যে বিশ্বকাপ পেলে চাননি
১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর। রিও ডি জেনিরো'র মারাকানা স্টেডিয়ামে পেনাল্টি কিক করার জন্য প্রস্তুত পেলে। 'আমার পা কাঁপছিল,' নিজের জীবনী নিয়ে নির্মিত এক ডকুমেন্টারিতে পরে সেই মুহূর্তটির কথা স্মরণ করে বলেছিলেন তিনি। একা আর ভয়ার্ত পেলে সেদিন মনে মনে নিজেকে বলেছিলেন: 'এ পেনাল্টি মিস করা যাবে না।'
নভেম্বরের সে রাতে ভাস্কো দা গামা'র গোলরক্ষক নিজেকে প্রস্তুত করলেন সান্তোস-এর তারকা ফরোয়ার্ডের পেনাল্টি শট আটকাতে। বলের দিকটা ঠিকমতোই আন্দাজ করেছিলেন তিনি… কিন্তু বল অব্দি পৌঁছাতে পারেননি। এক লাখ ভক্তের সামনে জালে বল পুরলেন পেলে। সে গোলের মাধ্যমে ১,০০০ গোলের মাইলফলক তৈরি হলো পেলের। আর তার উন্মাদনায় দর্শকদের অনেকে ছুটে গিয়েছিলেন মাঠের ভেতরে। সেদিন বলের পেছনে ভয়টা পেলের একার ছিল, কিন্তু আনন্দটা ভাগ হলো সবার মাঝে।
দিন তিনেক পর। তখন ব্রাজিলের ক্ষমতায় বসেছেন স্বৈরচারী জেনারেল এমিলিও গ্যারাস্তাজু মেদিসি। তিনি চাইলেন পেলের সঙ্গে দেখা করতে। ফুটবলের রাজা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ উড়ে গেলেন রাজধানী ব্রাসিলিয়ায়।
অল্প কয়েক সপ্তাহ আগে ক্ষমতায় আসা মেদিসি ভাবমূর্তির ক্ষমতা বেশ ভালোভাবে বুঝতেন। একজন তারকা খেলোয়াড় ও ফুটবল খেলার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে তিনি ব্রাজিলের সবচেয়ে ভালোবাসার বস্তুর সঙ্গে নিজেকে খুব সহজেই যুক্ত করে নিতে পারতেন।
এদিকে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বেশ সাবধানতার সঙ্গে এগোতেন পেলে। 'আমি সর্বদা দুয়ার অবারিত রেখেছিলাম… সবাই তা জানে। এমনকি সবচেয়ে খারাপ মুহূর্তেও।' অনেকে পেলের এ চিন্তাধারার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি।
'মানুষ সবসময় চায় আমি পক্ষাবলম্বন করে চলি,' তিনি বলেছিলেন।
পেলের সমর্থকেরা সর্বদা এটা মানতেন যে, মতপার্থক্যের ঝুঁকি গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রের ক্ষেত্রে কখনোই সমান ছিল না। ২০২১ সালের ওই ডকুমেন্টারিতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে পেলে বলেন: 'আমার মনে হয় না আমি অন্য কিছু করতে পারতাম। আমি একজন ব্রাজিলিয়ান আর আমি ব্রাজিলের জন্য কেবল সর্বোত্তমটাই চাই… একথা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি যে, মাইনে পাওয়া ঢের রাজনীতিবিদের তুলনায়—আমি ফুটবল, আমার জীবনযাপন দিয়ে ব্রাজিলের জন্য অনেক বেশি কিছু করেছি।'
১৯৬৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে দেওয়ার মাধ্যমে ব্রাজিলে স্বৈরাচার জেঁকে বসে। প্রেসিডেন্ট আর্তার দে কস্টা সিলভা নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন—অনেক অধিকার ও স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। দেশে সেন্সরশিপ নীতি তৈরি হয়, রাজনৈতিক মতবিরোধীদের ওপর নেমে আসে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের খড়গ।
প্রাতিষ্ঠানিক এ ধরনের আতঙ্কের পরিবেশে সিলভা'র উত্তরসূরী জেনারেল মেদিসিকে রবিবার দিনগুলোতে নিয়মিত মারাকানা স্টেডিয়ামে দেখা যেত। ব্রাজিলের মানুষের ফুটবলের প্রতি এ ভালোবাসাকে কাজে লাগিয়ে পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া অনৈতিক কাজগুলো থেকে নিজেকে আড়াল করতে সক্ষম হলেন নব্য এ স্বৈরশাসক। হাজার গোলের মালিক পেলের সঙ্গে ছবি তুলে তিনি সহজেই একজন সাধারণ, ফুটবলপ্রেমী হিসেবে নিজের ইমেজ তৈরি করে ফেললেন।
