ফেরি-কাহিনি
এককালে রচনা লিখতে হতো। এসএসসি বা এইচএসসি উভয় পরীক্ষাসহ স্কুলেও এর হাত থেকে মাফ পাওয়ার পথ ছিল না। ১৯৬০ বা ১৯৭০-এর দশকের কথা। বাংলা রচনার জন্য সে সময়ে নাইন-টেনের ছাত্রদের কাছে হরলাল রায়ের বইটি বিস্তর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ঘাটের আত্মকথা, ডাকপিয়নের আত্মকথা, যদি আমি যদি লক্ষপতি হইতাম, নৌকা ভ্রমণ, স্টিমার ভ্রমণ, জ্যোৎস্না রাতসহ নানা রচনা ছিল বইটিতে।
'সৃজনশীল' ছাত্র হতে ওই সব রচনা মুখস্থ করতে হতো। দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন-সহযোগে। 'কমন' পড়লে উগড়ে দাও। নম্বর কামাও। না হলে মাথা চাপড়াও! 'আমি যদি লক্ষপতি হইতাম—তাইলে কি করিতাম' তার বিবরণ দিয়েছিল আমাদের পরিচিত এক ছাত্র। মিহি, সুগন্ধি উত্তম চালের সের আট বা বারো আনার সে যুগে লক্ষ টাকার মালিক হওয়া মানে ধনকুবের বনে যাওয়া! সে কথা 'প্রসঙ্গ উল্লেখপূর্বক' ব্যাখ্যারও প্রয়োজন নেই আজকের দিনে!
ছাত্রটি লিখেছিল, 'লক্ষপতি হইলে বিশাল বাড়ি বানামু। চাঁদপুরের জেলখানার চেয়েও উঁচা দেয়াল দিয়া ঘিরিয়া দেবো বাড়িটি। ভীষণ মুরতির দৌবারিক (মেঘনাদ বধ থেকে টুকেছিল) রাখবো বাড়ির গেইটের দরজায়। থাকিবে সরাইলের কুত্তার চেয়ে মারাত্মক ডোবারম্যান পিনসার (মাসুদ রানা থেকে টোকা)। আর স্কুল বা শহরের পরিচিত কোনো ছাত্র-শিক্ষক যেন ঢুকতে না পারে, তাই এমত ব্যবস্থা। কারণ ইহারা সবাই অতীব অর্থহীন মানুষ। আমার অর্থ হইলে তাহারা ধার নেওয়ার জন্য ক্রমাগত ভিড় করিবে এবং ধার নিয়া আমাকে লক্ষপতি থেকে আবার হাজার বা শতপতি, ফইর তুইল্যা গলাছিলা মুরগির মতো এক্কেবারে পথের ফহির বানাইয়া দিবো! শ্যাষে আমাকে ফেরিঘাটে বসিয়া ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে অন্নের সংস্থান করিতে হইবে।'
হরলাল রায় বা সে সময়কার কোনো ইংরেজি বা বাংলা রচনা বইতে 'ফেরি ভ্রমণের' বর্ণনা ছিল না। রচনায় 'ফেরিঘাট' আমদানির উৎস কী ছিল—এখন ভাবলে অবাক হতে হয়। এমন 'সৃজনশীল' ছাত্র পরবর্তী জীবনে কী হয়েছিল, তা-ও জানা নেই।
ফেরিকে উপজীব্য করে প্রথম বাংলা উপন্যাস পড়েছিলাম, যত দূর মনে হয় তার নাম ছিল 'শ্রীমতি ক খ গ এবং' ঈদসংখ্যা চিত্রালীতে প্রকাশিত উপন্যাসটি নাকি খেলা রাম খেলে যা'র ধাঁচে লেখা হয়েছিল! ১৯৭২ বা ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত সে উপন্যাসের পুরো নাম বা লেখকের নাম পেটে আছে মনে আনতে পারছি না!
