'লালসালু' সমাজকে কোন বার্তা দিয়েছে?
যখন পাকিস্তান আমল থাকে, স্বৈরাচারের কাল থাকে, সামরিক শাসন থাকে, তখন 'লালসালু' পাঠ্য থাকে, পরীক্ষায় প্রশ্নের জবান লিখতে হয়, কিন্তু যখন কথিত গণতান্ত্রিক সুবাতাস বইতে শুরু করে, 'লালসালু' অন্তরালে চলে যায়।
যেকালে আমি ও আমার বন্ধুরা পড়েছি, 'লালসালু' সমাজকে কোন বার্তা দিচ্ছে, তা ততটা অনুধাবন করতে না পারলেও উপন্যাসের ছোট ছোট দু-একটি কথোপকথন ছিল আমাদের ঠোঁঠের ডগায়। আমরাই একজন অন্যজনকে জিজ্ঞেস করতাম: কি রে ব্যাটা, খৎনা হইছে?
হোক বা না হোক—হেঁচকা টানে লুঙ্গি খুলে পরীক্ষা করার মতো ধৃষ্ঠতা আমাদের হয়নি, হয়েছিল (আমার বাপেরও খৎনা হয় নাই)
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সেই মহব্বতনগর গ্রামের আগত মোদাচ্ছের পীরের মাজারের স্রষ্টা মজিদের।
মজিদ 'বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে ধাঁ করে তুলে ফেলে তার লুঙ্গি, ছেলেটি পালাতে পারেনি, মজিদের সন্ধানী চোখ দেখে তার শিশুমুণ্ডু ত্বকে আবৃত। এই অনাচার মেনে নেওয়া যায় না, সুতরাং তাকে খুঁটির সাথে বাঁধা হলো, মজিদ ঘোষণা করল, আজ নামাজের পর আমিই তোর খৎনা দিমু।
এই জাহেলের দেশকে জাহেলমুক্ত করতে আসরের নামাজের পর ছুরি-তেনা আনতেই কোরবানির ছাগলের মতো খুঁটিবন্দী ছেলেটি আতঙ্কে আর্তনাদ করতে করতে একসময় বলেই ফেলে, 'আমার বাপেরও খৎনা হয় নাই—তানিরে আগে দেন।'
তার বাবা খালেক ব্যাপারীর লজ্জায় মাথা গেল, হতভম্ব হয়ে রইল মজিদ—এ দেশে আর কত বেপারিয়তি কারবার চলবে? কেয়ামত এসে গেছে নাকি? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বর্ণনায় বাপ-বেটার খৎনা পর্ব:
'আধ ঘণ্টার মধ্যে দু'দুটো খৎনা হয়ে গেলো। ব্যাপারটা ঠিক হাটবাজারের মধ্যে যেন হলো। কারণ বাপ-বেটাকে ধরবার জন্য লোকের প্রয়োজন ছিলো বলে এবং এ সব দৃশ্য না দেখে থাকা যায় না বলে ঘরটায় ভিড় জমে গিয়েছিলো। শুধু তাই নয়, পেছনে বেড়ার ফুটো দিয়ে দেখলো পাড়ার যত মেয়েরা, ছুকড়ি, জোয়ান, বুড়ী। রহীমা পর্যন্ত না দেখে পারলো না। স্বামীর কীর্তিতে উজ্জল হয়ে ওঠা চোখে অন্য মেয়েদের সঙ্গে সে-ও মুখে আঁচল দিয়ে খানিকটা হাসলো।'
জীবনসংক্ষেপ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জন্ম ১৫ আগস্ট ১৯১২ (জন্মতারিখ নিয়ে দ্বিমত আছে; সৈয়দ আবুল মকসুদ বিভিন্ন কাগজপত্রে ভিন্ন ভিন্ন তারিখের সন্ধান পেয়েছেন, জন্মসন নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই। অধিকসংখ্যক কাগজে উল্লেখিত ১৫ আগস্টই গৃহীত হয়েছে। তার জন্মস্থান চট্টগ্রামের ষোলশহর। মা চট্টগ্রামের মেয়ে, বাবা নোয়াখালীর; বাবা সৈয়দ আহমদউল্লাহ বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য ছিলেন। ১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহ জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন তিনি ৫২ বছর বয়সে অকালপ্রয়াত হন। বাবার বদলির চাকরির কারণে বারবার তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদল