ক্রিকেটরঙ্গ, ক্রিকেট-চুম্বন ও টি-টোয়েন্টি
ইংলিশ ক্রিকেটার ফ্রেড ট্রুম্যান ক্রিকেটের মাঠজীবন পার করে সাংবাদিক প্যাভিলিয়নে বসতেন বিবিসির ধারাভাষ্যকার হিসেবে। আমার কালের অনেকেই তার সুললিত রসাত্মক ক্রিকেট বর্ণনা শুনেছেন। ২০০৬ সালে তার মৃত্যু হয়। তাকে নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য। ফ্রেডের স্ত্রী এনিড চ্যাপম্যান স্বামীর খুব খোঁজখবর রাখতেন। একদিন এনিড ফ্রেডের খোঁজে ক্লাবে ফোন করলেন।
যিনি ফোন ধরলেন, তিনি বললেন, দুঃখিত ফ্রেড তো এইমাত্র ক্রিজের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। এখনই ব্যাট করতে শুরু করবেন। তার ব্যাটিং শেষ হলে আপনাকে কলব্যাক করার জন্য তাকে বলব কি?
এনিড বললেন, তার দরকার হবে না, আমি ফোন ধরে আছি। আমি জানি ফ্রেড বেশিক্ষণ টিকতে পারে না।
শেষের বাক্যটি এনিড যে অর্থেই বলে থাকুন না কেন কিংবা আদৌ যদি না-ও বলে থাকেন, তবুও এটা ক্রিকেটের এবং নরনারীর সম্পর্কের একটি ক্লাসিক্যাল উদ্ধৃতিতে পরিণত হলো এবং এ মুখ সে মুখ হয়ে সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ল। সেকালে ভাইরাল শব্দটিও চালু হয়নি আর ভাইরাল করার মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তখন ছিল না।
ঠিক এই কৌতুকটি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে শর্মিলা ঠাকুর ও তার স্বামী ভারত জাতীয় দলের ক্রিকেট ক্যাপ্টেন নবাব পতৌদিকে নিয়েও প্রচলিত হয়ে ওঠে। শর্মিলা ঠাকুরও নাকি বলেছেন, আমি জানি ও বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না।
সময় বদলেছে। একাল বেশিক্ষণ টিকে থেকে রয়েসয়ে হাই তুলে পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচ খেলার কাল নয়। দ্রুতলয়ে সবকিছু করার বৈশ্বিক ঢেউ ক্রিকেটের গায়ে লেগেছে আরও বেশি। এসেছে সব মিলিয়ে আড়াই ঘণ্টার ক্রিকেট। কুড়ি ওভার ব্যাটিং-বোলিংয়ে বড়জোর সত্তর মিনিট, তারপর দশ মিনিটের ব্রেক, তারপর আবার কুড়ি ওভার ব্যাটিং-বোলিংয়ে সত্তর মিনিট। মোট ১৫০ মিনিট মানে আড়াই ঘণ্টা।
সুতরাং ফ্রেডের স্ত্রী এনিড যা বলেছেন, তার সাথে শুধু এটুকু যোগ করলেই টি-টোয়েন্টির সাফল্য নিশ্চিত-যাই করো, ঝটপট করো, বেশিক্ষণ ক্রিজে থেকে খুটখুট করার দরকার নেই।
অস্ট্রেলিয়ার একটি ক্রিকেট ক্লাবের ফান্ড রেইজিং ম্যাচে অতিথি খেলোয়াড় হিসেবে এসেছেন বিশ্বখ্যাত অ্যালান বোর্ডার। তার নাম শুনেই দর্শকে মাঠ ভরে গেছে। টিকেট বিক্রি হয়েছে দেদার।
ব্যাট করছেন অ্যালান বোর্ডার। বল করছেন ক্লাবের ফার্স্ট বোলার নেড। তিনি কখনো কোনো টেস্ট প্লেয়ারের বিরুদ্ধে বল করেননি। এটাই প্রথম এবং তা-ও আবার অ্যালান বোর্ডারের মতো ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে। বোলার নার্ভাস হয়ে পড়ছিলেন।
