ওয়েবকে দেবে মেরে!
অ-তে 'অজগর' ওই আসছে তেড়ে
ওয়েব টেলিস্কোপকে দেবে মেরে!
চমকে উঠলেন! অজগরের মতো শান্ত সাপ মহাকাশ-দুরবিনকে মেরে দেবে কীভাবে! গাঁজার নৌকা পাহাড় দিয়ে যায়। কিন্তু না, আর কিন্তু কিন্তু করার দরকার নেই। নজর টানার জন্যই এমনটা করা হয়েছে। 'অজগর' নয় ওটা হবে গ্রহাণু। গ্রহাণু বললেই মহাজাগতিক অতিকায় প্রস্তরখণ্ডের ছবি ভেসে ওঠে মনে। সে রকম বিশাল গ্রহাণু আঘাত হানলে মহাকাশ দুরবিনটি সমূলে 'নাই' হয়ে যেত। দুরবিনে আঘাত করেছে গ্রহাণু নয়, নুড়ি, মহাজাগতিক নুড়ি। মেরে দেবে না এরই মধ্যে মেরেও দিয়েছে।
এতে ক্ষতিও হয়েছে। ১৯টি ষড়ভুজ স্বর্ণ-দর্পণের একটির ক্ষতি হয়েছে এই নুড়ির আঘাতে। সি৩ অংশের আয়না দেবে গেছে খানিকটা। তবে আশার কথা হলো, ক্ষতি যাই হোক তাতে জেমস ওয়েব মহাকাশ দুরবিন সংক্ষেপে জেডব্লিউএসটির সামগ্রিক কার্যক্ষমতার মোটেও ক্ষতি হয়নি। অন্তত এখনো এ দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা।
মহাকাশযাত্রার আগে যে আন্দাজ করা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ওয়েবের। সে অনুমানকে ছাড়িয়ে গেছে ক্ষতির পরিমাণ। ওয়েবের জীবনে মহাকাশের ইট-পাটকেল অর্থাৎ শিলার আঘাতে ক্ষতির প্রভাব কতটা দাঁড়াবে, সে বিষয়ে নাসা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি।
জেমস ওয়েব মহাকাশ দুরবিনের প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয় ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে। স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের এক কর্মশালায় এ পরিকল্পনা করা হয়। হাবল মহাকাশ দুরবিন (এইচএসটি) পাঠানোর আগেই তার উত্তরসূরির বিষয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ওয়েবের পরিকল্পনা করেন। দুই দশকের বেশি সময় ধরে এ দুরবিন নির্মাণে একযোগে কাজ করেছে নাসা, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা বা ইএসএ, কানাডীয় মহাকাশ সংস্থা বা সিএসএ। ২০০৪ সালের মার্চে ওয়েবের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিলম্ব ও বাজেটবহির্ভূত খরচের অভিযোগে ২০১১-তে এসে ওয়েব নির্মাণ বন্ধ করার হুমকি দেয় মার্কিন কংগ্রেস। এ সত্ত্বেও কাজ বন্ধ করেননি বিজ্ঞানীরা। ২০১৬-তে এর কাজ শেষ হয়।
এরপর শুরু হয় ওয়েবের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পালা। ওয়েবকে যেখানে বসানো হবে, সেখানকার তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে। অর্থাৎ মাইনাস ২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মহাশূন্যের সেই প্রচণ্ড শীতল এবং বিরান মণ্ডলে ওয়েব যেন কাজ করতে পারে, সে জন্যেই কঠোর সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে।