ঘটে। ১৯৩৯ সালে কুড়িগ্রাম হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৪১ সালে কৃতিত্বের সাথে আইএ পাস করেন। তার ক্লাসমেটদের মধ্যে ছিলেন সানাউল হক (সিএসপি উত্তীর্ণ), নাজমুল করিম (সমাজবিজ্ঞানের খ্যাতিমান অধ্যাপক), মুসলিম লীগের রাজনীতিবিদ খাজা খায়েরউদ্দীন এবং বামপন্থী রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ তোয়াহা। তিনি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে বিএ পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএতে ভর্তি হন। কিন্তু বাবার মৃত্যুতে পরিবারের দায়িত্ব নিতে মাঝপথে আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। আইএ প্রথম বর্ষে থাকার সময় কলেজ ম্যাগাজিনে একটি গল্প মুদ্রিত হয়।
ছাপার হরফে এটিই প্রথম প্রকাশনা।
১৯৪৫ সালেই ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যানে সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন, একটি প্রকাশনা সংস্থাও খোলেন। সে বছরই প্রথম বই গল্পগ্রন্থ 'নয়নচারা' প্রকাশিত হয়। ভারত ভাগের পর ১৯৪৭-এ তিনি রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে সহকারী বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৪৯-এ প্রকাশিত হয় 'লালসালু'। এ বছরই বার্তা সম্পাদক পদে করাচিতে রেডিও পাকিস্তানে চাকরি শুরু করেন। ১৯৫২-এর অক্টোবর প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে সিডনির পাকিস্তান দূতাবাসে চলে আসেন, ১৯৫৪-এর অক্টোবরে তার ঢাকা প্রত্যাবর্তন; সরকারি তথ্য অফিসার হিসেবে কিছুকাল কাজ করার করাচি বদলি হন; ৩ অক্টোবর আন মারি ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিয়ে হয়। দেনমোহর ধার্য হয় পাঁচ হাজার টাকা। আন ধর্মান্তরিত হয়ে হলেন আজিজা মোসাম্মৎ নাসরিন।
১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত জাকার্তা দূতাবাসে। স্বল্পকালের জন্য লন্ডন ও বন দূতাবাসেও প্রেস অ্যাটাশে ছিলেন। ১৯৫৯-এ কন্যা সিমিনের জন্ম। ১৯৬০-এ ইতালি ভ্রমণ করেন, ১৯৬১-তে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৬৪-তে পুত্র ইরাজের জন্ম, ১৯৬৫-তে 'দুই তীর' এবং ১৯৬৮-তে 'কাঁদো নদী কাঁদো' প্রকাশিত হয়। 'লালসালু'র ইংরেজি অনুবাদ 'ট্রি উইথাউট রুটস' প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে।
প্রচ্ছদশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
নওরোজ কিতাবিস্তানের কর্ণধার মোহাম্মদ নাসির আলী; স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর তিনিই প্রকাশক। তার দ্বিতীয় উপন্যাস 'চাঁদের অমাবস্যা' ছাপার কাজ অর্ধেক শেষ। কিন্তু প্রচ্ছদ তো লাগবে। কে আঁকবেন? লেখকের কোনো পছন্দ আছে কি না, জানা দরকার। কিন্তু লেখক-প্রকাশকের অবস্থানগত দূরত্ব অনেক। প্রকাশক ঢাকায়, লেখক প্যারিসে। বাকিটা প্রকাশকের জবানিতে:
আমি তাকে চিঠি লিখে জানতে চাইলাম প্রচ্ছদটা কী রকম হবে, কাকে আঁকতে দেব, ক্ষুদ্রাকারে প্রচ্ছদপটের কোনো খসড়া প্রতিলিপি অনুমোদনের জন্য প্যারিসে তার কাছে পাঠাব কি না ইত্যাদি। জবাবে যা লিখে পাঠালেন তাতে আমি বরং খুশিই হলাম। তিনি লিখলেন, এ সময়ে আমি নিজেই ছবিটবি আঁকার চেষ্টা করতাম, বেশ ঝোঁক ছিল সেদিকে। এখন সব ছেড়ে দিয়েছি। কে কী বলবে, জানি না। তবু যদি বলেন তো আমি নিজেই প্রচ্ছদের জন্য একটা কিছু এঁকে পাঠাতে পারি। ওখানে বন্ধুদের দেখালে যদি সবাই পছন্দ করেন, তবে ছাপাবেন, নয়তো ভালো কোনো শিল্পীর সাহায্য নেবেন।
প্রকাশকের কাছে এটা মনে হয়েছে মনিকাঞ্চনযোগ—'বলা বাহুল্য, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের চাঁদের অমাবস্যা বইয়ের যে প্রচ্ছদপট আপনারা দেখছেন, তা সেই অনুরোধেরই ফল। সযত্নে প্যারিস থেকে প্রেরিত প্রচ্ছদপট দিন পনেরোর মধ্যেই ঢাকায় এসে পৌঁছল। বিশেষ করে দেখালাম তার অন্যতম বিশিষ্ট বন্ধু কবি সানাউল হক সাহেবকে। এই বইখানার পাণ্ডুলিপি তিনিই প্যারিস থেকে বয়ে এনে আমাকে দিয়েছিলেন। গ্রন্থকারের অনুপস্থিতিতে তিনি বন্ধুর পক্ষে আমাদের সঙ্গে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেছিলেন।
প্রকাশক মোহাম্মদ নাসির আলী লিখেছেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর তৃতীয় পুস্তক 'কাঁদো নদী কাঁদো'র জন্য প্রচ্ছদ আঁকা থেকে তিনি লেখককে নিষ্কৃতি দেননি। 'দুই তীর' গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি যথারীতি এল, প্রকাশকের আগাম চাহিদা অনুযায়ী প্রচ্ছদও দ্রুত এসে পৌঁছল। প্রচ্ছদশিল্পী এবং গল্পকার একই ব্যক্তি। কিন্তু ভিন্ন একটি সমস্যা দেখা দিল, গ্রন্থের নাম লেখক রেখেছেন 'স্তন'—এই নামের একটি বিখ্যাত গল্পের নামে। এই নামে গ্রন্থ প্রকাশ করা ঠিক হবে কি না, এ নিয়ে প্রকাশক দ্বিধান্বিত। দু-একদিনের মধ্যেই বাংলা একাডেমিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বন্ধু কবি সানাউল হক ও অপর একজনের সাথে প্রকাশকের দেখা হয়ে গেল। প্রকাশক তার দ্বিধার কথা জানালেন। সানউল হক বললেন, আমাদের নাম করে ওকে জানিয়ে দিন, স্তন নামের বই কোনো নারী কিনবে না। পুরুষও দোকানে এসে বইয়ের নাম বলে বইটি চাইতে দ্বিধা করবে। সুতরাং বই বিক্রি হবে না। মোহাম্মদ নাসিম আলীর চিঠি পেয়ে তিনি তার দ্বিমত পোষণ করলেন না বইয়ের পূর্ব-প্রচ্ছদের ওপরই স্তন-এর জায়গায় বসানো হলো 'দুই তীর'। মোহাম্মদ নাসির আলীর লেখা 'কথাশিল্পীর চিত্রশিল্প' সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যুর দশ দিন পর ১৮ অক্টোবর ১৯৭১ ইত্তেফাকে ছাপা হয়। এই অংশটিসহ অপর সকল উদ্ধৃতি সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখিত 'সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য' গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য 'লালসালু'র প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন জয়নুল আবেদিন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'পদস্খলন'
