ভাষার জীবন, ভাষার মরণ
ভাষা কোনো শূন্যস্থানে টিকে থাকে না। ভাষা তখনই টিকে থাকে, যখন কোনো গোষ্ঠী সেই ভাষাটিকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করে এবং এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। কোনো গোষ্ঠী তখনই ভালোভাবে বেঁচে থাকে, যখন সেখানে থাকার মতো একটি স্থিতিশীল পরিবেশ এবং টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থাকে। তাই কোনো ভাষা কেন জন্মে বা মরে যায়, সেটি বুঝতে হলে কেবল ভাষাই নয়, বরং কোনো জনগোষ্ঠী তাদের ভাষাটিকে জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে কাজে লাগায় তার বিশ্লেষণও জরুরি।
কোনো বাস্তুতন্ত্রে একটি প্রাণী যেভাবে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যেভাবে প্রাণীটির সাথে বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশসহ অন্যান্য প্রাণীগুলো নির্ভরশীল, ঠিক একইভাবে সমাজের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের সাথে ভাষা জড়িত। পরিবেশে একটি ছোট পরিবর্তন যেমন কোনো প্রাণীকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে, ঠিক তেমনিভাবে সমাজের পরিবর্তনও কোনো ভাষাকে ঠেলে দিতে পারে বিলুপ্তির দিকে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক ব্রাজিলের কথা। ১৯৮৭ সালে উত্তর ব্রাজিলের ইয়ানোমামি আদিবাসীদের এলাকায় সোনার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে মাত্র ৮ হাজার আদিবাসী থাকতেন। আট মাসের মধ্যে ৩০ হাজার স্বর্ণসন্ধানী ওই এলাকা ছেয়ে ফেলে। ব্রাজিল সরকারের তথ্যানুযায়ী, তাদের সংস্পর্শে এসে প্রতিদিন গড়ে একজন আদিবাসী মারা যেতে থাকেন, ঝুঁকিতে পড়ে যায় তাদের ভাষা।
ভাষা মারা যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ কোনো ভাষাগত দুর্বলতা নয়। যখন ভাষা পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়, তখন তার গভীরে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কিংবা পরিবেশগত কারণ থাকে। ভাষা আর সমাজের এই জটিল সম্পর্ক বোঝার জন্য একটি উদাহরণ প্রয়োজন। আর এর জন্য সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ পাপুয়া নিউগিনি। ১,৩০০টি ভাষার এই দেশে পরিবেশগত ও মানববৈশিষ্ট্যের বৈচিত্র্যও কম নয়। বিশ্বের ১৩.২ শতাংশ জীবিত ভাষা এই দ্বীপটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যেখানে দ্বীপটির জনসংখ্যা পুরো পৃথিবীর মাত্র ০.১ শতাংশ!
ভাষার স্বর্গ পাপুয়া নিউগিনি
পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ভাষার দেশ পাপুয়া নিউগিনি। যদি পরিবেশের কথা বলা হয়, সেটিও কম বৈচিত্র্যময় নয়। পাহাড়-পর্বত আর খরস্রোতা নদীতে ভরপুর এই দেশ তার প্রতিকূল পরিবেশের জন্যই বাইরের পৃথিবী থেকে অনেকটাই আলাদা। দ্বীপটির দক্ষিণ উপকূলে থাকা বন্দর পোর্ট মোর্সবি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে জায়গায় অবস্থিত রাজধানী, যার সাথে দেশটির বেশিরভাগ অঞ্চলের যোগাযোগ নেই। রাজধানীর তুলনায় দ্বীপটির অভ্যন্তরে থাকা লোকজনই বেশি। অনেক গ্রামই কোনো শহরের সাথে সড়কপথের মাধ্যমে সংযুক্ত নয় এবং কাছের কোনো শহরে যাওয়ার একমাত্র উপায়: পায়ে হেঁটে দুই সপ্তাহ হাঁটা।
সাম্প্রতিক এক হিসাব অনুযায়ী, বনে ঢাকা পাহাড়-পর্বতের উপত্যকার মাঝখানে টিকে রয়েছে প্রায় ৮৩০টি ভাষা। অর্থাৎ প্রতি ৫ হাজার মানুষের জন্য গড়ে একটি ভাষা রয়েছে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে ভাষার সংখ্যা থাকত ৬৬ হাজার!
