ছু-মন্তর ছু
বাঙালি জাদুকর: হাওয়া থেকে টাকা
ওপারে বাপ-বেটা দুই পিসি সরকার (বাবা পিসি পুরো বাঙ্গাল, এপারের) আর জুয়েল আইচ তো আমাদের সর্বজন পরিচিত। তবে আমাদের কাছে স্বল্প পরিচিত বাঙালি জাদুকর পিসির গুণকীর্তন তো করতেই হয়।
শ্রীরামপুরের জমিদার পুত্র গণপতি চক্রবর্তী একেবারে ছোট বয়সেই সিদ্ধান্ত নিলেন পড়াশোনা করে সময় নষ্ট করবেন না। একটাই তো জীবন, মন যা চায় তিনি তা-ই করবেন। তাকে পাঠশালামুখী ও গ্রন্থমুখী করার সকল পারিবারিক উদ্যোগ ব্যর্থ হলো। তিনি গান আর তবলাবাদন নিয়ে মেতে রইলেন। তারপর মোক্ষম অস্ত্রটি তার ওপর প্রয়োগ করা হলো—যদি পড়াশোনা না করেন এবং হিসাব-কিতাব না বোঝেন, তাহলে বাবার মৃত্যুর পর জমিদারি চালাতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে তাকে সম্পত্তিচ্যুত করা হবে। এই হুমকিতে তেমন ভাবান্তর না হলেও তিনি ভাবলেন দেখি কী করা যায়।
ভাবতে ভাবতে তিনি জমিদারির নিকুচি করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। পলাতক জীবনে দু-একজন স্ট্রিটি ম্যাজিশিয়ান মানে পথের জাদুকর তাকে আকৃষ্ট করেছে এবং যখন পলাতক গণপতির সন্ধান অনেকেই জানলেন, তখন দেখা গেলো তিনি বিখ্যাত বোসের সার্কাস দলের একজন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জাদুকর হিসেবে একসময় তার আবেদন এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে ১৯২০-এর দশকে একেকটি শোর জন্য তাকে ৩০০ টাকা সম্মানী দিতে হতো। তিনি দুহাতে টাকা কামিয়েছেন, দুহাতে তা বিতরণ করেছেন স্বজন ও অভাবীদের মধ্যে।
অজিতকৃষ্ণ বসুর জাদুকাহিনী থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করতেই হচ্ছে। 'কেবল একটি ম্যাজিক শেষ করেছেন গণপতি চক্রবর্তী। গণপতির সাথে দেখা করলেন এক দরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণ। গণপতির কাছে তার একটি আরজি আছে, সে আরজি মঞ্জুর করতেই হবে। হাওয়া থেকে টাকা পড়ার, টাকা ধরার বিদ্যাটা তাকে শিখিয়ে দিতে হবে। নিদারুণ অর্থাভাব আর সহ্য হয় না। পারানি কড়ির অভাবে মেয়েটার ভালো সম্বন্ধ হাতছাড়া হতে যেতে বসেছে।
অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল জাদুকর গণপতির দুটি চোখ। গরিব ব্রাহ্মণকে বললেন, ভাই সত্যি সত্যি হাওয়া থেকে টাকা ধরার বিদ্যা জানলে কি আর এত লোকজন, লটবহর নিয়ে ঘুরে ঘুরে জাদুর খেলা দেখিয়ে টাকা রোজগার করতে হতো আমাকে? যুক্তিটা হৃদয়াঙ্গম করে তখন হতাশ হলেন কন্যাদায়গ্রস্ত গরিব ব্রাহ্মণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে পুরো হতাশ হতে হয়নি। সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করে ব্রাহ্মণের মেয়েটির ভালো বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন গণপতি।
জাদু দেখে রবীন্দ্রনাথও থ
