কিপলিংয়ের মুগলি ছাড়া অন্য প্রাণীরা সব কোথায়!
১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয় রুডওয়ার্ড কিপলিংয়ের 'দ্য জাঙ্গল বুক'। সেই থেকে এই বইয়ের জনপ্রিয়তা আজও অম্লান এবং সেটি ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রতি কোণে কোণে। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে কিপলিং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এবং তার আরও অনেক বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম আছে, যার বেশ কয়েকটি নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, নানান ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, কিন্তু জনপ্রিয়তার দিক থেকে 'জাঙ্গল বুকে'র ধারেকাছে কোনোটি আসতে পারেনি।
ভারতের মধ্যপ্রদেশের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থানে এক বন পাহাড়, সেখানকার অধিবাসী নানা জীবজন্তু এবং তাদের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে এক বিস্ময়কর মানবশিশু মুগলিকে যেভাবে কিপলিং উপস্থাপন করেছেন, তা আজ এই শতাব্দী পার হয়েও মানব মনে বিশেষভাবে দোলা দেয়। পরবর্তীতে এই বই নিয়ে একাধিক সিনেমা হয়েছে, অজস্র অ্যানিমেশন মুভি হয়েছে, যা দিন দিন এই বই বিশেষ করে কাহিনি এবং এর মূল চরিত্র মুগলিকে করে তুলেছে লেখক কিপলিংয়ের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়।
মুগলি ছাড়া জাঙ্গল বুকের অন্যান্য প্রাণীদের কী হাল-হকিকত?
নেকড়ে
অসহায় ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া মানবশিশু মুগলিকে পেলে পুষে বড় করেছিল নেকড়ের দল। মুগলি নিজেকে তাদেরই একজন ভেবেছে সবসময়। নেকড়েদের আমরা যেরকম হিংস্র, রক্তপিপাসু প্রাণী বলে ভাবতে অভ্যস্ত, এই বইটা পড়ার সাথে সাথে শিশুরা সেই ধারণা থেকে সরে আসে। বরং তারা দেখে মানবসমাজের মতোই নেকড়েসমাজেও আছে মায়া-মমতা, ভালোবাসা, ত্যাগ এবং সর্বোপরি শৃঙ্খলা। দিনের শেষে এখানে দলের জন্য যেটা ভালো, ঠিক সেই কাজটি করা হয় এবং সেটার দিকে কঠোর দৃষ্টি রাখেন একজন দলনেতা।
আমাদের এই গল্পের দলনেতার নাম 'একেলা', দলীয় সিদ্ধান্তে তিনিই অনুমতি দেন সেই কুড়িয়ে পাওয়া মানবশিশুকে নেকড়েদের সাথে পালনের জন্য।
পুরো গল্পে নেকড়ে দলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেকড়ে 'একেলা' হলেও মুগলির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেকড়ে কিন্তু ছিল 'রক্ষা', যাকে সব সময় মা-নেকড়ে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, মুগলি যাকে সব সময় মা বলে ডাকত এবং যে একেবারে শিশুকাল থেকে মুগলিকে দুধ খাইয়ে বড় করেছে এবং বলা চলে একক তেজস্বী ব্যক্তিত্ব দিয়ে রক্ষা করেছে মানবশিশুকে নেকড়ে পালের মাঝে। এছাড়া আছে স্নেহময়ী বাবা নেকড়ে 'রামা', একেলার নাতনি 'লীলা', মুগলির সকল ভাইয়ের মধ্যে তার সবচেয়ে কাছের জন ধূসর নেকড়ে ভাই।
উপন্যাসের জল অনেক দূর গড়াবার পর অন্য এক নেকড়ে দলের সঙ্গে তাদের দেখা হয়, ওন-তোল্লা নামের এক নেকড়ে তাদের বুনো কুকুর ধোল সম্পর্কে সাবধান করে, পরবর্তীতে যে বুনো কুকুরের দলের সাথে নেকড়েদের মরণপণ যুদ্ধ হয়, এই ওন-তোল্লার প্রতিশোধের কামড়েই সেই ধোল সরদারের মৃত্যু হয়।