খুলনা যাওয়ার জন্য প্রথম বড় ফেরিতে উঠি। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে। এর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক পাড়ি দিতে গিয়ে প্রথম বড় ফেরিতে উঠেছি। এর ভেতর কাঁচপুর, মেঘনা এবং দাউদকান্দির ফেরি সবচেয়ে বড় ছিল। তবে আরিচা-দৌলতদিয়া ফেরির কাছে সেগুলো 'ডিঙ্গি নৌকা'। খুলনা যাওয়ার পথে পথে তখন গোয়ালন্দেও ফেরি ছিল। আম্মার গল্প করেছেন, স্টিমারে চাঁদপুর থেকে টাঙ্গাইলের (ঠিক কোথায় মনে নেই) ধলেশ্বরী যাওয়ার পথে গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে যেতেন। ঘাটে পানির বিশাল ঘূর্ণি ছিল। কিশোরী বয়সী আম্মা তাতে একটা পয়সা ফেলতেন। পয়সা ঘূর্ণিতে পড়ে তলিয়ে যাচ্ছে তা দেখতে খুব ভালো লাগত। গোয়ালন্দ ঘাটে আসলেই আম্মাকে নানা পানিতে ফেলার পয়সা দিতেন। আম্মার এ শখটা খুবই বিচিত্র মনে হতো। গোয়ালন্দ ঘাটের সে ঘূর্ণি দেখার একটা ইচ্ছা ছিল। তবে গোয়ালন্দ ঘাট দেখার সে সময়ে সেই ঘূর্ণির দেখা মিলল না। একইভাবে দেখিনি লাল কাপড় পড়া জাহাজঘাটের কুলি বহরকেও। এ কুলি বহর দেখেছি চাঁদপুর, নারায়ণগজ্ঞ এবং ঢাকার স্টিমারঘাটে।
গোয়ালন্দ ঘাট নিয়ে নানা লেখা পড়ে যে ভাব তৈরি হয়েছিল, তার সাথে বাস্তবের মিলের ছিল বড়ই অভাব। তবে তখনো গোয়ালন্দ নামে একটা ঘাট অন্তত ছিল। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী সেই গোয়ালন্দ ঘাট আর এখন নেই!
এর অনেক পরে আরিচা-নগরবাড়ি ফেরিতে চড়ি। রাজশাহী যাওয়ার জন্য। ফেরিতে এক ফকির একতারা বাজিয়ে গান শোনাচ্ছিল। 'মন আমার দেহ ঘড়ি' মনের ভেতর এখনো তার সুরটি রয়ে গেছে। ফেরির শ্রোতারা তাকে খুশি মনেই টাকা-পয়সা দিচ্ছিলেন। হানিফ সংকেতের গুরু ফজলে লোহানি তখনো টিভিতে আসি আসি করছেন। হয়তো সঠিকভাবে জানানো গেলে তার গান প্রচার হতো যদি কিছু মনে না করেন অনুষ্ঠানে।
ইহাকেই কহে ইন্ডিয়ান আম
১৯৯০ দশকের প্রথমদিকের ঘটনা। কালীগঞ্জ থেকে ফিরছি। ভারতীয় কিছু আম সস্তায় পেয়ে কিনি। দেখতে চমৎকার আমগুলো ভয়াবহ টক। পরে খেতে গিয়ে টের পাই। আমার মনে হয়, মাথার উকুন-নিক-পুইঞ্চাল বা দাঁতের পোকা ফেলতে ও আমের প্রয়োগ হতে পারে। হাতে ঝোলানো আম নিয়ে দৌলতদিয়া ঘাটের ফেরিতে ওঠার পথে জন্য ডাবল মার্চ করছিলাম। দুই পুলিশের ডাকে হল্ট করতে হলো আমাকে। তাদের চোখ আমের দিকে। এটি তখন নিষিদ্ধ পণ্য হিসেবে গণ্য। তাদের নজর দেখেই যা বোঝার বুঝলাম। পকেটে থেকে পত্রিকার কার্ডটা বের করে দিলাম। পদে এবং বয়সে সিনিয়র পুলিশ তখন সাথীকে বললেন, হ্যাঁ, দেখো ইহাকেই কহে ইন্ডিয়ান আম। ভালো করিয়া অবলোকন করো। এবং এর কয়েক সেকেন্ড পর কহিলেন, জি, আপনি যাইতে পারেন!
ঘাটের খাবার
১৯৯০-এর আরেক কাহিনি। সরকারি প্রকল্প মূল্যায়ন এবং পরিবীক্ষণের দায়িত্ব নিয়োজিত এক কর্মকর্তাকে নিয়ে ভ্রমণ করছি ওই পথে। সাতক্ষীরা অঞ্চলের কয়েকটা প্রকল্প দেখে ফিরছেন। দৌলতদিয়াতে ফেরি আসতে দেরি হচ্ছিল। উনি তখন ঘাটের খাবারের প্রশংসায় ফেটে পড়ছিলেন। অগত্যা বললাম, অসুবিধা নেই স্যার আপনি খেতে পারেন।
আপনি খাবেন না?
