জেগে উঠল লোকটা, চোখজোড়া বিস্ফারিত। হাত মাথার উপর তুলে ফেলেছে। মাযলটা মুখের আরো ভেতরে ঠেলে দিল ও। দম বন্ধ হয়ে আসায় কেশে উঠল লোকটা।
কথা বলে উঠল তারিক, 'হেলো, হেনরি শাটনার, ডাইরেক্টরেট অপারেশনসের ডেপুটি ডিরেক্টর, সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। তোমার সাথে শেষমেশ দেখা হওয়ায় ভালো লাগছে।'
২২
ওকে হেলান দিয়ে বসাল তারিক। একটুও ঝামেলা করল না সে, চেঁচাল না। নিজের নির্দোষিতার পক্ষে সাফাইও গাইতে গেল না। হালকা নীল পাজামা টপ পরেছে সে, ধূসর চুল এখনও নিপাট। শাটনারের মুখের ভেতর থেকে বন্দুকটা কিঞ্চিত বের করে আনলেও তার মুখ বরাবর তাক করে রাখল। এবার বাম হাতে এনভিজি খুলে ল্যাম্পসাইড বাতিটা জ্বালল ও। ওটার পাশে নাইট স্ট্যান্ডে রাজ্যের বই আর ফোল্ডার ঠাসাঠাসি করে রাখা।
চোখ পিটপিট করল শাটনার, রগড়াল।
'আমার সিকিউরিটি ফোর্সের কি হলো?'
'জিরোচ্ছে আরকি।'
ফের চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকাল সে। 'হাত দুটো যেভাবে আছে ওভাবেই রাখ,' বলল তারিক।
'ঠিক আছে,' বলল সে। 'চশমাটা পরতে পারব তো?'
নাইট স্ট্যান্ড থেকে চশমা নিয়ে শাটনারকে দিল ও। ওটা চোখে লাগিয়ে বিস্ময় মেশানে কণ্ঠে বলল, 'তুমি...তুমি তারিক।'
'ভালোই মনে আছে দেখছি।'
'তুমি এখানে কি করছ?'
'"ছেড়া সুতো জোড়া লাগানো"র কথা শোনোনি? স্রেফ এরকম একটা কিছু বলতে পার একে। আজ রাতে তোমাকে খুব শক্ত করে বেঁধে রাখছি আমি।'
'কিন্তু...কেন?'
'কি? তোমার কি ধারণা দার্কোকে শেষ করাতেই আমার অপারেশন শেষ হয়ে গেছে? উঁহু। সেটা ছিল স্রেফ এক নম্বর পর্যায়। এটা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্যায়। একাই কাজটা করতে এসেছি আমি।'
'তুমি...' আমতা আমতা করছে সে। 'কিন্তু তুমি এখানে কেন?'
একথায় চিড়ে ভিজল না।
ভ্যানিটির সাথে ঠেস দেয়া একটা চেয়ার দেখতে পেল তারিক। লোকটার স্ত্রী আর ছেলে এখন ওরিগনে আত্মীয়- বাড়ি বেড়াতে গেছে। এখন এখানে কেবল ওরা দুজন। পিছিয়ে এসে চেয়ারটা টেনে খাটের কাছে নিয়ে এলো ও। বসে অ্যাসল্ট প্যাকটা খুলে রাখল।
'তুমি ঠিকমতো খেলছ না,' বলল ও। 'অবশ্যই চলতি ফ্যাশনের সাথে তাল মেলাতে পারনি। অস্ত্র কিন্তু আমার কাছে। প্রশ্ন করার কথা আমার।'
'তুমি...দার্কো লিয়েসকে আস্তে করে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তোমার,' কোনোমতে তোতলাতে তোতলাতে বলল সে। 'নীরবে!'
'লোকটা তো মারা গেছে, তাই না?'
