ঈদ স্পেশাল: ভাড়া চক্ষুর দোকান
১
মেইন মার্কেটের বাইরে গেলে চেহারাটা পাল্টাতে থাকে। সুন্দর সুন্দর সাজানো দোকানে খদ্দের আসে কিন্তু বাইরে যাবার পিছনের দরজাটা দিয়ে বের হলে অনেক আলাদা দুনিয়া, গরিব মানুষের পসরা দেখা যায়। আধা দামে সব পাওয়া যায়। কী ধরনের পণ্য, এক নম্বর না দুই নম্বর, পচা-ধচা তফাৎ কিছুই থাকে না। দামটাই আসল। কাবাব রোলের ভ্যানগাড়িটার পিছনে ছোট দোকানের সাইনবোর্ডটায় লেখা, 'চক্ষু ভাড়ার দোকান। সস্তায় সব কিসিমের চোখ পাওয়া যায়।'
২
মানুষের কত রকম নেশা, কত রকম খাওয়া, নেয়া। নেশা করলে অন্য দুনিয়ায় যাওয়া যায়। কিন্তু সবাই ট্যাবলেট আর পাউডারের নেশা করে না, ভাবনার, চিন্তার, কল্পনার নেশা করতে চায়। আবার অনেকে নেশা করতে চায় কিন্তু টাকার অভাব, টাইমের অভাবে পারে না। শুধু নেশা করলে তো হয় না। শুইতে হয়, মজা লইতে হয় নেশার আরামের।
এরকম কিছু লোক মাঝে মাঝে চোখ ভাড়া নেয়। চোখের মধ্যে চোখ লাগালে যার চোখ তার সব স্মৃতি কথা, কল্পনা মাথায় এসে যায়। বেশিরভাগ মানুষ সুখী চোখ চায়। একটু আনন্দ চায়। ছোট ছোট বোতলে লেবেল করা। কোনটা কার, কী ধরনের চোখ, সুখ আনন্দের, কষ্টের চোখ পাওয়া যায়; দুইটারই খদ্দের আছে। কিছু মানুষ কষ্টে আনন্দ পায়। দামি মদখোরের চোখ পাওয়া যায়। তবে ঐগুলার দাম একটু বেশি। কিন্তু তাও মদ, সবার চেয়ে সস্তা।
নেশাখোরের চোখ পাওয়া সহজ। ঐগুলা মরার পর ফ্যামিলি চোখ বিক্রি করে দেয় যাতে মরার পর আন্ধা দেখে ফেরেশতারা কবরে আজাব কম দেবে। নেশাখোর অনেক কিন্তু অনেক চোখের কোনো স্মৃতি নাই, কিসুই পাওয়া যায় না। তাতেও ভাড়া হয়, ইনকাম খারাপ না। নেশা না করে ওদের চোখ লাগিয়ে নেশার হালকা স্বাদ পাওয়া যায়। আর কেউ কেউ শূন্যতার নেশা করে।
৩
মাঝে মাঝে অনেকের অন্যকেউ হতে ইচ্ছা করে। তখন মানুষ যে যার পছন্দের মানুষের চোখ ভাড়া নেয়, অন্যের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখে। সাধারণ মানুষ অসাধারণ হয়ে যায় নিজের চোখের ওপর অন্য চোখের লেবাস পরিয়ে। রাস্তার লস্কর যেমন মহারাজ হয় পোশাক পাল্টিয়ে। যারা চোখ ভাড়া নেয় তারা তেমনি মানুষ। তাদের জীবনের সাদা ভাতে কল্পনার ঝোল-টক দরকার।
