শেষ সাদা শিকারি!
শিকারের গল্পে আজও শিহরণ জাগে। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক ভারতের জিম করবেট থেকে শুরু করে ডোনাল্ড অ্যান্ডারসন পর্যন্ত নানা শিকার কাহিনির বিচিত্র সম্ভার আজও পাঠকের মহাভোজের আয়োজন করতে পারে। পাঠককে টেনে ধরতে পারে। কিন্তু শিকার কাহিনিতে কী এমন আছে যে পাঠককে আজও নাওয়া-খাওয়া ভুলিয়ে মগ্ন করে রাখতে পারে?
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কেনেথে অ্যান্ডারসনের পুত্র ডোনাল্ড অ্যান্ডারসনের আত্মজীবনী দ্যা লাস্ট হোয়াইট হান্টার। এ বইয়ে ১৯৬০-এর দশকে ভারতে 'লাইসেন্সধারী শিকারির' জন্য প্রযোজ্য কতগুলো শর্ত তুলে ধরা হয়েছে। এসব শর্ত হলো:
১। মাচা থেকে বা প্রাণীদের পানি খাওয়ার জায়গায় কোনো শিকার করা যাবে না।
২। সূর্যোদয়ের আগে বা সূর্যাস্তের পরে শিকার করা চলবে না।
৩। রাস্তা বা পায়ে চলার বুনো পথ থেকে ১০০ গজ দূরে বাঘ বা চিতাবাঘ শিকার করা যাবে না।
৪। বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যের ভেতরে সব প্রাণী শিকার করাই নিষিদ্ধ। শিকারের জন্য সংরক্ষিত এলাকায়ই শুধু শিকার করা যাবে।
৫। লাইসেন্সধারী শিকারি কোনো সময়ই দুটির বেশি অস্ত্র বহন করতে পারবেন না
৬। শিকারি শুধু নীলগিরি ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাসোসিয়েশনে নিবন্ধিত লাইসেন্সপ্রাপ্ত শিকারিদের গাইড হিসেবে সঙ্গে নিয়ে শিকারে যেতে হবে।
ডোনাল্ডের চেয়েও খ্যাতিমান ছিলেন তার বাবা। নিজ বাবার ছায়াতেই তিনি বেড়ে উঠেছেন, সে কথা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তার আত্মজীবনী নিজ জীবনের কিছু ঘটনার এক অনন্য সংকলন। পুস্তকটির যেখানে ডোনাল্ড নিজ বাবা সম্পর্কে কথা বলেছেন কিংবা কীভাবে নিজের মধ্যে শিকারের সংবেদনশীলতার বিকাশ ঘটেছে তার বর্ণনা দিয়েছেন, সে অংশগুলো শিকার সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠকের কাছে বইটার আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ডোনাল্ড নির্মম হয়ে উঠেছেন। তার নিজ ভাষায়,
বড় বড় প্রাণী হত্যা করে মানুষের সেবা করেছি এমন কথা বলে আত্মপক্ষ সমর্থন করব না। সে সময় বাঘ, চিতাবাঘ বা বুনো কুকুরকে উৎপাত হিসেবে গণ্য করা হতো। ওসব প্রাণী নিধনের জন্য শিকারিকে পুরস্কৃত করার চল ছিল। ...আমার মতো শিকারিরা বন বিভাগের নির্ধারিত কঠোর নিয়মকানুন মেনে শিকার করেছে। তবে আমরা যে কাজগুলো করেছি, সে জন্য যে কেউ আমাদের বিবেককে সর্বদা প্রশ্ন করতেই পারেন।
শিকারের জন্য যেসব নিয়মকানুনের তালিকা ডোনাল্ড দিয়েছেন, সেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ক্রমবর্ধমান সংগঠিত শিকার পর্বকে নিয়ন্ত্রণ করা। ১৯৭২ সালের বন্য প্রাণী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের আগপর্যন্ত শিকারের এ ধারার চল ছিল ভারতে। স্বাধীনতার আগে শিকার বলতে বোঝা যেত রাজকীয় বিনোদন। উপমহাদেশের রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে শিকারের চেতনা জোরালোভাবেই বিরাজ করেছে। সে সময়ে ব্রিটিশ রাজের সেবার প্রয়োজন ছাড়া যুদ্ধেও অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। ব্রিটিশরাই প্রথম বুনো প্রাণীগুলোকে উৎপাত হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাদের 'নিকেশ' করার জন্য পুরস্কারের প্রচলন করে। পরে শিকারকে পুরুষত্বব্যঞ্জক ক্রীড়া হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হয়। এ ক্রীড়ায় মেতে উঠতে উৎসাহিত করা হতে থাকে। 'ইন্ডিয়ানস ওয়াইল্ডলাইফ হিস্টরি: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন' পুস্তকে ইতিহাসবিদ মহেশ রঙ্গরাজন লিখেছেন—
