হাসান আজিজুল হক যখন মৃত্যুর ঘুমে
সকল মৃত্যুই, তা যতই ধীরে ঘটুক না, তা শেষ পর্যন্ত হয় আকস্মিক, আপতিক ও অনভিপ্রেতই; বলতে কী একদা ২০২১-এর ১৫ নভেম্বর রাত ৯টা ১৫ মিনিট ছিল আমাদের তেমনি এক পথভ্রষ্ট-অহৈতুক কর্মবিপাক ও বিবর্তন। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান স্থপতি হাসান আজিজুল হক অনেক দিন ধরেই ঘোর লাগা এক আচ্ছন্নতার ভেতর ধ্যানমগ্ন ছিলেন তাঁর ঘরে যখন তাঁর এই কামরাটি ওষুধ, অক্সিজেন এবং অ্যান্টি বেডসোর ম্যাট্রেস ইত্যাদি মিলিয়ে ইতোমধ্যেই সুপ্রচুর সক্ষমতায় হাসপাতালের আবহ নির্মাণ করে ফেলেছে।
আমরা এবং অপর মানুষেরা: 'উঁকি দিয়ে দিগন্ত'-এর মতো হাসান আজিজুল হক নামক এক মহীরুহ চাক্ষুষ করি এই আপাত হাসপাতাল-কামরার দরজায় ধাক্কা দিয়ে। এ বছরেরই ২১ আগস্ট, তিনি যখন খানিকটা বিবশ ও হতচেতন তখন একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স শান্তিকর্তা সেজে হাসানকে সম্ভাব্য বিপর্যাস থেকে রক্ষা করে। আমরা আনন্দচিত্তে তাঁর ঘরে ফেরাকে স্মরণ করি। কিন্তু অচিরেই, উজান রাতে হেঁটে যাওয়া হাসানের ওষুধ-ভান্ডার ক্রম বিকশিত হয় এবং তিনি শয্যাবন্দী হয়ে পড়েন। দর্শনশাস্ত্রে যদি মৃত্যু এবং মৃতের বর্ণনা হয়, হাসান কী কখনো এই প্রকার কথোপকথন করেছিলেন দর্শনের ছাত্র হিসেবে? ঘুম-ঘুম হাসানকে এসব জিজ্ঞাসা করা হয় না। অ্যারিস্টটল বলতেন মৃত হওয়ার অর্থ, নিজের ঘরে ফিরে যাওয়া! অনেক দিন আগে উন্মুল-হাসান তাঁর অননুকরণীয় শারীরিক ভাষা এবং বাগ্মিতায় যখন কথা বলতেন তখন তাঁর 'গল্পের জায়গা জমি মানুষ' আর ঘরবাড়ি জীবন্ত হয়ে উঠত: আমরা রুখো কর্কষ মাটির উত্তাপ ও ঘ্রাণ খুঁজে পাই যেন। তাঁর বর্ণনায় শরতের মাটি হাড়ের মতো সাদা হয় আর সেই রং ফুটে ওঠে তাঁর অনর্গল বাক্যের ভেতর। এক মুহূর্তে চৈত্র মাসের সাদা ধুলো মুখগহ্বরে আছড়ে পড়ে। শীতরাতের হীম কালো আকাশ আমাদের গলা বুক ভারী করে দেয়। কামারশালার আগুন শরীর উত্তপ্ত করে; মোষ এবং মানুষ যুগপৎ জিব ছড়িয়ে রক্তমুখী হয়, বিদ্বেষ পোষে...তারপর আবার গলায় গলায় ফিরে আসে। হাসান বলেন ওঁর দেশ গায়ের মানুষেরা এইভাবে সমগ্র তৈরি করে, হয়তো এইভাবেই মানুষ মানুষকে পাইয়ে দেয়।
নিভু নিভু চোখে, তরল খাবার-তরল ওষুধ চিবুতে চিবুতে দেয়ালের ওপাশে স্ত্রীর পোর্ট্রেট খুঁজে পান মানুষ মৃত হলে কী দ্রুত এক খণ্ড ছবিতে রূপান্তরিত হন! হাসানের এক জন্মদিনের গা ঘেঁষে, ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি স্ত্রী শামসুন্নাহার মৃত্যুবরণ করেন। আমি ভাবি, নদী এবং সমুদ্র যেমন এক জীবন ও মৃত্যু কি তাই? নাকি মৃত্যু তখনই আন্দাজ করা যায় যখন মৃত ব্যক্তিটি হয় আমাদের প্রিয়জন? মৃত্যু কী তবে শেষ ঘুম নাকি এটি চূড়ান্ত জাগরণ?
