লাতিন আমেরিকায় ভাইরাস
মে মাসের শেষে, এই পত্রিকারই এক রিপোর্টারের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম যে এই মহামারির একটি পরোক্ষ সমস্যা যা আমাদেরকে স্পর্শ করেছে তা হল এর রাজনৈতিক ফায়দার ভাগটা কম। মহামারি, তখনও বলেছিলাম, আজও আবার বলছি, এমন একটি পরিস্থিতি যাতে হারাতেই হয়, জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নে জয়ী হবে অর্থনীতির ঘাতক, এবং এরকম-সেরকম। অবশ্যই, এই পরিস্থিতি যে কোনো দেশের নেতাদের জন্যই হতাশার, এবং পক্ষাঘাতের দিকেও ঠেলে দিতে পারে সমস্যাটি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, কিংবা - বাকি ক্ষেত্রে, যা সংখ্যায় অধিক - স্বৈরাচার, মিথ্যাবাদিতা এবং অবহেলার দিকে। এরকমটাই ঘটেছে লাতিন আমেরিকায়।
মে মাসে আমি যখন ওই চকিত অভিমত দিচ্ছিলাম, মহামারির মনোযোগ তখনো আমার মহাদেশের দিকে ধাবিত হয়নি, যদিও উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছিল। অসৎ, অসাবধানী ও স্বেচ্ছাচারীরা নিজেদের কাজ ঠিকই চালিয়ে গেল।
মেহিকোতে, প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস মানুয়েল লোপেস ওব্রাদোর প্রতিদিন আমাদেরকে তার আবোলতাবোল কথাবার্তার দুঃখজনক প্রদর্শনী উপহার দিলেন, ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ও শিশুদেরকে গালে চুমো দিয়ে এই পরামর্শ দিলেন যে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সেরা প্রতিষেধক হল সততা আর ধর্মীয় চেতনার মিশ্রণ। ব্রাজিলের জইর বোলসোনারোকে দেখা গেছে সেনাদের প্যারেডে, ফৌজি পোশাক পরা বাচ্চাদেরকে উঁচুতে তুলে ধরে আছেন - বানোয়াট পিস্তল আর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট তাদের পরনে - আর অভিযোগ করছেন যে মহামারি মিডিয়ার তৈরি করা ফ্যান্টাসি ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এই অবস্থা কেটে যাবে, নারীর অন্তঃস্বত্ত্বা দশার মত। তার ছেলে, যে কিনা কংগ্রেসের সদস্য, জোর দিয়ে বলেছে যে এই সঙ্কট চীনা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়; এবং এক খ্রিষ্টীয় ধর্মপ্রচারক, যে ব্রাজিলিয়ো সরকারী দলের এক প্রভাবশালী নেতা, মাথার একটা চুলও না নেড়ে বলেছেন যে কোরোনাভাইরাস হল ভয় ছড়ানোর জন্য শয়তানের এক কারসাজি।
তাই কেউ হয়তো এই বিশ্বাসের দিকে ঝুঁকবেন যে, লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল দুইটি দেশে যা হচ্ছে তা বিবেচনায় নিয়ে, বিজ্ঞানের প্রতি যাদের দীর্ঘদিনের অনীহা এবং সস্তা কুসংস্কারের ব্যাপারে প্রবণতা, সেই জনস্বার্থ-রক্ষক এবং স্বৈরাচারীরাই সবচেয়ে সেরা গৃহকর্তা, ভাইরাসের জন্য। কিন্তু বাস্তবতা, যা আমাদের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারনার চাইতেও অনেক গোঁয়ারগোবিন্দ।
এতটা স্বচ্ছও নয়, একুয়াদোরে লোকজন রাস্তাঘাটে মারা গেছে, চিলে এবং পেরুতে, তাদের যথেষ্ট চেষ্টা সত্ত্বেও ইতালি এবং স্পেনের মত পরিসংখ্যানের তালিকায় সমপর্যায়ে চলে গেছে। কোলোম্বিয়ায়, যেখান থেকে আমি লিখছি, ওই একই পরিসংখ্যান এখনো মনে হচ্ছে সরকারের পক্ষে, যদিও যে কেউ অবস্থাটা বুঝতে পারছে: খারাপটা এখনো আসতে বাকি।