একবার গণপতি চক্রবর্তী জাদু দেখাতে চলে এলেন শান্তিনিকেতন। ভিআইপি দর্শক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জাদুকর সাথে এনেছেন তার কাঠের বাক্স 'নল্যুশন বক্স'। বাকিটা অজিমকৃষ্ণ বসুর 'যাদু-কাহিনী' থেকে জেনে নিই:
খেলা আরম্ভ হবার আগে সন্তোষ মজুমদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আরও অনেকে বেশ ভালোভাবে বাক্সটি পরীক্ষা করলেন। গণপতির দু'খানা হাত পিছমোড়া করে এবং দু'খানা পাও কষে বাঁধা হলো। তারপর তাকে একটি থলেতে পুরে থলের মুখ বেঁধে সেই বাক্সে পোরা হলো। বাক্সটি চারদিক থেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তালা বন্ধ করে বাক্সের সামনে কালো পর্দা ঝুলিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই পর্দা ভেদ করে দু'খানা হাত বেরিয়ে এসে ঘণ্টা বাজাতে লাগল। হাত দুটি সরে যেতেই পর্দাও সরিয়ে দেওয়া হলো, দেখা গেল বাক্স বন্ধুই আছে।
বাক্সের ওপর বায়া-তবলা রেখে পর্দা ঝুলিয়ে দিতেই দর্শকদের ফরমায়েশমতো তাল বাজতে লাগল বায়া তবলায়। ভুতুড়ে ব্যাপার। পর্দা সরে গেলো, বাক্স পূর্ববৎ। আবার পর্দার আবরণ। সঙ্গে সঙ্গে যাদুকর নিজে বেরিয়ে এলেন। বলা হলো, আপনারা যাদুকরকে এমনভাবে চিহ্নিত করে দিন যেন ঐ চিহ্ন দেখে চিনে নিতে পারেন। যাদুকরকে কেউ পরিয়ে দিলেন আংটি, কেউ চশমা। যাদুকর পর্দার আড়ালে যেতে পর্দা সরিয়ে নেওয়া হলো। দড়ি খুলে তালা খুলে বাক্স খুলে, মুখ বাঁধা থলি খুলে দেখা গেল দর্শকদের দেওয়া আংটি আর চমশা পরা অবস্থায় থলের মধ্যেই রয়েছেন, তেমনি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় যাদুকর গণপতি।
পাষণ্ড এবার ঝুড়িটা তুলে নিতে টকটকে আরো রক্ত বেরিয়ে এল, কিন্তু মেয়েটি কোথায়? ঝুড়ির নিচে মেয়েটি নেই। তাহলে মেয়েটি কি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? এ রকম ছুরির আঘাতে মেয়েটার নির্ঘাত মৃত্যু হওয়ার কথা? কি হলো মেয়েটির? কোথায় গেল! 'কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখলাম সেই মেয়েটিই ভিড়ের ভেতর থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বকশিস চাইছে। খুশি হয়ে আমরা তা দিলাম।
রবীন্দ্রনাথ লেখার যাদুকর বটে, তাতে তাৎক্ষণিক বিস্ময়ের উপাদান কম, কিন্তু গণপতির সবটাই বিস্ময়কর। রবীন্দ্রনাথ কি অবাক না হয়ে পারেন।
রেভারেন্ড কন্টারের দেখা বিস্ময়কর স্ট্রিট ম্যাজিক
যিশুখ্রিষ্টের শিক্ষা প্রচারে এবং খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার মিশন নিয়ে ইংরেজ পাদ্রি রেভারেন্ড হোবার্ট কন্টার ভারতবর্ষে এসেছিলেন। ঠিক ১৯০ বছর আগে ১৮৩২ সালে মাদ্রাজের রাস্তার ধারে এক খেলার মাঠে একটি ম্যাজিক দেখে অবাক হয়ে তিনি তার বর্ণনাটি লিখে ফেলেন: ইয়ান ফ্রস্ট রচিত জাদুগ্রন্থ 'দ্য ইন্ডিয়ান বাস্কেট ট্রিক'-এ পাদ্রির দেখা সে জাদুর যে বর্ণনা দিয়েছেন, অজিত কৃষ্ণ বসুর অনুবাদ থেকে তা তুলে ধরছি:
একজন মোটাসোটা ভীষণ চেহারার মানুষ এগিয়ে এল একটি অতি সাধারণ বেতের ঝুড়ি নিয়ে। তারই অনুরোধে আমরা ঝুড়িটাকে খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম। লোকটি একটি বছর আটেক বয়সের মেয়েকে ঐ ঝুড়িটা দিয়ে ঢেকে রেখে কিছুক্ষণ ঐ ঝুড়ি-ঢাকা মেয়েটির সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে কথাবার্তা বলল। আমাদের মাত্র কয়েক ফুট দূরে ঝুড়ির তলা থেকে মেয়েটির কণ্ঠস্বর এমন পরিষ্কার শোনা গেল যে মেয়েটি যে ঐ ঝুড়ির তলাতেই রয়েছে সে নিয়ে আমাদের আর কোনো সন্দেহই রইল না। বাকিটার সংক্ষিপ্ত বিবরণ: মেয়েটার সাথে কথা বলতে বলতে যাদুকর ভীষণ ক্ষেপে উঠল এবং তাকে হত্যা করার হুমকি দিল। কাতর কণ্ঠে মেয়েটি প্রাণ ভিক্ষা চাইলেও এই পাষণ্ডের হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হলো না। সে বেতের ঝুড়িটাকে এক পায়ে চেপে ধরে হাতে একটি তলোয়ার নিয়ে এর ধারালো অগ্রভাগ দিয়ে ঝুড়িতে খোঁচাতে শুরু করল। মেয়েটির চিৎকারে দর্শকরা হতভম্ব হয়ে পড়ল। লোকটার চেহারা আরো উগ্রমূর্তি ধারণ করল। এদিকে ঝুড়ির ভেতর থেকে মেয়েটির রক্ত বেরিয় আসত থাকল। তার নির্মম তলোয়ার চালনা থামার লক্ষণ নেই। রেভারেন্ড কন্টার ভাবলেন নিজেই উঠে গিয়ে এই পাষণ্ডকে পিটিয়ে মাঠ ছাড়া করবেন। ততক্ষণে মেয়েটির ছড়িয়ে পড়া রক্তে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দর্শকরা সকলেই সন্ত্রস্ত এবং স্তম্ভিত।
পাষণ্ড এবার ঝুড়িটা তুলে নিতে টকটকে আরো রক্ত বেরিয়ে এল, কিন্তু মেয়েটি কোথায়? ঝুড়ির নিচে মেয়েটি নেই। তাহলে মেয়েটি কি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? এ রকম ছুরির আঘাতে মেয়েটার নির্ঘাত মৃত্যু হওয়ার কথা? কি হলো মেয়েটির? কোথায় গেল! 'কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখলাম সেই মেয়েটিই ভিড়ের ভেতর থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বকশিস চাইছে। খুশি হয়ে আমরা তা দিলাম।
সবারই সম্বিত ফিরল, এটা সত্যি কিছু নয়, এটাই ম্যাজিক। রেভারেন্ড লিখেছেন, এটি তার দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ম্যাজিক।
জাদুতে আষাঢ়ে গল্প যোগ
জাদুর বর্ণনায় কিছু আষাঢ়ে গল্প যোগ হয়ে থাকে, অজিত কৃষ্ণ বসু উল্লেখ করেছেন পিসি সরকারকে নিয়ে একটি জাদুর বর্ণনা: একজন বলে চলেছেন, আমরা রেস্তোরাঁয় খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি সামনের টেবিলে পিসি সরকার দু'জন বন্ধু নিয়ে গপ্পো করছেন। আমরা তখনই উঠে গিয়ে তাকে ধরলাম একটা যাদু দেখাতেই হবে।
মাথায় দুধের ড্রাম নিয়ে দু'জন দুধওয়ালা যাচ্ছিল। দুধ যাতে ছিটকে না পড়ে সে জন্য ড্রামের ভেতর খড় ভাসিয়ে রাখা হয়। পিসি সরকার তাদের ডাকতে বললেন। এলে পরে তাদের অনুরোধ করলেন একটু দুধ খাওয়াতে। দুধওয়ালা দু'জন বলল, কোনো উপায় নেই, দুই ড্রামই বায়না করা, এখন পৌঁছে দিতে যাচ্ছে তারা।