ছোট দেশ ও কম জনসংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও এখানে ভাষার বণ্টন একরকম নয়। দেশের অভ্যন্তরে থাকা মূল হাইল্যান্ডে বাস করা আদিবাসীদের মধ্যেই প্রধান ভাষাগুলো ব্যবহার হয়। সবচেয়ে বড় দশটি ভাষাতেই ৩০ হাজার থেকে এক লক্ষ লোক কথা বলে, যেটি মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। এই হিসাবে প্রান্তিক পর্যায়ের বহু ভাষা রয়েছে, যেগুলোতে ৫০০ জনেরও কম লোক কথা বলে। এবং এটি কোনো সাম্প্রতিক তথ্য নয়, বরং বহুদিন ধরেই চলে আসছে। এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, বেশ কিছু ভাষাতে একেবারেই কম লোক কথা বললেও সেই ভাষার ব্যবহার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে রয়েছে, একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। এ কারণেই ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের একেবারে নিখুঁত গবেষণাগার হয়ে উঠেছে দ্বীপটি।
৪০ হাজার বছর আগেও দ্বীপটিতে মানববসতি থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেও এর লিখিত ইতিহাস একেবারেই সাম্প্রতিক সময়ের এবং কয়েক জায়গায় মাত্র কয়েক দশক আগে থেকে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের সংস্পর্শে আসা শেষ বড় এলাকা এটি এবং বেশিরভাগ জায়গাতেই এক শতাব্দীরও কম সময় আগে বহির্বিশ্বের মানুষের পা পড়েছে।
পাপুয়া নিউগিনির ভাষাকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেন ভাষাবিদেরা: অস্ট্রোনেশিয়ান এবং নন-অস্ট্রোনেশিয়ান (পাপুয়ান)। অস্ট্রোনেশিয়ান ভাষাগুলোকে এর গাঠনিক কাঠামো বিশ্লেষণ করে এর বিবর্তনের ধাপগুলোকে সহজে বোঝা গেলেও পাপুয়ান ভাষাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক খুবই অস্পষ্ট। অস্ট্রোনেশিয়ান ভাষাগুলোর বেশিরভাগই উপকূলীয় অঞ্চলে, ফলে বোঝা যায় যে এগুলো দ্বীপের অভ্যন্তরে থাকা পাপুয়ান ভাষাগুলোর তুলনায় অনেক পরে তৈরি হয়েছে।
নিউগিনির জনগণরা মূলত একইজায়গায় একটি নির্দিষ্ট এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বাস করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। পর্বতের উঁচু এলাকাগুলো আলপাইন জলবায়ুর হওয়ায় সেখানে গত কয়েক শতাব্দী ধরে মিষ্টি আলুর ব্যাপক চাষ হচ্ছে, যার ওপর নির্ভর করেই সেখানে জনসংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। এসব উঁচু জায়গায় প্রচুর লোক একসাথে থাকে, যে কারণে এই অঞ্চলগুলো কয়েকটি ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
অন্যদিকে উপকূলীয় ও মাঝারি উচ্চতার অঞ্চলগুলো রেইনফরেস্ট, জলাভূমি আর তৃণভূমি বিস্তৃত এবং তেমন ঘনবসতিও চোখে পড়ে না। আর ঠিক এ জায়গাতেই ভাষার ব্যাপক বৈচিত্র্য দেখা যায়। অনেক দূরে দূরে অবস্থিত গ্রামগুলোতে ৫০ থেকে ১০০ জন লোক বাস করে, যার অনেকগুলোতেই তাদের অনন্য ভাষা ব্যবহার দেখা যায়। আবার পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রাম মিলে কোনো নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে, যার ফলে সেই ভাষায় খুব বেশি হলে কয়েক হাজার মানুষ কথা বলে।
পাপুয়া নিউগিনিতে কেন এতগুলো ভাষা?
