দারোগা ও ‘রায় মহাশয়’
'দারোগা' ভিনদেশি এ শব্দ বাংলা ভাষায় দাপটের সাথেই রাজত্ব করছে। এ শব্দ কেবল পুলিশের পদবি নয়। বরং সম্মান, ক্ষমতা এবং মেজাজের প্রতীক হয়ে বহুকাল ধরেই বহাল তবিয়তে বাংলা ভাষা জুড়ে রয়েছে। গ্রাম্য বৃদ্ধ নারী সুবিচারে খুশি হয়ে মন খুলে দোয়া করছেন—বাবা, আল্লা তোমারে এরপর যেন দারোগা বানাইয়া দ্যান! এ গল্প সবাই জানি।
কিংবা মেজাজি মানুষকে বলা হয় দারোগা, কখনো কখনো মিলিটারির মেজাজ! গেঁয়ো ছড়াও আছে, কালুর বউ দারোগা/ডিম পেড়েছে বারোটা/কালুর সাথে রাগ করে/ডিম নিয়েছে ভাগ করে! এ ছড়া থেকে কারোই বুঝতে অসুবিধা হয় না কোনো এক কালুর স্ত্রী রত্নটি বড়ই মেজাজি। দাম্পত্য কলহের একপর্যায়ে তিনি বারো সন্তানকে ভাগ করে নিয়েছেন। তারপর তিনি কি স্বামীর গৃহে ছিলেন নাকি পিতৃালয়ের পথে পা বাড়িয়েছেন; নাকি দুই চোখ যে দিকে যায়, চলে যান! জানা নেই।
সিনেমায় সচরাচর দেখতে পাই, ঘটনা শেষে উদয় ঘটে পুলিশের। আর অনেক জায়গায়ই দেখানো হয় পুলিশ জাল টাকার মতোই পুরাই অচল। কিন্তু খুনি, দাগী অপরাধী বা জালিয়াতরা টাকশাল থেকে বের হয়ে আসা নতুন ঝকঝকে পাত্তির মতোই রীতিমতো সচল। বুদ্ধির কিংবা কুবুদ্ধির টেউ খেলছে তাদের মধ্যে। এত কিছুর পরও সার সত্যি কথাটা হলো, এখনো পুলিশ জেগে আছে বলেই সাধারণ মানুষ ঘুমাতে পারে নিরাপদে।
পুলিশকে বুদ্ধি কম হিসেবে উপস্থাপন মোটেও বাস্তব নয়। এ কথা আজ অনেকেই জানেন, বাংলা ভাষায় অপরাধকে কেন্দ্র করে কাহিনি লেখার সূচনা করেন দারোগা। সে লেখায় কেবল তার চাকরিজীবন থেকে নেওয়া কাহিনি শোনাননি। বরং তাতে 'শালর্ক হোমসগিরির' নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। অপরাধীর চতুরতা ধরতে তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন, নজর রাখছেন অকুস্থলের মানুষজনের ওপর, ছোটখাটো সূত্রও তার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে না। তারপর হ্যাঁ, সত্য প্রকাশিত হচ্ছে। ধরা পড়ছে মূল আসামি। আর এসবই ঘটছে কোনান ডোয়েল বা শরদিন্দুর লেখা প্রকাশের অনেকে আগেই। বরং বলা যায় হয়তো এর মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষায় অপরাধ কাহিনি রচনার ধারা প্রবাহিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় অপরাধ কাহিনি সৃষ্টির অন্যতম ভাগীরথ বাঁকাউল্লা নামের সে দারোগার ইতিহাস অষ্পষ্ট। এ নিয়ে অনেক কথা বা গবেষণা হয়েছে। বাঁকাউল্লা যে কাহিনি লিখেছেন, তা-ও অশেষ নয়। বরং মাত্র ১২টি মাত্র। তাতেই তিনি মাতিয়ে ফেলেছেন পাঠককে।
সেকালের সমাজব্যবস্থার অন্যতম চালচিত্র হয়ে উঠেছিল বাঁকাউল্লার দফতরের অন্যতম কাহিনি 'রায় মহাশয়'। এ কাহিনির উপ-শিরোনামে বলা হয়েছে, 'ভীষণ ষড়যন্ত্র—দলাদলির কাণ্ড'।