'মারা গেছে? হ্যাঁ, মারা গেছে। তার আরো আধডজন লোককে নিয়ে, তার ম্যানশনের উপরের অংশসহ। হতচ্ছাড়া সিএনএন সারা দুনিয়ায় জানিয়ে দিয়েছে সেটা। কি জিনিস কাজে লাগিয়েছ তুমি? অ্যান্টিট্যাঙ্ক উইপন?'
'প্রায় ঠিক ধরেছ,' বলল তারিক। 'টিবিজ-৭ভি থার্মোব্যাক অয়্যারহেডঅলা রাশিয়ান মেইড আরপিজি-৭ ব্যবহার করেছি। শহুরে লড়াইতে এই জিনিস কাজে লাগানো হয়। ওখানে থাকা উচিত ছিল তোমার। সবাই দুদ্দার করে বেরিয়ে আসার সময় দারুণ লাগছিল।'
'ওই জিনিস ব্যবহার করতে গেলে কেন?'
'হাতের কাছে ছিল, ব্যস।'
'নিরিবিলি সারার কথা ছিল কাজটা!' ফের বলল শাটনার। লোকটার হাবভাব দেখে এই আক্কেল নিয়ে ব্যাটা সরকারের এত উপরের মহলে উঠল কিভাবে, সেই প্রশ্ন জাগল তারিকের মনে। 'তুমি যা করেছ...বলতে গেলে দরজা খোলার জন্যে কামান দাগার মতো!'
'কিন্তু দরজা তো খুলেছে, তাই না,' পরিহাসের সুরে বলল তারিক।
'কাজটা শেষ হয়েছে। তোমার...তোমার এখানে আসা ঠিক হয়নি। কেন এসেছ?'
'আমার মিশন শেষ করতে। অপারেশন ওয়ালেবির অবসান ঘটাতে,' বলল ও। 'কোনো অপারেশনই শ্রেফ ফিল্ডে শেষ হয়ে যায় না। বেশ নিরাপদ দূরত্বে শেষ হয়, যখন জেরা, পর্যালোচনা, কি শিক্ষা মিলল আর কি কি ভুল হয়েছে তার একটা ফর্দ বানানো হয়।'
ফের চোখ রগড়াল শাটনার।
'আভিয়ানোয় ডাল্টন বলেছিল তোমার জন্যে কাজ করছে সে, ঠিক?' জানতে চাইল ও।
'হ্যাঁ।'
'তার মানে পরিকল্পনা, অপারেশনাল অর্ডার আর সমস্ত তথ্যের মাধ্যম ছিল সে-ই।'
'ওটাই ওর কাজ।'
'বেশ কাজটা সে ভালোভাবেই করেছে,' বলল ও। 'একেবারে গোড়া থেকেই যেন আমরা বেঈমানির শিকার হই, সেটা নিশ্চিত করেছে।'
ধীরে ধীরে চোখের পাতা নাচাল শাটনার।
একটা কথাও বলল না।
খেই ধরল তারিক। 'তোমার তরফে দুর্দান্ত অপারেশন, ডেপুটি ডিরেক্টর,' বলল ও। 'আমার দলের চারজন সদস্য আর আমার সাথে বেঈমানি করা হয়েছে। কিসের জন্যে?
ডাল্টন নিশ্চিত ছিল না, তবে আমার আন্দাজ আরো বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক ইস্যু ছিল এটা। আমাদের একটা স্টিলথ হেলিকপ্টারে স্যাবটাজ করা হয়। ক্লেটনের প্যারাশ্যূট বিকল ছিল। ওদিককার প্যারামিলিটারি বাহিনী আমাদের যাওয়ার কথা জানত। কেন?'
'সেটা তোমার মতো পদের লোকদের চেয়ে অনেক উপরের মামলা,' আস্থার সাথে বলল সে।
'তাতে সন্দেহ নেই,' বলল ও, 'তবু আমি জানতে চাই।'
'কেন?'
