বরিশালের জগদীশ হল
১.
কে এই বনলতা সেন?
এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আমাদের জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। তবে স্বয়ং জীবনানন্দ দাশের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উত্তরটি কিন্তু চমৎকার: 'শিল্পী ও কবিমাত্রই জীবনপ্রেমিক। প্রেম ছাড়া সৃষ্টি হয়? প্রকৃতি পুরুষকে সেই আবহমানকাল জুড়ে রঙে, রূপে, গন্ধে, স্পর্শে, মোহে মুগ্ধ করে রেখেছে। প্রকৃতির প্রেমেই ঘর বেঁধেছে পুরুষ আবার প্রকৃতির প্রেমেই ঘর ছেড়েছে, সে সবই শান্তি পাবার কামনায়।
কিন্তু শান্তি কি সে পেয়েছে? অতৃপ্তিই শিল্পীর রূপ...আমার সকল কবিতার প্রেরণা।...এক-একটি ছবি যা আমরা ভুলতে পারি না সারাজীবনেও। রোজই তো কত মানুষের মুখ দেখি, প্রতিমুহূর্তে মানুষের মুখের মিছিল। তবু তো ভুলি না দু-একটি মুখ, একটি কণ্ঠস্বর, একটি রং আলোর রেখা, দু'দণ্ডের শান্তি। এক অপরিচিতের ভিড়ে তাদের সঙ্গে বোধহয়,আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের পরিচয়। কোনদিন হয়তো আমাদের পরম আত্মীয় ছিলেন। অবিস্মরণীয় মুহুর্তই হয়তো সৃষ্টির মূল, কে জানে?'
২.
গবেষণার কাজটাকে আমি অন্তত এ জীবনে কখনোই আর পার্টটাইম হিসেবে দেখতে শিখলাম না। যখন যেখানে যাই, কারও সঙ্গে কথা বলি, কোনো কিছু দেখি, মাথার ভেতর অনবরত কাজ করতে থাকে কোনো না কোনো অমীমাংসিত প্রশ্নের অধ্যায়।
যেমন আজ। ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়েছিলাম একদম ভিন্ন একটা কাজে। কিন্তু যখন আবিষ্কার করলাম যে বাড়ির গৃহকর্ত্রী বরিশালের অতি প্রাচীন 'জগদীশ থিয়েটার'-এর মালিক উপেন্দ্রচন্দ্র গুপ্তর মেয়ে, তখন যে কাজে গিয়েছিলাম তা মাথায় উঠল। এতদিন জীবনানন্দ দাশের ডায়েরি ও লেখার সূ্ত্রে, বহুবার জগদীশ থিয়েটারের উল্লেখ পেয়েছি কিন্তু উপেন্দ্রচন্দ্রর ছবি তো বহুদূর, তাঁর সম্পর্কে বিশেষকিছু উদ্ধার করতে পারিনি। অথচ জীবনানন্দের সমবয়সী উপেন্দ্রচন্দ্রর কথা খুঁজলে নিশ্চয় ডায়েরিতে পাওয়া যাবে।
কী লিখছেন জীবনানন্দ বরিশালের ১৯৩০-এ তৈরি এই প্রাচীন সিনেমাহলটি নিয়ে যা ১৯৬৭-তে মালিকানা পরিবর্তন হয়ে কাকলি হল হবে?
বরিশাল শহরে সিনেমা হল খুলেছে নতুন। মাইকে মাইকে প্রচার হচ্ছে। মেয়ে-বউরা যেন দলবলসহ যায় সেই সিনেমা দেখতে। অন্যদিকে শহরের গোড়াপন্থীরাও প্রচারে নেমেছেন, চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে, শহরে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাবে সিনেমা দেখলে। বিশেষত মেয়েরা সংসারে মতি হারাবে। এইসব তথ্য তৎকালীন পত্রিকা থেকে উদ্ধার করে কৌতুক হয় যেমন, আবার সমাজতত্ত্বের সারসত্যটাও টের পাওয়া যায়।
জীবনানন্দ তো এমন একটা সময়েই বড়ো হয়ে উঠছেন। সিনেমার প্রায় সমবয়সী ছিলেন যে মানুষটা! জীবনানন্দ তাঁর গল্পে লিখছেন:
'একটা ছ্যাকরা গাড়ি ব্যান্ড বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। রোজই সকালে ঘটা করে যায়। প্রবোধ বললে, 'এ আবার কী? সার্কাস - টার্কাস এসেছে নাকি?'