বাইরের খাবারের প্রতি বরাবর নিষেধাজ্ঞার খড়গ ঝুলিয়ে রেখেছেন আম্মা-আব্বা। সেরা খাবার মানে ঘরের খাবার—এ কথা মগজে স্থায়ীভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আজও সে বোধ থেকে বের হতে পারিনি। যতই দামি হোক রেস্তোরাঁ বা হোটেলের খাবার সহজে গিলতে চাই না। ভদ্রলোকের প্রশ্নের জবাবে বললাম, কলা ছাড়া আর কিছুই খাব না।
সে কী, আপনি খাইবেন না আমি খাইব, তা হয় না। বলার চেষ্টা করলেন। আমি আর একবার খেতে বলার পর তিনি বললেন, আপনি যখন অনুরোধ করছেন না করি কী করে!
তারপর বসে গেলেন ভোজে। বলা ভালো মহাভোজে। সমারসেট মমের দ্য লাঞ্চন গল্পটি যাদের পড়া আছে, তাদের কাছে ভদ্রলোকের অতি-আহার পর্বের বিস্তারিত বিবরণের দরকার নেই। ওর চেয়ে সরস বর্ণনা কেউ দিতে পারবেন না। পাঙাশ ও রুই মাছের কয়েকটা বড় পেটি, ইলিশের বড় বড় টুকরা, ডিম, বড় আকারের গলদা চিংড়ি মাছ, মুরগির আস্ত রান, ছোট মাছ সবই খাচ্ছেন। দুই-আড়াই প্লেট ভাত, দুই বাটি ডাল, সবজি খেয়ে বেজার মুখে বলছেন, এখন আর খাইতে পারি না। তা ছাড়া প্রজেক্টের কাজে বাইরে গেলে কখনোই খাই না! আজ খাচ্ছি, তা-ও আপনি বলার জন্যই! ভোজোৎসব চলাকালে মাঝখানে বিজ্ঞাপনবিরতি হিসেবে আস্ত একটা পরোটা আর গোশতও খেলেন 'খানিকটা।' শেষে ঘন দুধ, সর দেওয়া দুই কাপ চা পরপর 'পানান্তে' নানা মসলাসহযোগে বানানো ডাবল পান মুখে পুরলেন। হালকা চালে প্রায় রাগ প্রধান তালে ঢেকুর তুলতে তুলতে বললেন, আজ খুব মেপে খেলাম। ইচ্ছা থাকলেও বেশি খাওয়া হলো না। কেন হলো না, সে কারণ ব্যাখ্যা করলেন না। বেকুব আমি জানতে চাইলাম না।
ফেরিতে চড়ার পর উনি কচুর গল্প জুড়লেন। আসার পথে রাস্তার এক হাট থেকে বিশাল একটা কচু কিনেছিলাম। ভদ্রলোক কিনবেন কি না, জানতে চেয়েছিলাম। উনি জোর গলায় বলেছিলেন, না না, কিছুই কিনব না।
সে কথার অর্থ বুঝতে পারিনি। যাক কচুর গল্প ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে শুনতে শুনতে মনে হলো ওনাকে ভাগ দিতেই হবে। ওই বিশাল কচুর অর্ধেকটা দিলাম। কচু আমার অতি প্রিয়। অত বিশাল মানকচু খুবই কম দেখেছি ঢাকার বাজারে। তাই মন খারাপ লাগলেও দিলাম। ভদ্রলোক এবার বেজায় খুশি হয়ে বললেন, হ্যাঁ একেই বলে ইনসাফ—'দ্য ড্যানিয়েল কেইম টু জাস্টিস'! শেক্সপিয়ার সাহেব নিশ্চয়ই খুশিতে ডুগডুগি বাজিয়েছেন সেদিন! কিংবা হয়তো বলেছিলেন, হুররে খাই মুড়ি গুড়রে!