৪
আত্মহত্যা করা মানুষের চোখ সে বেশি রাখে না। মর্গের ক্লিনাররা এই সব চোখ বিক্রি করে। পোস্টমর্টেমের পর এইগুলা পাওয়া যায়। একটা সিরাম চোখ সে পইড়া দেখসিলো ঘণ্টাখানেকের জন্য। তারপর দুই দিন ঘুমাইতে পারে নাই, ভয়ে, কষ্টে।
সে প্রথমে বলে দিসিল বেশি বিজনেস হইব না ভাবসে। খালি মরার কষ্ট যাতে তাতে বেশি রেট পাওয়া যায় না। তবে তা-ও লোকে আইসা খোঁজ নেয়। কয় এটাও মজা লাগে। যারা গল্প-কবিতা লেখে তারা এইগুলা বেশি পছন্দ করে। কয় লিখতে সুবিধা হয়।
কেউ কেউ এগুলা পইরা বাড়ির ছাদ থন লাফ দিসিল। পুলিশের ত্যাগ চোখে তার দোকান থন ভাড়া নেয়া চোখ পাইসিল একবার। অনেক ঝামেলা করসে পুলিশ। পরে সে 'লাগাইন্না' মানুষের চোখ হেগো ফ্রিতে দিয়া বাঁচছে। চোখ লাগাইলে যখন খুশি লাগাইতে পারে যারা তার মজা পায়।
৫
লাশগুলারে উপরে নিতে সাইকেলের ভ্যানগাড়ির মতো গাড়ি আসে। উপরে থেইকা নাইমা তারা লাশ টোকাইনি হয়। মাঝে মাঝে হেরাও চক্ষু দিয়া যায়, দান করে আর কি। এত লাশ এত চক্ষু নিয়ে করব কী তারা? মানুষ খালি মরে আর মরে। যাওনের আগে তারা দোকানে মিষ্টি চা খায়, সাথে বইয়া দুইটা কথা কয়, তারপরে আকাশে উড়াল দেয় লাশ লইয়া।
৬
দুই কিসিমের পাবলিকে নাম আকাশ থন। যারা লাশ টানে এরাই বেশি নামে। আকাশের কামলা কওয়া যায়। হেগুলা সাধারণ খাটইন্না, মাল টানা, লাশ টানা পাবলিক। বৃষ্টি হইলে দোকানের টিনের নিচে খাঁড়ায় থাকে।
কিন্তু অন্য কিসিমের এক পদ আছে, এরা যান কবচ করতে নামে, জল্লাদের লাহান। হেরা আঙ্গুল দিয়া জবাই দেয়, অর্ডার লইয়া নামে, নাম-তারিখ মিলে, তারপর শেষ কইরা দেয় আসমানি কায়দায়। হেগো চোখগুলা পাথরের লাহান। দোকানির বড় সাধ হয়, ত্যাগ চক্ষু দেইখা। একখান পাইলে হেভি দামেই ভাড়া দিতে পারত। কিন্তু আসমানি চক্ষু আলা লগ গো কেমনে জিগায় এই কথা?
একদিন একটা জল্লাদ সারা দিন বইয়া আসিল তার দোকানে, কথা কয় নাই। তারপর সন্ধ্যায় আসমানি কামলারে ঠিকানা দিসে, কৈসে লাশ কই পাওয়া যাইব। তারপর চইলা যায় আকাশে সাইকেল মাইরা। জবাই দিল কহন? এ জন্যেই বইয়া আসিল?