বর্তমান ভারতবর্ষের নেকড়েদের অবস্থা যথেষ্টই করুণ, কোনোমতে কয়েক হাজার নেকড়ে টিকে আছে, যার মধ্যে বরং হিমালয়ের নেকড়েদের অবস্থা একটু ভালো। এই সময়ে মুগলির সঙ্গীসাথি পশু-পাখিদের নিয়ে উপন্যাস লিখতে হলে নেকড়েদের নিয়ে সম্ভবত আর লিখতেন না কিপলিং।
বাঘিরা, আমাদের প্রিয় কালো চিতাবাঘ
আমরা সাধারণত কালো চিতাকে প্যানথার বলে ডাকি, সত্যি বলতে প্যান্থার বলতে আলাদা কোনো প্রাণী নেই, এটি এক মেলানিস্টিক ধরনের চামড়ায় বেশি মেলানিনসমৃদ্ধ চিতাবাঘ এবং আমরা একসময় ভাবতাম এই কালো চিতাবাঘ কেবলমাত্র আমাজনেই দেখা যায়।
সত্যি বলতে জাঙ্গল বুকের অ্যানিমেশন দেখে প্রথম জানতে পারি যে ভারতেও এই ধরনের কুচকুচে কালো চিতাবাঘের দেখা মেলে, বড় সুখের কথা এই যে ভারতে এখনো বেশ কয়েকটি ন্যাশনাল পার্কে কালো চিতার দেখা ভালোই মেলে, আর সমগ্র ভারতে অন্তত ১৪ হাজার চিতাবাঘ গণনা করা হয়েছে, তা-ও সেভেন সিস্টারের সাত রাজ্য বাদ দিয়ে। মুগলির সেই বাঘিরা এখনো নানা বনে বহাল তবিয়তেই টিকে আছে ভাবতেই অপার আনন্দ লাগে।
ভালু নামের শিক্ষক ভালুক
মুগলির সত্যিকারের শিক্ষক ভালু নামের ভাল্লুক, যে তাকে জঙ্গলের আইন ও জীবনের আইন সম্পর্কে যতটুকু পারে শিখিয়েছে অভিজ্ঞতা থেকে। বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, এটি আমাদের কালো ভাল্লুক, যাদের বাংলাদেশের গহিন দু-একটি বন ছাড়া এখন আর দেখা যায় না কিন্তু ভারতের বেশ কিছু জায়গায় তারা এখনো টিকে আছে। ভালুকেরা মানুষের মতোই সর্বভুক। কিন্তু জাঙ্গল বুকে মৌমাছির মধুর প্রতি ভালুকদের যে পরিমাণ লোভী দেখানো হয়েছে, বাস্তবে ব্যাপারটা এমন নয়, সত্যি বলতে ভাল্লুকেরা যেকোনো খাবারে খুব আগ্রহ নিয়ে সংগ্রহ করে ও খায়।
শেরে খান নামের বাঘ
মুগলির আবির্ভাবের দিন থেকেই তার শত্রু জঙ্গলের একমাত্র বাঘ শের খান। যে শত্রুতা শের খানের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল। বাঘ ভারতের জাতীয় প্রাণী, যদিও মানুষের চোরাশিকারের কারণে বাঘের সংখ্যা সারা পৃথিবীতে কমছে, তবুও সারা পৃথিবীর বুনো বাঘের প্রায় অর্ধেকই অর্থাৎ চার হাজার বাঘ এখনো ভারতের নানা এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
কা নামের অজগর
অজগরেরা এখনো ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় জনসংখ্যায় ভালোই আছে, যদিও বিশালদেহী অজগরদের হঠাৎ করে দেখা মেলা দুষ্কর। মানুষ আজ সব জায়গায় খেতখামার আর বাসস্থান গড়ে এদের অস্তিত্ব করেছে। সামনের দিনগুলোতে কা-দের অবস্থা আসলেই খারাপ।
রামা নামের বুনোমহিষ
বিশালদেহী বুনোমহিষেরা একসময় ঢাকার অদূরে দলে দলে থাকলেও আজ সারা বাংলাদেশ থেকে তারা বিলুপ্ত, যদিও ভারতের বেশকিছু জায়গায় টিকে আছে।
বান্দরলোগ অর্থাৎ বানরেরা
ঠিক কোন জাতের বানর, তা মুগলির জবানে পরিষ্কার বোঝা যায় না; কিন্তু এটুকু জানা যায় যে জঙ্গলের প্রতিটা প্রাণী এই বানরকুলকে অত্যন্ত ঘৃণা করে; কারণ, তাদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই, তারা অত্যন্ত নোংরা এবং স্বার্থপর। সেই সাথে তারা মুগলিকে অপহরণ করেছিল বলে আরও অপ্রিয় হয়েছিল সবার কাছে। এই বানরদের এখনো ভারতের অনেক বড় বড় শহরের ভেতরে এবং চারপাশের বনে বেশ ভালো সংখ্যায় দেখা মেলে। বাংলাদেশের মূলত তাদের ঘাঁটি শেষ পর্যন্ত সুন্দরবন, সেই সাথে সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি বনে। আর অদ্ভুতভাবে ঢাকা মহানগরীতে এখনো কয়েকটা বানর দল টিকে আছে।
বানর দলের রাজা ওরাং ওটাং?