অর্ধনিমীলিত চোখের ভেতর, মস্তিষ্কের ভেতর, অথবা শরীরের আরও সব গোপন গলি-ঘোঁজ জুড়ে কবে এক 'স্মৃতির ভোরবেলা' নির্মাণ হয়েছিল। হাসান ফিসফিস করেন: 'স্মৃতিকে কতটা পিছনে নেয়া যায়? নিশ্চয়ই চেতনার পিছনে নয়, আমার ধারণা, শুধুমাত্র চেতনাতেও স্মৃতি নেই, যদি থাকেও আধো অন্ধকারেই ডুবে থাকে, চেতনা-আত্মচেতনার মাঝখানে সান্ধ্য জায়গাটায় অনেকবার ফিরে যেতে চেয়েছি। সে যেন শুধু চাঁদের আলো নয়, স্বপ্নের চাঁদের আলো। কোনো কিছুই ঠিক মতো ঠাহর হয় না। তবু অস্তিত্বের মানে তো একটাই, তা হলো কোনো মানেই নেই তার, সারা জীবন মানুষের, কোনো না কোনো একটা অর্থ বুঝতেই কেটে যায়, সে বুঝতেও পারে না।'...
বাংলা ভাষাভাষী জনপদের সকল সম্মাননা এবং ভালবাসায় অভিসিক্ত হাসানও কী জীবন নামক মহাশয়কে বুঝতে বুঝতে কখনো-বা এমনইভাবে প্রশ্নকাতর হয়েছেন দর্শনের জ্ঞানতত্ত্ব, প্রমাণকাণ্ড প্রজ্ঞার অভিঘাতে?
হয়তো তখনই কানে কানে কথা হয় 'চোখ বন্ধ করো'... মৃত্যু অনেকটা ঘুমিয়ে পড়ার মতই। ২০০৫ এবং ২০১৫ রাষ্ট্রের গোপন-প্রকাশ্য অন্ধকার-ধর্মময় দলের গুপ্ত বাহিনী দ্বারা আদিষ্ট হয়ে দু-দুবার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হাসান এবার স্বেচ্ছায় চোখ বন্ধ করেন। এই অগোছালো দেশে হাসান বই দিয়ে পূর্ণ করে অনেকগুলো শেলফ গোছালো করেছিলেন একদা। অনেক দিন আগে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বর্ধমান থেকে ছিটকে পড়া হাসান বিবিধ ভ্রমণ সূত্রে হয়ে ছিলেন ক্রমবর্ধমান। যখন তিনি ছিলেন তরুণ, তখন তাঁর মাথায় অজস্র বাক্য-শব্দ জন্ম নিত ভালবাসার কাঙ্গাল হয়ে; তারপর প্রাচীন শব্দেরা হতো তাঁর হাতে প্রগাঢ় নতুন শব্দ, নতুন মৃত্যু শব্দ, নতুন রক্তশব্দ ও নতুন ভীতিশব্দ। বাক্য-শব্দ কুড়োতে কুড়োতে হাসান যেদিন ভাবলেন আমাদের বিপ্লবেরা আজ স্বপ্নহীন অথবা মুক্তির আকাক্সক্ষাহীন, তখনই তিনি ঘুমিয়ে পড়ার মতই গভীরভাবে চোখ বন্ধ করলেন স্বেচ্ছায়। শহরের, গ্রামের, আরও দূর প্রান্তের কতিপয় বংশীবাদক কানে কানে বলে, চোখ বন্ধ করো মৃত্যু অনেকটা ঘুমিয়ে পড়ার মতই!
এই ঘুম রাজ্য, যখন প্রাজ্ঞমৃত্যু হয়ে, আধোচেনা হয়ে নির্মাণ করে এক প্রয়াণ পটভূমি তখন অনন্ত দ্বন্দ্বে কণ্ঠস্বর বাষ্পরুদ্ধ হয় আর প্রাচীন সেই বোধিজুড়ে নির্মাণ হয় সপ্রতিভ আঘাত। ২০২১-এর ১৫ নভেম্বর রাত নয়টা পনেরো মিনিটে হাসান আজিজুল হক বিরচিত মৃত্যু উপাখ্যান এইভাবে অসমাপ্ত হয়। আমাদের দুর্বল চিত্র ভয় তাড়ানোর জন্য স্ত্রোত্র পাঠ করে মৃত্যু হয়তো অনেকটা ঘুমিয়ে পড়ার মতই, মৃত্যু রেখে যায় আমাদের আধোচেনা জীবন আর মৃত্যু-ঘুমের আগেই আমরা অনন্ত অভ্যস্তায় মৃত্যুকে মনে রাখতে শিখি নিরন্তর। এবার নিজেকে শোনাই: ঘুম ঘুম চোখের হাসান আমাদের স্মৃতিরাজ্যে প্রবেশ করছেন ক্রমশ, এর অর্থ তিনি একটি অবিনশ্বর সম্পদে রূপান্তরিত হচ্ছেন। ঘুম ঘুম চোখের হাসান নির্বাপিত হচ্ছেন, আর তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বয়ন হচ্ছে অনন্ত জাগরূক। আর কে না জানে, যাকে ভালোবাসা যায়, তিনি হন আমাদের রক্তমাংসেরই অংশ। হাসানের ঘুম-ঘুম মৃত্যু আমরা বলি এইভাবে নির্মাণ করে চূড়ান্ত এক জাগরণের পটভূমি।