৭
দোকানিরে হঠাৎ একবার এক জল্লাদ এক জোড়া চোখ দেয়। মানুষ খুন করসিল, তাই উঠায় নিতে কৈসে। 'দেহ, খদ্দের পাও কিনা। তোমার এহানে তো বসি। তাই দিলাম।' বেশি কথা হয়নি। সে বোতলে ভিজিয়ে রাখে। তবে খবর ছড়ায় যে তার কাছে অদ্ভুত কিসিমের চোখ আছে। নেশাখোরের চোখের চেয়ে বেশি চাহিদা। মানুষে খুনে অনেক আনন্দ পায়। মানুষ বারবার নেয়, বারবার খুন করে চোখ লাগিয়ে। ওর ইচ্ছা হয় যদি এ রকম আরো ১০টা পাওয়া যেত, ভালো কামাই হতো।
একদিন অন্য এক জল্লাদকে বলে কথাটা। সে মাথা নাড়ে। পেলে দেবে। সবাই তো খুন করে না। দোকানদার আশায় আশায় থাকে কবে আরো কিছু খুনির চোখ পাবে।
৮
রাতে অনেক বৃষ্টি নামসিল তাই উপরের লোক দোকানে রাত কাটায়। কৈসে ঝোল দিয়া রুটি খাইব, সাথে সামান্য কয় পিস বটি। দোকানদার আইনা দিসিল ওরে। সে খাইসে, খুশি হইসে। দুধ চা আর সিগারেট খাইতে খাইতে কৈসিল, 'বুঝি, কেন উপরে যাইতে চায় না কেউ কেউ। উপরে এত ভালো ঝোল রান্না কে করব তাদের জন্য।'
সারা রাত বৃষ্টি হৈসিল। পানিতে নাইয়া গেসে সব। দোকান খুললেও কাস্টমার পাইব কই? জবাইওয়ালা তাকায় থাকে বৃষ্টির দিকে। কয়, উপরে থন পড়ে তো, তাই এত ভালো নজরে আসে না। খারাপ না, এই বৃষ্টি? কোন মাসে কোন মাসে হয় এইদিকে? আমাদের তো বদলির চাকরি। মাঝে মাঝে ঠাউর করতে পারি না। তারপর বাইরে চইলা যায়। রাতে ফিরে, কয় অনেক কম সিল। একসাথে কয়েকটা লাশ উপরে পাঠাইতে হইব। তোমাগো কত মজা, শুরু আসে শেষ আসে। মাইয়া মানুষের চোখ নিবা, কয়েকটা আনসি।
৯
মাইয়া মানুষের চোখ ভালো চলে, বিশেষ কইরা যদি সে মহিলাদের অনেক সোহাগের অভ্যাস থাকে। যারা অনেক পুরুষের সাথে শোয় তাগো চোখের দাম বেশি। মাইয়া-পুরুষ, সবাই ধার নেয়, মজা পায়। কিন্তু বাজেরা মাইয়া লোকদের চোখের দাম কম। লোকে কয় হেরা নাকি মুখে হাসে, চোখে হাসে কিন্তু মাথার ভিতরে কাঁদে। তাই ওতে কোনো সুখ নাই, আনন্দ নাই।
পরকীয়া মাইয়া লোকের চোখ চলে সব চাইতে বেশি। সেগুলা খুন হইলে বেশি পাওয়া যায়। হয় স্বামী না হয় পরকীয়া প্রেমিক খুনের পর চোখ উপড়াইয়া ফালায় যখন। সেটা সে কিনা রাখে হাসপাতাল থন। ভালো দাম পাওয়া যায় ভারতে।
১০
একবার অ্যাকসিডেন্ট হয় বড় রকম তার দোকানের সামনে। চার-পাঁচটা লোক গাড়ির ভিতর ছিল যারা একেবারে থেঁতলাইয়া যায়। অনেক রাতের ঘটনা, দোকানদার মুততে উঠসিল তখন দেখে গাড়ি উল্টায়া রাস্তায় রাখা ডিভাইডারে ধাক্কা মারে। কেউ বাঁচে নাই, শরীরগুলা ভর্তা হইয়া যায়। সে কাছে দিয়ে দেখে কয়েকটা চোখ মাথা থন ছিটকাইয়া রাস্তায় লাফাইতাসে। এরা কে সিল সে জানে না তাই সাদা বোতলে রাখত, ভাড়া দিসে সস্তায়।
যখন হটাৎ কইরে অনেকে চায় চক্ষুগুলা ভাড়ার জন্য তখন বুঝে ঐগুলার অনেক মজা, পইড়া দেখসে, পার্টি, ম্যাসাজ গান গান, মাইয়া-পুরুষের ঢোলাঢুলী, আইটেম চোখ। ভালো তেজারত হয়। সে তার পাশের দোকনেও মাল রাখা শুরু করে।
১১
আসমানি কামলারা মাঝেমধ্যে তারে জিগাইত মাল আসে কি না। যেগুলার কোনো দাম নাই, যে মুর্দাগুলারে মানুষ তো দূরে থাক কুত্তারাও চায় না, বুড়া, চিমসা, ফেলাইন্না লাশের লাহান সেগুলারে তারা নিত। পাইকারি হারে উপরে তাগো দাম আসে। কামলা সারা হেগো কেউ নিত না। দোকানদার খবর রাখত, কারণ হেদের চোখ বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। এমনি মানুষ উপড়াইয়া ফলে দেয়। বুড়ারা এত দেখসে, বুইজা, না বুইজা তাই ফালা। তবে যারা মাথা কখনো কখনো খালি করতে চায়, সাত-আট ঘণ্টার জন্য, পুরান দিনের সিনেমা দেখতে মন চায়, তারা নেয়। সিন চলতাসে কিন্তু বুঝার পারে না। খিল খিল কইরা হাসে। অরে, এমন আসিল নাকি, দুনিয়া, এমন হইল নাকি, বেটা বুড়া, এত পাপ করসে..
