শঙ্খসঙ্গে একজীবন
১.
নিরুর জীবনে বনতুলসীর চারা তরতর করে বেড়ে উঠেছিলো, চারা তাকে দিচ্ছিলো অক্সিজেন আর পুষ্টি, সঙ্গের আনন্দ এইভাবে কোনোদিন পায়নি সে। সময়ের নিয়মেই সে চারা একদিন শুকিয়ে আসে আর চূড়ান্ত অবসাদের ভেতরে তিরতির কাঁপতে থাকে এক সন্ধ্যাতারা, নিরুর মনের আকাশে। বয়সে অনেকটাই ছোটো সে তারার গায়ে চিত্রকলার বহুবর্ণ আর ভাস্কর্যপ্রতিম ধ্রুপদী মেধা। আস্তে আস্তে একলা থাকার অসুখ সেরে ওঠে। প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে দক্ষ ভেষজজ্ঞানী প্রাকতরুণী অমরকিশোরীর এক আধোচুমুতে কোনো এক শীতের ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যায় ভাড়া বাসার তিনতলার সিঁড়িতে প্রায়তিরিশ নিরুর শরীর ও মনের যাবতীয় রোগবালাই সেরে যায়। তারপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত।
চারুকলা প্রদর্শনীর ফাঁকা গ্যালারি কিংবা বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের অলস কনেদেখা আলোর বিকেলগুলো লিখিত হতে থাকলো চকিত চুমুতে। চুমুই যে দুনিয়ার একমাত্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত খাবার কিংবা শিবরাম যে বলেছিলেন, পেতে পেতে খাওয়া আর খেতে খেতে পাওয়ার কথা সেসব আনন্দ এখন প্রায়চল্লিশ নিরুর জীবনে গতজন্মের স্মৃতি কেন না ওর আছে নীল নক্ষত্রের দোষ। জন্মমুহূর্তে কারো কারো এমন হয়। এই দোষ থাকলে যা ছুঁতে চায় দোষী, সব সরে সরে যায়। তারা একদিন নিভে যায়। নিরু সম্পর্কের শুরুর দিনেই শেষ দিনের ক্রন্দন সম্পর্কে জেনে ফেলে যেভাবে জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা আমাদের জানান, যে সকল নক্ষত্রের আলো আমাদের কাছে আসে সেসব আসলে বহুশতাব্দী আগেই মৃত। একজীবনে বনতুলসীর মৃদু ছায়ার আরাম, সন্ধ্যাতারার আভা তার শরীর মন স্পর্শ করবে না।
শহরের চিত্র প্রদর্শনীর ফাঁকা গ্যালারি, বেসরকারীটির লিফটের ওঠানামা, তার পেছনের নির্জন গলিতে আর যায় না সে। এই দুজন মানুষের সাথে সংযোগের বিন্দু ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। বনতুলসী টিউশনের পয়সা বাঁচিয়ে নিরুকে উপহার দিয়েছিলো প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা 'অন্ধের স্পর্শের মতো', প্রেমের শুরুর বেলায় জন্মান্ধের আকুল হাতের গহন স্পর্শই পেতে চেয়েছিলো সে। আর সন্ধ্যাতারা জানতে চেয়েছিলো, রবীন্দ্রনাটক প্রসঙ্গে এক অঝোর বর্ষার রিক্সার অবসরে আর তখন নিরুর সেরিব্রাল ইন্টেলেকচুয়ালিটি বলে দিয়েছিলো, 'কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক'- এর কথা। পরে, সম্পর্কের আলোবিচ্ছুরণ ফুরিয়ে গিয়েছিলো বলে পাঠপ্রতিক্রিয়ার হদিশ নিতে পারেনি। এসব মর্ত্যলোক ও পৃথিবীর কথা, দীর্ঘ দীর্ঘ ঘুমের স্বপ্নে আজো অবশ্য তাদের সাথে কথা ফুরায়নি। বনতুলসীর ছেলেকে কোলে তুলে আইসক্রিম কিনে দিতেও আটকায়নি কোথাও, পাশে হয়তো বৌ ঘুমাচ্ছে, তবু। এখন সে জানে, প্রেম আসলে মর্বিড, ইন্টেলেকচুয়ালিটি প্রেম বাঁচাতে পারে না।
আমি আর নিরু একইদিনে একই মুহূর্তে জন্মেছি একই মাবাবার গর্ভে। আমি নিরু নই, আমরা যমজ নই, আমরা একই দেহে লীন নই। আমাদের দুজনের মাবাবা সেই আমলে রীতিমত চিঠি লিখে এক বছর প্রাকবিবাহ প্রেম করেছেন আর পরের বছরেই আমরা পৃথিবীতে আসি। শঙ্খ ঘোষের মহাপ্রয়াণের খবরে আন্তর্জাল যখন ছদ্মশোকে কাঁপছে আমি হাতে তুলে নিয়েছিলাম শঙ্খের পুরনো এক কীটদষ্ট কবিতার বই আর এই গদ্যের লেখার আমন্ত্রণ পেয়ে আমার নিরুকে মনে পড়ে। আমার ঠোঁট শিরশির করে ওঠে। আমি ওকে চিৎকার করে ডাকি, আমার গলা ভেঙে যায়।
২.
