সময়, ব্যাখ্যা মেলেনি আজও!
ছোটবেলায় 'সময়ের মূল্য' নিয়ে রচনা যেমন লিখেছি, ঠিক সেভাবে মাথায় গেঁথে নিয়েছি 'সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না'- এই আপ্তবাক্যটিও। সবখানেই সময়ের গুরুত্ব যে বেশ পাকাপোক্ত অবস্থানে রয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের তেমন কোনো সময় আমরা পাইনি।
তবে সময়ে সময়ে এই সময় নিয়েই আমাদের যত তালগোল পেকে যায়। কখনো হয়তো কোনো টাইম ট্রাভেল সিনেমা দেখতে গিয়ে এই তালগোল নিয়ে মাথা ঘামাই, কখনোবা সময়ের অস্তিত্ব নিয়েই চোখ টাটাই।
ঘড়ির কাঁটা যতই সময়কে করে দিক না কেন নির্দিষ্ট কিংবা সময়কে ছাঁচে বাঁধার তোড়জোড় করে ফেলুক ক্যালেন্ডারের পাতা, সময় সে তো আপন মর্জির মালিক বলে মনে হয়, সময় নিয়ে ভাবনা-চিন্তারও তাই শেষ নেই বিজ্ঞানে।
সময় পরিভ্রমণ কি আসলেই সম্ভব?
বর্তমানে গাড়ির ব্র্যান্ডের নাম 'টাইম মেশিন' করে নিয়ে কেউ কেউ হয়তো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান, তবে একসময় টাইম ট্রাভেলারের ধারণা থেকে সত্যিকারের টাইম মেশিন নিয়ে মাতামাতি হয়েছে প্রচুর। ১৮৯৫ সালে লেখা এইচজি ওয়েলসের কল্পকাহিনী 'টাইম মেশিন' সেই উৎসাহ বাড়িয়েছে বৈ কমায়নি একরত্তি। সেই কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে একই নামের সিনেমা। পরবর্তী সময়ে একই ধারণা কাজে লাগিয়ে অন্য বহু সিনেমা পেয়েছেন আগ্রহী দর্শকেরা।
হেঁয়ালির দুনিয়ায় 'গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স' বেশ জনপ্রিয় একটি ধারণা। সোজাসাপ্টাভাবে বলতে গেলে, আপনি যদি টাইম ট্রাভেল বা সময় পরিভ্রমণ করে সুদূর অতীতে গিয়ে আপনার পিতামহকে হত্যা করেন, তাহলে আপনার বাবার অস্তিত্ব থাকবে না। এবং একই পরম্পরায় আপনার অস্তিত্বও থাকার কথা নয়, সেক্ষেত্রে কী ঘটবে? আপনি কি বর্তমানে বেঁচে থাকবেন, নাকি থাকবেন না? আপনার সাথে জড়িত সবকিছুতে আপনার প্রতিস্থাপিত ব্যক্তিটিইবা কে হবে?
হ্যাঁ, জনমানুষের অত্যন্ত আগ্রহের এই বিষয়টি আসলেই সম্ভব; শুধু যেমন সিনেমার পর্দায় দেখেছি, ওভাবে সম্ভব নয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বমতে চললে, যত দ্রুতগতিতে ভ্রমণ করা হবে, সময়ের বোধ তত ধীর হবে। এ নিয়ে একটা পরীক্ষাও নাকি করা হয়েছিল। দুটো ঘড়িতে একই সময় সেট করে রেখে দেওয়া হয়েছিল দুটো স্থানে; একটি পৃথিবীতে, আর অন্যটি এমন এক উড়ন্ত উড়োজাহাজে, যা কি না উড়ে যাচ্ছিল পৃথিবী পরিভ্রমণের ঠিক একই দিকে।
তো, ভ্রমণ শেষে ঘরে ফিরবার পর বিজ্ঞানীরা আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন, উড়োজাহাজে থাকা ঘড়িটির সময় অন্য ঘড়ির চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে ছিল। সে ঘড়িতে এক সেকেন্ডের জায়গায় আরও কিছু কম সময় ব্যয় হয়েছিল।
সময়ের শুরু ও শেষ কোথায়?