শুধু তাই নয়, এমন একটা সমাজের দিকে আমরা এগুচ্ছি, তিন মাসের অধিক বাধ্যতামূলক কোরেন্টিনের পর, বলাই যায়, সবাই হাঁপিয়ে উঠবে। মৌলিকভাবে অসমীচীন অর্থনীতির বন্ধের কারণে অনেকেই ইতোমধ্যে হতাশা ও দারিদ্রের মুখে পড়েছে, এবং আমাদের নেতাদের পরস্পরবিরোধী ও চপলমতি দিকনির্দেশনার কারণে, যারা পিতৃসুলভ খবরদারি ও খেয়ালমাফিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দোল খেয়েছে, নিশ্চয়তার চাইতে বরং বিশৃঙ্খলাই সৃষ্টি করেছে। সব শেষে, মহামারি মোকাবেলায় এতদিনকার পদক্ষেপ আমাদেরকে একটা অতলে নিয়ে যাচ্ছে, এবং ভবিষ্যৎকে আশঙ্কায় ফেলার বাগড়া দিচ্ছে, অবিশ্বাস।
তাদের প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যাপারে লাতিন আমেরিকান সমাজের আস্থা নেই, এবং এর পেছনে সঙ্গত কারণ আছে। গত তিন মাসে কোলোম্বিয়ায় আমরা যখন গৃহবন্দী, আমরা জানতে পেরেছি যে দুর্নীতিবাজরা মহামারির খাত থেকে ২০০ মিলিয়ন ইউরো হাতিয়ে নিয়েছে, প্রেসিডেন্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দোহাই দিয়ে ৯ লক্ষ ইউরো খরচ করেছে, এবং এই অর্থটা শান্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে নির্ধারিত তহবিলের। সরকারি দলের এক মহিলা সাংসদ মহামারিকে গালমন্দ করেছে, অনেকটা বোলসোনারোদের মত, এবং বলেছেন যে বহু লোক ইনফ্লুয়েন্জায় মারা যাবে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে যে আরও বেশি লোক মারা যাবে সে কথা কেউ বলছে না, এবং তার দল লা হাবানায় হওয়া শান্তি চুক্তিকে যে ভেস্তে দিল সে কথা কে বলবে! এই বিষয়ে ভাবতে গিয়ে আমার মনে পড়ল আমার দেশ, গত অর্ধ শতাব্দীর দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে, তার জিডিপি-র ৩.২% এর পেছনে খরচ করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও শান্তির আহ্বানকে উপেক্ষা করেছে অথচ ২০১৬ সালের গণভোটে তার সিদ্ধান্ত হয়েছিল; এটা অসম্ভব না যে সরকারি দল, এই প্রত্যাখ্যানের উপর ভর দিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছে, এখন নিজেদেরকেই জিজ্ঞাসা করছে অবস্থাটা কী দাঁড়াত যদি ওই শতকরা হিসাবটা আমাদের টলোমলো স্বাস্থ্যখাত কিংবা আমাদের সামাজিক কল্যাণের খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য ব্যয় করা হত। কিন্তু সেই প্রশ্নটা আরও বেশি সরলতা প্রত্যাশা করে যা আমার ভান্ডারে নেই।
একটা সমস্যার কথা আলাদা করে বলতেই হয় আর তা হল সরকারের প্রতি নাগরিকদের অনাস্থা, এবং নাগরিকদের প্রতি সরকার যে অনাস্থা বোধ করে তা। এখন, এই মহামারির সময়ে, বিষয়টি আরও নির্দিষ্ট রূপ ধারন করেছে। কোলোম্বিয়ায়, অন্য অনেক জায়গার মত, সত্তুরের বেশি বয়সী জনগণের জন্য সঙ্গনিরোধ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, এবং অন্য যে কারও মত আমিও এর পন্থার প্রয়োজনীয়তা বুঝি; কিন্তু আমি ভাবছি এর কী প্রয়োজনীয়তা ছিল যে, তাদের বয়সের কারণে ঝুঁকির বিষয়টি আমলে এনেও, সরকার তাদের জীবনের ব্যাপারে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে তাদেরকে যেনতেনভাবে বঞ্চিত করতে পারে - এমনকি আত্মীয়-পরিজনের পাশে থেকে মরতেও দেবে না। সরকারি সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যাতে ভেঙ্গে না পড়ে তার সুরক্ষা বিধানের চিন্তা এবং ইউরোপকে যে অসমম্ভব নৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে পড়তে হয়েছিল তা এড়ানোর জন্য: অমুকের বদলে তমুক মরুক। কিন্তু কেউ একবারও ভাবেনি যে যাকে ঘিরে এ-সিদ্ধান্ত হয়তো সে নিজেই এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে পারত, তার নিজের ঝুঁকি, নিঃসঙ্গতা ও কষ্টটা সে নিজেই সামাল দিতে পারে।