সে আমার কথা শোনে না, আমার কথা শোনানোর জন্যে তাকে খুঁজে পাই না আমি। ফলে আমাকেই লেখাটা শুরু করতে হয়, লেখার মাঝে তার দেখা পেলে আমি ছুটি পাবো। আমাদের দেশের বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের খানিকটা আগে, ডিসেম্বর ১৯৬১ সালে নতুন সাহিত্য ভবন থেকে অনিল কুমার সিংহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে গেলো 'সূর্যাবর্ত' সংকলনটি। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকল্পিত এই স্ংকলনে প্রচ্ছদশিল্পী নিজের নাম লিখতেন পূর্ণেন্দুশেখর পত্রী। অতি তরুণ, ত্রিশস্পর্শী শঙ্খ সেখানে লিখলেন এক মহৎ প্রবন্ধ। নাম – 'স্বাভাবিক ছন্দ ও রবীন্দ্রনাথ'। পরবর্তীতে লেখা তাঁর গদ্যরচনার অধিকাংশ চরিত্রনমুনা এই গদ্যে দেখা যায়। পাঁচটি অংশ তুলে দেয়া যাক –
ক . প্রায় আশি বছর আগে এক বাঙালি যুবকের মনে হয়েছিল, 'যদি কখনো স্বাভাবিক দিকে বাংলা ছন্দের গতি হয় তবে ভবিষ্যতের ছন্দ রামপ্রসাদের ছন্দ অনুযায়ী হবে।
খ . লৌকিক জগৎ থেকে সচেতন সাহিত্যজগতে এনে ছড়ার এই প্রতিষ্ঠা আমরা জানি রবীন্দ্রনাথেরই অন্যতম কীর্তি।
গ . গদ্য কবিতা সৃষ্টির পশ্চাৎপটে অন্যতর বহু হেতুকে অস্বীকার না করেও বলা সঙ্গত মনে করি যে পরিশেষের দুর্বলতাগুলি মুছে নেবার এক উলটো প্রয়াস থেকে এলো পুনশ্চের কবিতা, যার পর থেকে হসন্ত মধ্য চলিত ক্রিয়ার ব্যবহার কবিকে অনিবার্যভাবে আকর্ষণ করত গদ্যছন্দের অভিমুখে।
ঘ . বস্তুত, এই কৃত্রিম শ্বাসাঘাতজনিত ছন্দস্পন্দ নির্মাণ এবং অতিনিরুপিত বৈচিত্র্যহীন পর্বসন্নিবেশই ছড়ার ছন্দের প্রধান দুর্বলতা। তরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠিকই লক্ষ্য করেছিলেন যে স্বাভাবিক ভাষার স্বাভাবিক ছন্দ ঐটে, কিন্তু প্রৌঢ় বা বৃদ্ধবয়সেও যে তাঁর দুর্বলতার কথা তিনি বলেননি বা সেই দুর্বলতা মোচনের সাধনা করেননি তা ভাবলে বিস্ময় লাগে ।
ঙ . ভবিষ্যতের বাংলা ছন্দ রামপ্রসাদের ছন্দ হবে না বটে, কিন্তু সেই ছন্দেরই এল মুক্ত রূপ হতে তার বাধা কী?
