দাবার জগতে সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধ: কারপভ বনাম করচনোই শতাব্দী সেরা লড়াই
৩০ বছর বয়সী রুশ গ্র্যান্ডমাস্টার দাবাড়ু আনাতোলি কারপভ। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির শীর্ণকায় এই ভদ্রলোক নিজের চলন-বলনে সবসময়ই অত্যন্তকৌশলী। কমিউনিস্ট পার্টি এবং তরুণ কমিউনিস্ট লিগ কমোসোমোলের সদস্যও তিনি। সোভিয়েত নবজাগরণের পুরোদস্তুর প্রতিনিধি বলা যায় তাঁকে। কখন কোথায় কীভাবে ঠিক কথাটা বলতে হবে, তা তাঁর জানা এবং সেজন্য সবার শ্রদ্ধার পাত্রও। দাবার আসরের বাইরেও বেশ স্নিগ্ধ চিন্তা-চেতনার মানুষ। তবে মোটামুটি সবার কাছে শ্রদ্ধাভাজন হলেও জীবনের অর্ধশতাব্দী পেরোনো ভিক্টর করচনোইকে তিনি সত্যিই অপছন্দ করেন। ইতালির মেরানোতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে তাঁদের দেখা হয়েছিল ১৯৮১ সালে। তবে এখানেও যদি তাঁদের তিন বছর আগের ফিলিপাইনের ম্যাচের পুনরাবৃত্তি ঘটত, তবে সেটা স্রেফ দাবায় সীমাবদ্ধ থাকত না বলে আশঙ্কা ছিল।
তৎকালীন সোভিয়েতদের চোখে কারপভ ছিলেন দাবার মহানায়ক। আর তাঁর বিপরীতে আছেন ভঙ্গ স্বাস্থ্যের অধিকারী রুগ্ন একজন ব্যক্তি, যিনি 'নৈতিকভাবে স্খলিত'; কারণ স্রেফ সামান্য কিছুর আশায় ১৯৭৬-এ সোভিয়েত থেকে আশ্রয় নিয়েছেন নেদারল্যান্ডসে। দেশবাসীর কাছে করচনোই তাই একজন বিশ্বাসঘাতক। ১৯৭৮-এ করচনোই-কারপভ যখন একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে খেলেছেন, তখনো সেখানে বৈরিতা ছিল। দুজন যখন মেরানোতে আবার মুখোমুখি হবেন, ততদিনে শত্রুতা আরও গাঢ় হয়েছে। দুয়ের মধ্যেকার লড়াইটা স্রেফ ব্যক্তিগত না, বরং রাজনৈতিকও।
সোভিয়েত প্রচারণাও আগুনে ঘি ঢালার কাজ জারি রাখল। '৮১-এর আগস্টেই সোভিয়েত সংবাদসংস্থা তাস দাবি করল, করচনোই দক্ষিণ আফ্রিকার টুর্নামেন্টে আন্তর্জাতিক ক্রীড়ার গণতান্ত্রিক আদর্শের সাথে প্রতারণা করেছেন। আর কারপভ নিজেও ততদিনে করচনোইকে 'অনৈতিক' আখ্যা দিয়ে ফেলেছেন; কারণ, করচনোই নিজের পরিবার ছেড়ে দেশত্যাগী হয়েছেন। স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে রেখেই মূলত করচনোই পাড়ি জমিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের অ্যামস্টারডামে।
করচনোইও অবশ্য কম যান না। দেশত্যাগী হওয়ার পর সোভিয়েত ব্যবস্থাকে আক্রমণ করার কোনো সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি। কারপভের তিরস্কারের প্রত্যুত্তরেই তিনি বারবার দাবি করে এসেছেন যেন তাঁর সন্তান এবং সহধর্মিণীকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। করচনোই-পুত্র আবার অত্যাবশ্যকীয় সামরিক দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগে ১৯৭৯ সালে হাজতবাসী হয়েছেন। কারাভোগের ছয় মাস তার এখনো বাকি। এদিকে সোভিয়েত দাবাড়ুদেরও নিন্দা করা থামাননি করচনোই। প্রতারণার অভিযোগ তো তুলেছেনই, পাশাপাশি সোভিয়েতরা কীভাবে একাট্টা হয়ে পশ্চিমাদের নাকানিচুবানি খাওয়াতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, মোক্ষম সময়ে কঠিন কঠিন অভূতপূর্ব সব চাল হাজির করে, সেসবও বলেছেন। রুশরা কেন তাঁকে বয়কট করল, সেটি নিয়ে জানিয়েছেন নিন্দা। এজন্য তাঁকে নিরন্তর অপমান-ভর্ৎসনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, এমনকি জীবনের ওপর হুমকিও এসেছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
