পনেরো মিনিটের শহর: বাস্তব নাকি পরাবাস্তব
'১৫ মিনিটের শহর' নগর ব্যবস্থাপনার নতুন ধারণা বিশেষ। এমন একটা শহরের কল্পনা, যেখানে যেকোনো এলাকাতেই বসবাস করি না কেন, ১৫ মিনিটের মধ্যে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা একদম হাতের নাগালে। একটা গণ্ডির ভেতরে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে অফিস, স্কুল, হাসপাতাল, বাজারসদাই, বিনোদন এবং নিয়মিত জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সব গন্তব্যে এই সময়সীমার মধ্যে পৌঁছে যাবার আকাঙ্ক্ষা। কোভিড ১৯-এর বন্দিদশায় যখন সবাই বিকল্প ব্যবস্থাপনা খুঁজছে, সেই সময়টায় এলাকাভিত্তিক সমাধানের উপায় হিসেবে ১৫ মিনিটের শহর ধারণার আবির্ভাব। একটা বিশেষ পরিস্থিতির ধারণা বা প্রস্তাবনা হলেও পরবর্তীতে এর উপযোগিতা বিশ্লেষণ করে আলোচনা চলমান রয়েছে।
নতুন শহরের পরিকল্পনা কিংবা পুরোনো শহরকে নতুন করে গোছাতে চাইলে এমন বিবেচনা মাথায় রেখে ওই এলাকার যেকোনো বয়স, অবস্থান এবং পরিস্থিতির মানুষদের জীবনযাপন ব্যবস্থাপনার সমাধান খুঁজতে এই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুযোগ-সুবিধার বিকেন্দ্রীকরণ, অর্থনীতির আঞ্চলিক মেরুদণ্ড শক্ত করা, কমিউনিটির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য ইত্যাদিকে প্রাধান্য দিয়ে যৌথ অধিকারের বোঝাপড়া দিয়ে সামাজিক ভারসাম্য গড়ে তুলতে পারলে সেটা হবে ভবিষ্যতের জন্য বিশাল অর্জন। প্রশ্ন হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতির সাথে কীভাবে মোকাবেলা করবে এই আকাঙ্ক্ষা।
১৫ মিনিটের শহরের যে কল্পনা, তাতে ছয়টি মৌলিক চাহিদাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, বসবাস, কাজের জায়গা, কেনাকাটা, স্বাস্থসেবা, শিক্ষা এবং বিনোদন। যানবাহননির্ভরতা বাদ দিয়ে শুধু হাঁটা এবং সাইকেল ব্যবহারের সুযোগের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সামগ্রিক যে জীবনযাপনের সংস্কৃতি বা অভ্যাস তার সাথে এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলেই অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে হয়তোবা। স্থাপত্য এবং নগর পরিকল্পনা অনেক যৌক্তিক হলেও ব্যবহারকারীদের মানসিকতা, আচরণ, সামাজিক কাঠামো, অবস্থান এসব ঠিকমতো যাচাই না করলে এমন আশাবাদ হোঁচট খেতে বাধ্য।
তাই ধারণাটিকে মোড়ক বা মলাট হিসেবে দেখলে মনে হবে আত্মঘাতী মানুষদের মাঝেমধ্যে সান্ত¦না হিসেবে যেমন একেকটা নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হয়, তেমনই একটা কিছু। ১৫ মিনিটের শহর শুনলেই মনে হয় 'এক সপ্তাহে ইংরেজি শেখার কোর্স' '২৪ ঘণ্টায় ওজন হ্রাসের অফার'-এর মতো কিছু। সেভাবে দেখলে বিষয়টা চমকপ্রদ এবং মুখরোচক। যেমন প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আবার সেটাকে নতুন মোড়কে রক্ষা করতে সাসটেইনেবিলিটির