পাপুয়া নিউগিনির উপকূলীয় অঞ্চল এবং মাঝারি উচ্চতার এলাকায় কেন এত বেশি ভাষার বৈচিত্র্য, সে প্রশ্নে নজর দেওয়া যাক। এর একটি উত্তর লুকিয়ে রয়েছে এর পরিবেশের মধ্যেই। এই উর্বর পরিবেশের কারণে ৫০ থেকে ১০০ জন মানুষ মিলেই নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে ফেলার মতো জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারে। তাদের অন্য গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করতে হয় না। এছাড়া তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বিস্তীর্ণ ভূমি প্রয়োজন, যা অনেকে একসাথে থাকলে ভাগ-বাঁটোয়ারার ঝামেলায় যেতে হতে পারে। তাছাড়া ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য মারণঘাতী রোগের বিস্তারের কারণে তারা নিজেরাও একে ওপর থেকে আলাদা থাকতে পছন্দ করে। এসব কারণেই তারা ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায়। তবে এটাই নিউগিনির পূর্ণচিত্র নয়।
অনেকের মনেই এখন ভাসতে পারে, পাপুয়া নিউগিনির পার্বতীয় অঞ্চল আর নিজেদের টিকিয়ে রাখার মতো পরিবেশ থাকার ফলেই গোষ্ঠীগুলো আলাদা থাকার ফলেই তাদের মধ্যে এই ভাষাগত বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটি পুরোপুরি এমন নয়। মূল খাদ্য নিজেরাই উৎপাদন করতে পারলেও অন্যান্য পণ্যের জন্য তাদের অন্য গোষ্ঠীগুলোর সাথে পণ্য আদান-প্রদান করতেই হয়। উপকূলীয় অঞ্চলের গোষ্ঠীগুলো সমুদ্র থেকে শামুক তুলে আনে, এদিকে হাইল্যান্ডের লোকজনেরা পাখির পালক আদান-প্রদান করে তাদের সাথে। পাথর দিয়ে তৈরি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, মাটির পাত্র, লবণসহ বিভিন্ন জিনিস এক বিশাল সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে পুরো নিউগিনিতেই পাওয়া যায়।
এই ধরনের বাণিজ্য মূলত বিভিন্ন উৎসব বা আঞ্চলিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। ভাষাগত ভিন্নতা ছাপিয়ে গিয়ে বিপুল পরিমাণ পণ্যের আদান-প্রদান হয়। এর ফলে প্রায়ই বিভিন্ন গোষ্ঠী একে-অপরের সাথে হাত মেলায়, যা প্রায়ই রূপ নেয় তৃতীয় আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। পাপুয়া নিউগিনিতে গোষ্ঠীগত যুদ্ধ একেবারেই স্বাভাবিক নিয়মিত ঘটনা। যখন কোনো গোষ্ঠী যুদ্ধে হেরে যায়, তখন বিজয়ী গোষ্ঠীর মধ্যে একাত্ম হয়ে যায় তারা। একইসাথেগোষ্ঠীগুলো বড় হতে থাকলে এবং মহামারি বা রাজনৈতিক ঝামেলা দেখা গেলে অনেকসময় আলাদাও হয়ে যায়।
হাইল্যান্ডের মতো এলাকায় যেখানে গোষ্ঠীগুলো বড়, সেগুলোর প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষগুলো সাধারণত একাধিক ভাষা ব্যবহার করে। তবে যেখানে গোষ্ঠীগুলো ছোট ছোট, সেখানকার জনগোষ্ঠীর জন্য একাধিক ভাষা জানা বাধ্যতামূলক। এক গবেষণায় দেখা যায়, লোল্যান্ডের একটি গ্রামে চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা গড়ে ৫টি ভাষা জানেন: একটি নিজেদের ভাষা, একটি লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা এবং তিনটি স্থানীয় পার্শ্ববর্তী গোষ্ঠীর ভাষা।
একাধিক ভাষা জানা এবং সে ভাষায় কথা বলা কেবল প্রাত্যহিক ব্যাপারই নয়, বরং সম্মানেরও ব্যাপার; নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও কথা বলার সময় তাদের ভাষাগত দক্ষতা প্রদর্শন করে। অনেক বালককেই পার্শ্ববর্তী গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভাষা শেখার জন্য, যাতে তারা পরবর্তীতে দোভাষী এবং বক্তা হিসেবে কাজ করতে পারে।