মাত্রই ৮৯ বছর পার করেছিলেন শঙ্খ, অসুস্থও ছিলেন কিছু মাত্রায় কিন্তু স্বাভাবিক ও জীবনব্যাপী সহজসৌজন্যবশত অতিমারীর ঘনঘটার ভেতরেও নানাকিছু উদ্বোধন, উন্মোচনের জন্যে লোকজনের আসার বিরাম ছিলো না। আমি প্রায়ই দেখেছি, অন্তর্জালে সজ্জন, স্মিতমুখ শঙ্খ ঘোষের পাশে দাঁত কেলিয়ে নিজেকে মালটিট্যালেন্ট প্রমাণ করতে হাতে মাল নিয়ে পোজ দিচ্ছেন কোনো কবিযশোপ্রার্থী তরুণ কিংবা নির্মাতা। জনসংযোগের বারণ না মেনে চমৎকার অচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।
এখন বাংলা ভাষার পন্ডিত মণীন্দ্র কুমার ঘোষের পুত্রের সম্পূর্ণ জীবনের দিকে আমরা তাকাতে পারি। অবশ্য এই বিপুল জীবনের যে বিস্তার তা এই তাৎক্ষণিক গদ্যে ধারণ অসম্ভব। ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, শিক্ষক পিতা আর মা অমলাবালার ঘরে জন্মালেন তিনি। পাবনা জেলার পাকশীর চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে পড়েছেন ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী। স্কুলের কাছেই বাড়ি তবু বাবা চাননি ক্লাস সিক্সের আগে ভর্তি করিয়ে দিতে। তাঁর শিক্ষক নির্মলচন্দ্রের 'রাজর্ষি' পড়ানোর নরম আলতো ধরণ এই সংবেদী কিশোরের বাকি জীবনে ছায়া ফেলে গেছে। বাবার সূত্রেই রবীন্দ্রানুরাগ আত্মায় মিশে গিয়েছিলো। একবার, ছোটো ভাই নিত্যপ্রিয়ের অসুস্থতায় ক্লাস মুলতুবি না করে বাবা হাতে তুলে নিয়েছিলেন 'নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থখানি আর পড়ে যাচ্ছিলেন পরপর, পরিণত বয়সে বুঝতে পেরেছিলেন বাবা কোথাও একটা আশ্রয় পেতে চাইছেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। ১৯৪৬ সালে যুগান্তর পত্রিকায় প্রথম কবিতা ছাপা হলো যদিও বইতে যা ছাপতে দিয়েছেন তাঁর আদিকবিতা 'কবর', সতের বছর বয়সে লেখা, 'আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা'। নতুন ধরণের একটা স্বর যা পূর্বজদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা ।
৩.
প্রকাশন সংস্থা প্যাপিরাস প্রতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মদিনে ছোটো এক পুস্তিকা প্রকাশ করে, শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে। অগ্রন্থিত লেখা, দেয়া বা নেয়া অগ্রন্থিত কবিতা বা অনুবাদে তা সংকলিত হয়।
গতবছরের 'শঙ্খ ৮৮' শীর্ষক সে পুস্তিকায় প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাসের সাক্ষাৎকারে পাচ্ছি, ছাত্রশিক্ষকের সুন্দর সম্পর্কের নজির। তিনি বলছেন, 'আমার ধারণা ছিল, বলতে গেলে একটা হীন অহংকার ছিল যে বাঙলায় আমি প্রায় সব সবজান্তা। এর ফলে ক্লাসে পড়ানোর আগে আমি বিশেষ তৈরি হয়ে যেতাম না। একটি ছাত্র আমার সে অহংকার একদিন চূর্ণ করলো।
ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে প্রমথ চৌধুরীর একটা প্রবন্ধ পড়াচ্ছি – তাতে 'কাক' আর 'কলবিঙ্কের' বিপরীত তুলনা ছিল। কলবিঙ্কের মানে আমি জানতাম না। পড়াতে পড়াতে ধরেই নিলাম যে ওটা ময়ূর হবে। একটি ছাত্র সে ভুল ভেঙে দিলে – ছাত্রটির নাম নিত্যপ্রিয় ঘোষ, শঙ্খ ঘোষের অনুজ।' এখন, শঙ্খ ঘোষের বাড়ির সকলে করোনাক্রান্ত তাই ভাই নিত্যপ্রিয় দাদাকে জানালা থেকে শেষ বিদায় দিলেন। কিন্তু দুই ভাইয়ের প্রসঙ্গ তুললাম আরেক কারণে। অনুসন্ধিৎসু পাঠক খেয়াল করলে দেখবেন, দাদাকে খানিক রবীন্দ্রপুজারী ধরণের মনে হলেও অনুজ কিন্তু রবীন্দ্রের একাধিক মিথ ভেঙে দিচ্ছেন গদ্যে, কঠিন ভাষায় যা বাঙালি পাঠকের গ্রহণ করতে সময় লেগেছে।