বানর দলের রাজা আসলে কে? নানা অ্যানিমেশন মুভিতে দেখানো হয়েছে যে বানর দলের রাজা একটি ওরাং ওটাং এবং বাস্তবের বোর্ণিও দ্বীপের বাসিন্দা এই প্রাণীটি কী করে অন্ধ্রপ্রদেশের মধ্যে এসে পড়ল, সেই নিয়ে খুব একটা সদুত্তর পাওয়া যায় না। তবে কিপলিংয়ের গল্পে কোনো ওরাং ওটাংয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় না। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, স্রেফ অ্যানিমেশন মুভির গল্প আরেকটু জমানার জন্য এই বিশালদেহী এপকে আমদানি করা হয়েছে।
হাতি থা
থা নামের আদি হাতি, গজনি নামের স্ত্রী হাতি এবং হাতির পুত্র হাতি নামেই পরিচিত এই উপন্যাসে। জঙ্গলের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হাতি, যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে তার পরামর্শ মেনেই চলে সমস্ত প্রাণী। এক হিসেবে জঙ্গল বুকের জঙ্গলের রাজা বাঘ কোনোমতে নয় বরং হাতি। এশীয় হাতিদের এখনো ভারতবর্ষের নানা এলাকায় দেখা যায়, যারা বছর ঘুরে বিচরণ করতে থাকে।
জাকালা নামের কুমির
নদীর কুমির জাকালার পিঠে চাকু মেরে একবার মুগলি তার চাকু ভেঙে ফেলেছিল। কাঠের গুঁড়ির মতো ভেসে বেড়ানো এই কুমিরেরা এখনো ভারতবর্ষের বিভিন্ন নদীতে টিকে আছে, তবে বাংলাদেশের এই মিঠাপানির কুমিরেরা আর নেই।
তাবাকি নামের শিয়াল
মুগলির শত্রু শের খানের সব সময়ের চামচা বিশ্বস্ত শেয়াল তাবাকি। বাস্তবে শেয়ালেরা এখনো মোটামুটি ভালোভাবেই টিকে আছে ভারতের সবখানে। অনেক গ্রামেগঞ্জে সন্ধ্যার পরে তাদের কোরাসই জানান দিয়ে দেয় তাদের উপস্থিতি।
তবে কটিক নামের যে সাদা সিলের কথা বলা হয়েছে, সেটার নিছক গল্পের খাতিরে, তাছাড়া সমুদ্র থেকে এত দূরের একটি বনে নদী দিয়ে হলেও কোনো সিলের চলে আসার কথা না।
এছাড়া শাহি নামের সজারু, চিল নামের চিল, রিক্কি টিক্কি নামের বেজি, থু ও নাগ-নাগিন নামের কেউটে সাপ, মৌর নামের ময়ূর, চিকাই নামের ছুঁচো, ফেরাও নামের কাঠঠোকরা, মাং নামের বাদুর, দর্জি নামের টুনটুনি পাখি ইত্যাদি পশু-পাখিএখনো টিকে আছে আমাদের চারপাশের পরিবেশে। তাদের অধিকাংশের অবস্থা সেই মুগলির আমলের মতো আর নেই, মানুষের উন্নয়ন ও নগরায়নের ফলে সেই প্রাণীদের অবস্থা ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। এখনকার দিনে 'জঙ্গল বুক' লিখতে হলে কল্পনার ঝাঁপি খুলে ধরলেও কিপলিংকে কিছুটা অন্যভাবেই লিখতে হতো হয়তো।