তারা চলে গেল, যাদুকর মুচকি হাসলেন।
কয়েক মিনিট পরই দুই দুধওয়ালা হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এল। তারা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, কর্তা কতটুকু দুধ চান, দেব। আমাদের সর্বনাশ করবেন না। দুধ ফিরিয়ে দিন। তারা ড্রাম নামাল। দেখা গেল ভেতরে এতটুকু দুধ নেই, আছে কেবল খড়কুটো।
তাদের অনুনয়ে যাদুকরের মন ভিজে গেল। বললেন যাও ঠিক হয়ে যাবে। তারা আবার রওয়ানা হলো। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা বুঝল তাদের ড্রামের ওজন বাড়ছে। একসময় তারা বুঝে গেল দুধ ফিরে এসেছে।
কাজেই ম্যাজিশিয়ানকে অসন্তুষ্ট করতে নেই। তাতে এমন শিক্ষাই হবে। বাস্তবে এমন যাদু কি কখনো দেখিয়েছেন পিসি সরকার? না, দেখাননি। কিন্তু স্বল্প পরিমাণ দুধ গায়েব হয়ে যাবার এবং আবার ফিরে পাবার জাদু তিনি মঞ্চে দেখিয়েছেন। একটি জগ থেকে কাগজের ঠোঙায় দুধ ঢেলেছেন, জগ শূন্য করার পর ঠোঙায় সব দুধ দর্শকদের দিকে ছুড়ে দেবার ভান করলেন কিন্তু ঠোঙা থেকে এক ফোঁটা দুধও ছিটকে পড়ল না। ঠোঙাটা দলা পাকিয়ে মুষ্টিতে চেপে ধরলেন, হাতে কেবলই কাগজের দলা, দুধ নেই। দুধ গেল কোথায়? বাস্তবের এই জাদুটা বহু মুখে ছড়াতে ছড়াতে দুধের জগ থেকে দুধের ড্রামে পরিণত হয়েছে।
গণপতি জাদুকরের কংশ কারাগার
জমিদারপুত্র গণপতি চক্রবর্তী মানে জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী (জন্ম ১৮৫৮, মৃত্যু ২০ নভেম্বর ১৯৩৯) বাড়ি থেকে পালিয়ে বোসের সার্কাসে যোগ দিলেন। সার্কাসে গণপতির ভূমিকা শুরুতে কিছুই ছিল না। সিনেমার এক্সট্রার মতো; তিনি সার্কাস দলের ফাও। কিন্তু দলের মালিক বোসবাবুর আনুকূল্য পেয়ে দু-একটা সার্কাসের পরপর একটি কি দুটি ম্যাজিক দেখান। কিন্তু যত সময় যেতে লাগল, তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করলেন। তিনি গুরুগম্ভীর ম্যাজিশিয়ান নন, অসাধারণ কৌতুকপ্রিয় মানুষ, অসাধারণ কমেডিয়ান। দর্শক হাসাতে তিনি অদ্বিতীয় হয়ে উঠলেন। কিন্তু সৃজনশীল গণপতি জানেন, লোক হাসানো তার পেশা হতে পারে না, তার কাজ মানুষকে বিস্ময়াভিভূত করা।
আমি পকেটের ভেতর নিজের অজান্তেই হাত দিতে যাব, ঠিক তখনই আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা আমার বয়সী এক বালক চিৎকার দিয়ে উঠল, 'এই শালা আমার বিচি লইয়া গেছে!' তারপর ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। আমি দ্রুত পকেট থেকে হাত বের করে আনি, আমারও কি একটা নাই। পয়সা তো আমিও দেই নাই! এর মধ্যে বালকের কান্নার ভাষা বদলে গেছে, 'আমার বিচি ফেরত দে।' জাদু দেখতে দাঁড়ানো কয়েকটি মেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। একজন জিজ্ঞেস করল, 'কিসের বিচি?
