ছয়জনের ‘রেংমিটচ্য ভাষা’ বাঁচাতে শব্দভান্ডার বই
বান্দরবানে ম্রো জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় 'রেংমিটচ্য ভাষার' শব্দভান্ডার নিয়ে জানুয়ারি মাসে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম রাখা হয়েছে 'মিটচ্য তখক' অর্থাৎ 'রেংমিটচ্য ভাষা'। তবে আলাদাভাবে রেংমিটচ্য ভাষার কোনো লিখিতরূপ না থাকায়– ম্রো ও বাংলা শব্দের মাধ্যমে এ ভাষার উচ্চারণ লেখা হয়েছে। ২০১৩ সালে থেকে ১০ বছর ধরে রেংমিটচ্য ভাষার শব্দ সংগ্রহ করে বইটি প্রকাশ করেছেন- ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াঙান ম্রো।
রেংমিটচ্য ভাষীরা ম্রো জনগোষ্ঠীর হলেও, তারা রেংমিটচ্য ও ম্রো উভয় ভাষাতেই কথা বলে থাকেন। তবে ম্রোদের মধ্যে শুধু রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারা জীবিত মানুষ মাত্র ছয়জন। এখন যাদের অধিকাংশের বয়স ষাটোর্ধ্ব। ভাষা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ছিল, রেংমিটচ্য ভাষার এ ছয়জন লোক মারা গেলে পৃথিবী থেকে আরেকটি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তার মধ্যে প্রকাশিত হলো 'রেংমিটচ্য তখক' বা 'রেংমিটচ্য ভাষার' শব্দভান্ডার বইটি। তিন হাজারের বেশি শব্দভান্ডার এই বইটি বের হওয়ার কারণে একেবারে ভাষা বিলুপ্তির হাত থেকে কিছুটা রক্ষা হলো বলে মনে করেন এ ভাষার লোকজন।
১৯৯৯ সালের দিকে কুকি-চিন ভাষা (খুমি, ম্রো, খিয়াং ও রেংমিটচ্য ভাষা) নিয়ে গবেষণা করতে বাংলাদেশে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ও ভাষাবিজ্ঞানী ডেডিভ পিটারসন। পরে ২০০৯ সালে বান্দরবান জেলার আলীকদমে এসে রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ শুরু করেন। মূলত তিনিই প্রথম ম্রোদের মধ্যে রেংমিটচ্যভাষীদের খুঁজে বের করেন। এসময় তার এই গবেষণার কাজে সহযোগী ছিলেন, ম্রো ভাষার লেখক ইয়াঙান ম্রো। তখন থেকে ডেভিড পিটারসনের সঙ্গে রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। এসময় ডেভিড পিটারসন রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ২২ জনকে খুঁজে বের করেন। পরে ডেভিড পিটারসন চলে যাওয়ার পর ইয়াঙান ম্রো নিজেই এ ভাষা নিয়ে নতুনভাবে কাজ করা শুরু করেন।
২০১৩ সাল থেকে আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকা ঘুরে তাদের শব্দ সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালে রেংমিটচ্য ভাষার লোকজন ইয়াংঙানকে জানিয়েছিল, তাদের ২২ জনের বাইরে আরও ১০ জন রেংমিটচ্যভাষী ম্রো থাকতে পারে, যারা ভালো করে এই ভাষায় কথা বলতে পারেন। এই ১০ জন রেংমিটচ্যভাষী কোন এলাকায় রয়েছে, এখনো খুঁজে বের করার চেষ্টা রয়েছে তার। তবে ওই ২২ জনের মধ্যে বিভিন্ন সময় মারা যাবার পর রেংমিটচ্যভাষী এখন মাত্র ছয়জন জীবিত রয়েছে।
বতর্মানে জীবিত রেংমিটচ্যভাষী এই ছয়জন ম্রো হলেন- আলীকদম সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের ক্রাংসিং পাড়ার বাসিন্দা মাংপুং ম্রো (৬৯),কুনরাও ম্রো (৭২), কুনরাও ম্রো (৬২) এবং নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মেনসিংপাড়ার বাসিন্দা থোয়াই লক ম্রো (৫৭)। অন্য দুজন হলেন- নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবট পাড়ার বাসিন্দা রেংপুং ম্রো (৫৪) ও কাইংওয়াইপাড়ার (সাংপ্লপাড়া বলা হয়) বাসিন্দা মাংওয়াই ম্রো (৬৫)। তার মধ্যে মাংপুং ম্রো, রেংপুং ম্রো ও মাংওয়াই ম্রো তারা আপন ভাই। এছাড়া, জীবিত এই ছয়জনের মধ্যে কুনরাও ম্রো নামে দুজন মহিলা রয়েছে এবং বাকি চারজন হলেন পুরুষ।