যে চর্চা তা আসলে ঠিক কতটা আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পেরেছে বা পারবে, তারও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষা করার জন্য যতটা শ্রম তার চেয়ে অনেক বেশি শ্রম ও মূল্য দিয়ে সাসটেইনেবিলিটির সনদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ঘুরেফিরে বাণিজ্যচর্চাকেই প্রভাবিত করছে। সাধারণ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা করে প্রয়োজনমাফিক জীবনযাপনের যে দর্শন, সেটা হারিয়ে গেলে তখন সম্ভাবনা নিয়ে এটা-ওটা কথা বলা যায় ঠিক, শেষ পর্যন্ত ফলাফল হয় শূন্য।
যদিও এই ধারণাটিকে অনেকেই পরিকল্পিত লকডাউন বা ১৫ মিনিটের জেলখানা আখ্যা দিয়ে স্বাধীন জীবনযাপনের চলমান প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণের আরেক অভিসন্ধি মনে করছেন। তবু আমরা বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েই আমাদের বাস্তবতা এবং সম্ভাবনা নিয়ে কিছুটা ব্যাখা-বিশ্লেষণ করতে পারি। ষাট, সত্তর এবং আশির দশকেও পাড়া-প্রতিবেশীর যে আচার, আচরণ, সামাজিক চর্চা এবং বোঝাপড়া ছিল তা কিন্তু নানা অজুহাতে পাল্টে গেছে। এটা নিয়ে প্রশ্ন করলে নিজেদেরই করতে হয়; কারণ, এই বোঝাপড়ার অনেক কিছুই আসলে সামাজিক আদর্শের ওপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক অবস্থান, সমাজ-সংস্কৃতি- রাজনৈতিক বিশ্বাস, যার ওপর নির্ভর করেই চাহিদার ক্ষুধা নির্ধারিত হয় তার মূলে না গেলে এটা শুধু তাত্ত্বিক আলোচনা হিসেবেই বিবেচিত হবে। যেহেতু কোভিডকালীন বন্দিদশায় এই ধারণার উন্মোচন, তার মানে কিছুটা বাধ্য হয়েই সব ভুলে জীবন বাঁচানোর তাগিদেই একটা সীমরেখায় অনুগত হবার পরিকল্পনা। ১৫ মিনিটের মধ্যে হাতের নাগালে সবকিছু পেয়ে যাওয়া মানে তো স্বর্গবাস। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন কি অনুশাসন নাকি অনুপ্রেরণায়? তুলনামূলকভাবে যেসব শহরে জনসংখ্যা কম, সুপরিকল্পিত নগরবিন্যাস, গণপরিবহন, জনসাধারণের নিয়মকানুন মেনে চলার সংস্কৃতি এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভবিষ্যতের সুন্দর সমাজ গড়ার অঙ্গীকার, অনুপ্রেরণা আছে তাদের কাছে এর উপযোগিতা যেমন, বিপুল জনসংখ্যা-জনঘনত্ব নিয়ে অপরিকল্পিত শহরে তা মহাসংগ্রামের বিষয়। পাশ্চাত্যের অনেক শহরে সামাজিক ঐতিহ্য বজায় রেখে এলাকাভিত্তিক অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের নিয়মতান্ত্রিক আশাবাদ চর্চায়। আমাদের শহরে এমন আকাঙ্ক্ষার সম্ভাবনা খুঁজলে প্রয়োজন ব্যবস্থাপনার প্রতি প্রথম স্তরের শ্রদ্ধা। কারণ, এমন একটি সমাধান বাধ্যতামূলক হলে তা হবে মানবাধিকারের বিষয়। যেকেনো জটিল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার প্রাথমিক উপায় হলো যোগ্য অভিজ্ঞ মানুষদের বাস্তবমুখী সুষ্ঠু পরিকল্পনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। পরিকল্পনা