এই একাধিক ভাষা শেখার সংস্কৃতি পাপুয়া নিউগিনিতে টিকে রয়েছে কেন, সেটি জানা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, এটি আমাদেরচিন্তা করতে বাধ্য করে, কেন আলাদা আলাদা ভাষা টিকে রয়েছে। আমরা ভাবতে পারি, কেবল আলাদা আলাদা দূরবর্তী জায়গায় থাকার কারণেই এই একাধিক ভিন্ন ভাষার জন্ম হয়েছে এবং এদের মধ্যে যোগাযোগ সহজ করলেই তা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, নিউগিনির এই গোষ্ঠীরা চাইলেই একই ভাষার নিচে একত্র হতে পারত, তাদের সেই সুযোগ ছিল। কিন্তু তারপরেও তারা তা করেনি। তারা হয়তো নিজের ভাষায় যে শব্দটি নেই, অন্য ভাষা থেকে সে শব্দটি ধার করেছে, কিন্তু সেগুলোকেও নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করে নিয়েছে, উচ্চারণ করেছে নিজেদের অ্যাকসেন্টে। গোষ্ঠীদের মধ্যে আন্তযোগাযোগ ভাষাকে এক জায়গায় নিয়ে আসেনি, বরং নিজেদের ভাষা রক্ষা নিয়ে আরও সচেতন ও গর্বিত করে তুলেছে বলে জানিয়েছেন ভাষাতত্ত্ববিদ জিলিয়ান স্যাংকঅফ।
অনেকেই মনে করেন, যে ভাষাটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, সে ভাষাটিকেই একসময় সবাই গ্রহণ করে নেবেন। কারণ, এর অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে, তথ্য আরও সহজে আরও বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে আদান-প্রদান করার সুযোগ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ছোট ভাষাকে মানুষ আঁকড়ে ধরে রাখে; কারণ, এর কোনো বিকল্প ভাষা নেই অথবা এই ভাষা হারিয়ে গেলে তাদের অনেক বস্তুগত ক্ষতি হবে। কিন্তু ভাষার সাংস্কৃতিক মূল্য যে অন্য সংস্কৃতিতে বেশি হতে পারে, এটিই অনেকে ভুলে যায়।
আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সুবিধাকে বিবেচনায় না নিয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেওয়াকে আদিম বর্বর কিছু মনে হতে পারে। যেমন অনেক তাত্ত্বিকই নিউগিনির আদিবাসীদের আদিম মনে করেন, কারণ তারা খাবার নিজেদের জন্য জমিয়ে না রেখে উৎসবে প্রতিবেশী বা অন্যদের জন্য দান করে দেন। কিন্তু তারা এ সময় মানব ইতিহাসের পূর্ণচিত্রকে বিবেচনায় আনতে ভুলে যান। ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় ধরেই মানুষ খাবার থেকে শুরু করে সবকিছুর ওপরই অন্য ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল। একজন ব্যক্তি কী পরিমাণ সাহায্য পাবে, তা নির্ভর করত অন্যদের সাথে তার সামাজিক সম্পর্ক কেমন তার ওপর। বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতায় অবশ্য এই ধারণাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কারণ, তাদের প্রয়োজন এখন মেটে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। পরিবার, প্রতিবেশী বা বন্ধুদের ওপর নির্ভরশীল হতে হয় না তাদের। কিন্তু নিউগিনির সমাজে টিকে থাকতে হলে সামাজিক সম্পর্ক অপরিহার্য, এর কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের দ্রুত অনুধাবন করা উচিত, অর্থনৈতিক মূল্য ছাড়াও আমাদের সামাজিক মূল্যও রয়েছে। কমিউনিটির সাথে ভালো সম্পর্ক থাকা অনেকসময় সম্পদ বা টাকার চেয়েও ভালো কাজ করে। নিউগিনির মতো সমাজে এটি আরও বাস্তব। সেখানে সমাজের নেতৃত্বস্থানীয়রা সম্পদ বেশি থাকলেও তাদের ক্ষমতা টাকার পাহাড় থেকে আসে না, বরং আসে তার সাথে কত প্রভাবশালী মানুষের সম্পর্ক আছে তার ওপর।