তিনি নতুন জাদু বানালেন কংশ কারাগার। কংসের কারাগারে বন্দী বাসুদেব—এই পুরাণকে গণপতি ব্যবহার করে লোহার শিকের বড় খাঁচা তৈরি করলেন। তাকে হাতকড়া পরিয়ে পায়ে ডান্ডাবেড়ি লাগিয়ে খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে তালা মেরে দেওয়া হলো, হাজার দর্শকের চোখের সামনে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল শূন্য খাঁচা পড়ে আছে। জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী আয়েশ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যারা তাকে কারাবন্দী করেছে তারা চটে যেতেই বিস্মিত দর্শকের চোখে পড়ে হাতকড়া আর ডান্ডাবেড়ি লাগানো গণপতি মোটেও বাইরে নন, কংশের কারাগারের ভেতরেই আছেন।
এগুলো ছিল বিশ্বসেরা জাদুকর হুডিনির জাদুর সমক্ষ। বরং গণপতির বাড়তি যোগ্যতা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত কমেডি সৃষ্টি করা। বোসের সার্কাসে যারা তাকে দেখেছেন সবার জন্যই তা স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তার তুল্য কোনো বাঙালি বা ভারতীয় জাদুকর ছিলেন না। চেহারা, আকৃতিতে, নতুন জাদু ও কমেডি সৃষ্টি করে তিনি মার্কিন জাদুকর আলেকজান্ডার হারম্যানের মতো অনেক বড় লাখপতি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন পিসি সরকারের মেন্টর।
বাচ্চালোক তালিয়া বাজাও
ষাটের দশকে আমার হাফপ্যান্ট পরা যুগে ঢাকা শহরে কোনো নো কোনো রাস্তার মোড়ে, আমগাছের নিচে, কিংবা স্কুলের মাঠে কিংবা অবস্থাপন্ন বাড়ির উঠানে প্রায়ই চিৎকার শোনা যেত, বাচ্চালোক তালিয়া বাজাও। দুই করতল একত্র করে যত জোরে শব্দ করা সম্ভব, তাই করে তালিয়া বাজাতাম। আমরা ঘিরে থাকতাম হাতে ডুগডুগি বাজানো জাদুকরকে। একদিনের ভয়ংকর এক জাদু আমার মতো ক্লাস থ্রিতে পরা জাদুর পৃষ্ঠপোষককে এবং আমার চেয়ে বড় কজনকে কাঁদিয়ে ফেলল। তিনি বিভিন্ন ধরনের হাত সাফাই জাদু দেখিয়ে অ্যাক্রোব্যাট হিসেবে মাথায় ভর দিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে দেখালেন। তারপর তার ইংলিশ হ্যাট সবার সামনে মেলে ধরলেন, সন্তুষ্ট হয়ে যে যা পারেন জাদুকরকে কিছু যেন দেন।
আমি এবং আমার মতো আরও অনেকেই কিছু দিইনি। হঠাৎ জাদুকর চিৎকার করে উঠলেন, খামোশ এক পা-ও নড়বে না। যেসব 'পোলাপান' আমার জাদু দেখেছে কিন্তু পকেটে পয়সা থাকার পরও আমাকে পয়সা দেয়নি, এখনই তাদের বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। পোলাপান যারা পয়সা দাওনি প্যান্টের পকেটের ভেতর দিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখো—নাই, একটাও নাই।
কী নাই!
আমি পকেটের ভেতর নিজের অজান্তেই হাত দিতে যাব, ঠিক তখনই আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা আমার বয়সী এক বালক চিৎকার দিয়ে উঠল, 'এই শালা আমার বিচি লইয়া গেছে!' তারপর ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। আমি দ্রুত পকেট থেকে হাত বের করে আনি, আমারও কি একটা নাই। পয়সা তো আমিও দেই নাই! এর মধ্যে বালকের কান্নার ভাষা বদলে গেছে, 'আমার বিচি ফেরত দে।' জাদু দেখতে দাঁড়ানো কয়েকটি মেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। একজন জিজ্ঞেস করল, 'কিসের বিচি?