কাহিনিটি এখানে নিজ ভাষায় উপস্থাপন করছি। এ কাহিনির সূত্রপাত হয় অস্পষ্ট দাস নামে লেখা একটি উড়োচিঠির মাধ্যমে। চিঠিটি পুলিশের বড় সাহেবের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে অভিযোগ করা হয়েছে, কোনো এক জেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের জমিদার রামতারণ বাবুর বিধবা বোন সৌদামিনী গর্ভপাত করেছেন। রামতারণ বাবু নিজেই তার বিশ্বাসী ভৃত্য শ্রীদাম ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে সেই 'সাতমেসে' গর্ভভ্রƒন অন্দরের পুকুরপাড়ে তেঁতুলতলায় মাটিচাপা দিয়েছেন। এদিকে বিধবা সৌদামিনী যে গর্ভবতী হয়েছে, তাহারও সাক্ষী আছে। জমিদার বাবুর আদেশে অন্দরপুকুরে পরিবারের খাবার মাছ ধরতে গিয়ে দুই জেলে সৌদামিনীকে গোসল করার সময় দেখেছে। তাদের কথামতো 'জেলেরা সৌদামিনীকে পূর্ণগর্ভা' দেখেছে। এদিকে প্রসবকাজে সহায়তার জন্য জমিদার বাড়ির বাঁধা দাই কাওরা হরিশের স্ত্রীকে ডাকা হয়নি। ডাকা হয় তারাপুরের রূপচাঁদ হাড়ির স্ত্রীকে। এ ছাড়া জন্মের পর শিশুটি একবার কেঁদেও উঠেছিল এবং সে কান্নাও শুনতে পেয়েছে দ্বারিক চৌকিদার। চিঠির শেষে বলা হয়েছে, 'পুলিশ তদন্তে আসিলে সকলই বিদিত হইবেন।'
উড়োচিঠির বক্তব্য বিশ্বাস করেন পুলিশের বড় সাহেব। তিনি মনে করেন, এ ধরনের কলঙ্কজনক বিষয় গোপন করা জমিদারদের পক্ষে অসম্ভব নয়। তিনি এ ঘটনার তদন্তের ভার দেন বাঁকাউল্লার ওপর।
অন্তঃপুরবাসী জমিদারের বোনের বিরুদ্ধে তদন্ত কী করে চালাবেন—সেটাই বাঁকাউল্লার প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। 'জমিদার-লোকেরা অসীম ক্ষমতাপন্ন; একটু এদিক ওদিক হইলে, নিজের দেহেরও আশঙ্কা আছে। ঘটেও এমন। যেমন ভয়, তেমনি ভাবনা।' এই ভয়-ভাবনাকে সঙ্গী করেই কৃষ্ণপুরের পথে রওনা হলেন দারোগা বাঁকাউল্লা।
নিজ অভিজ্ঞতায় বাঁকাউল্লা জানেন, এসব ক্ষেত্রে বিত্তশালীরা অভাগিনীদের নৌকায় করে গয়া কাশী পাঠিয়ে দেন। সেখানে রামতারণ বাবু কেন এ কলঙ্কের ডালি মাথায় নিলেন? এটাই তার প্রথম চিন্তার বিষয় হয়ে উঠল।
কৃষ্ণপুরের জমিদার বাড়িতে পৌঁছে স্থানীয় দারোগাসহ নানা লোকের ভিড় দেখতে পেলেন তিনি। মামলার কাগজপত্র দেখে বুঝতে পারলেন, আটঘাট বাঁধা প্রমাণ। জমিদারের অপরাধ প্রমাণিত। অস্পষ্ট দাসের চিঠিতে বর্ণিত স্থানে শিশুর অর্ধবিকৃত লাশ পাওয়া গেছে। রামতারণ বাবুর খাস খানসামা শ্রীদাম ঘোষ আলো হাতে আগে আগে গিয়াছে। আর বিধবা বোনের মৃত সন্তানকে নিয়ে পিছে পিছে গেছেন জমিদার রামতারণ বাবু। শ্রীদাম গর্ত খোঁড়ার পর মৃত শিশুকে গর্তে ফেলে মাটিচাপা দেন খোদ রামতারণ বাবু।
তবে এমন প্রমাণিত ঘটনাও অবিশ্বাসের অনেক কারণ দেখতে পেলেন দারোগা বাঁকাউল্লাহ। বাড়ির ভেতর প্রচুর জায়গা থাকতে বোনের জারজ সন্তানকে কেন পুকুরপাড়ে পোঁতা হলো? রাস্তা থেকে অন্দরমহল প্রায় আধমাইল দূরে অবস্থিত। সাত মাসে জন্মগ্রহণকারী নির্জীব শিশুর কান্না অত দূরে শোনা সম্ভব কি? কাওরা হরিশের স্ত্রীর এজাহারই বা নেওয়া হলো না কেন? তবে বাঁকাউল্লা ঠিক করলেন, প্রথমেই সৌদামিনীকে দেখা উচিত।
তিনি গোপনে রামতারণবাবুকে ডেকে নিয়ে সৌদামিনীকে দেখার ব্যবস্থা করলেন। রামতারণ বাবুকে বললেন, সৌদামিনী আমার বোন। ধর্মের বোন। এবং পুলিশের লোক হলেও বাঁকাউল্লা মানী লোকের সম্মান বজায় রাখতে জানেন।
শেষ পর্যন্ত রামতারণবাবুকে নিয়ে সৌদামিনীকে দেখলেন। বাল্যবিধবা একুশ-বাইশ বছরের সৌদামিনী দেখতে সুন্দরী। তাকে দেখে কষ্ট অনুভব করেন বাঁকাউল্লাহ। একই সাথে নিশ্চিত হন যে তার গর্ভপাত হয়নি। গর্ভপাত হলে তার চেহারা বা শরীরে এর প্রভাব থাকত।