বাঘ ছিল অনাচারী পশুর প্রধান উদাহরণ, বাঘকে জয় করতে পারলে সে কাজকে ব্রিটিশ রাজত্বে শান্তি বজায় রাখার শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো... শিকার ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যুক্তি ও বাগাড়ম্বরের গভীর প্রতীক। বুনো জন্তু-জানোয়ারের কবলে পড়েছে শিশুসন্তানেরা, এমন অসহায় মাকে রক্ষা করছেন সাহসী শ্বেতাঙ্গ পুরুষ।
বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবেশগত অপরাধগুলোর অন্যতম হলো ১৯ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের বন্য প্রাণীর ব্যাপক নিধন। এ ধারা ২০ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলেছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সাহিত্যের একটি রোমাঞ্চকর রূপের সৃষ্টি হয়েছে। আজকের দিনেও সে সাহিত্যের রস গ্রহণের নতুন নতুন পাঠক পাওয়া যাচ্ছে। জিম করবেট এবং কেনেথ অ্যান্ডারসন পর্যন্ত নানা শিকারির শিকারসংক্রান্ত রচনার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজের অধীনে বনের রোমান্টিক সৌন্দর্য পরিবেশন করা হয়েছে। ভারত স্বাধীনতা হওয়ার পরে শিকার নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শিকারের এমন ধারা এখন কার্যত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে ডোনাল্ডের দাবি যে তিনিই এ উপমহাদেশের 'শেষ সাদা শিকারি'। নতুন সাহিত্যের অনুপস্থিতি এবং বিদ্যমানগুলোর জনপ্রিয়তার সাথে সাথে আমরা অভিযোজনগুলোও প্রত্যক্ষ করছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কল্পনার মিশেল দেওয়া করবেটের জীবনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক উপন্যাস 'ইন দ্য জঙ্গলস অব দ্য নাইট'-এর কথা। এমন গ্রন্থ শিকার সাহিত্যের উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়েই চলেছে।
কিন্তু এই ধরনের গ্রন্থের পাঠকেরা আখ্যানের অন্তর্নিহিত বিপরীতমুখী ধারার মুখে পড়েন। এসব শিকারির পরিবেশিত শিকার কাহিনির মধ্য দিয়ে ভারতীয় জঙ্গলের সৌন্দর্যের সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটেছে। পাঠককে গভীরভাবে টেনে ধরতে সক্ষম এসব লেখায় শিকারের ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকগুলো নিপুণভাবেই ধামাচাপা পড়েছে। সংরক্ষণের কথা এবং ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের বিষয়টি তারপরও অনেকেই তুলে ধরেছে।
শিকার হলো দুঃসাহসিকতায় আচ্ছন্ন ছেলেদের জগৎ। সাহসিকতা ও পৌরুষ ভাবের সমন্বয় ঘটেছে এ জগতে। রাজকীয় ক্রীড়া জগতের বহু গুণাবলির পাশাপাশি সামরিক জগতের বীরত্ব ও সাহসিকতাকে দেখতে পাওয়া যাবে শিকারের এ জগতে। বড় প্রাণীকে তাড়া করা বা অনুসরণ করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রের মতোই অসীম সাহসিকতার প্রয়োজন পড়ে। কিংবা হয়তো তার চেয়েও বেশি সাহসিকতা দেখাতে হয়। সাবেক সেনা শের জং নিজ স্মৃতিকথা 'ট্রিস্ট উইথ টাইগারস'-এর ভূমিকায় লিখেছেন, 'মানুষকে বলা হয় নিয়তির সাথে লুকোচুরি বা লীলাখেলা করে। আমি বাঘের সাথে লুকোচুরি বা লীলাখেলা করেছি...একে বাগাড়ম্বর মনে হতে পারে কিন্তু আমি সে কাজটি করতে চাইনি। কারণ, বাঘ শিকার আমাদের পরিবারের এক পুরানো বিনোদন, যা বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে আসছে...।' তিনি আরও লিখেছেন, 'আমার তারুণ্যের সেই দিনগুলোতে আমার জীবনজুড়ে ছিল কেবল বন্দুক, ঘোড়া এবং কুকুর।' অথবা পেশাদার শিকারি অজাইকুমার রেড্ডি তার 'ম্যান ইটিং টাইগার্স অব সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া' বইয়ে লিখেছেন, 'শতভাগ সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে আমি নিজেকে অনেকবার ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি, অনেকবার মৃত্যুর কবল থেকে পালিয়ে এসেছি... এরপর আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।'