গত কয়েক শতাব্দী ধরে পাপুয়া নিউগিনিতে ভাষাগত তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, একধরনের ভাষাগত সাম্যাবস্থা টিকে ছিল পুরো দ্বীপজুড়ে। হঠাৎ করে কোনো ভাষার খুব জোরালো প্রভাব দেখা যায়নি, আবার খুব দ্রুত একাধিক ভাষা মারা যায়নি। এই প্রবণতা ভাষাতাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, বরং এর কারণ বোঝার জন্য আমাদের এর সমাজব্যবস্থা বোঝার প্রয়োজন ছিল। আর এভাবেই বোঝা গেল কীভাবে এবং কেন ছোট ছোট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গোষ্ঠীগুলো নিজেদের অনন্য ভাষাগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে।
ভাষা যেভাবে মারা যায়
ভাষার মারা যাওয়ার প্রক্রিয়াকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হলো, জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। বিগত পাঁচ শ বছরে অসংখ্যা ভাষা এভাবে হারিয়ে গিয়েছে। যখন ইউরোপীয়রা আমেরিকায় পাড়ি জমায়, তখন তাদের কাছ থেকে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন রোগের জীবাণু ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ আদিবাসী আমেরিকানদের মেরে ফেলে। পুরো জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অনেক জায়গাতেই, বিশেষ করে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে। যার ফলে হারিয়ে যায় অসংখ্য ভাষা। ক্যারিবীয় অঞ্চল আর অস্ট্রেলিয়াতেও একই পরিণতি হয় অনেক ভাষার।
তবে কেবল জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেই যে ভাষার মৃত্যু হয় এমন নয়। যেমনটা হয়েছে কর্নিশদের ক্ষেত্রে। তারা এখনো ভালোভাবেই বেঁচে আছে এবং জনসংখ্যাও বেড়ে চলেছে। কিন্তু তারা এখন যতটা না কর্নিশ ব্যবহার করে, তার চেয়ে বেশি ব্যবহার করে ইংরেজি। এ ধরনের মৃত্যু হলো এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় স্থানান্তর। এই স্থানান্তর আবার দুইভাবে হতে পারে, একটি চাপ প্রয়োগ করে, অন্যটি স্বেচ্ছায়।
ইতিহাসে অনেকবারই প্রভাবশালীরা তাদের ভাষাকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করেছে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে বেশিরভাগ সময়েই এই বাধ্যতামূলক ঘোষণা আরও প্রতিরোধের শিকার হয়েছে। তবে ভাষাকে যদি এর অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে ছোট ছোট ভাষাগুলো দ্রুত মারা যায়। এখান থেকেই ভাষা, অর্থনীতি ও সমাজের আন্তঃসম্পর্ক অনুধাবন করা যায়। রাজনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে সাধারণত ভাষাকে মেরে ফেলা যায় না, তবে যদি অর্থনৈতিক সুবিধা ও সামাজিক সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রভাবশালী ভাষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়, তবে ফলাফল হয় আরও কার্যকর। ভাষাকে জীবিত রাখতে হলে সমাজে এর বাস্তব মূল্য থাকতে হবে, অন্যথায় এটি হারিয়ে যাবে কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই।
ভাষার মৃত্যুর তৃতীয় কারণ স্বেচ্ছায় অন্য ভাষায় স্থানান্তর। এ ক্ষেত্রে সেই ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠীটি মনে করে তাদের ভাষার তুলনায় অন্য ভাষায় কথা বলা আরও কার্যকর। নৃতত্ত্ববিদ সুসান গাল তার গবেষণায় দেখিয়েছেন কীভাবে অস্ট্রিয়ার লোকজনহাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে বাদ দিয়ে জার্মান ভাষায় কথা বলা শুরু করে। বিশেষ করে অস্ট্রিয়ান নারীরা তাদের বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জার্মানভাষী পুরুষদের বেছে নেন। তবে এ ধরনের স্থানান্তর হতে কয়েক দশক এমনকি কয়েক শতাব্দীও লেগে যেতে পারে।