পাঠকের মনে গুছিয়ে রাখা স্থিতাবস্থা তছনছ করে দে সেই ভাইয়ের তুলনায় শঙ্খ অনেক শান্ত ও বন্ধুপ্রতিম, তিনি আস্তে পাশে এসে বসে বলবার কথাটি বলেন। লোথার লুৎসেকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, 'আসলে আমার কাছে কবিতা লেখা, সেটা আসলে নিজেকেই আর একটু তৈরি করা হয়ে গেল ব্যাপারটা – making of a poem is making myself, practically –এবং সেটা যখন হচ্ছে তখন তো আমি জানি না যে আমি কী হতে যাচ্ছি, সে কবিতাটিই আমাকে হইয়ে দিচ্ছে তো খানিকটা।'
অগ্রজ লেখকদের রচনায় লেখাকে দিয়ে যে কাজটা করিয়ে নিতে চান তার পুরোটা পাওয়া গেল না বলেই তিনি ভাবলেন, লিখবেন। যুদ্ধ, বিয়াল্লিশের আন্দোলন, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, পঁয়তাল্লিশের নেতাজিকে নিয়ে উন্মাদনা, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, সালচল্লিশের দেশভাগ আর স্বাধীনতা। ছিলেন দূর এক মফস্বলে, খণ্ডিত আর স্বাধীন দেশের কলকাতায় এসে পড়লেন পনেরো বছর বয়সে। তখন সময়টা কেমন? অরুণ মিত্র লিখেছিলেন একবার, 'আমার বিশ্বাস ন্যস্ত ছিল পাথরে/ এক অনমনীয় পাথরে।'
স্পষ্ট এক শিবিরবিভাজন, বামপন্থীরা যাবতীয় ত্যাগ আর সদিচ্ছা সত্ত্বেও নতুন ধরণের লেখা চিনতে পারছেন না। অনেক পরে শঙ্খগৃহীত সাক্ষাৎকারে সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্বীকার করবেন কোথাও একটা প্রবণতার ভুল ছিলো – 'দলের শৃঙ্খলা এক সময়ে কবিতার হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছিল।' প্রশ্ন ছিলো শঙ্খ তরফে – 'মার্ক্সবাদী সাহিত্য বিচারের মধ্যে যে গন্ডিবদ্ধতা আপনার কি মনে হয় কখনো কখনো তাতে আপনি আচ্ছন্ন হয়েছেন?', উত্তরদাতা স্বীকার করেন – 'অবশ্যই গণ্ডিবদ্ধ হয়েছি। জীবনানন্দের বিষয়েই হাতেনাতে পেশ করা আছে লিখিত প্রমাণ।'
৪.
আমার খাতাপত্র গুছিয়ে রাখতে গিয়ে পেয়ে যাই নিরুর নোটখাতা । সেখানে কভারে সে লিখে রেখেছে, বঞ্চিত বাঞ্চোত। ভেতরে তার ব্যক্তিগত দিনপঞ্জি আর নানারকম নোটস। একটি অংশ তুলে দিই:
আজ ফেব্রুয়ারির ছাব্বিশ তারিখ, দুই হাজার নয়। বনতুলসীর বাসায় কেউ ছিলো না তাই আমি আমন্ত্রিত ছিলাম। লেবুর শরবত কিংবা ডিম মামলেট খাওয়ার জন্যে আমি যাইনি সে কথা সেও জানে। এতোদিন জোরাজোরি করলেও চুমুটা প্রথমবার কপালে জুটলো আজ। প্রথমবারেই মনে হলো, ত্বকে ত্বকে এই স্পর্শটুকুর জন্যেই এতো ইতিহাস ও তা থেকে বিচ্যুতি! এতো বিজ্ঞাপন ও আত্মা শুদ্ধ খুলে দিয়ে বিশ্ববাজারে নুংকু আড়াল দাঁড়িয়ে পড়া! আমি ওকে প্রাণ খুলে চুমুটা ফিরিয়ে দিতে পারলাম না বিনিময়ে দিলাম 'নির্মাণ' পত্রিকার নতুন সংখ্যা।
প্রথম চুমুর আনন্দে (কিংবা আমারই মতো বিরক্তিতে) বিছানায় শুয়ে সে খানিক জোরে শ্বাস নিচ্ছিলো। তার বিকশিত পুষ্পদুটি দেখে মনে হলো, আহা আমার সন্তানের খাদ্য ভাণ্ডার। পত্রিকায় মুদ্রিত শঙ্খ ঘোষের প্রথম কবিতার চার লাইন সে পড়ে তারপর –'ভাবো কি আমিই আছি আমি/ চলছি ফিরছি কথা বলছি বলে?/ আমার আছে গোপন ওপরঅলা/ যা ঘটে সব রিমোট কন্ট্রোলে।' তারপর সে ঝকঝকে দাঁতে হাসে ও আরেকবার চুমুর দিকে এগিয়ে আসে।