শিকার নিয়ে লেখা বইগুলো আকর্ষণ শক্তি অতি প্রবল। রিভার্স ডাইজেস্ট ড্রামা ইন রিয়েল লাইফ বা বাস্তব জীবনের নাটকের উত্তেজনা এতে পাওয়া যায়। তবে এ কাহিনিতে যদি একটি মানুষখেকোকে যোগ করা যায়, তবে উত্তেজনা উঠে তুঙ্গে। করবেটের বর্ণনা বিবেচনা করুন, 'আমরা যতই প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেলাম, মাঠটি ততই দৃশ্যমান হয়ে উঠল এবং প্রান্তের একটি সংকীর্ণ কিনারই মশালের আলোর বাইরে ছায়ায় রয়ে গেল। তখনই চিতাবাঘটি রাগে গরগর করতে করতে প্রান্তসীমা থেকে লাফ দিল।'
এই চিতাবাঘের হাতে প্রাণ দিয়েছে ৪০০ মানুষ। জনাকয়েক ভীত গ্রামবাসী এবং পাইনগাছের ছাল-বাকল দিয়ে তৈরি মশাল নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে বাঘটিকে একটু আগেই তাড়া করেছেন করবেট। তাড়ার মুখে কাঁটাগাছে উঠে গেছে চিতাবাঘটি।
শিকারের এসব কাহিনি পড়তে পড়তে মনে হতে পারে নিঃসঙ্গ শিকারি বন্দুক সম্বল করে বনে ঘুরে ঘুরে শিকার করছেন। সে ভাবনা অনেক সময়ই বাস্তব নয়। বাস্তবতা হলো, শিকারি নিঃসঙ্গ ছিলেন না; তিনি ছিলেন বিশাল এক শিকার দলের সদস্য। ভারতীয় রাজপরিবারের স্বজন-পরিজনবর্গ, সাম্রাজ্যের কর্মকর্তা, আমলা এবং প্রশাসক, ভৃত্য এবং হাতিদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল শিকারের এই বিশাল দল। 'দ্য টেম্পল টাইগার্স অ্যান্ড মোর ম্যান ইটারস অব কুমায়ুন'-এ করবেট লিখেছেন, 'তরাইয়ের তৃণভূমিতে সুশিক্ষিত হাতির পিঠে বসে গুলি চালানোকে আমার জানা সবচেয়ে মনোরম শিকার অভিযানগুলোর অন্যতম হিসেবে গণ্য করতে হবে।' দ্য তাল্লা দেস মানেতার বইয়ে বিন্দুখেরার সমভূমিতে এক শিকার দলের কথাও বলেছেন তিনি। এ দলে ১৭টি হাতি এবং ৯টি বন্দুক ছিল। এ দলের গুলিতে শেষ পর্যন্ত ৬৬টি পাখি এবং পাঁচটি প্রাণীকে প্রাণ বলি দিতে হয়।
ব্রিটিশ অভিজাতরা যে শিকারের বিশাল বহর নিয়ে বের হতেন, তার তুলনায় এসব দলকে নেহাতই নস্যি গণ্য করা যায়। নেপালি তরাইতে ব্রিটিশ রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর ১৮৭৬ সালের শিকার অভিযান নিয়ে এক ঐতিহাসিক বর্ণনা আছে। এতে বলা হয়েছে, জঙ্গলকে ঘিরে বাঘকে তাড়া করার জন্য 'সাত শ হাতিকে লাগানো হয়। আর যুবরাজ (আলবার্ট) (এক দিনে) কমসে কম ছয়টি বাঘকে গুলি চালান। রাজা জর্জের মহা রাজ্যাভিষেকের অংশ হিসেবে ১৯১১ সালের নেপালে চলে এ শিকার অভিযান। অভিযানের বলি হয় ১৮টি গন্ডার, ৩৯টি বাঘ এবং চারটি শ্লথ ভাল্লুক। সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় ভারতের বড় লাট লর্ড লিনলিথগোর শিকার অভিযান। ১৯৩৮ সালের এ অভিযান শেষে মারা পড়ে ১২০টি বাঘ, ২৭টি চিতাবাঘ, ১৫টি ভালুক আর ৩৮টি গন্ডার।
শিকার শুধু ব্রিটিশ রাজের একচেটিয়া অধিকার ছিল না। উপমহাদেশের রাজরাজরা ও তাদের পরিবার-পরিজন সমানভাবে জড়িত ছিলেন এতে। এদেরই অন্যতম কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভূপ বাহাদুর। ২৬ বছরে ৩৬৫টি বাঘ, ৩১১টি চিতাবাঘ এবং ২০৭টি গন্ডার শিকার করে তিনি রেকর্ড গড়েছেন। (আরেক ভারতীয় রাজা ১১৫০ বাঘ শিকারের দাবিদার ছিলেন!)
