মুর্তজা বশীরকে লেখা সাঈদ আহমদের অপ্রকাশিত চিঠি
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় আধুনিকতার দীক্ষা যাদের মাঝে সঞ্চার হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর (১৯৩২-২০২০) ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাট্যকার সাঈদ আহমদ (১৯৩১-২০১০)। শিল্পের নানা শাখায় দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের বিভিন্ন প্রবণতা তাঁদের উজ্জীবিত করেছে নানা সময়ে। দুজনেরই জন্ম ব্রিটিশ ভারতের ঢাকায়—একজনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, আরেকজনের জন্ম পুরান ঢাকার ইসলামপুরে। বাবা বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কারণে ইউরোপীয় শিল্প বিষয়ে প্রথম পাঠ সম্পন্ন হয় মুর্তজা বশীরের এবং অগ্রজ ভাইদের সংস্পর্শে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা; অপর দিকে ঢাকার এক সংস্কৃতিমনস্ক পরিবার সাঈদ আহমদের কাজের সৃজনশীলতাকে তুমুলভাবে প্রভাবিত করেছে। সাঈদ আহমদের অগ্রজেরা হলেন চলচ্চিত্র পরিচালক ও পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার (বর্তমান 'এফডিসি') প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নাজির আহমদ (১৯২৫-১৯৯০) এবং প্রখ্যাত শিল্পী হামিদুর রাহমান (১৯২৮-১৯৮৮)।
মুর্তজা বশীরের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৫৮ সালে লন্ডন থেকে বশীর ঢাকায় ফিরে আসার পর সাঈদ আহমদের সাথে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন শামসুর রাহমান অর্থাৎ সাঈদের বাচ্চু ভাই। ২৮ বছরের দীপ্তিময় যৌবন ও টগবগে আমুদে সাঈদকে প্রথম দর্শনেই বশীরের ভালো লেগে যায়। তখন সাঈদ আহমদের কর্মস্থল ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি—প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের 'ডেপুটি কন্ট্রোলার অব নেভাল অ্যাকাউনট্যান্ট' পদে। পরিচয়ের পর থেকে পরবর্তী চার বছর তাঁদের মাঝে নিয়মিত পত্রালাপের কথা জানা যায়। ধারণা করা হয়, ১৯৬২ সালের পর থেকে দুজনের মধ্যে চিঠি লেখালেখি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এই গ্রন্থনায় অন্তর্ভুক্ত চারটি চিঠিতে সাঈদ আহমদ তারিখ উল্লেখ করেননি। তাই চিঠির ভাষ্য, ঘটনাপ্রবাহ ও অন্যান্য উপকরণ বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য রচনাকালে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়েছে। 'মুর্তজা বশীর ট্রাস্ট' ও শিল্পীর বড় মেয়ে মুনীরা বশীরের আন্তরিক সহযোগিতায় সাঈদ আহমদের এ দশটি অপ্রকাশিত চিঠি উপস্থাপন করা হলো।