বাসায় ফিরে আসতে আসতে অলোকরঞ্জনের কথাটা মনে পড়ে। তিনি লিখছিলেন এক জায়গায় – আমার মনে এখনো গাঢ় এই প্রতীতি, তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্রলক্ষণই সমীচীন স্তব্ধতা। বাসের জানালার পাশে বসে হাতের 'নির্মাণ' খুলে বসি, দেখি সেখানে সুতপা ভট্টাচার্য 'সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি' বইসম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন – 'where shall the world be found, where will the word/ resound? Not here, there is not enough silence' এলিয়টের এই লাইনগুলি আমার মনে পড়ে, যখনই শঙ্খ ঘোষের সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি পড়ি।
বাসের জানালা দিয়ে বাতাস আসে আর আমার মনে পড়ে আমাদের চুমুতেও কি এলিয়টকথিত এই এনাফ সাইলেন্স থাকে? শঙ্খ ঘোষের কবিতায় অবশ্য সমীচীন স্তব্ধতা বা এনাফ সাইলেন্সের বোধ ফিরে ফিরে আসে।
আরেক জায়গায় দেখি শ্রেষ্ঠ কবিতার একটি বাক্য লিখে রেখেছে সাথে তার মন্তব্য –
'জীবিকাবশে শ্রেণীবশে এতই আমরা মিথ্যায় জড়িয়ে আছি যে দিনরাত যে একটি কবিতার জন্যেও কখনো কখনো অনেকদিন থেমে থাকতে হয়।' এতো কিসের শ্রেণীর বড়াই তোমার শঙ্খ বাবু, বিলং তো করো একটা পাতিবুর্জোয়া মিডল ক্লাসে। আগের বাক্যটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, পুরো বইখানি পড়ে মনে হলো, কবির সারাজীবনের সাধনা শ্রেণীচ্যুত হয়ে আরেকটু ভালো, উন্নত সত্যে সুন্দরে উন্নীত হওয়া। মিথ্যে শব্দটি বিউটিফুল, নির্বোধ লোক মিথ্যে বলতে পারে না। তালা আবিষ্কারের পরেই সন্দেহ শব্দটা সভ্যতার সাথে অঙ্গাঙ্গী। বড়দের খেলার বেলুন আর ট্যাবলেট আবিষ্কারের পরেই এথিক্সের মা মাসী হয়ে গেছে।
৫.
আমি লেখাটা লিখতে লিখতে বার বার নিরুর কাছে, নিরুর সত্যে চলে যাচ্ছি , নিজের কথা কিছু লিখছিই না। শঙ্খ ঘোষের চলে যাওয়ার খবর শোনার পর একজন ব্রতধারীর কথা মনে পড়লো যার কাছে সকল মতের মানুষ আশ্রয় পেতে পারেন, এমনকি মতান্ধ হতে পারেন শমিত। 'শব্দ আর সত্য' বইতে যেমন লিখছেন তিনি –'আর সকলে মিথ্যা বলে বলুক, দু চারজনের কাছে আমরা সত্য চাই। আর সকলে ভ্রান্ত করে করুক, দু- চারজনের কাছে আমরা ব্রত চাই।' সে ব্রতের চেহারা কেমন? তা কি কোনো সুনির্দিষ্ট দলানুরাগী? তা তো নয়। যেমন সরস্বতী সম্মান তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নেননি কারণ তিনি অটলবিহারী বাজপেয়ী, একজন চিহ্নিত ঘাতক। পরে বাড়ি বয়ে এলো যখন প্রাইজ, নির্দ্বিধায় দিয়ে দিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে যাদের সাথে সেই ভারতকোষের কাজের সময়ই তাঁর আত্মার সম্পর্ক।
এখানে গভীর হয়েছিলো বন্ধু প্রদ্যুম্নের সাথে সম্পর্ক। কিছুদিন আগেই বন্ধুকে নিয়ে বই – পরম বন্ধু প্রদ্যুম্ন – বেরিয়ে গেছে। প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের কিংবদন্তী গ্রন্থ 'টীকাটিপ্পনী' সন্ধানী পাঠক মাত্রই পড়েছেন। এইবার এন আর সি বিরোধী আন্দোলনে সারা দেশ যখন উত্তাল তিনি লিখলেন 'মাটি' কবিতাটি। শেষ অংশটি এমন –' গোধূলি রঙিন মাচা, ও-পাড়ায় উঠেছে আজান/ এ- দাওয়ায় বসে ভাবি দুনিয়া আমার মেহমান/ এখনও পরীক্ষা চায় আগুন সমাজ/ এ-মাটি আমারও মাটি সে কথা সবার সামনে/ কীভাবে প্রমাণ করব আজ',