শিকার সাহিত্যের ধারাটি তখনকার পরিস্থিতির গোটা চিত্র আমাদের কাছে ফুটিয়ে তোলে না। আলো-আঁধারিতে ভরপুর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এতে আমরা পাই। শীতল যুদ্ধের গোয়েন্দা কাহিনির সাথে এর মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। এসব আখ্যানে গুপ্তচররা কীভাবে কাজ করেছিল তারই ব্যাখ্যান রয়েছে।
সংরক্ষণবাদীরাও শিকার কাহিনি পছন্দ করেন। এ ছাড়া শিকার কাহিনির প্রতি সাধারণ পাঠকবর্গের অব্যাহত মুগ্ধতা এবং ভালোবাসার ব্যাখ্যা কী? প্রখ্যাত বাঘবিজ্ঞানী উল্লাস কারান্থ বলেন, 'প্রকৃতিসংক্রান্ত বইয়ের স্তূপ এবং জিম করবেটের মানুষখেকোদের গল্প'-এর মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। নেতৃস্থানীয় বুনো জীববিজ্ঞানী এবং 'ফিল্ড ডেজ'-এর লেখক এ জে টি জনসিং শৈশবকালে জিম করবেটের একটি তামিল অনুবাদ পড়েছিলেন। তিনি বলেন, সে পুস্তক বন্য প্রাণীর প্রতি আমার অন্তর্নিহিত আগ্রহকে উদ্দীপ্ত করেছিল।
এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে ইচ্ছাকৃত দোদ্যুল্যমানতা। যেমন একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে করবেট এবং অ্যান্ডারসনের মতো শিকারিরা তাদের লেখায় নিজেদের উপস্থাপন করেন একজন সাদা ঔপনিবেশিক শিকারি এবং একজন উদ্ধারকারী হিসেবে। স্থানীয়দের প্রতি তাদের রয়েছে অপরিসীম মায়া এবং মানুষখেকো বাঘ শিকার করাকে 'মহৎ উদ্যোগ' হিসেবে চিহ্নিত করেন তারা। হ্যাঁ, তাদের ব্যাখ্যাটি সত্য, কিন্তু সেখানে প্রশ্ন রয়েছে। মানুষখেকোদের শিকার করেছেন এবং তাদের সম্পর্কে আরও অনেকেই লিখেছেন, যেমন অজয় কুমার রেড্ডি, শের জং এবং ডোনাল্ড অ্যান্ডারসন। কেন তারা করবেটের সমকক্ষ হিসেবে বিবেচিত হন না?
