অবন ঠাকুরের শুরুর দিনগুলো
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা আদর করে ডাকি অবন ঠাকুর, তিনি ছবি লেখেন, কথা আঁকেন। আমাদের হাতে আছে তাঁর ৯ খণ্ডের রচনাবলি, অসংখ্য চিত্র এবং 'খুদ্দুর যাত্রা' শীর্ষক রামায়ণ মহাগ্রন্থের নবব্যাখ্যা। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে অবন ঠাকুরের আবির্ভাবপূর্ব সময় একবার পাখির নজরে চটজলদি দেখে নেয়া যাক।
ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি কলকাতা শহরে ইউরোপীয় ঘরানার শিল্পশিক্ষার বিস্তারের আগেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, কেউ কেউ নিজস্ব চেষ্টায় শিল্পশিক্ষার জন্যে সপ্তাহে তিন দিন টিউশন দিচ্ছেন। জনৈক মিস্টার হোন ১৭৮৫ নাগাদ 'কলকাতা গেজেট' পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাচ্ছেন, তাঁর রাধাবাজারের বাড়িতে তিনি সপ্তাহে তিন দিন ছবি আঁকা শেখাতে চান। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রাজধানী কলকাতায় পাশ্চাত্য শিল্পবিষয়ক শিক্ষার সূত্রপাত ঘটল ১৮৩৯ সাল নাগাদ। ফ্রেডারিক কোরবিন, ইন্ডিয়া রিভিউ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক এই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি এক সভায় মেকানিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কথা উত্থাপন করেন। নির্মাণের কাজে ছাত্রদের ব্যবহারিক জ্ঞান দেয়াই এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য ছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছিলেন, 'এদেশীয়দের শ্রমজাত শিল্প' শেখাতে প্রতিষ্ঠিত হয় সংস্থাটি। তরুণদের মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহারিক শিল্পশিক্ষার প্রয়োজনে গুরুত্ব দিতে 'সোসাইটি ফর দ্য প্রমোশন অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট' গঠিত হয়। এই সোসাইটির প্রথম সভাতেই 'দ্য ক্যালক্যাটা স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট' প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সর্বসস্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অবশ্য এখানে আগ্রহী তরুণ সমাজকে উচ্চাঙ্গের শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্য ছিল না, সহজে জীবিকার্জনের কিছু উপায় শিখিয়ে দেয়ার জন্যেই এই আয়োজনের উদ্ভব। বাংলার লাট সিসিল বিডনের হস্তক্ষেপে ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা হয় একজন মনস্বী অধ্যাপককে, তিনি হেনরি হোভার লক। ১৮৬৪ সালের ২৯ জুন তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে আধুনিক শিল্প-শিক্ষার প্রকৃত ভিত্তিস্থাপন করেন। হেনরি ছিলেন লন্ডন সাউথ কেনসিংটন মিউজিয়াম স্কুল অব ডিজাইনের ছাত্র। এই স্কুল, ভারতের সব আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষের সূতিকাগার। তখন অবশ্য খোদ সাউথ কেনসিংটনেই ধ্রুপদি রেনেসাঁ অনুগামী একাডেমিক রীতি পেরিয়ে রোমান্টিক অভিব্যক্তিবাদী কাল শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ চিত্রকলা বাস্তব অতিক্রম করে মানুষের মনের অতলে হানা দিতে শুরু করেছে। লক পরিচালিত আর্ট স্কুলে যা দেখা যাচ্ছে, তাকে যথাযথভাবে তুলে ধরাতেই সব পরিশ্রম খরচ হয়ে গেল। শিক্ষার্থীদের মননের গঠনের দিকে খুব একটা নজর করা হলো না। তিনি কলকাতায় প্রথম স্থায়ী শিল্প প্রদর্শনীর স্থান, অর্থাৎ আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে আর্টস্কুলের সংলগ্ন বউ বাজার স্ট্রিটে এই প্রতিষ্ঠান জন্মায়। মাত্র আটচল্লিশে হেনরি প্রয়াত হলেন। তাঁর সুযোগ্য ছাত্র শ্যামাচরণ শ্রীমানী। ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম ভারত শিল্পবিষয়ক নিয়মিত বক্তব্য প্রচার ও নিবন্ধ লিখে সুধীজনের মনোযোগ পেয়েছিলেন। 'আর্যজাতির শিল্পচাতুরি' শীর্ষক ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গ্রন্থের তিনিই প্রথম অন্ধ অনুকরণ বন্ধ করতে বলেন ভারতীয় শিল্পীদের। তাঁর জীবনব্যাপী কাজে ভারতীয় শিল্পাদর্শের কথা আলাদাভাবে শোনা যায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের শিল্পভাবনার প্রেরণা হিসেবে বইটির উল্লেখ করেছিলেন পরবর্তীকালে।
১৮৭৮ সালে অন্নদাপ্রসাদ বাগচী, চার সতীর্থকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন কলকাতা আর্ট স্কুল। হেনরি লকের পর স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন উইলিয়াম জরিন্স আর অলিন্দো গিলার্ডিসহ অধ্যক্ষ। গিলার্ডির কার্যকাল ১৮৮৬-১৯০৫। তিনি তেলরং, প্যাস্টেল আর এচিং- এই তিন মাধ্যমেই সুদক্ষ ছিলেন। ছাত্রদরদী শিক্ষক হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। আমাদের রচনার নায়ক তাঁর কাছে কিছুকাল চিত্রবিদ্যার শিক্ষা নেবেন। স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টের প্রতিষ্ঠা ১৮৫৪ এবং ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জুলাই আরনেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল এসে সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ পদে যোগ দেয়ার মধ্যবর্তী ৪২ বছর যে ইউরোপমুখী শিল্পশিক্ষা, হ্যাভেল এসে সে বিষয়েই প্রশ্ন তুললেন। প্রাচ্যদেশীয় কলাশিল্পের ওপর গুরুত্ব আরোপে ছাত্রদের অনেকের প্রবল অসন্তোষ জন্মাল। কেউ কেউ বেরিয়ে ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জুবিলি আর্ট একাডেমিতে গিয়ে ভর্তি হলো, তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রণদাপ্রসাদ গুপ্ত ছিলেন বিদ্রোহী দল পাকানোর মূলে। গিলার্ডির অবসরের পর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডেকে আনলেন হ্যাভেল। ১৯০৫ সালের ১৫ আগস্ট যোগ দিলেন তিনি।
২
সাধনার উদ্বোধনী সংখ্যার প্রকাশ বাংলা ১২৯৮ সনের অগ্রহায়ণ, ইংরেজি-মতে ১৮৯১ সালের নভেম্বর ডিসেম্বর। দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুরের 'স্বপ্নপ্রয়াণ'-এর অলংকরণ হিসেবে অবন ঠাকুরের আঁকা ছবি মুদ্রিত হয়। চিত্রকর হিসেবে প্রথমবারের মতো পূর্ণ মর্যাদায় তার ছবি মুদ্রিত হয়, এমনকি পত্রিকার আগাম বিজ্ঞাপনে তার নাম মুদ্রিত হয়েছিল লেখকদের সাথে সমান সম্মানের সাথে। তার আগের সময়টা যদি দেখি, দেখতে পাওয়া যাবে একটি ছেলেবেলা ফুরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাযুক্ত বালককে। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে বাবা গুণেন্দ্রনাথের প্রয়াণের সময় তাঁর বয়স ছিল দশ। তার আগের ইতিহাস হচ্ছে, প্রাইমারি স্কুলে নির্দোষ শিশু অবন ঠাকুর অহেতুক শাস্তি পেলে স্কুল থেকে তাকে ছাড়িয়ে এনে বাড়িতেই শিক্ষার আয়োজন করা হয়। ছেলেবেলায় দাদা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরেক সম্পর্কিত দাদা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে চিত্রকলা শিক্ষক হরিনারায়ণ বসুর কাছে তেল রং প্রয়োগের শিক্ষা করতে দেখেন। সংস্কৃত কলেজে টানা ৯ বছর শিক্ষাকালে ১৮৮৩-৮৪ সালে পারিবারিক নৌভ্রমণে যান। নৌকার ছাদে বসে জলরঙে ছবি আঁকতে তার ভালো লাগছিল। সংস্কৃত কলেজের বন্ধু অনুকূল চট্টোপাধ্যায় তাকে লক্ষী সরস্বতীর ছবি আঁকতে উৎসাহ দেয়। জোড়াসাঁকোর কর্মরত মানুষজন, আশেপাশের নাম না জানা পথচারীদের প্রতিকৃতি অঙ্কন নিত্যকর্মে পরিণত হয় বালকটির। ঠাকুরদা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাবা গুণেন্দ্রনাথ, কাকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রত্যেকেই কলকাতা আর্টস্কুলের শুরুর দিকের ছাত্র ছিলেন।
কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিছু পারিবারিক প্রতিকৃতি অঙ্কন করলেও এই তিনজনের কেউই চিত্রকলাকে অবনীন্দ্রনাথের মতো যাপনব্রত করে নিতে পারলেন না। ১৮৮০ শেষ হয়ে আসতে আসতে অবন বড়দের সাথে নাটকের কাজে যুক্ত হলেন। গায়কদের সংগত করতে এস্রাজ বাজানো, মঞ্চ তৈরির, নানারকম বাদ্যযন্ত্রের তালিম নেয়া শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের 'বধূ' আর 'বিম্বাবতী'-র কবিতার অলংকরণ করেন সাধনা পত্রিকার পরের সংখ্যাগুলোতে। বাংলা ভাষার একটি বিশিষ্ট পত্রিকা শুরুর দিন থেকেই এইভাবে চিত্রকলার এক গুরুত্বপূর্ণ মায়েস্ত্রোর বিকাশের দিনগুলোতে সঙ্গ দিতে লাগল। অলংকরণের নতুনত্ব ও সম্ভাবনা ঠাকুরবাড়ির অগ্রজদের মনোযোগ আকর্ষণ করল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চিত্রকলাকে যাপনের অংশ করে নেবার পরামর্শ দেন কৈশোর উত্তীর্ণ অবনকে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী তাকে অলিন্দোর কাছে আঁকা শেখার ব্যবস্থা করেন। প্যাস্টেল আর তেল রং শিক্ষা করলেন তিনি ছয় মাস। 'চিত্রাঙ্গদা' নাটক এবং সাধনায় ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত অলংকরণ অবনের বয়সের সাবালকতার পাশাপাশি চিত্রকর হিসেবে বেড়ে ওঠার নিদর্শন।
চব্বিশ বছর বয়সে রবি কাকার উৎসাহে অবনীন্দ্রনাথ তুলির পাশাপাশি কলম হাতে তুলে নেন। এই উৎসাহ প্রদানের ঘটনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অক্ষরমালার সাথে চিত্রভাষার সম্মিলনের দিক থেকে ভাবতে গেলে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। শকুন্তলা ( ১৮৯৫), ক্ষীরের পুতুল ( ১৮৯৬) হাতে নিলে আমরা দেখতে পাব একজন চিত্রকর লেখক যখন নিজের গল্পে ছবি আঁকেন, তখন সেটি কতটা মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে। এই চিত্রণে লাইনের ঘনত্ব, আলো-ছায়ার বিন্যাস বিষয়ে অবনীন্দ্রনাথের নিয়ন্ত্রণ রসজ্ঞদের কাছে পরিলক্ষিত হয়। যদিও পাশ্চাত্য প্রভাব থেকে তখনো মুক্ত হননি তিনি। চার্লস লুইস পামারের শিষ্য ছিলেন তিনি। যেহেতু সাউথ কেনসিংটনের স্কুলটির সকল প্রশিক্ষিত ছিলেন পাশ্চাত্য অনুরাগী, অবন ঠাকুরও প্রথম জীবনে এই প্রভাব থেকে নিস্তার পাননি। রবীন্দ্রনাথ এই সময় ভাইপোকে দুই খণ্ডের মিকেলাঞ্জেলো জীবনী ও রবি বর্মার ছবির প্রতিলিপি উপহার দেন। দশ বছরের ছোট এই ভাইপোটিকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখবার মূলে একটি আনন্দের ইতিহাস আছে।
রবিজবানিতে শোনা যাক একটা নিতান্ত সামান্য ঘটনায় আমার প্রতি গুণদাদার (অবনের বাবার) স্নেহকে আমি কিরূপ বিশেষভাবে উদ্বোধিত করিয়াছিলাম সে-কথা আমার মনে পড়িতেছে। ইস্কুলে আমি কোনোদিন প্রাইজ পাই নাই, একবার কেবল সচ্চরিত্রের পুরস্কার বলিয়া একখানা ছন্দোমালা বই পাইয়াছিলাম। আমাদের তিনজনের ( দাদা সোমেন্দ্রনাথ, ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ) মধ্যে সত্যই পড়াশোনায় সেরা ছিলো। সে কোনো-একবার পরীক্ষায় ভালোরূপ পাস করিয়া একটা প্রাইজ পাইয়াছিল। সেদিন ইস্কুল হইতে ফিরিয়া গাড়ি হইতে নামিয়াই দৌড়িয়া গুণদাদাকে খবর দিতে চলিলাম। তিনি বাগানে বসিয়া ছিলেন। আমি দূর হইতেই চীৎকার করিয়া ঘোষণা করিলাম, "গুণদাদা, সত্য প্রাইজ পাইয়াছে।" তিনি হাসিয়া আমাকে কাছে টানিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "তুমি প্রাইজ পাও নাই?'' আমি কহিলাম, "আমি পাই নাই, সত্য পাইয়াছে।" ইহাতে গুণদাদা ভারি খুশি হইলেন। আমি নিজে প্রাইজ না পাওয়া সত্ত্বেও সত্যের প্রাইজ পাওয়া লইয়া এত উৎসাহ করিতেছি, ইহা তাঁহার কাছে বিশেষ একটা সদগুণের পরিচয় বলিয়া মনে হইল। তিনি আমার সামনেই সে-কথা অন্য লোকের কাছে বলিলেন। এই ব্যাপারের মধ্যে কিছুমাত্র গৌরবের কথা আছে, তাহা আমার মনে ছিলো না; হঠাৎ তাঁহার কাছে প্রশংসা পাইয়া আমি বিস্মিত হইয়া গেলাম। এইরূপে আমি প্রাইজ না পাইয়াও প্রাইজ পাইলাম।' এই ইতিহাসের পরবর্তীকালের ঘটনায় আমাদের চোখে পড়বে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের প্রথম দিকে পাওয়া এই বিস্ময়কে ভুলতে পারেননি। নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে এক দশকের মাত্র অনুজ ভাইপোকে বিস্মিত করেছেন সারাজীবন।
৩
১৮৯৭ সালে অল্প বয়সে প্রয়াত নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবির খোঁজ পরিচয় করাল ফ্রান্সেস মার্টিনডেলের সাথে। তিনি নগেন্দ্রকে চিনতেন ছেলেবেলা থেকে। আইরিশ মেলোডির ফ্রান্সেস অলংকৃত এক সেট উপহার পেলেন অবন। শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়, তাঁর অগ্রজ আত্মীয় উপহার দিলেন ভারতীয় মিনিয়েচার ছবি। এই দুই শৈলীর ছবি একসাথে দেখে অবনের মনে তৃতীয় এক পথের কথা জাগ্রত হলো। এই দুইয়ের প্রভাবে অবনের আঁকা প্রথম ছবি 'অভিসার'। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, ভারতীয় ধরনের আঁকার এই তাঁর প্রথম চেষ্টা। জলরঙে আঁকা এক ছোট ছবিতে রাধা, ফ্রেম করা হয়েছে ফ্লোরাল ডিজাইন আর লেখায়। গোবিন্দ দাস (১৫৩৭-১৬১২) প্রণীত বৈষ্ণব পদাবলী থেকে বাক্যগুলো নেয়া। লে আউট অবশ্য মার্টিনডেল অনুকরণে করা। 'রাধা'- কৃষ্ণলীলা সিরিজের প্রথম ছবি। প্রথম স্বকীয়তার দিকে পা বাড়ানো। ট্র্যাডিশনাল ভারতীয় মিনিয়েচার, যেমন একাধিক সীমানা, ক্যালিগ্রাফি টেক্সট, রঙের ঘন সংহত ব্যবহার, সুসংবদ্ধ কম্পোজিশন, সব মিলিয়ে নিজের শৈলীকে ভেঙেচুরে স্বতন্ত্র পথ তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। তখনো পাশ্চাত্য অনুগামিতা তাঁকে ছেড়ে যায়নি।
কৃষ্ণলীলার পর পামারের সাথে তাঁর চিন্তার দূরত্ব বাড়ে, ই বি হ্যাভেলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হ্যাভেলের সাথে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীই পরিচয় করিয়ে দেন স্নেহের অবনকে। হ্যাভেল নামক ভদ্রলোকটি ছিলেন প্রাচ্য শিল্পের একান্ত অনুরাগী। হ্যাভেলের সাথে আরও কয়েকজনের নাম না নেয়া অন্যায় হবে যারা চিত্রকর অবনীন্দ্রনাথের চলার পথে চিহ্ন রেখে গিয়েছেন। তাঁরা হলেন ভাবুক ও চিন্তক ওকাকুরা, ভগিনী নিবেদিতা। ওকাকুরার সৌজন্যে জাপান থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন ইয়োকোয়ামা টাইক্কান এবং হিশিদা সুনসো। 'জোড়াসাঁকোর ধারে' বইতে অবন জানাচ্ছেন, টাইক্কান আমায় লাইন ড্রইং শেখাত, কী করে তুলি টানতে হয়। আমরা তাড়াতাড়ি লাইন টেনে দিই, তার কাছেই শিখলুম একটি লাইন কত ধীরে ধীরে টানে তারা।' ওয়াশের পদ্ধতিও তিনি টাইক্কানের কাছে শিখেছিলেন বলে আমাদের উক্ত বইতে জানান।
শিল্পের ভেতরের আত্মশক্তি বিষয়ে অবনীন্দ্রনাথের ভাবনাটা জেনে নিলে তাঁর চিত্রসাধনার একটি দিক আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে পারে, যে বীজের মধ্যে মাটি ঠেলে ওঠবার শক্তি না পৌঁছল, সে বীজ ফল থেকে বেড়ে চলতে-চলতে গাছ হতে চলল না, কবির ভাষা ছবির ভাষা গায়ক নর্তক অভিনেতা এদের ভাষার পক্ষেও ঐ কথা। যে ভাষা প্রয়োগ করছে সেই দেখছে মন দিয়ে লেখা তীরের মতো সোজাসুজি চলে, কিন্তু অভিধান ইত্যাদি দিয়ে লেখা যতই ভারী করা যায়, শক্ত করা যায় ততই সে কচ্ছপের মতো আস্তে আস্তে চলে।' এই ধরনের ভাবনার কারণেই বোধ করি, অবনের ছবিতে রঙের উজ্জ্বলতা বেশি, তিনি মনের সরল প্রসন্নতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন আগে এবং এই কারণেই জীবনের শেষদিকে দীর্ঘ অনেক বছর চিত্রকলা থেকে বিদায় নিয়ে তিনি কাটুম কুটুমে মাতবেন। বিজ্ঞাপনের ছেঁড়া কাগজ, রাংতা কাগজ এমন নানা জিনিসকে ব্যবহার করে তিনি রামায়ণের এক নতুন ভাষ্য তৈরি করবেন, যেখানে প্রাচীন পুরাণ আর আধুনিক বিজ্ঞাপন একাকার হয়ে যায়। ফেলানো-ছড়ানো জিনিসের মর্মে মণিমাণিক্য আবিষ্কারের এক নেশায় পরিণত হবে, কিন্তু এসব আরও অনেক পরের ভিন্ন প্রসঙ্গ।