'হিসাব চুকোতে, সবকিছু ঠিক করতে।'
হাই তোলার ভান করল সে। 'বেশ, এটা বেড়ে বলেছ...এসো, তাহলে বরং এটা নিয়েই কিছু আালাপ করা যাক, ঠিকাছে? আমি এমনকি জোর করে আমার বাড়িতে ঢুকে কি করেছ সেসব ভুলে যাব...আমার পেরিমিটার সিকিউরিটির কি করেছ, তাও। আমাদের জন্যে একটু কফি বানাচ্ছি আমি।'
'আজকের দিনের সেরা অফার, তবে ফিরিয়ে না দিয়ে পারছি না, ডেপুটি ডিরেক্টর।' ঘড়ি দেখল তারিক। 'আমরা দুজনই ভালো করে জানি, পেরিমিটার গার্ডরা পনেরো মিনিট অন্তর যোগাযোগ না করলে তোমাকে উদ্ধার করতে দ্রুত একটা বাহিনী পাঠানো হবে। এখন পর্যন্ত আট মিনিট হয়েছে। ফলপ্রসূ আলোচনার জন্যে মিনিট সাতেক সময় আছে আমাদের হাতে।'
'আমার আগ্রহ নেই।'
দীর্ঘশ্বাস ফেলার ভাব করল তারিক। 'ডাল্টন বলেছিল, তুমি কঠিন চিজ।'
'শুনে খুশি হলাম।'
'অপারেশন শেষ হওয়ার পর আমাদের আরেকটা কাজও করতে বলেছিল ডান্টন। সেটা তোমার নির্দেশ নাকি তার নির্দেশ ছিল?'
'জানি না,' বলল শাটনার। 'ডাল্টন তোমাদের কিসের কথা বলেছিল?'
'একটা ডাণ্ডার মাথায় দার্কোর মাথা গেঁথে নিয়ে আসতে বলেছিল।'
অ্যাসল্ট প্যাকটা তুলে নিল ও। ওটার যিপ খুলতেই প্লাস্টিকে মোড়ানো একটা জিনিস বেরিয়ে এলো।
খিস্তি করে উঠল শাটনার। পলিশ করা কালো কাঠের হেডবোর্ডের সাথে ঠেস দিয়ে সোজা হয়ে বসল সে।
'দার্কোর হাড়মাংস পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তো অন্য সেরা কাজটাই করেছি আমি। তোমার চ্যালা ডান্টনকে ফিরিয়ে এনেছি।'
২৩
কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা যোগ করতেই যেন সিগ সওয়ারের হ্যামার টেনে পেছনে নিয়ে এলো ও। আরামদায়ক শোবার ঘরে বেশ জোরালো শোনাল শব্দটা। 'খোলাখুলি বাতচিত করি এসো, ডেপুটি ডিরেক্টর। আমি আমার বক্তব্য দিয়েছি। এবার তোমারটা শোনা যাক।'
আবার ঘড়ি দেখল ও। চট করে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল শাটনার, ওর কোলে পড়ে থাকা রক্তাক্ত জিনিসটার দিকে চোখ ফেরানোর সাহসে কুলোচ্ছে না। 'তোমার পদের চেয়ে অনেক উপরে...তোমার পদের চেয়ে অনেক উপরে...'
'বারবার একই কথা বলছ হে তুমি। আমার মন গলছে না। আসল কথা...'
'আলোচনা চলছে...অত্যন্ত স্পর্শকাতর আলোচনা।'
'এসব ব্যাপার বরাবরই স্পর্শকাতরই হয়, তাই না? আমাদের জানানো হয়েছিল, তার এলাকাকে শান্ত করার জন্যে দার্কোকে সরিয়ে দেয়াটা একটা ভালো কাজ হবে। একটা শন্তিপূর্ণ ফলাফলের দিকে ভারসাম্য হেলে পড়বে। হয়তো তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানো যাবে। এছাড়া আর কি ঘটছিল?'
'তোমার বেলায়?'
'বক্তিগতভাবে আমার, কিংবা আমার দল এবং আমার?'