করবেট এবং অন্যান্য শিকার লেখকদের মধ্যে একটি পার্থক্যের সীমারেখা এঁকেছে সহানুভূতি প্রদর্শন। শিকারসংক্রান্ত অন্য লেখকেরা কেবল নিজস্ব অনুপ্রেরণার বশে শিকারে নেমেছেন এমনটি নয়। কিংবা করবেট অন্যদের তুলনায় শিকার কাহিনি চমৎকারভাবে লিখেছেন, তা-ও নয়। তবে করবেট তার শিকার প্রাণীর জন্য করুণা ব্যক্ত করেছেন। এ প্রাণীর মৃত্যু অবধারিত জেনেও করুণা প্রকাশে পিছপা হননি তিনি। একইভাবে স্থানীয় মানুষজনকে রক্ষার জন্য শিকারে নেমেছেন। একইভাবে স্থানীয় মানুষদের জন্য দরদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। অন্যান্য লেখকও মানুষখেকোদের শিকার করেছেন ঠিকই কিন্তু তাদের শিকার বর্ণনায় নিজর কাজকে 'মহতী উদ্যোগ' হিসেবে তুলে ধরতে পারেননি। ডোনাল্ড লিখেছেন, 'আমার নিখুঁত গুলিবর্ষণে বাঘটি ঘটনাস্থলেই মারা যায় এবং শিগগিরই সকালের উজ্জ্বল সূর্যের আলোতে আমার শিকার করা প্রথম মানুষখেকো এবং আমি স্নাত হই। বাঘ এবং আমি দুইয়ে মিলে নরম আলোতে একটি অবিস্মরণীয় স্মৃতি সৃষ্টি হলো।' এবার করবেটের সাথে এর তুলনা করুন, তিনি তার শেষ মানুষখেকোকে গুলি করার পরে লিখেছেন: 'এমন কিছু সময় আসে, যখন জীবন একটি সুতোর ওপর ঝোলে...যদি আমার শিকারের ফলে একজন মানুষের জীবনও বাঁচানো যায়, তাহলেই আমি পর্যাপ্তভাবে পুরস্কৃত হয়েছি ধরে নিই।'
ভারত-নেপাল সীমান্তের পূর্ব কুমায়ুনে বেশির ভাগ শিকার করেছেন করবেট। কুমায়ুনের গ্রামবাসীদের সাথে করবেটের যে সম্পর্ক ছিল, দক্ষিণ ভারতীয় বনের আদিবাসীদের সাথে একই সম্পর্ক ছিল অ্যান্ডারসনের। সাবেক অবৈধ চোরা শিকারি বা পোচার বাইরা পূজারি এবং রাঙ্গার মতো ব্যক্তিদের সাথেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নীলগিরি ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাসোসিয়েশনের 'নিয়ম'-এর বাইরে গিয়ে স্থানীয় শিকারিদের জন্য নিজস্ব সম্মানের রূপরেখা তৈরি করেন এই দুই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। ভারতীয় শিকারির শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিনিধিত্ব করেন তারা। একজন সঙ্গহীন একলা মানুষ, সুন্দর কিন্তু বিপজ্জনক বনে অন্যদের স্বার্থে মারাত্মক মানুষখেকোকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছেন এককভাবে নিজেই। এ চিত্রটি অবশ্যই অসম্পূর্ণ, তবে নিঃসন্দেহে এমন একটি চিত্র, যা আমার মতো অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে। যখনই আমরা বনে পা রাখি, তখন এই রোমাঞ্চকর আখ্যানগুলো স্পষ্টভাবে মনের মধ্যে ভেসে ওঠে।
(বাঘ শিকার আর জিম করবেট মনে হয় যমজ শব্দ। একে অন্যের পরিপূরক। খুব অল্প বয়স থেকেই এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের স্কুলের পাঠ্যতালিকায় জিম করবেট ছিল। এ-ও একটি কারণ হতে পারে। একইভাবে হয়তো আসতে পারে বাংলাদেশে পচাব্দী গাজীর কথাও। তবে সে কাহিনি প্রচার পায়নি। বলা আর অ-বলা অনেক কাহিনির ভিড়ে শিকারের গল্প শিহরণ তোলে অনিবার্যভাবেই। কী এমন লুকিয়ে আছে এসব গল্প-কাহিনিতে! নির্মোহ সে বিষয় বিচারের চেষ্টার মধ্য দিয়ে আবার স্মরণ ও উপলব্ধি করি পুরোনো সেই শিকার কাহিনিগুলোকে। এ কথা হয়তো আজ অনেকেই জানেন না, শিকারের বিচিত্র কাহিনি পরিবেশন করতেন সেলিম (বায়োজিদ খান পন্নী) ভাইয়া। বাঘ শিকারের সাহসী কাহিনি সেকালে ছেপেছিল ঢাকার এক মাসিক পত্রিকা। কিশোর বয়সে পড়েছিলাম সে গল্প। কিন্তু আজ আর মনে নেই। কিংবা মনে নেই তার বইটির নামও। ঢাকার কাছাকাছি বাঘ শিকার করেছিলেন তিনি। এসব হারানো কাহিনিকে খুঁজে বের করা গেলে দারুণ হতো। এ রকম আরও কাহিনি যে অতীতের অন্ধকারে লুকিয়ে নেই—সে কথা কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন! পাঠকের পাতে যদি পরিবেশন করা যেত সেসব গল্প, তার স্বাদ হতো ভিন্নতর। হয়তো কেউ একদিন এসব হারানো গ্রন্থসম্ভার আর কাহিনিমালাকে আবার প্রকাশের উদ্যোগ নেবেন।)
- সূত্র: স্ক্রল ডটইন