গোলমেলে হলে বা বিবেচনাগুলো ঠিকমতো শনাক্ত না হলে সেটা ব্যবহারকারীদের কাছে কখনোই আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে না। আমাদের সমস্যা সেখানেই। কারণ, কোভিডকালীন বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক সময়ের সাথে মিলিয়ে পরিকল্পনা করলে সেটা কখনোই ফলপ্রসূ হতে পারবে না। কোভিড-পরবর্তী ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের যে বিবৃতি, যার অর্থ দাঁড়ায়—কোনো কিছুতে আপনার মালিকানা থাকবে না, কিন্তু আপনি প্রচণ্ড সুখে থাকবেন। এর প্রভাব কিংবা প্রযুক্তি নিয়ে যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট মুনাফা অনুরাগীদের কোনো ভবিষ্যৎমুখী ফাঁদ কি না, তার সাথে যোগসূত্র খোঁজার খানিকটা কৌতূহল আছে এর ভেতরে। কিন্তু একদম সাদামাটা যুক্তিতে ইতিবাচকভাবে দেখে এই প্রস্তাবনাকে যেকোনো পরিস্থিতির এলাকার ব্যবস্থাপনায় ফেললে একটা কিছু ফল পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। সে হিসেবে বলা যায় এলাকাভিত্তিক সংকট মোকাবেলার আলোচনায় '১৫ মিনিটের শহর' একধরনের সাধারণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। পক্ষে-বিপক্ষে নানান কথাবার্তা না হলে সমাজের যে মৌলিক বোঝাপড়া, সেটা গড়ে উঠবে কীভাবে?
নির্দিষ্ট এলাকায় নিয়মিত অভ্যাসে বেড়ে ওঠা এলাকাগুলোতে আকার-আয়তন বুঝে ১৫ মিনিটের সমাধান দেয়া হলেও ছক অনুযায়ী অন্যান্য প্রয়োজনের সমন্বয় কীভাবে ঘটবে, তার উত্তর খোঁজা যেমন জরুরি, তেমনি এই ক্রমবিবর্তনের সময়ে একক পরিবারের বাড়িগুলো প্রপার্টি ডেভেলপমেন্টের নামে বহু পরিবারের বাড়িতে পরিণত হবার ফলে সেই এলাকায় বেড়ে ওঠা সংস্কৃতি, সামাজিক চর্চার নানা ধরনের ব্যত্যয় ঘটছে, তা মেরামতের উদ্যোগ আসলে কে বা কারা নেবে সেটাও ভাববার বিষয়। প্রয়োজনমাফিক এলাকাভিত্তিক জীবনযাপনচর্চা গড়তে হলে বিভিন্ন বয়সের মানুষের আন্তরিকতা, আর্থিক অবস্থানের ঐক্য, ধর্মীয় এবং অন্যান্য সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের বিবেচনাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সেটা কি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সম্ভব? প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে কোভিড-১৯ ইত্যাদির কারণে সার্বিক মানসিকতায় যে প্রভাব পড়েছে, তাকে আলো দেখাতে হলে এই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন স্তরের অংশগ্রহণমূলক আলোচনার মাধ্যমে যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। একক পরিবারের জন্য নির্ধারিত জমিতে বহু পরিবারের বাড়ি নির্মিত হচ্ছে, তার বহিরাবরণ, চাকচিক্য দেখে সবাই চমকাচ্ছে ঠিক কিন্তু ভেতরের নিয়মিত জীবনযাপনচর্চার সংস্কৃতিটা কী? এরা যখন ওই প্রস্তাবিত ১৫ মিনিটের শহরের অংশ হয়ে উঠবে তখন তাদের ভূমিকা কী দাঁড়াবে?