ভাষার এই মৃত্যুকে ভিন্নভাবে আরও দুই ভাগে ভাগ করা যায়: 'ফ্রম টপ টু ডাউন' এবং 'ফ্রম দ্য বটম আপ'। টপ টু ডাউনের ক্ষেত্রে ভাষাগুলো সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (আদালত, অফিস, উপাসনালয় এবং রাজনীতি-অর্থনৈতিক বিষয়) থেকে হারিয়ে যায় এবং কেবল বন্ধু, পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফ্রান্সের ব্রেটন কিংবা স্কটল্যান্ডের গেইলিক ভাষা এর উদাহরণ। নতুন দেশে অভিবাসীদের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যেমন ব্রিটেনের পাঞ্জাবিভাষী কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ইতালীয়ভাষীরা প্রথমে নতুন দেশে নিজেদের প্রাথমিক ভাষা টিকিয়ে রাখলেও কয়েক প্রজন্ম পরেই তারা তাদের মূল ভাষা থেকে সরে গিয়ে সেই দেশের প্রধান ভাষা ইংরেজিতে স্থানান্তরিত হয়। সাধারণত প্রথম প্রজন্মরাই অভিবাসীরাই মূল ভাষায় সাবলীল হয়এবং প্রতি প্রজন্মে এই সাবলীলতা কমতে কমতে একসময় মূল ভাষা হারিয়েই যায়।
অন্যদিকেবটম আপ মৃত্যুর ক্ষেত্রে জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবন থেকে ভাষা হারিয়ে যায়, কেবল বিশেষ ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে সেগুলো টিকে থাকে। এ ধরনের মৃত্যুর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইউরোপের ল্যাটিন, ভারতের সংস্কৃত কিংবা ইহুদিদের মধ্যে প্রচলিত হিব্রু ভাষার কথা। সংস্কৃত দীর্ঘদিন ধরে কেবল পুরোহিতদের মধ্যেই প্রচলিত এবং বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই ব্যবহার করা হয়। হিব্রুও বহুদিন ধরে কেবল ধর্মীয় গ্রন্থ এবং ধর্মীয় আচারে ব্যবহার করা হতো। তবে জায়োনিজমের উত্থান এবং ইসরায়ের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এটিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার পর এটি আবার ফিরে এসেছে। বর্তমানে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের প্রধান ভাষা এটি।
ভাষার ভারসাম্যের পরিবর্তন
মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরেই পুরো পৃথিবীজুড়ে ভাষার ভারসাম্য বজায় ছিল। কিন্তু শেষ পাঁচ শ বছর ধরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে, যেগুলো ছোট ছোট ভাষাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, করে ফেলেছে বিলুপ্ত। মানবসমাজে কী এমন পরিবর্তন হয়েছে, যার ফলে এটি হচ্ছে?
এর প্রথম কারণ হলো শিল্পায়ন। প্রযুক্তির ভারসাম্য ব্যাহত করেছে এটি, সৃষ্টি করেছে অর্থনৈতিক অসমতা এবং পার্শ্ববর্তী গোষ্ঠী তথা পুরো বিশ্বের সাথেই যোগাযোগ বেড়েছে প্রচণ্ড।
দ্বিতীয় কারণটি হলো কৃষির বিস্তার। আর কৃষির বিস্তারের ওপর ভর করেই শিল্পায়ন (প্রথম কারণ) হয়েছিল। কৃষি বিপ্লবের শুরু হয়েছিল দশ হাজার বছর আগে এবং এখনো চলছে। তবে শেষ এক হাজার বছর আগে শুরু হওয়া ভাষাগুলোর ব্যাপকহারে মৃত্যুর সাথে দশ হাজার বছর আগের ঘটনা কীভাবে সম্পর্কযুক্ত? কৃষি কেবল শিকারি-সংগ্রহকারী গোষ্ঠীকেই হারিয়ে দেয়নি, বরং শুরু থেকেই দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে যখন ইউরোপীয় কৃষকেরা অস্ট্রেলীয় শিকারি-সংগ্রহকারীদেরহারিয়ে তাদের জায়গা দখল করে নেয়, তখন নিওলিথিক যুগ থেকে চলে আসা সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটে। আর এভাবেই কৃষিভিত্তিক সমাজের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে পৃথিবীর বহু ভাষা।