এই মহামারি, আর সব সঙ্কটের মত, প্রতিটা সমাজের খামতিটা উন্মোচন করে দিয়েছে। আমাদেরটা স্ববিরোধী মানসিকতার, ব্যাপারটা ব্যক্তির একার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না এবং, একই সাথে, নিজের মত করেই চলাই তার অভ্যাস, অন্যান্য গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য যে মুক্তি দেয় তা ব্যতিরেকেই। কখনো সে হতে পারে অসম্ভব রকমের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, কিন্তু আবার একই সাথে সহজেই অন্যের দুর্দশা-কষ্টটা মেনে নেয়, সব সময় অতটা বেশি না দেখলেই হল। কোরোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা গণনা করা হচ্ছে প্রতিদিন, অতি সতর্কভাবে, আর অন্যদিকে অর্থনীতির গায়ে ঝুলে আছে তালা, এবং ক্ষমাহীন কোরেন্টিনের শিকার আরও লাখ লাখ মানুষ যারা দৃশ্যমান নয়: অন্তরীন অবস্থায় নির্যাতনের শিকার নারী, চিরদিনের জন্য অভিঘাত-পীড়িত শিশুরা, এক আঘাতেই কয়েক প্রজন্মের সামাজিক উন্নতি গায়েব। মহামারির শিকার এইসব মানুষের কোনও হিসাবরক্ষক নেই, সামাজিক যোগাযোগে তাদেরকে দেখা যায় না, তারা রাজনৈতিক ক্ষতির কারণ না। সূচনায় আমি যে পরিস্থিতির কথা বলেছি, যেটাতে জেতা যাবে না, সরকার সমস্যাটার সমাধান করেছে ছ্যাবলামির সাথে: মিডিয়ার শাস্তি পরিহার করার চেষ্টায়।
লাতিন আমেরিকায় এমন কোনও দেশ নাই যা অন্তহীন অসাম্যে ভুগছে না, স্থানীয় সহিংসতা থেকে শুরু করে - আমার দেশ কোলোম্বিয়ার মত - কিংবা একই সাথে উভয় রকমেরই। এখন আমাদের রাজনৈতিক শ্রেনীর দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্তগুলি, দৃষ্টিক্ষীনতা বা মূর্খতার পরিণামে, আমাদের দুর্বল, দরিদ্র এবং ইতোমধ্যে সংঘাতময় জগতকে নানা রকমের সহিংসতার ভূখন্ডে পরিণত করতে পারে, পেলোপোনেসো-তে ফিরবার দরকার আমাদের নাই এই কথা স্মরনে আনতে যে মহামারি আর যুদ্ধ সব সময় হাত ধরাধরি করে চলেছে। এখন পর্যন্ত ভাইরাসটি মূলত ধনী দেশগুলি এবং কমবেশি স্থিতিশীল দেশগুলিতে প্রভাব বিস্তার করেছে, কিন্তু লাতিন আমেরিকায়, সেকেলে অগ্রাধিকারভিত্তিক চিন্তা বা মিডিয়া ভীতি শান্তির পথটাকে ওলোটপালোট করে দিতে পারে যেখানে শান্তির ব্যাপারটা নতুন, কিংবা যেখানটায় আগে ছিল না এমন জায়গায় নতুন করে বাঁধিয়ে দিতে পারে যুদ্ধ।
তর্জমা: রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
[হুয়ান গাব্রিয়েল বাস্কেস্ সমকালের একজন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৭৩ সালে, কোলোম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায়। সাতটি উপন্যাস, দুইটি গল্পগ্রন্থ ও চারটি প্রবন্ধের বই রয়েছে তার ঝুলিতে। বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন যার মধ্যে আল্ফাগুয়ারা এবং ইন্টারন্যাশনাল ডাবলিন লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড উল্লেখযোগ্য। এই নিবন্ধটি বেরিয়েছিল স্পেনের এল্ পাইস্ দৈনিকে, পহেলা জুলাইয়ে।]