চিঠি মূলত ব্যক্তিগত আলাপচারিতার স্মারক। মুর্তজা বশীরকে লেখা সাঈদ আহমদের চিঠিতে ব্যক্তিগত আলাপ ছাড়িয়ে দর্শন, ভূগোল, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য; বিশেষ করে নাট্যসাহিত্যের বিদগ্ধ আলোচনা মুখ্য হয়ে উঠেছে। সাঈদ আহমদের লেখালেখির শুরু তাঁর প্রথম কর্মস্থল করাচিতে। পাকিস্তান কোয়ার্টারলি, সিনটিলা, দ্য আউটলুক প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর সমালোচনা প্রকাশিত হতে থাকে। ওই সময়ে সাহিত্যসম্পর্কিত কয়েকটি প্রবন্ধ ইংরেজিতে ছাপা হয় যার মধ্যে ছিল আলবেয়ার কামুর ওপর লেখা একটি প্রবন্ধ। ১৯৬১ সালে 'দ্য ভিশন' পত্রিকায় তার প্রথম নাটক 'দ্য থিং' প্রকাশিত হয়, যা শুধু পাকিস্তানে নয়, উপমহাদেশের প্রথম 'অ্যাবসার্ড' নাটক ছিল। পরের বছরই নাটকটি বাংলায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয় 'কালবেলা' নামে। তাঁর দ্বিতীয় নাটক 'মাইলপোস্ট'ও (১৯৬৫) প্রথমে ইংরেজি এবং পরে বাংলায় লেখা হয়। একটি লোকগল্পকে অবলম্বন করে ১৯৬৭ সালে তিনি 'তৃষ্ণায়' নাটকটি রচনা করেন। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তাঁর চতুর্থ নাটক 'একদিন, প্রতিদিন'-এর পটভূমি ছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ এবং তাঁর শেষ নাটক 'শেষ নবাব' প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় সাঈদ আহমদের নাটক অনূদিত হয়েছে। বেকেট এবং আয়োনেস্কো তাঁর নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। নাটকের বাইরে লেখা তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে 'বাংলাদেশের সুরস্রষ্টা' (২০০৩), 'জীবনের সাত রং' (২০০৭), 'ইন পারসুট অব কালচার' (ইংরেজিতে) এবং 'ঢাকা আমার ঢাকা' (২০১০) অন্যতম। চিত্রকলা নিয়েও রয়েছে তাঁর অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা। ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি দুই খণ্ডে প্রকাশ করে 'সাঈদ আহমদ রচনাবলী'।
শিল্পী মুর্তজা বশীরের আঁকা উল্লেখযোগ্য সিরিজ হলো 'দেয়াল', 'শহীদ শিরোনাম', 'পাখা' ও 'কালেমা তাইয়্যেবা' । তিনি 'বিমূর্ত বাস্তবতা' নামে একটি শিল্পধারার প্রবর্তক। এ ছাড়া ফিগারেটিভ কাজে পূর্ব-পশ্চিমের মেলবন্ধনে তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। বিশেষ করে গত শতকের নব্বই দশক থেকে তাঁর আঁকা নারীচিত্রমালায় সেই মেলববন্ধনের চিহ্ন পাওয়া যায়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—গল্পগ্রন্থ: 'কাচের পাখির গান' (১৯৬৯) ও 'গল্প সমগ্র' (২০০৮); কাব্যগ্রন্থ: 'ত্রসরেণু' (১৯৭৬), 'তোমাকেই শুধু' (১৯৭৯), 'এসো ফিরে অনসূয়া' (১৯৮৫), 'সাদায় এলিজি' (২০১৭) ও বাংলা থেকে ইংরেজিতে স্ব-অনূদিত 'Fresh Blood, Faint Line' (২০০৮); উপন্যাস: 'আল্ট্রামেরীন' (১৯৭৯), 'মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে' / 'অমিত্রাক্ষর' (২০০৮); নির্বাচিত রচনা ও প্রবন্ধ: 'মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত' (২০০১), ও 'চিত্রচর্চা' (২০২০) এবং গবেষণাগ্রন্থ: 'মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ' (২০০৪)।