তিনিই কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পর পঞ্চাশের শুরুতে কোচবিহারে এক কিশোরীর গায়ে গুলির অভিঘাতে লিখেছিলেন 'যমুনাবতী'-র মতো কবিতা। আবার প্রায় অরুন্ধতী রায়ের কাম সেপ্টেম্বর প্রবন্ধের চেতাবনির ধরণে একটি তথ্য মনে পড়লো। ঐ প্রবন্ধে নাইন ইলেভেন দুনিয়ার ইতিহাসে আরো কেমন করে চিহ্ন রেখে গেছে সেসব কথাই বলেছিলেন তিনি। তেমন এক নাইন ইলেভেন এসেছিলো নব্বই সালে, কলকাতা তথ্যকেন্দ্রের দোতলায় কলকাতার লেখক বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে। উৎপল দত্তের মতো মানুষও বললেন, বামশাসন নিয়ে জনমানসে কোনো ক্ষোভ নেই। একমাত্র শঙ্খ ঘোষ পড়লেন, প্রতাপ আর অন্ধতা নিয়ে এক গদ্য।
যে নন্দীগ্রামের কারণে বামফ্রন্টের তাসের ঘর ভেঙে পড়লো সে নন্দীগ্রামের সময়েও তিনি রাস্তায় নেমেছেন, লিখে প্রতিবাদ করেছেন। পুরস্কার তাঁর মতো কোনো বাঙালি কবির কাছে ছুটে আসেনি এমন স্রোতের মতো কিন্তু সেসব তাঁকে অন্ধ করতে পারেনি। মুখ্যমন্ত্রীর পাশের আসনে বসে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ তিনি হেলায় তুচ্ছ করতে পারেন বর্ধমান থেকে এক দল তরুণ তাঁর কাছে আসবে বলে। আবার শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন? ছাত্রদের জবানিতে জানা যাচ্ছে, ছিলেন ছাত্রবান্ধব এবং অতিমূর্খ ছাত্রটির ঔৎসুক্যের উত্তরে অক্লান্ত। রক্তকরবী পড়ানোর শেষ ক্লাসে টেবিলে রাখা হয় রক্তকরবী ফুল।
ছাত্ররা যাতে পাঠের সাথে আরো একাত্ম হতে পারে। জুটলো প্রত্যেকের একটি, ছাত্রীরা গুঁজে নিলো কপালে। নিরু আমাকে বলেছিলো একদিন, ' দেখতে তথাকথিত ফর্সা ছিলো না বলে বনতুলসীকে তাঁর দলনেতা আন্তরিক ইচ্ছে সত্ত্বেও নন্দিনীর চরিত্র কোনোদিন করতে দেন নাই। রবীন্দ্রনাথ বলে না দিলেও এখন আর তখন এদেশে ওদেশে নন্দিনী মানেই ফর্সা ত্বক। আমরা কি কখনো শ্যামলা বা কৃষ্ণাঙ্গী নন্দিনী দেখবো না কখনো? অবশ্য চন্দ্রার চরিত্র সে এতো সুন্দর করতো, মঞ্চায়নের পর আমি যখন রিক্সায় তাকে বাসায় পৌঁছে দিতে সঙ্গ দিতাম তখন বলতাম – এতো সুন্দর ঝগড়া কেমন করে করো তুমি! ঝগড়া বলে মনেই হয় না।' তারপর নিরুর সাথে আমি হেসে উঠেছিলাম। বনতুলসীকে আমি স্নেহ করতাম। বড়ো ভাল আর আন্তরিক মেয়ে ছিলো।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের কবিবন্ধুদের কথা ভেবে শঙ্খ উদ্বিগ্ন হচ্ছেন, লিখছেন – 'জসীমউদ্দীন থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান পর্যন্ত কবিরা এখন কোথায়? এই মুহূর্তে ইয়াহিয়ার সৈন্যেরা না কি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইত্তেফাকের অফিস। ধ্বংস করেছে তার সাংবাদিক কর্মীদের। তাহলে আল মাহমুদ? কোথায় এখন তিনি? বোমায় বিধ্বস্ত রংপুর। কায়সুল হক? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আজ পনেরো দিনের পুরনো হলো, এর মধ্যে আমরা জেনেছি কীভাবে সামরিক অত্যাচার প্রথমেই ছুটে যাচ্ছে যে-কোনো বুদ্ধিজীবীর দিকে।' আঘাতের কাছে ঋণী কবি কেন না তা নিজের দিকে ফিরতে ও মানবচরিত্র বুঝে নিতে সাহায্য করে। এই স্থিরতার জোরেই তিনি পৃথিবীর সহবাসিন্দাদের শমিত করতে পারেন অক্ষরে।
এবং এইজন্যেই শঙ্খপ্রসঙ্গে বিশিষ্ট নাট্যকার অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলতে পারেন, মধুর আমার পাশে আছেন। আমরা যখন গাই 'মধুর আমার মায়ের হাসি', তেমন নম্র সুন্দর আদুরে ভাবেই তিনি মধুর শব্দটি উচ্চারণ করেন। তেমন মানুষ হতে পারলে জলে বাতাসে পরিপার্শ্বে মধুর ক্ষরণ অনুভব করা যায়। সঙ্গের আনন্দে মানুষের আরোগ্য ঘটানো যায়।
৬.