ঊর্মিলা বললে, 'টকি'।
প্রবোধ বিস্মিত হয়ে শুনল।
'দুটো বায়োস্কোপ কোম্পানি এখানে এসেছে জানোনা?'
প্রবোধ ঘাড় নেড়ে বললে, 'কবে এল?'
'তুমি চলে যাবার পর থেকেই কেমন চমৎকার পিকচার হাউস তুলে ফেলেছে ওরা, নদীর পারের কাছে।' প্রবোধ বিস্মিত হয়ে শুনল।
উর্মিলা বলল, 'গোড়ায় পিকেটিং হত। বায়স্কোপ বয়কট করা হয়েছি...'
প্রবোধ খানিকক্ষণ থেমে বললে, 'কিন্তু তবু ত সিনেমা কোম্পানি টিকল।'
ঊর্মিলা বললে, 'তুমি হলে কী করতে, পিকেট করতে যেতে?'
প্রবোধ ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, 'না।'
এরপরেও দীর্ঘসংলাপ আছে। জীবনানন্দ খুব সচেতনভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন তো। নয়তো কেন এতটা পরিসর দেবেন। বায়োস্কোপের বিরুদ্ধে যারা, ঊর্মিলার বর্ণনা মতে তাদের, ভালগার, মোস্ট ভালগার, কোরাপটিভ, মোস্ট কোরাপটিভও, ডিসইনটিগ্রেটি শব্দগুলো থেকে প্রবোধ আলাদাভাবে 'ডিসইনটিগ্রিটি' শব্দটি নিয়ে চিন্তা করতে বসে যায়।
জগদীশ হল। জগদীশ সিনেমা হলটির কথাই তো লিখেছেন জীবনানন্দ। ১৯৩০ সালে নগরীর ফজলুল হক এভিনিউ সড়কের মুখে জগদীশ হল নির্মাণ করেছিলেন বটতলা এলাকার তৎকালীন বিখ্যাত গুপ্ত পরিবারের উপেন্দ্রচন্দ্র গুপ্ত। বর্তমান সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের ছাত্রাবাস 'শহীদ আলমগীর হল' ছিলো গুপ্ত পরিবারের বাসভবন।
উপেন্দ্রবাবুর মৃত্যুর পর হলটি পরিচালনা করতেন তাঁর স্ত্রী স্নেহ রানী গুপ্ত। পরে ১৯৬৭ সালে ডা. সোবাহানের কাছে হলটি বিক্রি করে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায় গুপ্ত পরিবার। ডা. সোবাহান হলটি ক্রয় করে এর নামকরণ করেন 'কাকলী হল'। ৯০-এর দশকে সেটিও ভেঙে ফেলা হয়।
জগদীশ হল বন্ধ হয়ে যাওয়া বা ভেঙে ফেলার মধ্যে যেন জীবনানন্দেরও আংশিক মৃত্যু ঘটল। আসলে সময়ের মৃত্যু।
নীচে 'জগদীশ থিয়েটার'-এর উল্লেখ আছে এমন একটি সঙ্কলন। আর সদ্য উদ্ধার করা উপেন্দ্রচন্দ্র গুপ্তর ছবি। আমি এখন 'জগদীশ থিয়েটার'-এর ছবি খুঁজছি।
আসলে চিনি জোগান চিন্তামণি!
- লেখক: জীবনানন্দ গবেষক