এইচএসটির আয়নার ব্যাস ২.৪ মিটার আর ওয়েবের হলো সাড়ে ৬ মিটার। ওয়েবের আয়না তৈরি হয়েছে বেরিলিয়াম দিয়ে। ইস্পাতের চেয়ে ৬ গুণ শক্তিশালী এ ধাতুর ঘনত্ব অ্যালুমিনিয়ামের এক-তৃতীয়াংশ। দুরবিনটির নামকরণ করা হয় নাসার ১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত প্রশাসকের দায়িত্ব পালনকারী জেমস ই ওয়েবের নামে। তার দায়িত্ব পালনের সময়ে নাসার মারকারি, জেমিনি এবং অ্যাপোলো কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়। ২০০২ সালে ঘোষণা করা হয় যে নাসার পরবর্তী মহাকাশ দুরবিনের নাম রাখা হবে জেমস ওয়েব মহাকাশ দুরবিন। এ ঘোষণা দেন নাসার তৎকালীন প্রশাসক সিন ওকিফ। এ নামকরণ নিয়ে বেশ তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। কোনো মহাকাশচারীর নামে দুরবিনের নামকরণ করা হবে অনেকেই ভেবেছিলেন। এ ছাড়া সমকামীদের মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বহিষ্কার করার ঘটনায় ওয়েবের ভূমিকা নিয়ে এ বিতর্কের সূচনা। তখন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি ছিলেন ওয়েব। বিতর্কের রেশ এখনো পুরোপুরি থেমে যায়নি। ওয়েবের পাঠানো প্রথম ছবি উন্মোচনের সময় নাসার মুখপাত্র বলেন, মার্কিন মহাকাশ সংস্থার ইতিহাসবিদেরা মি. ওয়েবের ইতিহাস আরও খতিয়ে দেখবেন।
মে মাসের ২২ থেকে ২৪ তারিখে বাংলাদেশ সময় সকাল ৪টা ২০-এর মধ্যেই আঘাত হানা হয় ওয়েব দুরবিনে। এ ক্ষতি নিয়ে দ্বিতীয় কথাটি নিরাশার। কথাটি হলো, এ ক্ষতি সারানোর কোনো উপায় নেই। সোজা কথায় অপূরণীয় ক্ষতি।
আগে জানি না রে দয়াল
পীরিতের জ্বালা সম্পর্কে আগেভাগে ঠাহর না-ও করতে পারেন কেউ কেউ। তাতে দোষের কিছু নেই। পীরিতের দুনিয়া হলো ভাবের জগৎ। সেখানে অঙ্ক কষে আগেভাগে পথ তৈরি করা যায় না। কিন্তু মহাকাশ অভিযান মানে হিসাব কষে কষে চলা। তাহলে যে প্রশ্ন ওঠে, ওয়েব দুরবিনে তেড়ে আসা খুদে গ্রহাণু বা উল্কা নুড়ির আঘাত করতে পারে, সে হিসাব কী বিজ্ঞানীরা আগে করে উঠতে পারেননি?
এ বিষয়টা তারা আগেভাগেই ঠাহর করতে পেরেছেন। তবে এখানে বিজ্ঞানীদের 'জেনে শুনে বিষ পানের' নীতি মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো কক্ষপথ ছিল না। কথায় বলে, বাঁধিয়া মারিলে সয় ভালো। এখানেও ঘটেছে তাই।
নাসার সায়েন্স মিশন ডিরেক্টরেটের সহযোগী প্রশাসক ড. টমাস জুরবুচেন বলেন, মহাকাশে তৎপরতা চালাতে গেলে খুদে গ্রহাণু বা উল্কা নুড়ির আঘাত এড়াবার কোনো পন্থাই নেই। এমন আঘাতের পরও ওয়েব দুরবিন কাজ করছে। অভিযান চালানোর জন্য ন্যূনতম যে পর্যায়ে কাজ করার প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি মাত্রাই কাজ করছে ওয়েব।
আরও জানা গেছে, ওই নুড়িই কেবল ওয়েব দুরবিনে আঘাত করেনি। বরং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ওটাসহ আরো ১৯টি মহাজাগতিক নুড়ির আঘাত সইতে হয়েছে ওয়েবকে।