আয়ওয়ার ডায়েরি বইটির কথা আমার মনে পড়ে। নিরু আমাকে উপহার দিয়েছিলো। সেইখানেই দেখি শঙ্খ 'লা জিতে' সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা লিখছেন। নিরু দাগ দিয়ে পাশে লিখে রেখেছে, দেখতে হবে। সিনেমাটার বৈশিষ্ট্য হলো অজস্র স্থিরচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সাদাকালো। বনতুলসী খুব চমৎকার মাছ ভাজা করতে পারতো, মাতৃপ্রতিম। একদিন ওদের আসতে বলি। আমার স্ত্রী তখন বাড়িতে ছিলেন। আমি ছবিটি দেখতে দেখতে এক সময়ে উঠে যাই, ওদের সময় দিই। আহা আমার সহনাগরিক, এই বনেজঙ্গলে কসমোপলিট্যানে প্রেমের কোনো নিভৃতি নেই। অনেক পরে দেখি, তারা পরস্পরে বিলীন হয়ে আছে, পরস্পরকে গ্রাস করে ফেলেছে।
১৯৮১ সালে, আমাদের জন্মের বছরে, নভেম্বর মাসে 'ক্ষুধার্ত' পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি সিনেমা নিয়ে কয়েকটি কথা বলেন –'তাঁর ছবিতে ঠিক যে জায়গায় আঘাত করতে পারতেন ঋত্বিক ঘটক, বাংলা ছবিতে এখনও পর্যন্ত সেটা যে করতে পারেননি আর কেউ, তা ঠিক। আমাদের সমসাময়িক সত্যের সঙ্গে চকিতে জীবনের একটা মৌল সত্যকে মিলিয়ে দেবার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ঋত্বিকের, সেটা আর কারো ছবিতেই পাই না। ঠিক সেই জায়গাতেই ছবিকে মনে হতো কবিতার মতো । বাংলা ফিল্ম যে কবিতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না, এটা বেশ দুঃখের।'
আজ প্রায় চল্লিশ বছর পর ভেবে অবাক লাগে সত্যজিৎ রায় থাকবার পরেও, মৃণাল সেন থাকবার পরেও এমন জোরের সাথে এই কথা শঙ্খ কেমন করে বললেন! এদেশে ততোদিনে 'সূর্যকন্যা' হয়ে গেছে, হয়ে গেছে বহু আগে 'কখনো আসেনি' । এ কথা ঠিক, আমি আর নিরু একমত হয়েছিলাম বাংলাদেশের শিল্পকৃষ্টিকে প্রায়ই সীমান্তের অন্য পারের বাঙালি খানিকটা অবহেলার চোখেই দেখে। অবশ্য পরবর্তীকালের শঙ্খ ঘোষ, অরুণ সেনেদের জীবনব্যাপ্ত কাজ সীমান্তরেখাটিকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই সীমিত রেখেছে, মনে জাগিয়ে দিয়েছে এক অপার বাংলার বোধ। এখন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ঋতুপর্ণ ঘোষ অপর্ণা সেন কিংবা আরো পরের একেবারেই তরুণ প্রজন্মের দেবরাজ নাইয়া, জুল মুখার্জি, রফিকুল আনোয়ার রাসেলদের কাজ বাংলা সিনেমায় কবিতার সেই বোধ ফিরিয়ে আনছে ও আনবে।
এই গদ্যলেখাটির একেবারে শেষে এসে মনে পড়ছে এক বৃষ্টির বিকেলে কর্ণফুলির পাড়ে মদ খাওয়ার কথা। আমি আর নিরু। মাঝে অনেকদিন সে নিরুদ্দেশ। বনতুলসীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এক ধরণের কান্নামেশানো গলায় সে আমাকে বলেছিলো, 'সেদিন কি হলো শোন! ওর বিয়ে হচ্ছে, আমি জেনেছি অন্যের কাছে, মাঝে সাড়ে তিনশ মাইলের তফাত। তখন সন্ধ্যে নেমেছে। নিজাম ভাইকে ফোন করে কিছু টাকা নিলাম। প্রাণভরে মদ খাবো আজ। তিনি বেশি করেই দিলেন। বললেন, ফরেন খা, দিশি জিনিস পাহাড়ের বাইরে আরাম নাই। তা টাকা নিয়ে মদের দোকানের পয়সা দেবার গোল গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে, লম্বা লাইনে, গোটা শহর আজ পিপাসার্ত।
সামনে আর মাত্র একজন, তখনই বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো মনে পড়লো নির্মাণ সম্পাদক রেজাউল করিম সুমন ভাইয়ের কাছ থেকে নেয়া 'ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ' বইয়ের কথা। সে বইতে আছে কেমন করে বন্ধু নির্মাল্য আচার্যকে নিয়ে শঙ্খ ঘোষ সতীনাথ ভাদুড়ী রচনাবলী গুছিয়ে তুলেছিলেন চারটি খন্ডে। আরেক ঝিলিকে মনে পড়লো চেরাগীর প্রথমায় সতীনাথ আছেন। এখন প্রশ্ন মদ না সতীনাথ? মীমাংসা সতীনাথের দিকে ছুটলো। সেদিন রাতে 'অচিন রাগিণী' টানা পড়ে যে আত্মার আরাম পেয়েছিলাম পৃথিবীর কোনো তরলের পক্ষে দেয়া সম্ভব না।' আমি নিরুকে সহাস্যে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, 'বন্ধু, কোনোদিন পাল্টে যেও না।' সে চিৎকার করে বলেছিলো, দূর বাঞ্চোত! খুব আনন্দ হলে কমরেডের প্রতিশব্দ হিসেবে সে বাঞ্চোত বলে।
৭.