১২
হে মায়া হয়তো এই কামলাগো লাইগা। ইসসা হইতো দুই-একটা ভালো কিসিমের লাশ দেয় যাতে উপরে তাদের ইজ্জাত বাড়ে কিন্তু এতটা আগায় নাই। তবে সাথে গেসে, ঠিকমতো মাল নামাইতাসে কি না, আসমানি মাল গাড়ির কী নাম, কী উঠে কখন যায়। সে এই সব খবর রাখে। মুর্দার চোখগুলা পকেটে রুমালে পেঁচাইয়া সে দোকানে ফিরে। সে তো কারবারি। তয় কিসে প্রফিট কে কইব।
পাগলের চোখ কিনা লাভ নেই সে ভাবসিল কিন্তু এত দাম পাইসে সে, যে এখন সে ভগবানের কাজে দোয়া করা, কৃপা ভিক্ষা করে, আমারে পাগলা দে, আমারে সপ্তাহে একটা কইরা। মানুষ এত পাগল হওনের খায়েশ। কামলাগো সে কথাটা কৈসিল। হেদের আগ্রহ কম। এগুলার না আসে লাভ, না আসে লোকসান, কেউ নিতে চায় না উপরে। হেদের পাপ নাই পুননি নাই কিছুই আসে যায় না, কোনো হিসাবের মধ্যে নাই।
১৩
এত এত স্মৃতি, এত মানুষ অন্যের স্মৃতি খেতে চায়, তার দোকান জাগা দিতে পারে না খদ্দেরদের। আরো চোখ চাই তার। তাই একদিন সে কথাটা পাড়ে কামলাদের কাছে। 'আপনারা কৈলে, আমি বানাইয়া রাখুম আপনারা আইসা শুধু নিয়ে যাইবেন। দিনে দিনে মাল পাইবেন। কেমনে কী করতে হয় দেখিয়ে দিয়েন। আপনারা আরাম করেন, আমি গতর খাঁটি, আপনারা দোকান সামলান, আমি আপনাদের আরাম দেই'। তার ধান্দা ঠিক হইয়া যায়। কিন্তু আরো একটু লোভ বাড়ে। তাই একদিন সাহস কইরা বড়গুলারে কয় তারে সাথে নিতে। তারা চুপ বইয়া থাকে, ভাবে। বলে পরে খবর দিব।
১৪
কী হৈসিলো কেউ কইতে পারে না। তয় কিনা আরো দামি দামি চোখ পাওন যাইতে লাগল তার দোকানেই কি অসম্ভব দাম। গুলশান, বনানী থন মানুষ আইসা চোখ ভাড়া নিত। কি অদ্ভুত চোখের স্মৃতি। আকাশে উড়াল দিয়ে মাটিতে নামতাসে সাইকেল মাইরা। উপরে ঘুরে, নাচে, হওয়ার মধ্যে খেলে, বৃষ্টির মধ্যে দৌড় দায়।
তবে আর এক কিসিমের চৌখ আসে, সে ভাড়া দেয় না সহজে। মাঝে মাঝে কাম কাজ সব শেষ হইলে সে নিজেই পইরা স্বাদ নেয়, কেমন লাগে এই শেষ টাইমে যখন আসমানি আঙ্গুল উপরে থন নাইমা আসে গলায়। তহন কেমন লাগে... মারতে... মরতে।