অবশ্য করচনোই আর কারপভ—কেউই কাউকে নিয়ে খুব ভালো ধারণা পোষণ করতেন না। দুয়ের মধ্যেকার বৈরিতার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। করচনোইয়ের জন্মস্থান লেনিনগ্রাদ। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দাবাড়ুদের ঘাঁটি সেটি। দাবায় রুশদের আধিপত্যের কথা কে না জানে! সেই গর্বিত ইতিহাসেরই সামনের সারিতে দাঁড়াবার মতো সম্ভাবনা ছিল তাঁর। চারবার সোভিয়েত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পাশাপাশি, নিজ দেশে তিনিও শ্রদ্ধা পেয়েছেন একসময়।
মেধাবী কোনো সোভিয়েত দাবাড়ুকে তার জীবন-জীবিকা নিয়ে কোনো ভয়ে থাকতে হয় না। রাষ্ট্র তাকে শৈশব থেকেই ভীষণ যত্ন-আত্তি দিয়ে লালন-পালন করে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের জন্য প্রস্তুত করে। আর যখন সে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনে, তখন তার পুরস্কার হিসেবে মোটা অঙ্কের সম্মানী তো আছেই। কারপভ সেখানে একদম শীর্ষস্থানীয়। সেই সুবাদেই মস্কোতে একটি সুন্দর অ্যাপার্টমেন্ট, মার্সিডিজ এবং বিলাসবহুল গ্রীষ্মকালীন বাসভবন ডাচাও রয়েছে তাঁর।
কিন্তু করচনোই যতই মেধাবী হোন না কেন, কোনোদিনই কারপভের মতো সোভিয়েতদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেননি। রুশদের কাছে তিনি অশিষ্ট, মাথাগরম, রগচটা, ইহুদি একজন। ১৯৭৪-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের একজন প্রতিযোগী ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক এই আসরে দীর্ঘ তিন বছর ধরে কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় দাবাড়ুদের। সেখানে শেষ পর্যন্ত যে ছয়জন টিকে ছিলেন, তাদের মধ্যে তিনি একজন। প্রতিযোগিতার শেষ ভাগে প্রতিপক্ষকে হারাতে পারলেই চ্যাম্পিয়নশিপের আখ্যা। ১৯৭৪-এ সেখানে মুখোমুখি হয়েছিলেন কারপভ-করচনোই। বিশ্ব সেবারই প্রথম তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্র এক ঝলক দেখতে পেয়েছিল।
১৯৫১ সালে কারপভ জন্মেছিলেন দক্ষিণাংশের উরালের জলাতাউস্ত শহরে। শৈশবেই তাঁর পরিবার তাঁকে নিয়ে লেনিনগ্রাদে পাড়ি জমায়। অন্য সব সেরা দাবাড়ু, গণিতজ্ঞ, বিজ্ঞানী, সংগীতজ্ঞের মতো কারপভও খুব অল্প বয়সেই দাবা শুরু করেন—মাত্র চার বছর বয়সে। তাঁর প্রতিভার জন্যই তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন; লোকে তাঁকে দীর্ঘসময় ধরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন খেতাব ধরে রাখা মিখাইল বটভিনিকের উত্তরসূরি হিসেবে দাবি করত। বটভিনিককে অনেকে সর্বকালের সেরাদের একজন বলে মনে করে। কারপভও সেই গতিতেই এগিয়েছেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ডমাস্টার। দাবায় পয়েন্ট সিস্টেমের কারণে মূলত এক গ্র্যান্ডমাস্টারদের হারিয়েই গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পাওয়া সম্ভব।