একবার পাবনা থেকে ফিরছি। নগরবাড়ি ফেরির মাইল দুয়েক বা তিনেক আগেই প্রচণ্ড যানজটে আটকে গেলাম। 'ব্যাপারেশন' বুঝতে বাস থেকে নেমে হণ্টন ধরলাম। মাইলখানেক হাটার পর কারণ বোঝা গেল। এক সেতুর ওপর গাড়ির ধাক্কায় মহিষ মরে গেছে। মরা মহিষ রাস্তা আটকে দিয়েছে। বাস বা গাড়ির পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মহিষের মালিককে খুঁজতে ব্যস্ত সবাই। ফলে মিনিটে মিনিটে বাড়ছে যানজট। হাঙ্গামা না করে মরা মহিষকে সেতুর ওপর থেকে ফেলে দিলেই রাস্তা পরিষ্কার! কিন্তু কথাটা কারও মাথায় ঢুকছে না। সবাই ব্যস্ত।
এবারে বাসের এক যাত্রী কথাটা তুললেন। নিজেই এগিয়ে এসে মহিষের ঠ্যাং ধরে টানতে লেগে গেলেন। সাথে সাথে আশেপাশের লোকজন তাকে বাধা দিল। 'করেন কী স্যার করেন কী—আমরা করছি। দাঁড়ান' কইতে কইতে স্থানীয় সাত-আটজন ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এক মিনিটেই মহিষের মরদেহ চলে গেল সেতুর তলের নদী বা খালে। রাস্তাও সাফ। গাড়ি-ঘোড়া চলতে শুরু করল!
জেনারেল প্যাটন ছায়াছবিতে এ জাতীয় একটা দৃশ্য আছে। সামরিক বহরের পথ আটকে দেয় এক বৃদ্ধের ঘোড়ার গাড়ি। ওটাকে নানাভাবে সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা হতে থাকে। আর পার হতে থাকে সময়। জেনারেল প্যাটন ঘটনাস্থলে পৌঁছেই নিজ সাইড আর্মস, পিস্তল দিয়ে ঘোড়াকে গুলি করে মারেন। তারপর বৃদ্ধের চোখের পানি ও অভিশাপের থোরাই পরোয়া করে ঘোড়ার লাশসহ গাড়ি পানিতে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। রাস্তা সাফ। বাস, সামরিক বহর আবার পথ চলতে শুরু করে!
আশির দশকের শেষের দিকের কথা। শাহজাদপুর যেতে হবে অফিসের জরুরি দরকার। পরিকল্পনা করলাম বাংলামোটর থেকে খুব ভোরে বাস ধরে আরিচা যাব। সে সময় আমাদের বাসা ছিল নয়াটোলার ভেতরে। সকালে বাস পেতে সময় লাগল। অবাক হলাম। এত দেরি সাধারণত হয় না। তা-ও পেলাম লাল বাস মানে বিআরটিসি। তখনো কাগজ বিক্রির দোকানগুলো খোলেনি। তাই ঘটনা টের পেলাম না। আরিচা পৌঁছে বুঝতে পারলাম আসল ঘটনা। বাস ধর্মঘটে গেছে। কেবল হাতে গোনা কিছু লালবাস চলছে। ভয়াবহ ভিড়। উল্লাপাড়া বা ওদিকে যাওয়ার বাসে ওঠা মুশকিল। নিজের বোকামির জন্য মাথা থাপড়াতে ইচ্ছা হলো। কী করি! অফিসের কাজটাও বেশ জরুরি। এ বাস সে বাসে ঢু মারছি। সুবিধা করতে পারছি না। সে সময় এক মাতব্বর গোছের চেহারার এক লোক এগিয়ে এসে জানতে চাইল—কই যাইবেন?