মেদিসি'র পরের লক্ষ্য ছিল ১৯৭০ সালে মেক্সিকোতে হতে যাওয়া বিশ্বকাপ। কিন্তু চার বছর আগে ইংল্যান্ডের কাছে তিক্ত পরাজয়ের ম্যাচে খেলা থেকে বাদ পড়া পেলে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি আর কখনো কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলবেন না। 'বিশ্বকাপে খেলার আর কোনো ইচ্ছে নাই… আমার বিশ্বকাপ ভাগ্যই মন্দ,' ১৯৬৬ সালে ব্রাজিলে ফিরে কৌতুক করে বলেছিলেন পেলে। এর আগে ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন পেলে।
কিন্তু পেলেকে দরকার ছিল মেদিসির। বড় বড় পদধারী সামরিক কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়ে পেলের মনোভাব পাল্টাতে চেয়েছিলেন তিনি। পেলেও তখন নিদারুণ মনঃপীড়ায় ভুগছেন। 'দেশের জন্য বিশ্বকাপটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ওই সময় আমার পেলে হওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল না।'
রাজনৈতিক উত্তেজনা কেবল পেলেকে আক্রান্ত করেনি। মেদিসি যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন ক্রীড়া সাংবাদিক ও কোচ জোয়াও সালদানহা ব্রাজিল দলের দায়িত্ব নেন। নিষিদ্ধ ঘোষিত কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য এ কোচ নিয়মিত ক্ষমতাসীনদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে তার এক পুরোনো বন্ধু কার্লোস মারিঝেলাকে সরকারি লোকেরা খুন করে। এতে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হন সালদানহা।
বিশ্বকাপের ফাইনালের ড্রয়ের জন্য অংশ নিতে ১৯৭০ সালে মেক্সিকো যান সালদানহা। সেখানে তিনি আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষকে একটি ডসিয়ার দিয়েছিলেন। ওই ডসিয়ারে ৩,০০০ রাজনৈতিক বন্দির এবং স্বৈরশাসকদের হাতে নির্যাতিত ও নিহত ব্রাজিলিয়ানদের নাম ছিল। এর শাস্তি হিসেবে বিশ্বকাপ আসর শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে সালদানহাকে বহিষ্কার করা হয়।
সালদানহার স্থলে ব্রাজিলের কোচের দায়িত্ব পান মারিও জ্যাগালো। বিশ্বকাপ জেতার লড়াইয়ে ব্রাজিলকে আবারও প্রস্তুত করতে আর্মির ক্যাপ্টেন ক্লদিও কুতিনহোর কাছ থেকে প্রচুর সহযোগিতা পেয়েছিলেন নতুন কোচ। ব্রাজিলের জাতীয় দলের সাফল্য নিশ্চিত করা সেনাবাহিনীর 'প্রিয় প্রকল্পে' পরিণত হয়। তবে বিরোধী দল ও স্বাধীন গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ সেনাবাহিনীর এ আগ্রহ ও প্রচেষ্টা সন্দেহের চোখে দেখেছিল।
অনেকে মনে করেছিলেন, মেক্সিকোতে ব্রাজিল জয় পেলে তা-তে মেদিসির ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হতো। ওই বিশ্বকাপে মেদিসি'র ব্রাজিলের স্লোগানও ছিল অতি-জাতীয়তাবাদী ও দ্বিধাবিভক্তকারী: 'ব্রাজিল: ভালোবাসো অথবা ছাড়ো।'
খেলার জন্য সতীর্থ, ভক্ত, ও সরকার থেকে প্রচণ্ড চাপ আসছিল পেলের ওপর। অবশেষে তিনি রাজি হলেন বিশ্বকাপ খেলতে। আর পেলের নেতৃত্বেই সেবার ইতালিকে ফাইনালে ৪-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। মেদিসি যেমনটা চেয়েছিলেন সেবারের বিশ্বকাপ তার হোক; মানুষ মেদিসির বিশ্বকাপ হিসেবে সেটিকে মনে রাখুক—তা হয়নি। বরং ১৯৭০'র বিশ্বকাপটা আগাগোড়া পেলের বিশ্বকাপই ছিল।
'১৯৭০ বিশ্বকাপ জেতা ছিল আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত… কিন্তু এটা দেশের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদি সেবার ব্রাজিল হারত, তাহলে সবকিছু আরও খারাপের দিকে যেতে পারত। চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দেশের মানুষও একটুক্ষণের জন্য সবকিছু ভুলে আনন্দ করতে পেরেছিল,' পেলে স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে।
'বিজয়ের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিক ওই ট্রফিটা নয়। বরং তা হচ্ছে মুক্তির অনুভূতিটুকু!'