হাবল মহাকাশ দুরবিনকে ঢেকে রাখার ব্যবস্থা আছে। তেমন কিছু নেই ওয়েবে। একদম খোলামেলা অবস্থায় কাজ করছে ওটা। মানুষের মহাকাশে যাতায়াতের কক্ষপথের কাছাকাছি হাবলের অবস্থান। মহাকাশ খেয়াযান বা স্পেস শাটলের নভোচারীরা অনায়াস হাবলের কাছে যেতে পারেন। রক্ষণাবেক্ষণের কাজও সামাল দিতে পারেন তারা।
অন্যদিকে ওয়েব দুরবিন রয়েছে সংক্ষেপে এল টু নামে পরিচিত মহাকাশের লা গ্র্যানজ পয়েন্টে। মহাকাশের এদিকে হাতে গোনা মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে। উল্কা নুড়ির প্রকোপ কতটা এ অঞ্চলে, সে সম্পর্কে তেমন বিশেষ জ্ঞান নেই বিজ্ঞানীদের।
মহাকাশে তেড়ে আসা গ্রহাণু বা খুদে উল্কার আঘাত সইতে হয়েছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র বা আইএসএসকে। সইতে হয়েছে হাবল মহাকাশ দুরবিনকেও। তবে এসবই হলো মানুষের মহাকাশের যাতায়াতে কক্ষপথে। ক্ষতি হয়েছেÑ'কুচ পরোয়া নাই'। মেরামত করা যাবে।
ওয়েব মহাকাশ দুরবিন বসানো হয়েছে পৃথিবী থেকে পাক্কা ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে। মেরামত করার ইচ্ছা থাকলেও আপাতত কোনো উপায়ই নেই। এ পথের দূরত্ব বিষয়টি তুলে ধরতে গেলে ওয়েবের ভ্রমণসূচি তুলে ধরলেই হবে। গত বছরের শেষ দিকে ফরাসি গিনি থেকে যাত্রা শুরু করে ওয়েব। পূর্বপরিকল্পিত আজকের স্থানটিতে পৌঁছায় চলতি বছরের গোড়ার দিকে।
সোনা সোনা সোনা
বিয়ে করতে চলছেন তাদের বলছি, কনেপক্ষকে যদি বলে থাকেন ওয়েব দুরবিনের যে পরিমাণ সোনা ব্যবহার হয়েছে, সে পরিমাণ সোনা দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে আসব আপনাদের কন্যাকে। তাহলে? কনে এবং কনের বান্ধবীরা মোটেও ফুর্তিতে ধেই ধেই করে নেচে উঠবেন না। গুগলে তালাশ করলেই বের হয়ে আসবে, ৪৮ গ্রাম সোনা ব্যবহার হয়েছে ওয়েবে। আন্তর্জাতিক মাপে ১ ভরিতে হচ্ছে ১১ দশমিক ৬৬ গ্রাম। তা হলে ৪৮ গ্রামে পাচ্ছেন ৪.১৩ ভরি প্রায়। এখন ওই পরিমাণ সোনা দিয়ে গলা-কান ও হাতের মাঝারি মাপের গয়নাই টেনেটুনে হবে কেবল। জানাল আমার গিন্নি।
এককালে রুপার প্রলেপ দিয়ে আয়না তৈরি হতো। সে যুগের আয়না নিয়ে কৌতুক শুনিয়েছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। এক রাব্বি গেছেন তার শিষ্যের বাড়ি। বড়ই কৃপণ শিষ্য উপযুক্তভাবে গুরুকে সেবা করবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাই প্রথমেই সে স্বভাব দূর করতে শিষ্যকে গুরু নিয়ে গেলেন জানালার পাশে। রাস্তায় চলমান জনস্রোতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে গুরু জানতে চাইলেন, বাইরে কী দেখছ বৎস্য? শিষ্য বললেন, মানুষ। এবারে তাকে রুপার প্রলেপ দেওয়া আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করলেন, দর্পণে কী হেরিছ বৎস্য? শিষ্য কইলেন, আমাকে।
গুরু হতাশ গলায় কইলেন, বাবারে কয়েক টাকার রুপার প্রলেপ দেওয়া আয়নাতে আর মানুষ দেখতে পেলে না!