তিনি বল করলেন, বল বোর্ডারের অফ স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিল। ক্লিন বোল্ড আউট। কিন্তু করিৎকর্মা আম্পায়ার দেরি না করে নো বলের ইশারা দিলেন। সুতরাং বোর্ডার আউট নন। দুটো ঘটনাতেই স্ট্যাম্প উড়ে যাওয়াতে এবং আউট না দেওয়াতে বোলার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আম্পায়ারের দিকে এগিয়ে আসতেই আম্পায়ার চাপা গলায় তাকে বললেন, আরে আহাম্মক ভালো করে বল কর। এত যে দর্শক এসেছেন, তারা কেউ তোমার বোলিং দেখতে আসেননি, এসেছেন বোর্ডারের ব্যাটিং দেখতে।
ফ্রেড সব সময় বাড়িয়ে বলতেন বলেই পুরোনো অভ্যাসটা কাজে লাগিয়ে বেশ মজাদার একজন ধারাভাষ্যকার হতে পেরেছেন। ফ্রেড বললেন, 'আমি কেবল গাব্বা থেকে বের হয়েছি (ব্রিসবেন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের স্থানীয় নাম গাব্বা), অমনি অটোগ্রাফ নেবার জন্য ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি দল আমাকে ঘিরে ধরল।
'ফ্রেড, রাখো তোমার চাপাবাজি। তোমার অটোগ্রাফ নিতে এসেছে বললেই বিশ্বাস করব?'
ফ্রেড বললেন 'বিশ্বাস না হলে ডন ব্র্যাডম্যানকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো। তিনি তো আমার পাশেই ছিলেন।'
***
ফ্রেড একটি স্থানীয় ক্রিকেট টিমে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। দলের ক্যাপ্টেন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি ক্রিকেট খেলার কোনো অভিজ্ঞতা আছে।
থাকবে না মানে, অবশ্যই আছে। আমি তো ডন ব্র্যাডম্যানের সাথেও খেলেছি। এতে চলবে?
ক্যাপ্টেন বললেন, সত্যিই?
ফ্রেড বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। খেলা শেষে তিনি আমাকে বললেন, তোমাকে যদি ব্যাটসম্যান বলা যায়, তাহলে সেই তুলনায় আমি ডন ব্র্যাডম্যান। কী বুঝলেন? একবারে নিজের মুখে বলেছেন।
***
একজন অলরাউন্ড ক্রিকেটার মেডিকেল চেকআপ করাতে বড় ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন সমস্যাটা কী?
ক্রিকেটার বললেন, সমস্যা অনেক। আমি আগের মতো ফিল্ডিং করতে পারছি না, ক্যাচ মিস হচ্ছে, আমার বলে আগের মতো স্পিন হচ্ছে না, ব্যাটার পিটিয়ে যাচ্ছে আর ব্যাট ধরলে আমার অবস্থা আরও খারাপ। শেষ ম্যাচে ডাক। তাছাড়া আমার স্ত্রীও আমার পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
ডাক্তার আর না শুনেই বললেন, সমস্যা নেই। আপনি ক্রিকেট ছেড়ে অন্য কোনো খেলাতে মনোযোগ দিন।
ক্রিকেটার বললেন, 'কিন্তু তা কেমন করে সম্ভব? আমি যে পাকিস্তান (না বাংলাদেশ?) ন্যাশনাল টিমের ক্যাপ্টেন।'