বালকটির উচ্চস্বর কান্না। আরও মানুষ জমিয়ে ফেলল। জাদুকর দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে ডুগডুগি হাতে দ্রুত যখন স্থান ত্যাগ করছে, বালক কেঁদে কেঁদে বলছে, 'শালা আমার বিচি লইয়া চইলা গেল।' বয়স্ক এক লোক জাদুকরকে আটকে বললেন, 'পোলাপানের লগে যদি আর বিটলামি করছ, তোর ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিমুনে।'
আমার আতঙ্ক তখনো কাটেনি, আমারটা আছে কী নেই ভয়ে পরীক্ষাও করতে পারছি না। বাড়ি ফিরে পরীক্ষা করে আশ^স্ত হলাম আমার কোনো কিছু খোয়া যায়নি। সেই আতঙ্কজনক স্ট্রিট ম্যাজিকের পর আরও বহুবছর পার করে দিয়েছি। বহুবার কানে বেজেছে: বাচ্চালোক তালিয়া বাজাও।
আমার ম্যাজিক শেখা
জাদু দেখে বিস্মিত হয়নি এবং যাদু শিখে স্বজনদের অবাক করে দিতে চায়নি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি পিসি সরকার জুনিয়রের যাদুশিক্ষা থেকে শুরু করে হুডিনির জীবন—এ ধরনের কিছু বইপত্র পড়ে একটা সহজ জাদু শিখে ফেললাম এবং এক জাদুতেই ম্যাজিশিয়ান হয়ে গেলাম।
একই মাপের চার টুকরো ছোট সাদা কাগজ। আমি কলম নিয়ে বসে গেলাম এবং চারজনকে চারটি দেশের নাম বললাম। নাম এল: ফ্রান্স, লিখলাম; ইতালি, লিখলাম, স্পেন, লিখলাম; পর্তুগাল, তা-ও লিখলাম। ভালো করে কাগজ ভাঁজ করে তিনটা নিজের হাতে রেখে একটা দর্শকদের একজনের হাতে দিলাম। আমি একে একে তিনটা আগুনে পোড়াব এবং অগ্নিশিখা দেখে বলে দেব কোন দেশ পুড়ছে এবং সবশেষে দর্শকের হাতে কোন দেশ আছে। আমি আগুনের শিখা দেখে একে একে বলে যাচ্ছি পর্তুগাল পুড়ল, ফ্রান্স পুড়ল, স্পেন পুড়ল। আর দর্শকের হাতে থাকল ইতালি। দর্শক কাগজের ভাঁজ খুলে দেখল সত্যি ইতালি। আমি যাদের মুগ্ধ করতে চেয়েছি তারাও অবাক হলো কী দারুণ মেধাবী। আগুনের রং দেখে বলে দিতে পারে কোন দেশ!
ঠিক এই ম্যাজিকটিই দ্বিতীয়বার দেখাতে গিয়ে ত্যাদড় একটি মেয়ের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। দেশের নাম লেখা শেষ হবার পর সে কাগজগুলো চেয়ে বসল; না দিয়ে উপায় ছিল না। ফাঁস হয়ে গেল আমি চারটি কাগজেই ইতালি লিখেছি। মুখে যাই বলি না কেন, শেষটি ইতালি থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। ধরা পড়ে যাবার আশঙ্কায় ম্যাজিক শেখার সেখানেই আমার সমাপ্তি।
জেফরি কেলারের ম্যাজিক
অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী বলে কথিত জেফরি কেলার আসলে একজন উঁচু দরের ম্যাজিশিয়ান। ১৯৯৩ সালে আমার বিলেতবাসকালে তিনি বিবিসি টেলিভিশনের একটি লাইভ প্রোগ্রামে এলেন। বললেন কারও যদি কোনো অচল ঘড়ি থাকে এবং তিনি যদি লন্ডন এলাকার মধ্যে অনুষ্ঠানটি দেখছেন এমন হয়, তাহলে ঘড়িটি টেলিভিশনের ওপর রাখুন, দেখবেন ঘড়িটি কিছু সময়ের জন্য চালু হয়ে গেছে। মেরামতের অযোগ্য একটি ঘড়ি আমি টিভির ওপর রাখলাম এবং বন্ধ ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ ঘুরতে দেখে অবাক সত্যিই হলাম। মিনিট কয়েক ঘড়িটি চালু ছিল।
এর কী ব্যাখ্যা!