তাহলে সোনার প্রলেপ দেওয়া ওয়েব দুরবিনের আয়নার সামনে দাঁড়ালে কী দেখতে পেতেন এ শিষ্য? সে প্রশ্নের জবাব ভাবীকালের 'মুজতবা আলীর' জন্যই তোলা থাক।
তার বদলে আমরা বরং দেখি ওয়েব দুরবিনের দর্পণে কেন দেওয়া হলো সোনার প্রলেপ? অবলোহিত রশ্মি উচ্চ হারে প্রতিফলন ঘটনার সক্ষমতা আছে সোনার। এতে ঠান্ডা থাকবে ওয়েব। অন্যদিকে সহজে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নেয় না এ ধাতু। এ কারণেই মহাকাশ দুরবিনের জন্য উত্তম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে সোনা।
চিন্তাসূত্রে ভর করে এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, পৃথিবীর কাছাকাছি মহাকাশের কক্ষপথে ছেয়ে গেছে মানুষের পাঠানো কৃত্রিম উপগ্রহে। এসব কৃত্রিম উপগ্রহে এ পর্যন্ত যে সোনা ব্যবহার করা হয়েছে, তার পরিমাণ কত হবে জানেন? ৭৬ কেজি!
স্পেসস্যুটেও সোনা ব্যবহার হয়। সে কথাও অনেকেই জানেন। 'ভাইজর' বা 'শিরস্ত্রাণের' চোখের অংশে সোনার প্রলেপ দেওয়া হয়। এখানে অবলোহিত রশ্মিকে ঠেকাতে মানে বিকিরণ ঘটাতে সাহায্য করে সোনা। অন্যদিকে দৃষ্টিগ্রাহ্য আলো সহজে ঢোকার পথে বাধা সৃষ্টি করে না।
জেমস ওয়েব মহাকাশ দুরবিনের প্রস্তাবিত ব্যয় ছিল ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা পাঠাতে ব্যয় গিয়ে ঠেকেছে ১০ বিলিয়ন বা ১০০০ কোটি ডলারে। তাহলে আপনিও বলতে পারবেন, প্রকল্প ব্যয় কেবল বাংলাদেশেই দফায় দফায় বাড়ে না! বাড়ে মহাকাশ দুরবিনের বেলাও! দেবতার লীলাকে আমাদের বেলায় ব্যভিচার বলে গণ্য করা হবে কেন, এমন প্রশ্নও আপনি করতে পারেন।
ওয়েব বানানো এবং পাঠানোর টাকার এ অঙ্ককে আমাদের কাছে সুবিশাল মনে হলেও আমেরিকার মোট বাজেটের তুলনায় নেহাতই নস্যি। নাসার বিজ্ঞানীদের খুবই টানাপোড়নের মধ্যে কাজ করতে হয়, সে তথ্য জানেন অনেকেই।
অতীতের ছবি
জেমস ওয়েব মহাকাশ দুরবিনে কোটি কোটি বছর আগের মহাজগতের ছবি তুলেছে এ খবর শুনে উতলা হয়ে নাসিফার সাথে দেখা করতে এলেন পাশের বাড়ির ভাবি। আমেরিকার একটা নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে নাসিফা। আসার আগে ভাবি তাকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দিয়েছে, বোনরে তোর সাথে খুবই দরকারি কথা আছে। আমি আসতাছি।
নাসিফা অবাক। কী এমন দরকারি কথা থাকতে পারে।
নাসিফার ঘরে ঢুকে প্রথমে দরজার বন্ধ করে দিলেন ভাবি। তারপর ফিসফিস করে বললেন, আরে নাসিফা কি যেন 'ওয়াইফ' দুরবিন আকাশে বসাইছে আমেরিকা; ওইটা দিয়া নাকি কোটি কোটি বছর আগের ছবি তোলা যায়?
ওয়াইফ না ভাবি ওয়েব। জেমস ওয়েব।
বাদ দে ওইগুলো জাইন্যা কাজ কী। যাহাই ওয়াইফ তাহাই ওয়েব। হ্যাঁ, তুই তো আমেরিকায় স্টাডি করস, 'ইংরাজি' ভালো জানোস, বাংলা কইতেও আটকায় না। আমারে একটা চিঠি ভালোভাবে লেইখ্যা দে ওই নাসাওলাদের কাছে। তোর ভাইয়ের স্বভাব-চরিত্র সুবিধার মনে হইতেছে না আইজকাল। তার একটা অতীতের ছবি তুইল্যা দিলে বুঝতে পারুম কাগো সাথে ঢলাঢলি করেছে! দে না রে, তুই আমার মায়ের পেটের বোনই প্রায়। কাইন্দা-কাইট্টা লিখলে নাসাওলাদের মন গলবরে।