'কিছু কি এসে যায়?'
'হয়তো যায় না,' বলল ও। 'বাজি ধরে বলতে পারি, ওদের কারো নামই তোমার মনে নেই। আছে?'
'এটা...বেশ, না। মনে নেই।'
উঠে ব্যাটল-প্যাকের পকেট থেকে একটা জিনিস বের করল তারিক।
চারটা নেমট্যাগ, কয়েক সপ্তাহ আগে নিজ হাতে ওগুলো ছিঁড়ে স্টিলথ হেলিকপ্টারের গায়ে ঝুলিয়ে রেখেছির ও।
লোকটার পাজামার কোলে একে একে ট্যাগগুলো ফেলতে লাগল ও।
ক্লেটন।
শের।
খালিদ।
এবং সবশেষে বোরোযান।
চোখ নামিয়ে একনজর ওগুলো দেখে আবার মুখ তুলে তাকাল সে।
'তুমি...এসব ব্যাপার কেমন, তুমি জানো। আমাকে কি সত্যি ব্যাখ্যা করতে হবে, তারিক?'
'না, তবে তোমার জবানে আসল কথা শুনতে চাই। আমি একটু এমনই।'
ঠোঁট মুছল শাটনার। 'আলোচনার কথাটা...রাশিয়ানরা বিভিন্ন সার্ব উপদলকে মদদ দিচ্ছিল। বিরোধের অবসান ঘটাতে ইচ্ছুক ছিল ওরা। কিন্তু চুক্তি সেরে ফেলার ব্যাপার আমরা যে কত সিরিয়াস সেটা দেখানোর দরকার ছিল।'
'ওরা আমাদের যাওয়ার কথা জানত।'
'হ্যাঁ।'
'দার্কোকে নিয়ে ওদের মাথাব্যথা ছিল না।'
'না।'
'রাশিয়ানরা ওদের পেছনের উঠোনে আমেরিকানদের আনাগোনা পছন্দ করেনি, ওদের প্রভাববলয় বলেই মনে করে ওটাকে।'
'একদম ঠিক,' বলল সে।
'রাশিয়ানরা চুক্তি শেষ করতে কূটনীতিকরা কতটা সিরিয়াস বোঝাতে সার্বদের কাছে আমাদের শ্রেফ এক ধরনের উপহার হিসাবে তুলে ধরাটাই গোণায় ধরেছে। আমাকে আর আমার দলের লোকদের কোরবানি দিয়ে আমাদের পক্ষও কত সিরিয়াস সেটাই রাশিয়ানদের দেখাতে চেয়েছে, ঠিক?'
'ব্যাপারটা তাই ছিল,' বলল শাটনার। নাইটস্ট্যান্ডের ছোট ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকাল সে। ব্যাটা সময় গুনছে, বুঝতে পারল তারিক। 'তুমি অভিজ্ঞ লোক। এসব তোমার জানা। সৈন্য আর পেশাদারদের অনেক সময় বৃহত্তর স্বার্থে বলী দেয়া হয়। কিছু মনে করো না, তুমি আর তোমার দলের লোকজন খুবই উঁচু দানের আর গুরুত্বপূর্ণ দাবা খেলার গুটি ছিলে।'
'নিজেকে আমার কিন্তু সবসময়ই মন্ত্রী মনে হয়েছে,' বলল তারিক। 'ওদের দুর্দান্ত টুপি আমার পছন্দ ছিল।'
দম নিল শাটনার। 'শিগগিরই কুইক রিঅ্যাকশন ফোর্ষ এসে পড়বে, তারিক। এখানে বন্দী হতে এসেছ বলে মনে হয় না। কি চাও তুমি?'
'আমি ব্যাপারটা রফা করতে চাই,' বলল ও।
'মানে কি?'