উল্লাপাড়া।
হ। সিট দিতে পারুম তবে বগুড়ার ভাড়া দিতে হইব।
দরকার হলে আমি পঞ্চগড়ের ভাড়াও কবুল করব। সেখান বগুড়া কোন ছার।
জি দিব।
দ্যান।
দিলাম। লোকটা আমাকে একটা লালবাসে নিয়ে উঠলেন। তারপর জানালার কাছে একটা আসনে বসিয়ে চলে গেলেন। বসলাম তো বটে লোকটার নামধাম-পরিচয় কিছুই বোকার মতো জানতে চাইলাম না। একটু পরেই গাড়ির ড্রাইভার কন্ট্রাক্টর এসে হাজির। আমি কি করে গাড়ির আসনে বসলাম, জানতে চাইল কন্ট্রাক্টর। ঘটনা বললাম। সে বলল, না ও লোককে চিনি না। আইচ্ছা বসেন ফেরি পার হই তারপর বোঝা যাইব।
আমার মাথায় বাড়ি। ফেরিতে ভিড়ের মধ্যে লোকটাকে দেখতে পেলাম। দৌড়ে কনট্রাক্টরকে খুঁজে বের করে দেখালাম। এবার কন্ট্রাক্টর ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে হাঁক দিল, বড় ওস্তাদে ওনারে বসাইয়া গ্যাছে।
দেখা গেল দুজনেই তাজিম করছে তখন আমাকে। বড় ওস্তাদ কে বা কী তার পরিচয়, সে সম্পর্কে কোনো কথার জবাব দিলেন না গাড়ির লোকগুলো।
বড় ওস্তাদ আমাকে বলেছিল, দেখেন ভাই আপনাকে দেইখ্যা আমার ভালো লাগছে। আমার এক ভাই আছিল আপনার মতো বড় বড় চুল-দাড়িওলা। আইজ টিকিট আপনারে যে দামে দিলাম, তার তিন গুণ দামে বিক্রি করতে পারতাম। কিন্তু তার সে ভাই এখন কোথায় বা কী করে, সে কথার জবাব সে দেননি আমাকে।
শরীরের দাম লাখ লাখ টাকা!
পাবনা যাচ্ছি। আশির দশকের মাঝামাঝির ঘটনা। ফেরিতে উঠে হতবাক। পুলিশ আর পুলিশ। পাহারায় দাঁড়িয়ে আছে। ক্যানটিনের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম—ঘটনা কী? সে জবাব দিল, পুলিশর বড় স্যার যাইব। তাই এত পাহারা। অমনি তেড়ে উঠল আরেক সহযাত্রী—ওই মিয়া কী কও? পুলিশের বড় স্যার মানে কি সব পুলিশই বড় স্যার।
ক্যানটিনের লোকটা সাথে সাথে কইল—হ, ঠিক কইছেন। পাশের এক টেবিল থেকে এক তরুণ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করলাম। চেনা চেনা মনে হয়। ভাবছি। তখনই এগিয়ে এল সে। ভাই আপনি কী করিম পাটোয়ারি ভাইদের ব্যাচ?
করিম আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিল। জি। জবাব দিলাম।
আপনি মূসা রেজা ভাই না?
জি।
আমি রিন্টু। আপনাদের তিন ব্যাচ জুনিয়র।
এতক্ষণে বুঝলাম কেন পরিচিত মনে হচ্ছিল তরুণের চেহারা এবং কেন সে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।
ছেলেটি তুখোড় সাঁতারু ছিল। বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, এমনকি জাতীয় পর্যায়েও প্রতিযোগিতা করে ভালো করেছে। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে নিরাপত্তা বিভাগে কাজ করেছে। এখন দেশে ফিরেছে। শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। আমরা কথা বলার সময়ে আগে পিছে পুলিশ প্রহরায় এক দম্পতি ঢুকলেন ক্যান্টিনে। তাদের বসার জায়গা আগেই ঠিক করে রাখা ছিল। পুলিশের শীর্ষ বা শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তার কন্যা ও জামাতা। এ কথা ফিসফিস করে জানালেন এক ব্যক্তি।
এ দুইজনের শরীরের দাম লাখ লাখ টাকা। সাঁতারের সাবেক চ্যাম্পিয়ন ফিস ফিস করে বলল।
মানে?