১৯৫৫-এর জুলাই-আগস্টে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায়, সিডনি দূতাবাস থেকে ফিরে এসে তথ্য কর্তকর্তার চাকরি করছেন। একটি ব্যক্তিগত গাড়িও ছিল তার, তিনি চালাতেন, এ সময় পদব্রজে চলতে গিয়ে আছাড় খেয়ে চোট পেলেন। তখনকার চট্টগ্রামবাসী বন্ধু কমার্স কলেজের শিক্ষক শেখ আজিজুর রহমান, তত দিনে তার শওকত ওসমান নামটিই অধিক প্রতিষ্ঠিত, বললেন— এটা ওয়ালীউল্লাহর 'পদস্খলন'। দুজনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু সৈয়দ নূরুদ্দীনের কাছে শওকত ওসমান জানতে চান পদস্পলিত বন্ধুর হাল-হকিকত:
আর আর
(পদস্খলনের পর)
সেই গৌরাঙ্গ কিশোর-কুমার
ঢাকা নগরীর উৎসর্গীত বৃষ
চাকায় বাধিয়া রমণীর প্রাণ
যিনি ঘর্ঘর মটোর হাঁকান
তাইলে বায়ে বিদ্যুৎ সদৃশ
কি সংবাদ তার??
দেশ-বিদেশে চাকরি করা তিরিশ পেরেনো সুন্দর মুখাবয়বের বুদ্ধিদীপ্ত যুবকের মোটরের প্রতি আকৃষ্ট ঢাকার অভিজাত পরিবারের যুবতী কজন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মন তখন সিডনিতে, যার সাথে শিগগিরই আনুষ্ঠানিক সংসার শুরু করতে যাচ্ছেন, সেই আন মারি রয়ে গেছেন সেখানেই।
জীবন ও জীবিকা
১৯৫২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আন মারি আর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর যখন সাক্ষাৎ, সংস্কৃতিমনা সুশিক্ষিত ফরাসি নারী আন মারি বিস্মিত হলেন, এমনকি ফরাসি সাহিত্যও তিনি তার চেয়ে বেশি পড়েছেন। তিনি লিখছেন, ১৯৫২-তে অস্ট্রেলিয়াতে যখন আমাদের দেখা, তার ফরাসি সাহিত্য সম্পর্কে যে জ্ঞান আমি আঁচ করি, আমি হতভম্ব হয়ে যাই। তিনি ছিলেন সর্বভুক্ত পাঠক।
এই নিষ্ঠা তার বরাবরই ছিল। যখন স্টেটসম্যানে চাকরিতে ঢুকলেন, জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে পেলেন কবি সুবীন্দ্রনাথ দত্তকে; সম্পাদক ওয়ার্ডসওয়ার্থ সাহেব একই সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। তাদের সাথে যোগ্য সহকর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে কেবল উন্নত মানের ইংরেজি শেখার জন্য অতি ভোরে ঘুম থেকে উঠতে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে দিয়ে মধ্য চল্লিশের দশকের কলকাতা জীবনকে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন:
'চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি কলকাতার প্রগতিশীল লেখকদের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর ঘনিষ্ঠতা হয়। লাজুক প্রকৃতির ছিলেন বলেই কারও সঙ্গে দহরম-মহরমের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়নি, তবে অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ ও যোগসূত্র দীর্ঘদিন অক্ষুণ্ন ও অবিচ্ছিন্ন ছিল। সুধীর দত্তের সঙ্গে স্টেটসম্যান অফিস থেকেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক ঘনিষ্টতর হয়। দুজনের রুচি স্বভাব ও অভিজাত্যের ব্যাপারেও ছিল সাযুজ্য; তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, 'মাঝে মাঝেই যেতেন সুধীর দত্তের রাসেল স্ট্রিটের বাড়িতে। কবির বাসভবনের তিনতলার দক্ষিণের বারান্দায়, যেখানে প্রায়ই জড়ো হতেন কলকাতার বিদগ্ধ কবি-সাহিত্যিক ও পণ্ডিতেরা, কিছুক্ষণ কাটাতেন। সুধীর দত্ত যেমন কথা কম বলতেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আরও কম, কাজেই বেশির ভাগ সময় তিনি হতেন স্রোতা, অন্যরা বক্তা। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে সুধীন দত্তের বাসভবনেই তার পরিচয় হয় এবং তার চিন্তাধারায় প্রভাবিত হন। সুধীন দত্তের প্রথম স্ত্রীর সাথে তার পরিচয় ছিল না, কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে শুরু থেকে তার ঘনিষ্ঠতা জন্মে। রাজেশ্বরী দত্ত তাকে খুব সমীহ করতেন।
প্যারিসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উত্তরসূরি, পরবর্তীকালে রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেমের স্ত্রী নূরুন নাহার হাশেম স্মরণ করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দম্পত্তি এবং রাজেশ্বরী দত্তকে; বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত গায়িকা রাজেশ্বরী দত্ত ছিলেন এই দম্পতির পরম বন্ধু। তিনি এবার লন্ডন থেকে বেড়াতে এসেছিলেন এই দম্পত্তির কাছে। এক সন্ধ্যায় আমরা নিমন্ত্রিত হলাম রাজেশ্বরী দত্তের সাথে পরিচিত হতে। রাজেশ্বরী দত্ত নিজ হাতে রান্না করলেন এবং আন মারি রান্না করেছিলেন কুকিং অ্যাপল দিয়ে গরুর গোস্ত ভুনা। ডিনারের পর শুরু হলো রাজেশ্বরীর গান।
'লালসালু'র জন্য গাঁটের পয়সা এবং বড় গচ্চা
১৯৪৪-৪৫-এ কলকাতা থাকতেই 'লালসালু' লিখতে শুরু করেন। তিনি ঢাকায় এসে রেডিও পাকিস্তান ঢাকায় যোগ দেন, বার্তা বিভাগ নিমতলিতে, ভোরের শিফটে ডিউটি, লেখালেখির জন্য হাতে দীর্ঘ অবকাশ, এ সময় লালসালু শেষ করেন। লিখতেন আর বন্ধুদের শোনাতেন, অনেক কাটছাট করতেন। উপন্যাস গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো। বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের উপহার দিলেন এবং বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটির অধিকাংশ কপি পোকাদের উদরপূর্তিতে নিঃশেষ হলো।
লালসালু মুদ্রিত হয়েছিল দুই হাজার কপি, কিন্ত উপযুক্ত পরিবেশকের অভাবে এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ব্যক্তিগতভাবে বিক্রয়ের জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় শ দুয়েক কপি মাত্র বিক্রি হয়েছিল। এই উপন্যাস প্রকাশ করতে গিয়ে তার বেশ কিছু টাকা নষ্ট হয়।
অবশ্য গচ্চা যত বড়ই হোক লালসালুই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং বাংলাদেশের পথিকৃত ঔপন্যাসিকে পরিণত করছে।
স্টেটসম্যানের সাব-এডিটর
তার নিজের কথাই উদ্ধৃত করছি, ১৯৪৫-এ সৈয়দ নূরুদ্দীনকে লেখা চিঠি থেকে : এই এক জীবন। সারা রাত কাজ করি। বিরাট অফিস, দিনের বেলায় যে অফিস গম গম করে, সে অফিস নিস্তব্ধ। গুটিকয়েক আমরা বিরাট হলে কড়া আলোর তাল কাজ করছি, চিফ সাব-এডিটরের পেছনে টেলিপ্রিন্টার অবিশ্রান্ত খটখট করছে যত রাজ্যের খবর ভূতের মতো আপনা হতেই টাইপ হচ্ছে, আর আমরাও কাজ করছিই করছিই। ঘণ্টা বাজছে, বেয়ারা আমাদের কাজ ছাপাখানায় নিয়ে যাচ্ছে, আসছে। ক্যারিডে যেসব খবর পাঠানো হয়নি, সেসব খবরও আসছে অহরহ লোকে নিয়ে আসছে।