রেংমিটচ্য ভাষার শব্দভান্ডার বইটির সম্পর্কে ইয়াংঙান ম্রো বলেন, ২০১৩ সাল থেকে রেংমিটচ্য ভাষার লোকজনদের কাছ থেকে শুনে শব্দ সংগ্রহ করা শুরু করা হয়। ভাষাটি যাতে বিলুপ্ত না হয়, সংগৃহীত শব্দগুলো সংকলন করে নিজের খরচে এ বছর জানুয়ারিতে একটি বই আকারে বের করা হয়েছে। ৩৭ পৃষ্ঠার শব্দভান্ডার এ বইটিতে মোট ৩ হাজারের বেশি শব্দ রয়েছে। এ ভাষা মাত্র ছয়জন বলতে পারলেও বইয়ের মাধ্যমে রেংমিটচ্য ভাষা সম্পর্কে অনেক মানুষ জানতে পারবে। বইটিতে মোট ৩৫টি অধ্যায় রয়েছে। এতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখি, কীতপতঙ্গ, তরিতরকারি, খাদ্যের নাম, খেলাধুলার নাম, দিন ও মাসের নামরাখা হয়েছে। এছাড়া রেংমিটচ্য ভাষার বাক্য ও রেংমিটচ্য ভাষায় গণনাও রাখা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে মাত্র ১০০ কপি ছাপা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে আরও ১০০ কপি বের করার পরিকল্পনা রয়েছে তার।
বই প্রকাশের খবর পেয়ে আলীকদমের মেনসিংপাড়া থেকে রেংমিটচ্য শব্দভান্ডার বই নিতে জানুয়ারি মাসে বান্দরবান শহরে এসেছিলেন রেংমিটচ্যভাষী থোয়াই লক ম্রো। বইয়ের প্রচ্ছদে তার ছবি দেখে আল্পুত হয়ে পড়েন তিনি। বর্তমানে রেংমিটচ্যভাষী জীবিত ছয়জনের ছবি দিয়ে বইটি প্রচ্ছদ করা হয়েছে। কোনো একদিন বিলুপ্তপ্রায় এই রেংমিটচ্য ভাষার শব্দভান্ডার বই প্রকাশিত হবে কল্পনাও করেননি তিনি। ইয়াংঙান ম্রো তাকে ২০টি বই দিয়েছে। তার পাড়ায় গিয়ে সবাইকে দেখিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া তার এক নাতির জন্য বেশি খুশি হয়েছিলেন। যাতে তার নাতি এখন বাংলার মাধ্যমে রেংমিটচ্য ভাষা শিখতে পারবে।
বৃহস্পতিবার রাতে ইয়াংঙান ম্রোর মাধ্যমে কথা হয় দুই রেংমিটচ্যভাষী থোয়াই লক ম্রো ও মাংপুং ম্রোর সাথে। রেংমিটচ্যভাষী থোয়াই লক ম্রো একসময় সদর উপজেলার দুর্গম ক্রাংসিংপাড়ায় ছিলেন। এগারো বছর আগে সেখান থেকে জুমচাষের (স্থানান্তর চাষাবাদ) জন্য নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মেনসিংপাড়ায় চলে যান তিনি। ঘরে তার চার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী কেউ রেংমিটচ্য ভাষা বলতে পারে না। স্ত্রী আগে কিছুটা বলতে পারলেও তিনিও এখন মোটেও এ ভাষায় কথা বলতে পারেন না। কতগুলো সহজ কথা বুঝতে পারেন মাত্র। ছোট থাকতে তার বাবা-মা, তিন ভাই ও এক বোন এবং দুই মামি নিয়ে এক পরিবারে বাস করেতন থোয়াই লক ম্রো। তখনো সবাই রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তার বাবা মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত শুধু রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতেন। ম্রো ভাষা মোটেও বুঝতেন না। পরে তাদের ভাই-বোনদের মধ্যেও কথা না বলতে বলতে একসময় রেংমিটচ্য ভাষাটাই ভুলে গেছেন সবাই। পরিবারে থোয়াই লক ম্রো ছাড়া কেউ আর রেংমিটচ্য ভাষা বলতে পারেন না।