সকাল দেখেই দিন কেমন যাবে, তার একটা আঁচ করা যায়। কারপভের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। একের পর এক সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। ১৮ বছর বয়সেই তিনি বিশ্ব যুবচ্যাম্পিয়ন হন। গুরুত্বপূর্ণ একটি টুর্নামেন্টে যুগ্মভাবে প্রথম হন। মস্কোর আলেখাইন মেমোরিয়ালে অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্টে যে ১৮ জন গ্র্যান্ডমাস্টার অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে চারজন সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিলেন। কারপভকে অপরাজিতই মনে হয়েছে। একের পর এক টুর্নামেন্টে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে গেছেন। ১৯৭১-৭৮ পর্যন্ত সময়ে তিনি খেলেছেন ১৮৮টি টুর্নামেন্ট-গেম, এর মধ্যে হেরেছিলেন কেবল ছয়টিতে। অবশ্য হ্যাঁ, এখানে কিছু ম্যাচ ড্রও হয়েছিল।
তাই স্বাভাবিকভাবেই ১৯৭৪ সালে কারপভ-করচনোই যখন মুখোমুখি হলেন, তখন একটা উদ্দেশ্যকেই সামনে রেখে দুজনই খেলেছেন। আর তা হলো, তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ববি ফিশারকে কীভাবে পরাজিত করা যায়। সেই অর্জন কার কাছে এসে ধরা দেবে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লেনিনগ্রাদ অবরোধ দেখে বিধ্বস্ত করচনোই কি হারাতে পারবেন ফিশারকে? নাকি সোভিয়েত দাবার অঘোষিত রাজপুত্র কারপভই সেই সুযোগ লুফে নেবেন?
না, দীর্ঘসময় কঠিনভাবে টেক্কা দিয়েও করচনোই পারলেন না। মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে হেরে গেলেন। ঠিক এরপরই হলো অনুভূতির বিস্ফোরণ। তাঁর সাথে অন্যায় করা হয়েছে, তিনি অপমানিত হয়েছেন—এমনটা বললেন। তাঁর ধমনিতে বইতে থাকা ইহুদি রক্তই তাঁকে সোভিয়েতদের কাছে অপ্রিয় এবং অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে বলেও অভিযোগ তুললেন। 'শুরু থেকেই আমি ছিলাম একা এবং সেটি আর কখনোই পাল্টায়নি।' শুধু তা-ই নয়, সেই বিষোদ্গারে কিছু বাণ তিনি ছুড়ে দিয়েছেন কারপভের দিকেও। স্পষ্ট ভাষায় বললে, কারপভের দাবাশৈলীর দিকে।
কারপভের দাবা খেলার ঢং বেশ নীরস। কেবল তা-ই নয়, ববি ফিশারের সাথে খেলতে বসলে কারপভ কোনোদিনই পেরে উঠতেন না, এমনও বলেছেন।
এই পর্বের পর আর করচনোই-কারপভের একে অপরের প্রতি কোনো অনুরাগ অবশিষ্ট রলই না। করচনোইকে অবশ্য ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছিল। এরপর করচনোই দেশত্যাগ করলেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টির একজন সচেতন সদস্য হিসেবে কারপভও তাঁর সতীর্থদের সাথে করচনোই-নিন্দায় শামিল হলেন। করচনোইকে বয়কট করা হয়েছিল। যদি তিনি কোনো খেলায় অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তবে সেখানে আর কোনো সোভিয়েত তারকাকে দেখা যেত না। এটি করচনোইকে ব্যক্তিগতভাবে অতটা আঘাত না করলেও তাঁর আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়েছিল। চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে খেলতে না পারলে, অন্য ছোটখাটো দাবার আসর দাবাড়ুর জন্য খুব বেশি লাভজনক না। আর পেশাদার দাবাড়ুদের তো এই বড় আসরগুলোতে থাকতেই হয়। তাছাড়া খেলোয়াড়েরা দাবা নিয়ে শিক্ষাদান, লেখালেখি এবং বিভিন 'প্রদর্শনীর' মাধ্যমেই অর্থোপার্জন করে থাকেন। পাঠক ভাবতে পারেন, এখানে প্রদর্শনী আবার কোত্থেকে এল? মূলত ঝানু এবং দক্ষ দাবাড়ু যখন একইসাথে বেশ কয়েকজনের সাথে দাবা খেলেন, সেটিকে সিমুলটেনিয়াস এক্সিবিশন বা সংক্ষেপে সিমুল বলা হয়ে থাকে। আলেখাইন ৩০০ লোকের সাথে একত্রে দাবা খেলার রেকর্ডও করেছিলেন।
যা-ই হোক, ববি ফিশার খেলা থেকে অবসর নেওয়ায় কারপভ হয়ে ওঠলেন চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু সেটিতে তাঁর অবদান সামান্যই। তাই তিনি যে সত্যিকার অর্থেই শ্রেষ্ঠ চ্যাম্পিয়নদের কাতারের লোক, তা প্রমাণ করতে মনোযোগী হলেন। অনেক পেশাদার দাবাড়ু বিশ্বাস করতেন যে কারপভ হয়তো ফিশারের আত্মাকে ডেকে আনার চেষ্টাও চালিয়েছেন। সেটা কি সত্য না মিথ্যা, তা জানা নেই। তবে কারপভ টুর্নামেন্ট থেকে টুর্নামেন্ট চষে বেরিয়েছেন। একটি অভূতপূর্ব রেকর্ড ধরে রেখেছেন। সেরাদের সেরাকে হারিয়েছেন। আদতে তিনিই যে চ্যাম্পিয়ন, তা নিয়ে কারও মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না।
একইসাথে করচনোইও যে কারপভের পরের আসনটিই ধরে রেখেছেন, তাতেও সন্দেহ ছিল না। তাই তিন বছর স্থায়ী সেই প্রতিযোগিতার আসরে তাঁকে শুরুতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। যারা তাঁর মুখোমুখি হয়েছে, সবাইকে পরাজিত করেছেন অনায়াসে। ফিলিপাইনের ব্যাগিয়ো শহরে অনুষ্ঠিত সেই চ্যাম্পিয়নশিপে কারপভের মুখোমুখি হতে কী পরিশ্রমটাই না করতে হয়েছে করচনোইকে!
স্প্যাসকি-ফিশারের দুষ্টুমি-খুনসুটি যেভাবে ১৯৭২-এ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে রাজত্ব করেছে, কারপভ-করচনোইয়ের বাগ্বিতণ্ডা গণমাধ্যমে সেভাবে আসেনি। তবে কিছু ক্ষেত্রে, স্প্যাসকি-ফিশারের বাগ্যুদ্ধও কারপভ-করচনোই প্রতিদ্বন্দ্বিতার কাছে ম্লান হয়ে যায়। রেইকিয়াভিকে '৭২-এ স্প্যাসকি-ফিশার দ্বন্দ্বের কথা অনেক দাবা-ভক্তই জানেন। ফিশার প্রথমে আসরে উপস্থিত হতেই নিমরাজি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শিল্পপতি জিম স্লেটার তাঁর পারিশ্রমিকের পরিমাণ দ্বিগুণ করে দেওয়ায় তিনি আসেন।
মূলত প্রথম ম্যাচে বেশ কুখ্যাত একটি চালের জন্য হেরে দ্বিতীয় দফায় আসতে অস্বীকৃতি জানান ফিশার। তাঁর দাবি, সেই ম্যাচটি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হওয়ার কারণেই নাকি তিনি মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর একটি বদ্ধ ঘরে বসে স্প্যাসকির সাথে তৃতীয় ম্যাচটি জিতেছিলেনও তিনি। সেই টুর্নামেন্টে ফিশার যেভাবে নালিশের পর নালিশ করে গেছেন, তা ছিল দেখার মতো। ফিশারের এই কাণ্ডকারখানা স্থান করে নিয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সব পত্র-পত্রিকার প্রথম পাতায়।