'আমার দলের সদস্যদের সবার পরিবারের সরকারী স্ট্যান্ডার্ড বীমার চেয়ে বেশি হারে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়া ওদের কাজের স্বীকৃতিসহ ওদের আত্মীয়রা চিঠি পাবে। ওদের কারো আঠার বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়ে থাকলে ওদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে হবে।'
শাটনারের ঠোঁট পজোড়া পরস্পর চেপে বসল। কথাগুলো সে সহজভাবে নিচ্ছে বলে মনে হলো না, তবু চালিয়ে গেল ও। 'ওহ, আরেকটা কথা, ক্ষমা প্রার্থনা করে একটা চিঠিও দিতে হবে, সেটা পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিখলেই বেশি ভালো হবে। খবরকাগজে যা দেখলাম, হালনাগাদ বালকান্স চুক্তিকে সফলতার চিহ্ন হিসাবে উল্লেখ করছে সে। এই চুক্তি সফল করতে গিয়ে যাদের জীবন দিতে হয়েছে তাদের কথা স্বীকার করে নিলেই ভালো।'
চট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাল শাটনার। 'সেটা হবার নয়।'
'হলেই ভালো।'
'সম্ভব না,' বলল সে। 'তোমার ইউনিট...এত গোপন ছিল...আমাদের দ্বারা কিছুতেই ওটার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা সম্ভব হবে না। বিলকুল না।'
'যাতে সম্ভব হয়, সে ব্যবস্থা নাও।'
'পারব না।'
'তাহলে আমার মনে হয়, এখানে আমাদের আর কিছু করার নেই। রাজি হওয়ার মতো কাউকে না মেলা পর্যন্ত উপরের দিকেই তাকাতে হবে আমাকে।'
'আহ...কি, আমারও ডান্টনের অবস্থা করার কথা ভাবছ নাকি?'
'হ্যাঁ।'
প্রবল বেগে মাথা নাড়ল শাটনার। 'কিন্তু তারপর? আমার উপরঅলার খোঁজে নামবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রী? যারা এই সিদ্ধান্ত নিযেছে তাদের সবাইকে?'
'সেটাও ভাবা যেতে পারে বৈকি।'
'জাহান্নামে যাও,' বলল শাটনার।
'তোমার পর,' বলেই ট্রিগার টেনে দিল ও।
মাত্র একবার।
বাড়াবাড়ি করার দরকার ছিল না।
২৪
এতগুলো বছর ধরে স্বপ্ন আর পরিকল্পনা শেষে লেক যেমন হবে বলে ভেবেছিল, ঠিক তেমন আবিষ্কার করেছে ও। ছোট্ট শহর নানসেনের কাছে নিউ হ্যাম্পশায়ারের গভীর একটা অংশে পড়েছে লেকটা। এদিকে খুব একটা ট্যুরিস্টের আনাগোনা নেই বলেই জানানো হয়েছিল ওকে। টলটলে, নীল লেকের পানি। প্রচুর টাটকা পানির মাছ আছে। গ্রীষ্মে বাসা বাঁধতে আসে অভিবাসী পাখি। লেক ঘিরে ১৩০০ একরের বেশি জমি থাকলেও লোকসংখ্যা নেহাত কম।
ডকের শেষমাথায় বসে রোদ পোহাচ্ছে ও। ভালোই লাগছে। ভার্জিনিয়া থেকে বেশ কয়েকমাস আগে ফিরেছে ও। শাটনারের চেয়ে ঠাণ্ডা মাথার লোকদের সাথে আলাপআলোচনা শেষে সবকিছুর ফয়সালা করার পক্ষে সময়টা যথেষ্ট। পুরু বাদামী একটা খাম পড়ে আছে ওর কোলে। এখনও পর্যন্ত নজর করে তাকায়নি ওটার দিকে। স্রেফ লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করছে, মনটাকে শিথিল করার চেষ্টা করছে।