উহ! হোটেলে নিরাপত্তা বিভাগে কাজ করেছি। অতিথিদের পোশাক বা দামি গহনা দেখে বাড়তি নিরাপত্তাকর্মীদের দায়িত্ব ঠিক করতে হতো। আপনি বুঝতে পারছেন। ভদ্রলোকের পায়ে খাঁটি কুমিরের চামড়ার জুতা। হাতে ঘড়ি, আঙুলের হিরের আংটি, জামার কাপলিং, টাই ক্লিপ, ভদ্রমহিলার ভ্যানিটি ব্যাগ, বালা, গলার গহনা, হাতের আংটি সবই নামকরা ব্র্যান্ডের। ওগুলোর কথাই কইছি।
ফেরিঘাটের 'মানুষেরা'
ফেরি, লঞ্চ বা স্টিমারঘাট, রেলস্টেশন বা বাস টার্মিনাল ভালো মানুষদের জায়গা নয়। সাধারণভাবে মনে করা হয় ধান্ধাবাজ, মতলববাজ, জালিয়াত প্রজাতি থাকে এসব জায়গায়, মানুষ থাকে না! যাত্রীদের ঘাড় ভাঙতে হাজার মতলব আটে এসব প্রজাতি। কথাটা অসত্য বলা যাবে না। একবার চৈত্র মাসে নগরবাড়ি ঘাট পাড় হচ্ছি। ভাঙা বাসে যাচ্ছিলাম পাবনা। ফেরি থেকে নেমে ছুটছি বাসের খোঁজে। রোদের তাপের চেয়ে বালুর গরমে অবস্থা কাহিল! নদী ভাঙার কারণে ঘাট সরে গেছে। ফলে অনেক রাস্তা ছুটতে ছুটতে হাঁটতে হচ্ছে। একসময়ে মনে হলো তাপে-ঘামে দম ফুরিয়ে ফুস! ১১ নম্বর চালানো বা হাঁটা আর আমার কর্ম নয়। রিকশার সাথে মুলামুলি করছিলাম। ১০ টাকার কমে রাজি নয় রিকশাওলা। সে সময় পাশের এক দোকানদার নিজেই বললেন, স্যার, দুই পা হাঁটলেই বাস পাইবেন। রিকশা নেওয়ার দরকারই নাই স্যার। সত্যি তাই দোকানটা ঘুরতেই দেখি সারি সারি বাস। শুধু আমাকে নয় অন্য যাত্রীদেরও একইভাবে সতর্ক করছেন ওই দোকানদার।
১৯৮০-এর দশকের শেষ থেকে একটা সময়ে পিজির হোস্টেলে আড্ডা দিয়েছি। ন্যাংটাকালের বন্ধু হজরত আলী সে সময়ে অফথ্যালমলজিতে এফসিপিএস করছে। তার সুবাদেই যাতায়াতের শুরু। হজরত আলীর সূত্র ধরেই আলাপ হয় ড. ইসমাইল পাটোয়ারি, ড. আবদুল জলিল, ড. মেজর বাহার, ড. সালামসহ আরও অনেক চিকিৎসকের সাথে। এফসিপিএস পাসের জন্য যে কষ্ট করতে হয়, তা দেখে মনে হয়েছে আসামিদের যাবজ্জীবন বা ফাঁসি দেওয়ার বদলে এখানে পড়তে পাঠানো উচিত! গোসল করতে করতে বা প্রাকৃতিক ছোট বড় কাজ করার ফাঁকে একে অন্যকে অবিরাম প্রশ্ন করে চলেছে। নিজ বিষয়ের ওপর দখল পরীক্ষা চলছে খাওয়ার ঘরে বা 'আড্ডা'র ফাঁকে। সত্যি কথা হলো, এফসিপিএস পরীক্ষা যুদ্ধে যারা নামেন, তাদের আড্ডা দেওয়ার কোনো সময় থাকে না।
সে সময় পাটোয়ারিদের ঘরে মাঝে মাঝে এক পিচ্চিকে দেখতাম। 'মায়ে খেদানো, বাপে তাড়ানো' এসব পিচ্চির গালভরা নাম টোকাই। কার্টুন শিল্পীর জোরে এ নাম তখন মুখে মুখে ফিরছে। আর রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে 'পথকলি' নামকে জনপ্রিয় করার কসরত চলছে তখন। 