তবে এর চেয়েও বেশি আলোচনা-সমালোচনা-উত্তেজনা ছিল ১৯৭৮-এর আসরের কারপভ-করচনোইকাণ্ডে। সেখানে ববি ফিশারের কারিশমা না থাকায় হয়তো গণমাধ্যমকর্মীরা আর সেভাবে আগ্রহ পাননি। বিশাল দলবল নিয়ে ব্যাগিয়োতে পৌঁছেছিলেন কারপভ। তাঁর সাথে ভ্লাদিমির জুখার নামক একজন মনঃসমীক্ষকও ছিলেন। করচনোইয়ের বরাবর বসে ড্যাব ড্যাব চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকাই ছিল জুখারের একমাত্র কাজ। তৃতীয় ম্যাচে গিয়ে করচনোইয়ের মনে হলো, জুখার আসলে তাঁকে সম্মোহিত করতে চাচ্ছেন। তিনি সেটির নালিশ করলেন, প্রতিবাদ জানালেন। তবে সেজন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সপ্তম ম্যাচে পৌঁছাতে পৌঁছাতে করচনোই ততদিনে পাগলপ্রায় হয়ে গেছেন। আর কারপভও করচনোইয়ের চেয়ে বেশ এগিয়ে আছেন। করচনোই চিৎকার করে বললেন, মঞ্চ থেকে নেমে তিনি জুখারকে মারধর করবেন। এরপরই কেবল জুখারকে পেছনের সারিতে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
পুরোটা সময় কারপভ-করচনোইয়ের মাঝে বরফ শীতল স্নায়ুযুদ্ধ বিরাজ করেছে। আবার কারপভ খেলার মাঝে দই খেতে বেশ পছন্দ করতেন। সেটি নিয়েও তুমুল কাণ্ড বাধালেন করচনোই। তাঁর মতে, এই দইটিও হতে পারে একটি কোড। বিশেষ বিশেষ ফ্লেভারের দই যখন কারপভের কাছে আসছে, তখন সেটি হয়তো কোনো নির্দিষ্ট চালকে নির্দেশ করছে। তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির লোথার স্মিড ছিলেন সেই খেলার রেফারি। তিনি নিয়ম করে দিলেন, দই যদি আসেই, তবে সেটি মঞ্চে খেলার শুরুতে আসতে হবে, ঠিক সোয়া সাতটা বাজে, অর্থাৎ খেলায় কোনো জরুরি চাল আসার আগেই। উল্লেখ্য, স্মিড স্প্যাসকি-ফিশার দ্বন্দ্বের সময়ও রেফারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পাঠক এতটুকু পড়ে ভাবতেই পারেন যে দ্বন্দ্ব-নাটের গুরু স্রেফ করচনোই-ই ছিলেন। না, তা নয়। কারপভ নিজেও করেছিলেন বেশ কিছু নালিশ। শেষপর্যন্ত, অষ্টম ম্যাচের শুরুতে করচনোইয়ের সাথে করমর্দনেও কারপভ অস্বীকৃতি জানান। এরপর আর কখনোই তারা করমর্দন করেননি। এমনকি একে অপরের সাথে কথা পর্যন্ত বলতেন না।
চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে যে খেলোয়াড় ছয়টি খেলায় জিততে পারবেন, তিনিই জয়ী হবেন। এখানে ড্র গণনা করা হয় না। আর সেখানে কারপভ ৪-১-এ এগিয়ে গেলেন করচনোইয়ের চেয়ে। এরপর করচনোইয়ের খুঁটি আরও দুর্বল হয়ে পড়ল। সপ্তাহান্তে খেলার ফাঁকে করচনোই ম্যানিলায় গিয়ে মার্কিন যোগসাধককে নিয়ে এসেছিলেন। জুখারের কুনজর থেকে নিজেকে মুক্তি দিতেই নাকি এ কাজ করেছেন। অবশ্য সেটি কাজ করেছিল কিনা, জানি না, তবে পরের কয়েক সপ্তাহজুড়ে করচনোই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। কারপভের সাথে যেখানে একসময় তাঁর ৪-১ ছিল, সেটিই তিনি চারটি ম্যাচ জিতে ৫-৫-এ এনে টাই করে ফেললেন।