সন্ধ্যাতারা নিভে আসার আগে শেষ মোলাকাতের দিন কোনো চুমু ঘটেনি। বসুন্ধরায় গিয়েছিলাম সকাল সকাল মিরপুর থেকে অভুক্ত অবস্থায়। ভেবেছিলাম একসাথে শেষ খাবার খাবো। কেন না আজকের পর আর আমাদের দেখা হলেও কথা বলবো না। পিকাসোর পেইন্টিং এর এক বই ছিলো আমার কাছে, ফিরিয়ে দিতে, ওরই বই। সে আসে, গায়ে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের টি শার্ট, সবুজ এক পৃথিবী তার বুকের কাছে হাসছে। খেতে চাইলাম বলে সটান এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে 'এই লোকটাকে দুটো পরোটা আর ডাল দিন' বলে বিল মিটিয়ে সে বেরিয়ে গেলো। আমি ডালের পলিথিন আর রুটি দুটো নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকদিন আগে দেখেছিলাম, হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষেরা একটি শুয়োরকে চ্যাংদোলা করে বাসে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন খোঁচাতে খোঁচাতে।
শুয়োরের সে চিৎকার আমাকে অনেকদিন ঘুমের মধ্যে তাড়া করেছে। তবু এখনো মনে হয় সন্ধ্যাতারার বুকের কাছের সবুজ পৃথিবী আরো সবুজ হোক। ভালো তো বেসেছিলো একদিন। আর বনতুলসী সে-ই বা কি করবে, তোমায় তো সাড়ে সাত বছর সময় দিয়েছিলো, কিছুই জোটাতে পারোনি, এক বাঙালি নারী তোমায় জীবনের সাড়ে সাত বছর দিয়ে দিলো আর তুমি বসে বসে লেবেঞ্চুস খেলে। আর্থিক নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষা তো অন্যায় নয়। এসব কথা একদিন নিরুকে বলতে সে আমাকে বলে, এখন পরিস্থিতি খারাপ ভাই। শিল্পে শরণ নাও।
তারপর যখন দেশে মহামাri এলো, মানুষজনের কথা বলার পরিবেশ প্রায় নেই, তখন আবার নিরুই পড়ায় শঙ্খ ঘোষের এক গদ্য। তার এক অংশ –' শৃঙ্খলার অজুহাতে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের নামে যখন একটা প্রজন্মকে বিকৃত বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয় পুলিশের অন্ধকার গুহায়, তখন তার বিরুদ্ধে যদি আমরা সরব নাও হতে পারি, তার সপক্ষে যেন আমরা কখনো না দাঁড়াই। এতটুকু ধিক্কার যেন আমাদের অবশিষ্ট থাকে যা ছুড়ে দিতে পারি সেই জেলপ্রাচীরের দিকে, যার অভ্যন্তর ভরে আছে বহু নিরপরাধের রক্তস্রোত আর মাংসপিন্ডে-'
এইভাবে শঙ্খ ঘোষ আমার আর নিরু, বনতুলসী আর সন্ধ্যাতারার মতো অজস্র বাংলাভাষীর কাছে প্রাসঙ্গিক ও সত্য হয়ে থাকেন, হয়ে থাকেন আশ্রয়। এখন নিরু নেই, আমি বেঁচে থেকে শঙ্খ ঘোষকে কেন্দ্র করে আমাদের বিপুল উষ্ণতা আর আর্কটিক শীতল দিনগুলোর কথা বলে নিলাম। সন্ধ্যাতারা আর বনতুলসীর আমার স্বপ্নে আসার অবশ্যি বিরাম নেই। কবির মৃত্যু নেই বলে, তিনি কোথাও চলে যান না বলে শঙ্খ ঘোষেরও স্বপ্নের সেই সীমান্তহীন, সময়হীন, নিয়মহীন দেশে ঢুকে পড়তে বাধা নেই। এইভাবে কবি চিরজীবিত, মৃত্যুর পরেও সম্প্রসারিত তাঁর জীবৎকাল।