চেষ্টা করছে।
পুরোনো চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে তাকাল ও। ওটাকেই নিজের ঘর বানাতে যাচ্ছে। আনুমানিক বছর পঞ্চাশেক পুরোনো হবে ওটা। লেক এবং পাহাড়ের দিকে খোলা একটা ঘেরাও করা বারান্দা আছে। নিরেট দালান, তবে কিছু কাজ করাতে হবে। হাজারো ঝোপঝাড়, আগাছা আর মরা পাতার ঢিবিতে ভরা উঠোনের বেলায়ও একই কথা। হাতে প্রচুর কাজ। তবে সেজন্যে খারাপ লাগছে না।
আসলে কজেই ডুবে থাকতে চায় ও।
লম্বা সময় ঘুরে সংক্ষিপ্ত দরাদরি আর হুমকিধামকি শেষে নানসেনে এসে লেক মেরির কিনারা বরাবর একটা বাড়ি কিনতে এসেছে ও। সদাসয় ফেডারেল সরকার সহায়তা যুগিয়েছে অবশ্য। বেশি সময় নষ্ট করেনি ও, কিংবা দরাদরি করতে যায়নি। চাহিদামতো জায়গা পেতেই একটা দাম বলেছে ও, বাজারমূল্যের চেয়ে এক হাজার ডলার কম ছিল সেটা। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যেই ওর হাতে এসে গেছে এটা।
সত্যি বলতে কস্মিনকালেও নিজের কোনো বাড়ি ছিল না ওর। এর আগে সবই ছিল অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল কিংবা অস্থায়ী অফিসার্স কোয়ার্টার। প্রথম কয়েকটা রাত এখানে ঘুমোতে পারেনি ও, বাইরে লেকের টলটলে নীল জলের বেশ দূর পর্যন্ত প্রলম্বিত দীর্ঘ ডকে এসে জরোসড়ো হয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পাতলা ফোমের ম্যাট্রেসে শুয়ে বিশ্রাম নিয়েছে। চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শীতযাত্রার জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকা বুনো হাঁসের চেঁচামেচি কান পেতে শুনেছে। হাঁসের ঝাঁক কেবল দক্ষিণে যায়, তা নয়; এদিককারগুলো আবার শীতল আটলান্টিকের দিকে পাড়ি জমায়, গোটা শীতকালে একবারের জন্যে জমিন স্পর্শ না করে স্রোত আর ঢেউয়ের সাথে ভেসে যায়।
ব্যাগের ভেতর গুটিশুটি মেরে শুয়ে নিজের কাজের সাথে সাদৃশ্যের কথা ভেবেছে ও। অনেক দিন ভেসে বেড়িয়েছে ও। এখন শুকনো জমিনে ফিরে আসার সময় হয়েছে।
কিন্তু রাতে শেষ অপারেশনের স্মৃতিগুলো ফিরে আসে, ওদের সবার নাম মনে পড়ে। ওরা কিসের ভেতর গিছে তার কথা। এবং সবসময় আলীয়ার কথা। সবসময় আলীয়া।
লেক মেরির ওপাশ থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো। গাঢ় নীল রংয়ের ফাইবার গ্লাসে তৈরি ক্যানুতে চেপে পাশ দিয়ে যাচ্ছে এক দম্পতি। হাত নাড়ল ওরা।
পাল্টা হাত নেড়ে সাড়া দিল ও।
ওকে স্বাগাত জানানো হচ্ছে, মনটা কিছুটা প্রসন্ন হলো ওর।
পুরু খামটা তুলে ঝাঁকি দিয়ে ভেতরের কাগজপত্র বের করল ও।