এখন যিনিই পরের ম্যাচটি জিতবেন, তিনিই জয়ী। কী এক আশ্চর্য কাণ্ড! রুশরা তো আত্মহারা। মস্কোতে করচনোইয়ের কুশপুত্তলিকার দিকে লাঠিসোঁটা-পাথরও নিক্ষিপ্ত হয়েছে। পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই ম্যাচ অনুসরণ করছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোন দিকে যাবে? এ তো মহা মুশকিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল তারা। কারণ, দেশত্যাগের পর করচনোইয়ের নাম তারা মুখেও আনবে না। মস্কোর সংবাদপাড়ার লোকজন ভাবছিলেন যে এই আপদ কবে শেষ হবে! আর কারপভ যদি শেষ ম্যাচ হেরে যান, তখনই বা কী হবে? তবে এই মাঝামাঝি সময়েও তারা করচনোইকেই অপমান করা চালিয়ে গেলেন। করচনোইকে 'অত্যন্ত রুক্ষ, অপমানজনক, দাম্ভিক, বোকা'র মতো নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করে সাংবাদিকেরা পত্রিকায় লিখতে থাকলেন।
করচনোই ৩২তম গেমটি হেরেছিলেন। ম্যাচের ৯২তম দিনে কারপভ আবার নিজের খেতাব ফিরে পেলেন। রুশ আমলাতন্ত্রে হয়তো তখন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বয়ে গেল। তবে করচনোই তাঁর পরাজয়ের পেছনে রাজনৈতিক কৌতূহলকে দায়ী করেছিলেন।
কারপভের খেলার ঢং নিয়ে বলেছেন, 'ও বেশ কৌশলী হয়েই খেলে। তবে সেখানেও কিছু বড়সড় দুর্বলতা আছে।' এই ম্যাচটা ১৯ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়ার কথা থাকলেও করচনোইয়ের দাবি ছিল তাঁর পরিবারকে ছেড়ে দেওয়ার আগপর্যন্ত তিনি খেলতে বসবেন না। তৎকালীন আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশনের সভাপতি ফ্রিডরিখ ওলাফসন তখন এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ম্যাচটিকে এক মাসের জন্য তিনি পেছান। হয়তো মানবাধিকারের খাতিরেই সোভিয়েত সরকার করচনোইয়ের পরিবারকে ছেড়ে দেবেন, এ আশায়।
কারপভ খেলার সময় বেশ রক্ষণশীল কায়দায় খেলেন এবং এজন্য তিনি বেশ কয়েকবার ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন। তিনি বলেছেন, 'জেতাই আমার কাছে খেলার মূল উদ্দেশ্য। সেটি যদি একটু নীরসও হয়, তাতে আপত্তি কই? স্রেফ কৌশলী খেলাই হোক না! কারণ, আকর্ষণীয় এবং জটিল জটিল সব চালের বাহারে যদি কেউ খেলা হারতেই বসে, তবে লাভটা কোথায়? আমার কাছে জেতাটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।' পেশা জীবনের শুরু থেকেই তিনি এভাবে খেলে এসেছেন, দেখে মনে হবে কোনো নানা-দাদা খেলতে বসে অতি সন্তর্পণে সামনে এগোচ্ছেন, যিনি কোনো ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নন। কারপভ প্রতিপক্ষকে সরাসরিভাবে ঘুষি মারার চেয়ে তাকে নজরদারিতে রাখতেই বেশি আগ্রহী। আর ছোট কোনো সুবিধা পেলেও সেটির সদ্ব্যবহার দীর্ঘ মেয়াদে কীভাবে করতে হবে, সেটি তিনি ভালোভাবেই জানেন। খেলার কিছু সময়ের মধ্যেই প্রতিপক্ষ কোন দিকে এগোবেন, তা তিনি বোঝেন। খেলায় খুব আকর্ষণীয় তেমন কিছুই অবশ্য হয় না। স্রেফ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারপভ জিতে যান। তবে ঠিক একই কারণে কারপভের ম্যাচগুলো হয় বেশ একঘেয়ে। সেখানে কল্পনা বা সহজাত প্রবৃত্তির চেয়ে প্রাধান্য পায় সন্তর্পণে কুশলী হয়ে এগোনোর দৃঢ় মানসিকতা। কারপভের সমসাময়িক বা তাঁর উত্তরসূরিদের কজনই বা এত নিখুঁতভাবে এটি পেরেছেন?
পক্ষান্তরে, করচনোইয়ের ধারা একদমই ভিন্ন। মার্কিন গ্র্যান্ডমাস্টার রবার্ট বায়ার্নের মতে, দাবার জগতকে যদি মল্লযুদ্ধের মতো ভাবা হয়, সেখানে হয়তো করচনোই-ই প্রতিপক্ষকে সবচেয়ে জোরে ঘুষিটি মারেন। কোনোরকম আপোষ না করে আঘাত-প্রতিঘাতের যে দারুণ সমন্বয়—খেলার এই দারুণ আনন্দটাকে তিনি শতভাগ নিজের করে নিতে চান। কীভাবে সেখানে একের পর এক সংকট তৈরি করা যায়, সেই চেষ্টায় তিনি মেতে থাকেন সারাক্ষণ। করচনোইয়ের শৈলী তাঁর মতোই জটিল। করচনোইকে যারা চেনেন, তারা তাঁকে চঞ্চল, বাঁধনহারা, আবেগতাড়িত—মোটামুটি এসব বিশেষণেই আবদ্ধ করতে চান। প্রতিভাবান এবং প্রভাবশালী মার্কিন-অস্ট্রিয়ান দাবাড়ু ভিলহেল্ম স্টাইনিটজও তো এমন তকমাই পেয়েছিলেন। করচনোই যখন খেলতে বসেছেন, তখন হয়তো এমন একটি দাবার বোর্ডের দেখা মিলবে, যেখানে বোর্ডের বাইরেই অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘুঁটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
কারপভের অতি সতর্কভাবে খেলার কৌশলে করচনোই হয়ে উঠতেন অধৈর্য। '৭৮-এ তিনি নিজের পুরো শক্তিমত্তা দিয়েই চেষ্টা করেছেন কীভাবে খেলাটিকে এই ভঙ্গিমা থেকে বের করে অদেখা-অজানা কোথাও নিয়ে যাওয়া যায়। কারপভের মতো অতি মনোযোগী ছাত্রদের খেলার শুরুতে হওয়া কেতাবি সব চালই মুখস্থ এবং তারা সেটির বাইরে সহজে যেতে চান না। তাই তাঁর দিকে একদম ভিন্ন কিছু ছুড়ে দেওয়া যায় কিনা, করচনোইয়ের নিরন্তর চেষ্টা ছিল সেদিকে।
করচনোই ছিলেন আবেগপ্রবণ একজন মানুষ। সামাজিক পরিস্থিতির জেরে একটি উটকো ঝামেলায় আটকে ছিলেন। তাঁর আচরণ খুব পরিশীলিত ছিল না, দাবার বাইরে অন্য কিছুতে তিনি তেমন সময় অতিবাহিতও করেননি। তাই দাবাকে ঘিরেই সেটি আবর্তিত ছিল। নিজের জগতে নাকি তিনি বেশ বন্ধুপ্রতিম। ববি ফিশারের সাথেও নিজের মিল খুঁজে পেতেন। করচনোইকে যারা কাছ থেকে চিনতেন, তারা সবাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এসবই বলতেন।
অন্যদিকে যে কজন দেশত্যাগী রুশ গ্র্যান্ডমাস্টার কারপভের উত্থান দেখেছেন, তাদের অনেকেই তাঁকে পছন্দ করেন না। সোভিয়েত 'দাবার ফুয়েরার' বলে নিন্দাও করেন। কারপভ সহানুভূতিশীল কেউ নন। আদেশ দিতে পছন্দ করেন। আর কোনো খেলোয়াড়কে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ না করলে তাকে কীভাবে বিস্মৃত করে দেওয়া যায়, তা-ও তাঁর জানা আছে। অর্থাৎ এতটাই তাঁর প্রভাব। কারপভ যে সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন, এটিকেও অনেকে মেকি বলে দাবি করেছেন।
আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার আনাতোলি লেইনের মতে, কারপভের সাথে ইতালিতে করচনোইয়ের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারটিও অন্যায্য। কেন এমন ভাবেন? সেটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, দাবাড়ুদের ব্যাটালিয়নের সাথে করচনোইকে খেলতে হচ্ছে। সব রুশ গ্র্যান্ডমাস্টারই কারপভের অনুসারী। তাই করচনোই যখন খেলার মাঝে দুই সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে তাঁর পাশে থাকা মার্কিন বা কানাডিয়ান বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিচ্ছেন, তখন তারা শুধু কারপভের বিপক্ষেই খেলছেন না। বরং পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নের সেরা সেরা দাবাড়ু জোটবদ্ধ হয়ে কারপভকে সহায়তা করছেন। আবার কারপভ-করচনোইয়ের ২০ বছর বয়সের ব্যবধান তো আছেই।
তিন মাসব্যাপী একটি ম্যাচে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দিয়েও অনেক ধকল যায়। একজন তরুণ খেলোয়াড় এ ক্ষেত্রে সুবিধে পান। অবশ্য ইম্যানুয়েল লাস্কির মতো এমন দাবাড়ুও আছেন, যাঁরা পঞ্চাশ অতিক্রম করেও হাতে সস্তা চুরুট রেখে তাতে মাঝেমধ্যে টান দিয়ে অবলীলায় বড় বড় টুর্নামেন্ট জিতেছেন। করচনোইয়ের বন্ধুদের মতে, তিনি শক্ত-সামর্থই ছিলেন। ম্যাচের আগেও ব্যায়াম করে বেশ প্রস্তুতি নিতেন। দৌড়াদৌড়ি, সাইক্লিংয়ের মতো শরীরচর্চা করতেন। কিন্তু বয়স তাঁর ততদিনে ৫০। চোখজোড়া ক্লান্ত। মাংসপেশি ঝুলে পড়েছে, দুর্বল হয়ে গেছে। পরাজয়ের গ্লানি মানতে না পেরে ঘুমও কম হচ্ছিল। এই কারণে মস্তিষ্কও ছিল কিছুটা বিক্ষিপ্ত। যে চাপ তাঁকে নিতে হয়েছে, তা অত্যধিক। লম্বা টুর্নামেন্ট চলতে চলতে খেলোয়াড়দের ওজন অনেক কমে যাচ্ছে, এমনটাও দেখা যায় প্রায়ই। প্রতিবর্তী ক্রিয়াও যেন একসময় অচল হয়ে পড়ে।
টুর্নামেন্টে সময়ও ধরে-বেঁধে দেওয়া—আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ৪০টি চাল দিতে হবে। দাবাড়ু এটি করতে ব্যর্থ হলে তিনি খেলায় এমনিতেই হেরে যাবেন। অথচ যার শরীরে ব্যথা আর ক্লান্তি ভর করে আছে, তার পক্ষে তো মনোযোগ দেওয়া সম্ভব না। আর ইতিমধ্যেই আমাদের জানা, মনোযোগ সরে গেলে এই খেলায় কী হতে পারে। সিগারেটের ধোঁয়া, শোরগোল, জোরে কফির চুমুক দেওয়া, চেয়ারে অযথা নড়াচড়া করা কিংবা নাক খোঁচানো—যেকোনোটিই প্রতিপক্ষের উপাসনাসম মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়।
করচনোই-কারপভের খেলায় অনেক কদাকার ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক কাদা-ছোড়াছুড়ি আছে। দুজনই দুজনকে খুব অপছন্দ করতেন এবং দাবার বোর্ডেই হোক, রূপকার্থেই হোক, প্রতিপক্ষকে পরাজিত করাই তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য। দুজনই সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন। কারপভের জন্য অবশ্য বাজিটা স্পষ্টতই বেশি ভারী। তিনি যদি তাঁর নিজ দেশেরই অপ্রিয় এই বিশ্বাসঘাতকের কাছে যান, তবে নিজেও বেশ বিপদে পড়বেন। সোভিয়েত নবজাগরণের এ প্রতিভূ যদি তাঁরই ভূখণ্ডের সাবেক এবং 'ন্যূন' কারও কাছে হেরে বসেন, তাহলে সোভিয়েতরা সেটা মোটেও পছন্দ করবেন না। একেবারেই না। এখন পাঠকের মনে প্রশ্ন হতে পারে যে বুদ্ধির এ খেলায় তবে কে জিতেছিল? তাহলে পাঠককে বলে রাখি, জয়ী হয়েছিলেন আনাতোলি কারপভ।
১৯৮১ সালের অক্টোবর ১ থেকে নভেম্বরের ১৯ পর্যন্ত ইতালির সেই বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে কারপভ ছয়টি আর করচনোই দুটি ম্যাচে জিতেছিলেন। ১০টি ম্যাচ ড্র হয়েছিল। অবশ্য কারপভ হেরে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়নে কী হতে পারত, সেটি এখন স্রেফ আমাদের কল্পনাশক্তির ওপরই ছেড়ে দিতে হচ্ছে!