***
শয়তান স্বর্গের দ্বাররক্ষী সেন্ট পিটারকে ক্রিকেট ম্যাচে চ্যালেঞ্জ করে। সেন্ট পিটার একাদশ বনাম শয়তান একাদশ। সেন্ট পিটার বললেন, শোন হে শয়তান, ডব্লিউ জি গ্রেস, ব্র্যাডম্যান থেকে শুরু করে হানিফ মোহাম্মদ-সবই তো স্বর্গে আমার দলে।
শয়তান বলল চিন্তা নেই, নরকে আমার দলে ভালো ক্রিকেটার না থাকতে পারে, কিন্তু আম্পায়াররা সবাই নরকে।
***
পুনরায় ফ্রেড। বিছানায় ফ্রেড। তার স্ত্রী ন্যাকামি স্বরে বলল, 'সেই শনিবারের কথা মনে পড়ে, যেদিন তুমি আমাকে প্রপোজ করেছিলে? আমি বলেছিলাম, তোমার সাহস আছে, তুমি বোল্ড।'
ফ্রেড বললেন, 'কোনোভাবেই না, আমি কট হয়েছিলাম।'
স্পষ্টতই এত অধিকসংখ্যক ফ্রেড প্রমাণ করে, তারা সবাই ক্রিকেটের রম্য সাহিত্যের ফ্রেড। বাস্তবের ফ্রেড একজনই।
ক্রিকেট-চুম্বন
ক্রিকেট নিয়ে যাদের লেখালেখি সাহিত্য মানের শীর্ষে, তাদের অন্যতম স্যার নেভিল কার্ডাস (১৮৮৮-১৯৭৫)। তিনি ক্রিকেটার, ক্রিকেট কোচ এবং ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক।
১৭ জুন ১৯২১ তিনি এডিস কিংকে বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠান যাবার আগে তিনি ক্রিকেট মাঠেই ছিলেন, ল্যাঙ্কাশায়ার ও ইয়র্কশায়ারের মধ্যে খেলা চলছিল। তিনি ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। চার্চে গিয়ে বিয়ের কাজটা শেষ করে নব পরিণীতা স্ত্রীকে চুমো খেলেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করে দ্রুত মাঠে ফিরে এলেন। ল্যাঙ্কাশায়ার তখনো ব্যাট করছে। তার অনুপস্থিতির সময়টাতে দলের রানের সাথে যোগ হয়েছে মাত্র ১৭ রান। এই কাহিনি নেভিল কার্ডাসের স্মৃতিকথায় বিস্তারিত লেখা হয়েছে।
সম্পূর্ণ বিবসনা নারী (এবং কখনো পুরুষও) ম্যাচ চলাকালীন মাঠে ঢুকে পড়েছেন, দৌড়াচ্ছেন, গোটা স্টেডিয়ামের দৃষ্টি তার ওপর নিচ্ছে, পুলিশ ছুটছে তার পেছনে। একসময় তাকে ধরে ফেলে। গায়ের কোট খুলে তার নগ্নতা ডেকে দেবার চেষ্টা করে, তারপর হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ ভ্যানে তুলে নেয়। গত ষাট বছর ধরে যারা নিয়মিত মাঠে ও টেলিভিশনে ক্রিকেট দেখছেন, এমন দৃশ্য তাদের ফাঁকি দেবার কথা নয়। খেলার মাঠে অজ্ঞাত তরুণী প্রকাশ্যে ক্রিকেটারকে চুমো খাচ্ছেন, এমন দৃশ্যও ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।
১৯৬০-এর দশকের ভারতীয় ক্রিকেটের 'গ্ল্যামার বয়' আব্বাস আলী বেগ। তার সঙ্গী সুদর্শন খেলোয়াড়েরা হচ্ছেন নবাব পতৌদি, জয়সীমা, ফারুক ইঞ্জিনিয়ার, সেলিম দূররানী। ৬ জানুয়ারি ১৯৬০ মুম্বাই ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচ চলছে, এ সময়ের একটি অপ্রত্যাশিত কিন্তু বাস্তব চুম্বনের কথা উঠে এসেছে সালমান রুশদীর 'দ্য মুরস লাস্ট সাই' উপন্যাসে।
আসলে কি ঘটেছিল?