আমরা তেতলায়। দোতলায় একটা দিনব্যাপী বিরাট ঘরে বিশাল মেশিন। রাত সাড়ে তিনটায় গুমগুম করে উঠেছে সে মেশিন—সিটি এডিশন ছাপা হচ্ছে। তারপরে আরও কত এডিশন ছাপা হবে।
তারপর দেশভাগ কেন্দ্র করে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দুদিন প্রায় অভুক্ত এবং তৃতীয় দিন সম্পূর্ণ অভুক্ত থাকাকালে শওকত ওসমান ও বুলবুল চৌধুরী তাকে উদ্ধার করেন। তাকে পাকিস্তান বেছে নিতেই হয়। জন্মভূমি পূর্ব বাংলায় (পরে পূর্ব পাকিস্তান) ফিরে আসতে হয়।
লিখতে না পারার যন্ত্রণা
বিয়ের তিন মাস না পেরোতেই করাচি থেকে বদলি হলেন ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী শহর জাকার্তায় পাকিস্তান দূতাবাসে। আন মারি লিখেছেন তার স্বামী প্রত্যাশা ছিল তাকে জেনেভাতে পদায়ন করা হবে।
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার বন্ধু অধ্যাপনায় নিয়োজিত নাজমুল করিমকে লিখলেন, অভ্যাসমতো ইংরেজিতেই। চিঠির একাংশের অনুবাদ করেছি : আমি বরং অসুখী, কারণ আমি লিখতে পারছি না। ঢাকা থাকাকালে ইংরেজিতে যে উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেছিলাম, তা এখনো শেষ করতে পারিনি। এ ধরনের কূটনৈতিক জীবন শূন্যগর্ভ এবং অর্থহীন। আমার মনে হয় না আমি যোগ্য কোনো লেখক হয়ে উঠতে পারব, যে স্বপ্ন আমাকে শৈশব থেকে তাড়িয়ে এসেছে। কখনো কখনো আমি ভয়ংকর মূলবিচ্ছিন্ন ও বোধ করছি। যে কাজ আমি করছি, আমি জানি না এ ধরনের কাজ আমাকে কেন করতে হবে। আমার কোনো বন্ধুও নেই মানে সত্যিকারের কোনো বন্ধু। বিদেশভূমিতে আমার বন্ধু নেই, যা আছে তাকে বলা যায় ক্লাবে পরিচিত। আমি জানি আমি সময়ের অপচয় করছি। কিন্তু কারও জীবনের গতিধারা পরিবর্তন করা যে দুরূহ ব্যাপার।
লেখালেখিতে হবে না। সুতরাং তার পুরোনো আগ্রহ ছবি আঁকার ঝোঁকটি জেগে উঠল ইন্দোনেশিয়ার সৃজনহীন কূটনৈতিক জীবনে।
একটি ব্যক্তিগত পাদটীকা:
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিংবা তার মহিয়সী স্ত্রী আন মারিকে আমি কখনো দেখিনি। তার সন্তান সিমিন ও ইরাজকে দেখেছি। ২০১৯-এ একটি দিন আগে থেকে নির্ধারিত ছিল। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিশিষ্ট বন্ধু এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমানের পুত্র জানেসার ওসমান তাদের নিয়ে আসেন আমার কাছে। নির্লোভ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটিই শহরে জমি হাতছাড়া হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। ঢাকা জেলার সাবেক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কমিশনার হিসেবে আমার কিছু পরামর্শ তাদের চাই। যতটা সম্ভব পরামর্শ দিলাম, এতে পাঁচ মিনিটও লাগেনি। তারপর অন্তত এক ঘণ্টা পঞ্চান্ন মিনিট আমরা কথা বললাম সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে।