ভিনি, ভিডি, ‘ভেসপা’: অভিজাত এক দ্বিচক্রযানের কথা
জুলিয়াস সিজার বলেছিলেন, ভিনি, ভিডি, ভিসি। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। এ কথাকে উপজীব্য করে ভিনদেশি এক ভেসপা প্রেমিক লিখেছেন, এ যুগে সিজার থাকলে বলতেন ভিনি, ভিডি, 'ভেসপা'—এলাম, দেখলাম, ভেসপায় চড়লাম!
বাংলাদেশের ছবিও খুব আলাদা নয়। দেখুন:
কী রে, কী 'হুন্ডা' কিনলি?
জি ভাইজান, ইয়ামাহা। আইজকাল 'হুন্ডার' বাজারে ইয়ামাহা খুব চলতাছে।
হ। তবে আমার মেয়ে কইল জামাইরে যদি 'হুন্ডা' দেই, তয় যেন 'হুন্ডাই' দেই। কাওয়াসাকি, ইয়ামাহা— এসব 'হুন্ডা' তার পছন্দ না। আর যদি খরচ বেশি মনে না হয়, তবে ওই 'ভেসপা' দিতে পারি। 'ভেসপা'র নাকি ইজ্জতই আলাদা!
১. মোটরসাইকেল বলতেই এককালে 'হোন্ডা'কেই বোঝানো হতো। যে ব্র্যান্ডেরই হোক না কেন, লোকমুখে তাকে 'হোন্ডা' বলার চল ছিল। এই চল একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, সে কথা বোধ হয় জোর দিয়ে বলার সময় এখনো আসেনি। এভাবে 'নামকরণের' ধারা থেকে বেঁচে গেছে মোটরচালিত যে দুই চাকার যান, তার নাম 'ভেসপা।'
ইতালীয় ভাষায় বোলতাকে 'ভেসপা' বলা হয়। পরীক্ষামূলক মোটরসাইকেল দেখে কারখানার মালিক এনরিকা পিয়াজ্জিও নাকি বলে উঠেছিলেন, 'আরে এ তো দেখতে ভেসপার (বোলতা) মতো!' ব্যস, এ নামটাই টিকে গেল।
বোলতা শুনে কারও কারও নিশ্চয়ই ভারতীয় বাংলাভাষী লেখক তারাপদ রায়ের কথাও মনে পড়ে যেতে পারে। এক বাংলাভাষী 'বোলতা'র হিন্দি কী হবে, তা জানার জন্য হিন্দিভাষীকে প্রশ্ন করছেন, হামলোক বোলতা কো বোলতা বলতা হ্যায়। তোমলোগ বোলতা কো কেয়া বলতা হ্যায়? রেডিও তেহরানের হিন্দি ও উর্দু বিভাগকে এ চটুকি টিকাটিপ্পনিসহ শুনিয়েছিলাম। তারপর ওই দুই বিভাগের কোনো কোনো সহকর্মীর সাথে দেখা হলেই এ প্রশ্নটা হাসিমুখে ছুড়ে দিত। আর প্রশ্ন করার পর খানিক হেসেও নিত!
ভেসপা নিয়ে আরেক চটুকি শুনেছি অনেকে আগে। মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে এক লোক মাঝে মাঝেই ভেসপায় চেপে যুক্তরাষ্ট্র ঢোকে। পিঠে বিশাল বোঝা। দ্বিচক্রযানে নানা মালামাল ঠাসা। কিন্তু ওসবের কোনোটাই বেআইনি নয়। শুল্ক কর্মকর্তা নিশ্চিত, এই ব্যাটা হাওয়া খেতে যাতায়াত করে না। 'বাণিজ্য'—দুই নম্বরি কাম করে। অর্থাৎ চোরাচালান করে। দিনের পর দিন লোকটার পিছে লেগে রইল ওই কর্মকর্তা। কিন্তু সবই অশ্বডিম্ব! কিছুই ধরা গেল না।
একসময় কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ ফুরোল। অবসরে গেল।
সে সময় এক পানশালায় ওই লোকের সাথে দেখা। এবারে জানতে চাইল, সে কী করত?
চোরাচালান। লোকটা হাসতে হাসতে জবাব দিল।
না না, তা তো বুঝেছি। কী চোরাচালান করতে?
চোরাই পুরোনো মডেলের ভেসপা। তুমি আমার সবকিছু তন্ন তন্ন করে দেখেছ। কিন্তু কখনো খেয়াল করোনি প্রতিবার বদলে যাচ্ছে ভেসপা।
কর্মকর্তা তার বোকামি বুঝতে পারল। তারপর প্রশ্ন করল, এত কিছু থাকতে পুরোনো মডেলের চোরাই ভেসপা পাচার করতে কেন?
কারণ, ওর বাজারদর বেশি।
ইউটিউবে দেখলাম, একজন ১৯৬২ সালের ভেসপা চালাচ্ছেন। আগে তার বাবা ব্যবহার করতেন এ বাহন। পরে মাজাঘষা করে এখন চালাচ্ছেন তিনি। আরেক ভেসপাপ্রেমী টিবিএসকে জানালেন, তার সংগ্রহে ১৯৬৭ সালের ভেসপা আছে।
সম্ভবত, ভেসপার অন্যতম সৌন্দর্য এটাই। পুরোনো হয় কিন্তু বাতিল হয় না এই যন্ত্রযান।
যা-ই হোক, সাবধানে রাখবেন আপনার পুরোনো ভেসপা। কওয়া যায় না, এখানেও থাকতে পারে পাচারকারী!
২. উপকথার ফিনিক্স পাখির নাম অনেকেই জানেন। বলা হয়, পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও আমার ভস্ম থেকে উঠে দাঁড়াতে পারে এ পাখি। পাখির মতো ভেসপার কোনো পাখা নেই। নেই পালক বা পা। কিন্তু এরও জন্ম হয়েছে যুদ্ধের তাপে এবং বোমার আগুনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কারখানা থেকে।
সে সময় এ কারখানার মালিক এনরিকা পিয়াজ্জি।
মোটরসাইকেলের ইতিকথা
বাষ্পীয় ইঞ্জিন আর দ্বিচক্রযান বা বাইসাইকেল আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ১৯ শতকের বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, এই দুইয়ের মধুর মিলন ঘটানো গেলে চলার গতি বাড়বে। সড়ক দেখতে পাবে গতির ঝলক। মোটরচালিত বাইসাইকেলের দেখা মিলতে থাকে প্যাডলওয়ালা পিয়েরে মিকাক্স বাজারে আসার পরপরই। এ ধারা ১৮৮০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। পিয়েরে মিকাক্সের ছেলে আর্নেস্ট তার প্যারিসের কারখানায় প্রথম বানালেন মোটরসাইকেল। প্রথমে 'বোনেশেকার' বা 'হাড় নাড়ানো' সাইকেলের নকশার সাথে যোগ করা হলোখুদে বাষ্পীয় ইঞ্জিন। এর দেখাদেখি আরও নানা আদলের মোটরসাইকেলের উৎপাদন শুরু হলো। মোটরসাইকেল বানানোর জন্য অন্যান্য উদ্ভাবক বিভিন্ন বাষ্পীয় ইঞ্জিন ব্যবহার করেন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে সিলভেস্টার এইচ রোপার কয়লা পুড়িয়ে চলে এমন ফার্নেস ব্যবহার করেন। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে লুই-গুইলাম পেরিউক্স ব্যবহার করেন অ্যালকোহল বার্নার চেম্বার। এদিকে ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে লুসিয়াস কোপল্যান্ড ইংল্যান্ডেরে 'ফার্থিং-পেনি' হাই হুইল সাইকেলের সাথে জুড়ে দেন বাষ্পীয় ইঞ্জিন।
বিপ্লব বলতে যা বোঝায়, মোটরসাইকেল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সেটি ঘটে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে। দুই জার্মান উদ্ভাবক গটলিব ডেমলার এবং ভিলহেম মেবাচ এ বিপ্লবের নায়ক। পেট্রলের অভ্যন্তরীণ দহন বা ইন্টারনাল কমবাস্টন ইঞ্জিন বসানো প্রথম মোটরসাইকেল তৈরি করেন তারা। 'ডেমলার রিটভাগেন' সওয়ারি শকট বা রাইডিং ওয়াগন নামের এই যানকেই আধুনিক মোটরসাইকেলের প্রথম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়।'যাত্রা শুরু হলো এবার হলো যে সময়।' ব্যস! এরপর 'এই পথ চলাতেই আনন্দ' মেনে নিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করলেন অনেক উদ্ভাবক এবং প্রকৌশলী। তারা বানালেন নিজেদের মতো করে ইঞ্জিন বসানো সাইকেলের নিজস্ব সংস্করণ। তৈরি করতে শুরু করেন মোটরসাইকেল।
এক হিসাবে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতিদিন ২০ কোটি মোটরসাইকেল এবং ৫৯ কোটি গাড়ি চলছে। এর মধ্যে চীনে মোটরসাইকেল ও মোপেড মিলিয়ে চলছে ৩ কোটি ৪০ লাখ। ভারতে চলছে ৩ কোটি ৭০ লাখ।
ভেসপার ইতিহাস
রিনালডো পিয়াজ্জিও কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। তখন এ কারখানায় মোটরসাইকেল তৈরির কথা স্বপ্নেও ভাবা হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইতালি থেকে এই কোম্পানির হাত ধরে শুরু হয় ভেসপার ইতিহাস। যুদ্ধের বলি হয়েছে দেশটির অর্থনীতি। সড়ক-জনপথ বিধ্বস্ত। মোটরগাড়ি চালানো প্রায় দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠল। তখনকার কোম্পানিটির মালিক এনরিকা পিয়াজ্জির পরিবার বিমানশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নিজদের ব্যবসা আবার করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামা হলো। বুঝতে পারলেন ইতালির জনগণের এ সময় দরকার সুলভ যান। মোটরচালিত দ্বিচক্রযানের কথা ভাবলেন পিয়াজ্জি। এমন বাহন বানানো খরুচে নয়। এ ছাড়া বাহন হিসেবে নির্ভরযোগ্যও। ভেসপার নকশার সাথে নাম জড়িয়ে রয়েছে বিশিষ্ট বিমানপ্রকৌশলী কোরাডিনো ডিআসকানিওর। ইতালির প্রথম হেলিকপ্টারের নকশাও করেছিলেন তিনি। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন ছত্রীসেনা বা প্যারাট্রুপারদের জন্য বানানো হতো খুদে মোটরসাইকেল। জলপাই রঙের ছোট এই কুশম্যান এয়ারবোর্ন মোটরসাইকেলগুলো প্যারাসুট দিয়ে ছত্রীসেনাদের সাথেই ফেলা হতো। ভেসপার নকশার সাথে এ মোটরসাইকেলের মিল আছে। অন্যদিকে সেকালের মোটরসাইকেল আরোহীদের কাপড়চোপড় সহজেই নোংরা হতো। ইঞ্জিন ছিল বিশাল। মালামাল রাখার মতো জায়গা থাকত না। এ ছাড়া নারীদের পক্ষে চালানো সহজ ছিল না। সুতরাং ভেসপার নকশা করার সময় তাকে আরামদায়ক করা, নারীবান্ধব বানানো এবং সহজে ব্যবহারের দিকে খেয়াল রাখা হলো। ভেসপার অন্যতম বৈশিষ্ঠ হলো একটিমাত্র অখণ্ড ইস্পাতের পাত দিয়ে বানানো এ বাহন। মালামাল রাখার অনেক জায়গা। ইঞ্জিনের ওপরই বসার আসন রাখা হলো, ইঞ্জিনকে ঘিরে দেওয়া হলো এবং সেখানে মালামাল রাখার ব্যবস্থা হলো। বসার আরাম হলো। চালকের পোশাক নোংরা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেল। আর সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এ ইঞ্জিন চলে প্রায় আজীবন।
এদিকে মশকরা করে কেউ কেউ বলেন, ভেসপা তৈরিতে ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনির অবদান আছে! এ রসিকতাকে চট করে অসত্য বলা যাবে না। প্রথম ভেসপা বানানো হয়েছিল বিমানের যন্ত্রাংশ থেকে। এতে বসানো হয় মুসোলিনির বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ারের যন্ত্রাংশ। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ এপ্রিল ভেসপার পেটেন্টের জন্য আবেদন করে পিয়াজ্জিও। একই বছর ইতালির তুসকানির কারখানায় প্রথম তৈরি হলো ১৫টি ভেসপা।
ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্যে জানতে পারি, ১৯৫২ সালে ফরাসি জর্জেস মনোরেত একটি উভচর ভেসপা তৈরি করে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন। ১৯৫১ সালে ভেসপা ইতালীয় সেরা মোটরসাইকেল হিসেবে পুরস্কৃত হয়। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ভেসপা নিয়ে অভিযান শুরু হয় এ সময়। ইতালির বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জিয়ানকার্লো তিরোনি ভেসপা নিয়ে আর্কটিক সার্কেলে পৌঁছে যান। আর্জেন্টাইন কার্লোস ভেলেজ বুয়েন্স আয়ার্স থেকে ভেসপায় চড়ে আন্দিজ পর্বতমালা পার হয়ে চিলির সান্তিয়াগো পৌঁছেন। ১৯৪৮ সালে ফরাসি বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট পিয়েরে ডেলিয়েরে ভেসপা কিনেছিলেন। সেই ভেসপা নিয়ে তিনি ছয় হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে প্যারিস থেকে ভিয়েতনামের সায়গন পৌঁছেন। আফগানিস্তানের মরুভূমিও পার হয়েছেন এ ভেসপায়।
ভেসপা ও আজকের বাংলাদেশ
বাংলাদেশে দুই ধরনের মোটরসাইকেল চলে। এর একটি হলো 'হোন্ডা'। ভেসপা বাদে আর প্রায় মোটরসাইকেলকেই 'হোন্ডা' নামে ডাকার চল এখনো আছে। ভেসপার প্রতি মানুষ কেন আকর্ষণ বোধ করেন, সে কথা সুন্দর করে টিবিএসকে শোনালেন নাইকন ফ্যান ক্লাব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশ ভেসপা কমিউনিটির মডারেটর মাঈন আহমেদ। প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত, নাইকন ফ্যান ক্লাব বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখতে দেদার ঘাম ঝরিয়েছেন তিনি। এ কাজে তার চারপাশে চমৎকার কিছু মানুষও জড়ো করেছেন। এর সবাই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো নান্দনিক আন্দোলনে জড়িয়ে আছেন দীর্ঘদিন। তাদের সৎ চেষ্টা দেশের আলোকচিত্রের জগতকে সমৃদ্ধ করছে।
ভেসপা প্রসঙ্গে মাঈন আহমেদ বলেন, এটি চালাতে আরাম এবং চালানো শেখাও সহজ। এ ছাড়াছোটবেলায় বা তরুণকালে গুরুজনদের ভেসপা চালাতে দেখেছি। তাতে এ বাহনের প্রতি সহজ একটা টান তৈরি হয়ে গেছে। মূলত করোনার পর নিজে অফিসে যাওয়ার জন্য এবং গিন্নিকে অফিসে নামিয়ে দেওয়ার জন্য ভেসপা কেনেন তিনি। তাদের দুজনের অফিস দুই জায়গায়। ব্যস্ত সময়ে উবার বা পাঠাও-এ হন্যে হয়েও গাড়ি পাওয়া অনেক সময় দুষ্কর হয়ে ওঠে। সে সময় বাধ্য হয়েই ভেসপা কেনার দিকে ঝোঁকেন। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যে পরিমাণ মোটরসাইকেল আমদানি হয়েছে, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত তার চেয়ে অনেক বেশি মোটরসাইকেল আমদানি হয়েছে।
ভেসপার চাকা ছোট হওয়ায় যানজটের সময়ে গাড়ি ঘোরানোর কাজ খুব অল্প জায়গায়ই সারা যায় উল্লেখ করে ছোট চাকার সমস্যার কথাও জানান। তিনি বলেন, রাস্তা ভাঙাচোরা হলেও তাতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।
তিনি বলেন, স্কুটার বা স্কুটি জনপ্রিয় হওয়ার আরেকটি কারণ আজকাল নারীদের মধ্যে কর্মজীবী হওয়াসহ বহুমুখিতাবেড়েছে। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন বাহন হলে নিজের ইচ্ছা বা সময়মতো যাতায়াত করা যায়। নারীদের জন্য ভেসপা সত্যিই আদর্শ একটি বাহন। তুলনামূলকভাবে দাম বেশি হলেও টেকসই। ইস্পাতের বডি হওয়ায় সহজে ট্যাপ খায় না।
বাংলাদেশে ষাটের দশকের কিছু ভেসপা এখনো চলছে, এ কথা বলার পর সদালাপী মানুষটি জানান, আমার কাছেই ১৯৬৭ সালের একটি ভেসপা আছে। এ ছাড়া সুযোগমতো পেলে ফোক্সভাগনের বিটেল আদলের গাড়িও সংগ্রহ করবেন।
মাঈন আহমেদ আরও জানান, তার স্ত্রী ভেসপা চালানো শিখছেন। সাত দিনের কর্মসূচি। তিন দিনেই শেখার কাজ যথেষ্ট এগিয়েছে। এখন তার গিন্নি ভবিষ্যতে কোন ভেসপা কিনবে, তা দেখতে শুরু করেছেন।
মাঈন আহমেদ আরও জানান, বাজারে এখন ভেসপার নতুন গাড়িগুলোর সবই ফোর স্ট্রোক। টু স্ট্রোক হলো পুরোনো কালের ভেসপা। পুরানো ভেসপাতে ইঞ্জিন একপাশে থাকত, তাতে ভারসাম্যের অসুবিধা হতো। কিন্তু বর্তমানে ইঞ্জিন মাঝে বসানো হয়, তাতে ভারসাম্যের অসুবিধা আর নেই।
ভেসপা নিয়ে বের হলে সাধারণ যে প্রশ্নের মুখে অনেকেই পড়েন, তা হলো—এ গাড়ি কী ব্যাটারিতে চলে, না তেলে? তেলে চললে মাইলেজ কত পান? এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই বলেন, ভেসপা হলো খানদানি বাহন শখে চালাই। মাইলেজ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাই না। তবে সত্যি কথাটা হলো, তুলনামূলকভাবে ভেসপা তেল বেশি খায়। ঢাকায় এক লিটারে ২৫ মাইল পাওয়া যায়। মহাসড়কে পাওয়া যায় ৩৫।
এদিকে বিদ্যুৎ-চালিত ভেসপা বা ব্যাটারিচালিত ভেসপা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে বাহন আমদানি হয়নি এখনো। আমদানি হলে ব্যবহারকারীদের জ্বালানি খরচ অনেক কমে যেত। এ ছাড়া ভেসপার যন্ত্রাংশ নিয়ে বাংলাদেশের সমস্যা হয়। আমদানিকারকদের কারসাজিই এ জন্য দায়ী। ভেসপাচালকদের কাছ থেকে গলাকাটা দাম আদায় করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ভেসপা কমিউনিটি দুমাস আগে পুরান ঢাকায় নবাবি রাইড নামে একটা রাইডের আয়োজন করেছিল। সে রাইডে অংশগ্রহণকারীরা লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরে ছিলেন। আগামী মাসের সম্ভাব্য পাঁচ দিনের সফরের কর্মসূচির কথাও জানান তিনি। এই কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকা থেকে ভেসপা চালিয়ে কক্সবাজার যাওয়া হবে। সেখানে ক্যাম্প ফায়ার করে সাগরসৈকতে রাত কাটানো হবে। ভেসপা কমিউনিটিতে নারী ও পুরুষ উভয় আছেন। বহরে বেশির ভাগ বাহনই বেশ পুরোনো। তা ছাড়া এ কমিউনিটির অনেকের বয়স ৫০-এর ওপরে, তাই সতর্কতা হিসেবে বহরের সাথে থাকবেন চিকিৎসক। ভেসপার জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য থাকবেন টেকনিশিয়ান, পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ। বাহন নষ্ট হলে যেন সমস্যা না হয়, তাই সাথে পিকআপও রাখা হবে।
কক্সবাজার যাওয়ার পথে প্রথম দিন চট্টগ্রামে রাত্রি যাপন করা হবে। চট্টগ্রাম ভেসপা ক্লাবের আমন্ত্রণে পতেঙ্গা বিচসহ পুরো চিটাগাং শহরে র্যালি হবে। পরদিন সেখান থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেবে এ বহর। তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সৈকতের মেরিন ড্রাইভ দিয়ে টেকনাফে যাবে। ফেরার পথে একদিন চট্টগ্রামে কাটিয়ে পরদিন ঢাকার উদ্দেশে পথে নামবে ভেসপা বহর। এর আগে ভেসপা নিয়ে এত লম্বা সফরের আয়োজন আর করা হয়নি বলেই জানান মাঈন আহমেদ।
এ ছাড়া এ বছরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা রাইড হবে এবং ঢাকা থেকে সাভার স্মৃতিসৌধে যাবে ভেসপা বহর। আর ফেব্রুয়ারিতে হবে মাতৃভাষা রাইড। এদিকে চলতি মাসের ২৫ তারিখে জেনটেলমেন রাইড হবে। তবে জেনটেলমেন রাইড নামে হলেও তাতে নারী ভেসপাচালকেরা থাকবেন বলে প্রশ্নের উত্তরে জানানো হয়।
ইতালির সিনেমায় অনিবার্যভাবেই ভেসপার চেহারা মোবারক দেখা যাবে। তবে এর মধ্যে রোমান হলিডের অড্রে হেপবার্ন (আমি অবশ্য বলি অড্রে 'হার্টবার্ন!') ও গ্রেগরি পিকের ভেসপা চালানোর দৃশ্য অতুলনীয়। রোমের পথে পথে তাদের এলোপাতাড়ি ভেসপা চালানোর দৃশ্য বহুবার উপভোগ করা যায়। হাসা যায় প্রাণ খুলে। ভেসপাকে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে এ দৃশ্যের অবদান আছে। অন্যদিকে নির্মল হাসির তোড়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং দুঃচিন্তার জগদ্দল পাথর বুক থেকে নেমে যায়। ১৯৮০-এর দশকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের রোগী দেখতে গিয়েছিলাম অসময়ে। পরিচিত ডাক্তার থাকায় ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলাম। জেনারেল ওয়ার্ডে কী কারণে যেন রোগীদের অনেকেই উচ্চস্বরে হাসাহাসি করছিলেন। সে সময় হঠাৎ টহল দিতে আসেন গম্ভীরমুখো অধ্যাপক। তাকে দেখে রোগীরা হতচকিত হয়ে গেলেন। কিন্তু অবাক করে অধ্যাপক বললেন, হাসেন হাসেন জোরে জোরে হাসেন। হাসলে হার্টে ম্যাসাজের কাজ হবে। চান্স পাইলেই হাসেন আর হাসার চান্স তৈরি করেন। আপনারা হাসাহাসি শেষ করেন আমি একটু পরে আসি। বলে হাসি চাপতে চাপতে বের হয়ে গেলেন তিনি।
কাজী ভাই এবং দুর্দান্ত ভেসপা
কাজী আনোয়ার হোসেন বললেই মাসুদ রানার নাম ভেসে ওঠে। বাংলা ভাষাকে থ্রিলার উপযোগী করে তোলার কৃতিত্বের পুরোটাই দাবি করতে পারেন তিনি। পেপারব্যাক প্রকাশনীর পুরোধাই কেবল নন, নিজস্ব বিপণনব্যবস্থাও গড়ে তোলার কারিগর তিনি। কিংবা একক সম্রাট। তার দেখাদেখি অনেকেই এ পথে এসেছিলেন। তবে তারা টেকসই হননি। সেবা প্রকাশনীর সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে নিজেরাই পড়ে গেছেন। ইতিহাস জ্ঞান বা সাংবাদিকতার সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা তাদের কোনো সুবিধাই দেয়নি। আসলে পাঠকদের মূল্যবান হিসেবে ধরে নিয়েছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। পাঠকদেরও সে কথা বিনয়ের সাথে বোঝার অবকাশ করে দিয়েছেন। তার মতো এ কাজটি আর কেউ করতে পারেননি। তাই আখেরে টিকেও থাকতে পারেননি। আমি বরাবর কাজী ভাই নামেই সম্বোধন করতাম কাজী আনোয়ার হোসেনকে।
হয়তো অনেকেই জানেন না, কলমে কেবল নয়, ভেসপাতেও দুর্দান্ত ছিলেন তিনি। কাজী ভাইয়ের বাহন ছিল ভেসপা। বহুকাল চালিয়েছেন ওটা।
কাজী ভাইয়ের ভেসপায় সওয়ার হয়ে এক অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছিলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব আকমল আজাদ। চাকরিতে তখন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সদ্য যোগ দিয়েছেন, সে সময় রহস্যপত্রিকার আইন বিভাগে নিয়মিত লেখেন আকমল। পোস্টিং বোধহয় তখন রাজশাহীতে। ঢাকায় এসেছেন কোনো কাজে বা বেড়াতে।
এক রাতে কাজী ভাইয়ের ভেসপার পিছে সওয়ার হয়ে আকমল ফিরছেন কলাবাগান থেকে। গল্প করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছেন কাজী ভাই। হুঁ, হ্যাঁ করে জবাব দিচ্ছেন আকমল। সায়েন্স ল্যাবের কাছে ট্রাফিক লাইটে থামাতে হলো মোটরসাইকেল। নেমে দাঁড়ালেন আকমল। সবুজ আলো জ্বলে উঠতেই হুস করে বের হয়ে গেলেন কাজী ভাই। কিন্তু অপ্রস্তুত আকমল ভেসপায় চাপার সুযোগ পেলেন না। দাঁড়িয়েই রইলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর কাজী ভাই টের পেলেন, আরে, কথার তো জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর বুঝলেন আকমল পেছনে নেই। আবার ফিরে এলেন। ট্রাফিক বাতির কাছে চুপচাপ ভালো ছেলের মতো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন আকমল।
কাজী ভাইয়ের দুর্দান্ত ভেসপা চালানোর রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। রহস্য পত্রিকায় ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে কথা, ধানমন্ডি লেক নিয়ে একটা ফিচার করার কথা ছিল। নিজ গাফলতির কারণে সে ফিচার ছাপার মুখ দেখেনি। সে দুঃখের কথা পরে বললেও চলবে। সেদিন ওই ফিচারের মালমসলা সংগ্রহ করার জন্য কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন কাজী ভাই। সে জন্য ভেসপায় বসিয়ে আমাকে নিয়ে লেকের দিকে চলেছেন কাজী ভাই। সায়েন্স ল্যাবের কাছাকাছি এলাকায় এক তরুণ বড় চাকার চকচকে কাওয়াসাকি মোটরসাইকেল নিয়ে কাজী ভাইয়ের ভেসপাকে ভুলভাবে ওভারটেক করার চেষ্টা করল। কাজী ভাই বললেন- 'মূসা শক্ত হয়ে বসেন।'
কথা শেষ করার আগেই পুরোনো ভেসপা গর্জে উঠল। গতি ধাঁ করে বেড়ে গেল। এটা ভেসপার অন্যতম সৌন্দর্য। শূন্য থেকে ষাটে উঠতে কয়েক সেকেন্ড লাগে এ বাহনের। এমন বাহন দ্বিতীয় আর হয় না। তা যাকগে,তরুণ বেশি দূর যেতে পারেনি। তাকে ধাওয়া করলেন কাজী ভাই। ভেসপার দাবড়ানির চোটে সড়ক ছেড়ে তড়িঘড়ি সোজা ফুটপাতে উঠে যেতে বাধ্য হলো চকচকে নতুন মোটরসাইকেলের উদ্ধত চালক তরুণটি। ততক্ষণে ঠাহর করতে পেরেছে সে বালক, পুরোনো ভেসপার চালক যেনতেন কেউ নন। বরং কেউকেটা, অতিশয় দক্ষ। তাকে সম্ভ্রম করতেই হবে।
আমি মানলাম, 'এই না হলে মানায় মাসুদ রানার স্রষ্টাকে! রানার মোটরসাইকেল চালানোর হাতেখড়ি হয়েছে নিশ্চিতভাবেই কাজী ভাইয়ের দরবারে! আল্লাহ জানে, হয়তো রাহাত খানেরও ভেসপা চালানোর গুরু ছিলেন খোদ কাজী আনোয়ার হোসেন!'