আব্বাস আলী বেগ তখন অক্সফোর্ডের ছাত্র। রিচি বেনোর নেতৃত্বে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দল ভারতে এসেছে, এটা ১৯৫৯-৬০ মৌসুম। আব্বাস সময়মতো পরীক্ষায় বসবেন এই শর্তে কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে প্রথম টেস্টের দিন ভোরে দিল্লি বিমানবন্দরে নামলেন এবং টেস্ট ম্যাচে অংশ নিলেন। দিল্লি টেস্টে ভারত হেরে গেল। তারপর কানপুর টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ভারসাম্য পৌঁছাল। এবার গুরুত্বপূর্ণ বোম্বে টেস্ট। প্রথম ইনিংসে আব্বাস ৫০ রান করলেন, ভারত প্রথম ইনিংসে ৯৮ রানের লিড পেয়ে গেল। কিন্তু শেষ দিন ৬ জানুয়ারি ১৯৬০, চার উইকেট হারিয়ে ১১১ রান করে ভারত এবং ভারতের সমর্থকেরা ভয়ংকর দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। আব্বাস বেগ ব্যাট করতে নেমে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। আব্বাস বেগ আর রামনাথ কেনি ১০৯ রান যোগ করলেন। আব্বাসের দ্বিতীয় হাফ সেঞ্চুরি হয়ে গেল। চা-বিরতিতে আব্বাস বেগ সঙ্গীদের নিয়ে প্যাভিলিয়নে আসছেন, এমন সময় দর্শক ঠেকানোর বেড়া ডিঙিয়ে এক সুন্দরী যুবতী ছুটে এসে আব্বাসকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেলেন। থ হয়ে গেল রক্ষণশীল ভারতবর্ষের দর্শক।
আব্বাস আলী বেগ নিজেই বলেছেন, ইহকালে এই নারীর সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন না। তারা যখন প্যাভিলিয়নের দিকে এসেছিলেন, সাংবাদিকেরা ঘিরে ধরেছিল। এ সময় হঠাৎ কম বয়সী এক নারী ছুটে এল, মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটি ঘটে গেল। আব্বাস বেগ দুশ্চিন্তায় পড়লেন, অবশ্য চুমো নিয়ে নয়, দর্শকের আসনে ছিলেন তার বাবা ও মা, তাদের নিয়ে। ব্যাপারটা নিষ্পাপ একটি ঘটনা কিন্তু ভারতীয় সমাজের অনেকেই এটাকে অতি আধুনিকতার কুফল এবং ক্রিকেটের জন্য কলঙ্ক বিবেচনা করলেন। আব্বাস বেগ বললেন, তারপর তিনি বহু সুন্দরীর চিঠি পেয়েছেন এবং আন্তরিকতার সাথে সেসব চিঠির জবাবও দিয়েছেন।
সেদিন সর্বভারতীয় রেডিও আকাশবাণীতে ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন কিছুকাল আগের খ্যাতিমান ক্রিকেটার বিজয় মার্চেন্ট। ভারতের একদা তারকা খেলোয়াড়। তিনি রেডিওতে বললেন, আমি অবাক হচ্ছি-এত দিন এই সুন্দরী ও উদ্যোগী নারীরা কোথায় ছিলেন? বোম্বের এই ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে আমি সেঞ্চুরি করেছি, ডাবল সেঞ্চুরি করেছি-কিন্তু একজন সুন্দরীও এগিয়ে আসেননি।
তার কথা শেষ না হতেই সহভাষ্যকার বললেন, 'বিজয়, আমার ধারণা, তোমার ব্যাটিং তাদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।'
পাঁচ টেস্টের সিরিজ হলেও পরীক্ষা এসে যাওয়া আব্বাস আলী বেগের পক্ষে শেষ দুটোতে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, তিনি অক্সফোর্ডে ফিরে গেলেন।
সালমান রুশদীর উপন্যাসে জুগাইবির মা অরোরা মোরাস স্টেডিয়ামে এই দৃশ্য দেখে দ্রুত বাড়ি ফিরে যান এবং একটানা তুলি চালিয়ে যে চিত্রকর্মটি শেষ করেন, তার নাম দেন 'দ্য কিসিং অব আব্বাস আলী বেগ'।