বর্তমানে যে ছয়জন জীবিত রেংমিটচ্যভাষী রয়েছে, তারা নিজেরা একসঙ্গে কতবছর আগে দেখা হয়েছে জানতে চাইলে থোয়াই লক ম্রো বলছিলেন, একসঙ্গে দেখা হয়েছে বিশ বছরের মতো হয়েছে। হয়তো আরও বেশি হতে পারে। কয়েকজন একসঙ্গে দেখা হয়েছে, তা-ও খুব অল্প সময়ের জন্য। তবে দেখা হলে নিজেদের মধ্যে রেংমিটচ্য ভাষাতেই কথা বলতেন তারা। তিনি ছোট থাকতে তৈনখালের আশপাশে ১০-১২টির মতো রেংমিটচ্যভাষী পাড়া ছিল। সব পরিবারই নিজের রেংমিটচ্য ভাষা ভুলে গেছে। কেউ কেউ অন্য কোথাও গিয়ে একেবারে ম্রো ভাষার মধ্যে মিশে গেছে।
তবে এখনো একটা পাড়ায় তিনজন রেংমিটচ্যভাষী রয়েছে; আলীকদমের তৈন মৌজায় তৈনখালের ক্রাংসিং ম্রোপাড়ায়। আলীকদম উপজেলার সদর ইউনিয়ন থেকে তৈনখালের উজান দিকে আধ ঘণ্টার মতো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতে হয়। তারপর সেখান থেকে আড়াই ঘণ্টার মতো পায়ে হেঁটে গেলে সেই ক্রাংসি ম্রোপাড়া। এপাড়ায় রেংমিটচ্যভাষীরা হলেন মাংপুং ম্রো এবং কুনরাও ম্রো নামে দুজন নারী। তাদের মধ্যে সবসময় রেংমিটচ্য ভাষায় কথাবার্তা হয় বলে জানালেন মাংপুং ম্রো। নিজেদের মধ্যে দেখা হলে বেশিরভাগ সময় অতীতের স্মৃতির কথা জমে ওঠে। বিশেষ করে আগের দিনে নিজেদের মা-বাবার সাথে জুমচাষের স্মৃতি। বনজঙ্গলে বাঁশ-কাঠ সংগ্রহের গল্প। অতীত স্মৃতিচারণা করে আফসোস করে সময় কাটিয়ে দেয় তারা। জীবিত ছয়জনের যে চারজন পুরুষ রয়েছে, তার মধ্যে মাংপুং ম্রোরা তিন ভাই। তবে তিনজনই তিন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছেন। গত বছর তিনজনের একসঙ্গে দেখা হয়েছিল। কথাবার্তা হয়েছি সে রেংমিটচ্য ভাষাতেই।
রেংমিটচ্যভাষী যে ছয়জন রয়েছে, তার মধ্যে চারজনের বয়সও ষাটোর্ধ। তা-ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করেন কয়েকজন। ভাষাটিকে কীভাবে রক্ষা করা যায়- এমন প্রশ্নের জবাবে থোয়াইলক ও মাংপুং ম্রো বলেন, ক্রাংসিপাড়ায় একজন শিক্ষক রেখে রেংমিটচ্য ভাষা শেখানো হতে পারে। ম্রো ছেলেমেয়েদের শব্দভান্ডার শেখানোর মাধ্যমে ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখার পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তা নাহলে আমরা শুধু আফসোস করেই মারা যাব।
এদিকে ২০০৯ সালে খুঁজে পাওয়া রেংমিটচ্যভাষাগুলো রেকর্ডিং করে রেখেছিলেন ডেভিড পিটারসন। গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজে 'রেংমিটচ্য' ভাষাকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের জন্য সম্প্রতি চট্টগ্রাম শহরে আসেন তিনি। তার রেকর্ডিং করা কথাগুলো অনুবাদ করার জন্য চট্টগ্রাম শহরে চলে যান রেংমিটচ্যভাষী মাংপুং ম্রো ও থোয়াই লক ম্রো। চার দিন ধরে চলে ১৪ বছর আগে রেকর্ডিং করে রাখা রেংমিটচ্য ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের কাজ। থোয়াই লক ম্রো বলছিলেন, সেই ১৪ বছর আগে রেকর্ডিং করা রেংমিটচ্য ভাষার কথাগুলো একটাও ভুলিনি। সবটাই স্পষ্ট মনে আছে।
ডেভিড পিটারসনের 'রেংমিটচ্য ভাষা' নিয়ে গবেষণার সহযোগী ও মো ভাষার লেখক ইয়াঙান জানান, প্রথমে রেংমিটচ্য কথাগুলো পুরোনো রেকর্ডিংটা তাদের শোনানো হয়। তারপর একেকটি শব্দ ও বাক্য ম্রো ভাষায় আমাকে বলা হয়। পরে আবার ইংরেজি ভাষায় ডেভিডকে জানানোর পর উনি নোট করে রাখেন। এগুলো খুব কঠিন ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এভাবে ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।