ঢাকা বা দেশের অন্যান্য শহর নিয়ে ১৫ মিনিটের ধারণাকেন্দ্রিক কথা বলতে চাইলে বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন। শুধু আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং একজন স্থপতি হিসেবে অবলোকন বলতে চাইলেও অনেকগুলো স্তরের বিশ্লেষণ করতে হবে। মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে স্বাচ্ছন্দ্যের ছোটবেলা কাটিয়ে ক্রমশ বিশৃঙ্খলা এবং অব্যবস্থাপনা দেখতে দেখতে বড় হওয়া, যার মূল কারণ আসলে মনে হয়েছে দূরদৃষ্টির অভাব, যে কারণে ঠিকমতো মহপরিকল্পনা রচিত হয়নি। বিচ্ছিন্ন যা কিছু উন্নয়ন হয়েছে বা হচ্ছে তাতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দেওয়ায় এলাকাভিত্তিক বা সার্বিক একাত্মতা গড়ে উঠতে পারেনি। যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা না থাকলে কোনো ধরনের নাগরিক শক্তি গড়ে ওঠে না এবং এই ধরনের উদ্যোগের মর্মও তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এ ধরনের সমাধান পেতে হলে সবচেয়ে জরুরি আকাঙ্ক্ষার ঐক্য। দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং চিন্তাভাবনায় অস্থিরতা সমাজকাঠামোকে এতটাই এলোমেলো করেছে যে অযথা তর্কাতর্কি, যুক্তি পাল্টা যুক্তি দিয়ে ভীষণ প্রয়োজনীয় সমাধানগুলো পড়ে থাকছে অসহায়ভাবে। এর কারণ অনুসন্ধান না করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ কোনো কাজে আসে না। সাধারণ জ্ঞানের গুরুত্ব ভুলে অসাধারণ জ্ঞানের বাহারি চর্চা এলিট চিন্তাবিদের অবস্থানকে জৌলুশ দিতে পারলেও সেটার সারমর্ম দাঁড়াচ্ছে—'সৃষ্টি ধ্বংসের জন্যই।'
সভ্যতার বিভিন্ন ধাপে সচেতনতা বিষয়টা সার্বিক ব্যবস্থাপনাকে কখনো কখনো প্রভাবিত করতে পারলেও সেটা সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই। ধনী-গরিবের বিশাল ফারাক আর পুঁজিবাদের দাপটে বিপুল জনসংখ্যার শহরগুলো নানা পরিস্থিতিতে ডিগবাজি খায়। সেই সময়ে এমন মুখরোচক সমাধান শুনে সাধারণ জনগণ আশাবাদী হয়ে এক লাফ দিয়ে উঠলেও এর অর্জনের জন্য তাদের অংশগ্রহণ-ভূমিকা ইত্যাদি ব্যাখ্যা করে বোঝাবার মতো সামাজিক নেতৃত্বের অভাবও আছে।
এমন ধারণার শুরুতেই চলে আসে সমাজে মায়া-মমতার প্রভাব, কারণ জীবনযাপনের স্বাচ্ছন্দ্যকে সামাজিক চর্চায় অনুপ্রাণিত করতে হলে সবার আগে দরকার মানসিকতার বিশ্লেষণ। কারণ, পুরো বিষয়টি অংশগ্রহণমূলক। সমস্যা আছে এবং থাকবেই। মূল বিষয় বোঝাপড়া এবং একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের সম্প্রীতি এবং ঐক্য। মধ্যবিত্তের মানসিকতা ধারণা ছাপোষা চর্চা হলেও সেটাই আসলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ববোধ, মমত্ব বা শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠবে কী উপায়ে? ছিল তো সব একসময়ে—এটা বলে হাত গুটিয়ে রাখলে তো সমাধান এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে না।
যেকোনো ধারণাই আসলে শুরুতে অনেক প্রশ্নবিদ্ধ হয়। চলে আলোচনা-বিশ্লেষণ। আমাদের মতো দেশে এমন ধারণার প্রয়োগকে অমূলক না ভেবে এলাকাভিত্তিক সমাধানের উপায় খুঁজতে স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, সমাজবিদগণ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ চাইলে আগ্রহী দল গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে। সেটা রাষ্ট্রীয় বা যেকোনো প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতায় হতে পারে। কিন্তু কোথায় থেকে শুরু হতে পারে এই আকাঙ্ক্ষার যাত্রা। বিড়ালের ঘণ্টাটা আসলে বাঁধবে কে আগে?