'পিচ্চি', 'টোকাই' বা (অধুনা প্রায় লুপ্ত) 'পথকলি' যাই কই না কেন তাদের যন্ত্রণা কমে না। কেউ এদের সাথে মানবিক আচরণ করেন না। এদের বরাত অহরহ সমৃদ্ধ হয় 'দূর দূর ছাই ছাই' আচরণে। তবে পিজি হোস্টেলের পিচ্চির সাথে খুবই মানবিক আচরণ করত পাটোয়ারি ও তার ডাক্তার বন্ধুরা। ছিটেফোঁটা কাজের বদলে উদার হাতে খাওয়াত। খাবার নিয়ে যেতে দিত। নগদ পয়সাকড়িও দিত। ধমকের সুরে আদর করত। যেমন বলতে শুনেছি, অ্যাই এখনো নাশতা খাস নাই ক্যান? দশ মিনিটের মধ্যে নাশতা খাইয়্যা নে, নাইলে ৬ তলার জানালা দিয়া কিন্তু...' কিংবা বলতে শুনছি, 'অ্যাই ঘাসখোর তোরে কইছি চাইরটা বিস্কুট খাইতে তুই দুইডা খাইলি ক্যান, কি মায়ের জন্য নিয়া যাইবি? শুকনা ছাগল, ওই প্যাকেটের বিস্কুট কি আমরা খামু? ওইগুলো তোর।'
এমন ধমকে পিচ্চিদের হাসতে দেখছি। ডাক্তারের 'বিস্কুট' দিয়ে আমার 'উদার' হতে আপত্তির কী থাকতে পারে! তাই পিচ্চিদের 'খাওয়ানোর' বিষয়ে আমিও ছিলাম অতিশয় উদার।
১৯৯৩ বা ৯৪ সালের কথা। নগরবাড়ির ফেরিতে উঠেছি। শাহজাদপুর যাচ্ছি। আগের রাতে শরীর সুবিধার ছিল না। প্রায় খালি পেটে ঘুমিয়েছি। সকালে নাশতাও খেতে পারেনি। ফেরিতে চাপার পর ক্ষুধার রাজ্য এসে ভর করল। ফেরির চূড়ায় গেলাম। খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা হয় সেখানেই। ঢুকতেই এক কিশোর বয়সী পিচ্চি সালাম দিল বেশ জোরেই। চিনছেন স্যার। আমি শক্তিহীন স্মৃতির মানুষ আজীবন। বিনা দ্বিধায় না সূচক মাথা নাড়লাম। স্যার পিজিতে পাটোয়ারি স্যারদের ওইখানে দেখছেন।
ও। নিরাসক্তভাবেই জবাব দিলাম। কী খাব জানতে চাইল। খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই দেখি পিচ্চি গায়েব। দাম মেটাতে গেলাম। ম্যানেজার উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, স্যার দাম নিতে পারুম না। আপুনি যখন সিঁড়ি দিয়া উঠতাছেন, তখন আমার ওই পোলাডা আমারে কইল, পিজির ভালো মানুষের একজন আইতাছেন। উনি খাইলে দাম নিয়েন না। আল্লার কসম লাগে দাম নিবেন না। আমি ওই পোলাডার মতো ভালো কামের লোক দেখি নাই। ওরে কথা দিছি দাম নিমু না। স্যার আমারে মাফ কইরেন, আপনার কাছ থেকে পয়সা নিতে পারুম না।
ভাইরে আমি না, ভালো মানুষ ওই ডাক্তাররা। তাগো তহবিল দিয়ে আমি একটু ভালোগিরি ফলাইছি। এ কথা বললাম বহুবার। কিন্তু ফল হলো না। আর পিচ্চিকেও পেলাম না কাছেপিছে। কেবল মনে হলো আমি হঠাৎ করে লিলিপুটের চেয়ে ছোট বা ক্ষুদ্রাদি ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছি। পিচ্চিটা বাড়ছে হু হু করে। গ্যালিভারকেও অতিক্রম করছে তার 'বড়ত্ব।' ভাবাভাবি যাই হোক, কোনোভাবেই খাবারের দাম দিতে পারি নাই সেদিন।
নগরবাড়িতে নামার সময় দেখলাম ওপর থেকে হাসি মুখে হাত নাড়ছে পিচ্চিটা।
ফেরি ধুলাবালির জায়গা। মুক্ত হাতে ধোঁয়া বিলাতে বিলাতে হুংকার দিয়ে নেমে যায় বাস বা ট্রাক। ধুলা বা ধোঁয়ার সোহাগে হয়তো জ্বলছিল দুই চোখই। কাজের সময় পাওয়া যায় না যে জিনিস, সেটাই হলো প্রয়োজনীয়। সব সময়ই রুমাল থাকে পকেটে। সেদিনই প্রয়োজনের সময় পাচ্ছিলাম না। চোখ মুছছিলাম শার্টের আস্তিনেই। ফেরি থেকে নেমে টের পেলাম রুমালটা রয়েছে আমার শার্টের বুকপকেটে। কখনো ওখানে রুমাল রাখি না।