বাঁকাউল্লা জমি নিয়ে দলাদলি এবং বিবাদের বিষয় জানতে পারলেন একটু তদন্ত করেই। যে দুই জেলে সাক্ষী দিয়েছে, এবারে তাদের জেরা করলেন তিনি। দেখা গেল, একজন বলছে সৌদামিনীর বয়স ৩০, অন্যজন বলছ ১৫ বা ১৬। দেখতে কেমন, এ প্রশ্নের জবাবে একজন বলল, কালো, অপরজন বলল, ফরসা। কোন ঘাটে সৌদামিনী গোসল করছিল? একজন বলল পশ্চিম, অন্যজন বলল পূর্ব। আগেই বলা হয়েছে সৌদামিনীর বয়স ২০ বা ২১। তার গায়ের রং ফরসা। অন্দরপুকুরের পূর্ব বা পশ্চিম দিকে কোনো ঘাট নেই। ঘাট হলো উত্তর দিকে।
বাড়ির পাঁচ মেয়েকে দুই দলে ভাগ করা হলো। একটি দলে সৌদামিনীকে রাখলেন বাঁকাউল্লা। তারপর জেলে দুজনকে বললেন, সৌদামিনীকে শনাক্ত করো। জেলেরা দিদি-ঠাকুরানীকে চিনতে পারলেন না।
জেলে দুজনকে নজরবন্দী করে রাখা হলো।
শ্রীদাম বলেছে সে কোদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়েছে। অথচ খন্তা দিয়া গর্ত করার আলামত দেখতে পেলেন বাঁকাউল্লা। তাকে তলব করা হলো কিন্তু পাওয়া গেল না।
বাকি রইল লাশ রহস্য। এ রহস্যেরও আলামত মিলল, তদন্তের জন্য ডাকা লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় নানা বিশ্লেষণ দিচ্ছিল। বাঁকাউল্লা গোপনে পাশের ঘরে আত্মগোপন করে শুনলেন তাদের কথা। তিনজনের কথা থেকে জানতে পারলেন, মুসলমানের কবর খুঁড়ে শিশুর লাশ জোগাড় করা হয়েছে। যে লোক এ কাজ করেছে, সে সকালে নিজ জামাইবাড়ি ভেগে যাওয়ার মতলব করছে বলেও আলাপ থেকে জানতে পারলেন। লাশ চোরের বাড়িতে পাহারাদার রাখার ব্যবস্থা করলেন বাঁকাউল্লা।
সকালে ঘুম ভেঙে বাইরে আসামাত্র তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। লোকটার নাম অদ্বৈত ঘোষ। জেরার সময় তাকে ভয় ও লোভ দেখানো হলো। শেষে অদ্বৈত যে কবর থেকে লাশ তুলে এনেছে, তা দেখিয়ে দিল।
বাঁকাউল্লার তৎপরতায় প্রমাণ হলো রামতারণ বাবুকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য গ্রামের মানুষ এ মিথ্যা ঘটনা সাজিয়েছে। এ ঘটনার পরিকল্পনা করেছে যে চারজন, তাদের আসামি করে চালান দেওয়া হলো। তবে শ্রীদাম পলাতক রয়ে গেল।
সৌদামিনী শ্রীদামকে কাকা বলে ডাকত। শুধু তা-ই না, তাকে কাকার মতো সম্মানও করত। সেই সৌদামিনীর চরিত্রকে এমন কলঙ্কিত করতে দ্বিধা করল না! এক সপ্তাহ পরে থানা খবর পেল, 'গ্রামের উত্তর পার্শ্বের এক তেঁতুলগাছে শ্রীদাম গলায় দড়ি দিয়ে মরিয়াছে।'
বাঁকাউল্লা জানান, সৌদামিনীকে ধর্মভগ্নী বলেছিলাম। মোকদ্দমা মিটে গেলে রামতারণবাবু নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর, এ ঘটনার ৩০ বা ৩২ বছর পরে ধর্মভগ্নীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন তিনি। এ ধর্মসম্বন্ধ এখনো পুরুষানুক্রমে চলছে। (একজন মুসলমান দারোগাও হিন্দু বিধবার 'ধর্মভগ্নী' হতে পারেন। সে 'ধর্মসমন্ধ' পুরুষানুক্রমে চলতেও পারে, মূল কাহিনির চেয়ে বিম্মিত করছে এ বর্ণনা। 'রায় মহাশয়'-এর শেষে পড়া শেষ করে, অনেকের মতো আমারও মনে হলো, ফিরে আসুক আবার সে দারোগা, ফিরে আসুক আবার সে 'ধর্মসমন্ধ।')