বেশ ভালো সংগ্রহ। ওর নামে বাড়ির মালিকানা। স্থানীয় সিটিজেন্স ব্যাংকে মোটা অঙ্কের জমা টাকার রশিদ। ওর বাকি জীবন মাস শেষে টাকা জমা হওয়ার হিসাব দেয়া কাগজও আছে।
ক্লেটন, শের, খালিদ এবং বোরোযানের পরিবারের নামে পাঠানো চিঠির অনুলিপি।
একদম নির্ভুল, পূর্ণাঙ্গ। গতকাল প্রত্যেকটা পরিবারকে ফোন করেছিল ও, ওরাও একই রকম প্যাকেজ হাতে পেয়েছে কিনা, নিশ্চিত হতে চেয়েছে ও; তো ওকে ভুয়া কোনো কাগজ গছিয়ে দিয়ে ফাঁকি দেয়া হয়নি, জানে।
উল্টেপাল্টে দেখার সময় দুটো পুরু চিঠি খসে পড়ল ওর কোলে। প্রথমটা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তরফ থেকে চমৎকার পূর্ণাঙ্গ ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠি। চিঠিটা আলোয় তুলে ধরে স্বাক্ষর পরখ করল ও। খাঁটি বলেই মনে হচ্ছে। অটোপেন নয়।
এক ধরনের সন্তোষ বোধ করল ও।
এবার দ্বিতীয় চিঠিটা নিয়ে দেখার সময় সন্তোষের ভাবটা আরও বাড়ল। কাগজের মাথায় সহজ দুটো বাক্য:
দ্য হোয়াইট হাউস
ওয়াশিংটন
ওই লেখাটার নিচে ক্ষমা মঞ্জুর নিয়ে শুরু হয়ে ওর নাম উল্লেখ করে সযত্নে মুসাবিদা করা পূর্ণাঙ্গ একটা অনুচ্ছেদ রয়েছে। আরেকটা স্বাক্ষর তাতে।
নিশ্চিতভাবেই অটোপেন নয়।
আরও একটা খাম রয়েছে। ওটার বুকে এক ডাক্তারের নাম লেখা, তবে এটা আজকের জন্যে নয়।
সব কাগজ আবার খামে ভরে রাখল ও।
এই অপারেশনটা শেষ করো।
'শেষ করেছি, আলীয়া,' ফিসফিস করে বলল ও।
খামের একেবারে নিচে এক টুকরো ভেলক্রো-ব্যাক্ড কাগজ। ওটাও বের করল তারিক। উঁচু হয়ে থাকা পুরোনো দাগ পড়া হরফের উপর হাত বোলালো: আহসান।
একটা নৌকা ভেসে যাচ্ছে। একদিনে আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার মতো শক্তিশালী এঞ্জিন থাকে এসব নৌকার। ঠিকমতো সামাল দেয়ার জন্যে গলুইয়ে একটা ছোট ইলেক্ট্রিক থ্যাস্টার।
মোটাসোটা দুজন জেলে কাজ করছে। মুখ ভর্তি দাড়ি ওদের, রোমশ, টাট্টুভরা বাহু। শর্টস আর ট্যাঙ্কটপস ওদের পরনে। নতুন বাড়ির বেশ কাছে এসে পড়েছে ওরা, ক্যানুর সেই দম্পতির কথা ভেবে দুজনের উদ্দেশ্যেই হাত নাড়ল ও।
গাঢ় সানগ্লাসের ওপাশ থেকে ওর দিকে তাকাল দুই জেলে। ওদের ক্যামো-স্টাইল বেসবল ক্যাপ খুলে গেল।
পাল্টা হাত নাড়েনি ওরা।
হঠাৎ একটা ভাবনা খেলে গেল ওর মাথায়। প্রায় বিষম খাওয়ার দশা হলো। এই কাগজপত্রের নিচে পুরোনো সিগ সওয়ারটা থাকলে ভালো হতো।
বলা তো যায় না।
ফের হাত নাড়ল ও।
পাল্টা সাড়া নেই।
লেকে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রথম দিন কাটানোর ভালো উপায়ই বলতে হবে।
মনটা শান্ত হবে ভেবে দীর্ঘশ্বাস টানল ও। কিন্তু লাভ হলো না।
মোটেও না।
ফের কাপড়ের টুকরোটার দিকে নজর ফেরাল ও।
আহসান।
- (চলবে)