কসমোলজি বা বিশ্বতত্ত্বের মতে, ১৪ বিলিয়ন বছর পূর্বে বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের সাথে শুরু হয়েছিল সময়েরও যাত্রা। কিন্তু এরপরও কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে এর আগে সময় কি থমকে ছিল? নাকি শুধু সময়ের প্রভাব, অর্থাৎ 'বয়স বৃদ্ধি' বোঝার জন্য বিশ্বের অন্যান্য সবকিছুর জন্ম প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সময়ের যাত্রার শুরু এরও আগে? সময় বলতে এখন আমরা যা বুঝি, তা হচ্ছে পরিবর্তনের কাণ্ডারি।
প্রাচীন গ্রিকরা সময়ের উৎপত্তি নিয়ে প্রায়ই বেশ তর্কাতর্কি বাঁধিয়ে দিতেন। অ্যারিস্টটল অবশ্য সময় শুরুর ধারণার পক্ষপাতিত্ব না করে অসীমতার দিকে ঝুঁকেছিলেন। ইয়স্তেন গার্ডারের বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক কল্পকাহিনি 'সোফির জগত'-এ একটি প্রশ্ন বারবার যেমন সোফিকে ভাবিয়েছে, 'Can Something come out of nothing?'; অর্থাৎ, 'শূন্য থেকে কি কিছুর সৃষ্টি হতে পারে?'- সেটি অ্যারিস্টটলের এই ভাবনা থেকেই ধার করা। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, শূন্য থেকে জন্ম হতে পারে শুধু শূন্যের, তাই শূন্য থেকে মহাবিশ্বের জন্মের ধারণাটি অত্যন্ত ভ্রান্ত। সময়ের সীমারেখা টেনে নিয়ে অবশ্যই অতীত ও ভবিষ্যতের দোরগোড়ার দেখা মিলবে, তবে সেখানে আদিবিন্দু থাকবে কি না- এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
সময় থেমে গেলে কারও বয়স বাড়ত না, সময় থেমে গেলে পুরনো হতো না কালকের নতুন কেনা উপহারটা, পান্তাভাত হয়ে যেত না গরম হাঁড়ির ভাতটাও। সময় চলছে, এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ- আমরা ও আমাদের আশপাশ পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই, এমনটা হতেই পারে, সময় আগেও ছিল, শুধু এর প্রভাব লক্ষ করার জন্য কোনো মূর্ত বিষয় ছিল না। তবে এতেও কিন্তু সময়ের যাত্রার আদিবিন্দুটি নির্ধারণ করা যায় না। সময়ের চেয়ে বড় প্রহেলিকা পাওয়া ভার, তাই সে রহস্যমোচন বোধকরি সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
সময় যখন মহাশূন্যে
'সময় আপেক্ষিক'- কথাখানা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান বহুবার বলেছে ঠিকই, কিন্তু সহজ কথাটা বুঝতে গিয়ে মাথায় খেলে যায় অনেক জটিলতা। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী, 'স্পেস-টাইম' নামক একটি নতুন শব্দযুগল উঠে আসে। এটি দিয়ে বোঝানো হয়, মহাশূন্যের সময়। পৃথিবীর সময়ের মতো নয়, স্পেস-টাইম বরং অনেকটা বাঁকানো। তাই পদার্থ ও শক্তি দ্বারা এতে পরিবর্তন আনা যায়।
তাই আমাদের অবস্থান ও গতির উপর নির্ভর করে, সময় ধীরে বা দ্রুত চলতে পারে এবং স্পেস-টাইমের বিভিন্ন অংশে এর প্রভাব ভিন্ন হয়ে থাকবে। তাই আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের চেয়ে একটু দেরিতে বুড়ো হবার স্বাদটুকু পেতে পারেন।
আজ-কাল-পরশু
এখন আপনি এই লেখাটি পড়ছেন। এখন আপনি সময়ে নিয়ে কিছু একটা ভাবছেন। তবে পদার্থবিজ্ঞানের পক্ষ ধরলে, সময়ের খোপে ঠিক 'এখন' বলে কিছু হয় না। বিজ্ঞানে দর্শনের বহু ছাপ রেখে যাওয়া বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এ বিষয়ে বলেছিলেন, 'আমাদের পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মধ্যকার পার্থক্য এক নাছোড়বান্দা ভ্রমমাত্র।'
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ের কারণে একই পৃথিবীর মানুষ হয়ে আমরা সবাই বাস করি ভিন্ন ভিন্ন টাইম জোনে। শুধু ঘড়িতেই নয়, ক্যালেন্ডারেও এই আগপিছ দেখা যায়। তাই অস্ট্রেলিয়ায় বৃহস্পতিবার ভোর ৪টা বেজে ১৪ মিনিট হলে বাংলাদেশে ঘড়ির কাঁটা থাকে বুধবার বেলা ১১টা ১৮ মিনিটে। এক্ষেত্রে ৭,১৭১ কিলোমিটার দূরত্বে সময়ের পার্থক্য হলো ৭ ঘণ্টা। এই বিষয়টি শুধু বিভিন্ন দেশেই যে ঘটে, তা নয়। রমজান মাসে ইফতার আর সেহরির সময়ের তালিকা দেখলে মনে হবে, একই দেশে সময় যেন ভিন্নভাবে চলছে, কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বিভিন্ন বিভাগে রোজা রাখা হচ্ছে, আবার ভাঙাও হচ্ছে।
এই সময়ের তারতম্যের কারণ হলো পৃথিবীর পরিভ্রমণ। এই পরিভ্রমণের সময় বিভিন্ন বিন্দুতে, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে সূর্যালোক পড়ে কিংবা পড়ে না, আর এ থেকেই জন্ম নেয় আলো-আঁধার; দিন-রাত। আর তাই এখানে রাত হলেও, আমেরিকায় মানুষ মধ্যাহ্নভোজে ব্যস্ত থাকে।
সময়ের ভাঁজে বন্দী সময় রহস্য কিছু উন্মোচিত হয়েছে, কিছু এখনো রয়ে গেছে ধোঁয়াশায়। বিজ্ঞানের ক্রমশ অগ্রগতির মধ্য দিয়ে ঠিক সময়ে হয়তো সেগুলোও ধরা দেবে প্রমাণিত কোনো সত্য হয়ে, নতুন সেসব সত্য আমাদের দারুণভাবে চমকে দিয়ে হয়তো মিথ্যে করে দেবে বর্তমানে জানাশোনা অনেক কথাই। সময়ের মুখাপেক্ষী হয়ে সময়ের রহস্য দেখে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া এসব অমীমাংসিত আলাপ নিয়ে এ সময়ে তেমন কিছু করার নেই।