মুর্তজা বশীরের সঙ্গে সাঈদ আহমদের বন্ধুত্ব অন্তরঙ্গ এবং দৃষ্টান্তপূর্ণ। এসব চিঠিতে নানারূপে তা ফুটে উঠেছে। তাঁদের বন্ধুত্ব কেমন ছিল, এর উল্লেখ পাওয়া যায় ২০১৪ সালে প্রকাশিত মুর্তজা বশীরের 'আমার জীবন ও অন্যান্য' গ্রন্থে—'পিকাসো একটি খাতায় তাঁর প্রিয় বন্ধুদের নাম টুকে রেখেছিলেন, কেউ মারা গেলে সেই নাম কেটে দিতেন। আমার তেমন খাতা নেই, তবে আমার হৃদয়ের উষ্ণ প্রস্রবণে আপন কয়েকজনের নাম লেখা রয়েছে। সেখানে হাসান হাফিজুর রহমান, ফজলে লোহানী, দেবদাস চক্রবর্তী, আলাউদ্দিন আল আজাদ ও শামসুর রাহমান ফুটন্ত বুদ্বুদের মতো অনবরত উথালপাথাল। এই বুদ্বুদরাশিতে জাগ্রত হলো আরেকটি নাম—সাঈদ আহমদ।' এসব চিঠি সেই বন্ধুত্বেরই স্মৃতি বহন করে চলেছে... (ভাষা ও বানানে মূল চিঠি অনুসরণ করা হয়েছে)
১২/২/৬৩
করাচি
বশীর,
তোমার লেখা চিঠি অনেক দিন আগেই পেয়েছি। কিন্তু যদি বিশ্বাস কর যে জীবন কিভাবে কাটছে। ঝামেলা সবার সংগেই লেগে আছে। আর সবারই নিজেরটা অন্যের চেয়ে বড়। তবুও আমি জানি তুমি জীবনকে (বিশেষ করে এখন) সূক্ষ্ম্যকোন-থেকে দেখছ বা হয়ত আমি এখনও দেখতে পারছি না। অভিজ্ঞতা অর্জন করাই মূখ্য উদ্দেশ্য। তা হাসিতে হয় বা কান্নায় কারণ এ ক্রিয়ার দাম কম, উপলব্ধির দাম অনেক বেশী।
মানসিক আর শারিরীক দুই এর অবস্থা বেশ সংগীন হয়ে পড়েছিল। এখন কোন মতে গুছাতে আরম্ভ করেছি। বেশ কষ্টকর ব্যপার। স্বপ্নের ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো সব খুঁজে পাচ্ছি না। তাই হয়ত আরও একটু সময় লেগে যাবে। হয়ত পাবই না। অগত্যা করাচি ত্যাগ করার মনস্ত করেছি।
ইনশাল্লাহ ২৫ তারিখে এখানে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে লাহোরের দিকে রাওয়ানা হবো। 'ওয়াপদা'তে চাকুরি করার ইচ্ছে হচ্ছে। এ পরিবেশ থেকে দূরে গিয়ে একটু ভাবার সময় চাই। পারভিনের সংগে প্রায় পাকাপাকি করে ফেলেছি। বড় ভাই ঢাকা থেকে এলে পরেই সব কাজ গুছিয়ে নেবে। তবে শীলার অবস্থা দেখে বেশ কষ্ট হয়। বেচারী আমার জন্যে অনেক করেছে। আর এ বয়সে হোচট খাওয়া, স্বীকার করে নেওয়া একটু শক্ত ব্যপার। তবুও আমাদের বন্ধুত্য হয়ত ছিন্ন হবে না।
তোমার লাহোর আর পিণ্ডির ক্যাটালগ দেখেছি। পিণ্ডিতে ছবি বিক্রি হয়েছে জেনে খুশি হলাম। টাকা পয়সা কেমন করতে পেরেছ। কারণ তোমার জন্যে জীবন এখন ছেলে খেলা নয়। আর একটি প্রাণী তোমার দিকে চেয়ে আছে। আশাকরি তুলুর শরীর ভাল আছে। মাঝখানে শরীর খারাপ হয়ে গেছিল বেচারী একটু কমজোর তাই ওর দেখাশুনা ভাল করে করো। আর তাছাড়া একেবারে বিদেশে।
তোমার শরীর কেমন আছে? ওখানে ত বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল। বিশেষ কোন কষ্ট হয়নি ত। তুলুর ওভারকোট বেশ কাজ দিয়েছে। করাচিতে exhibition করার ঠিক করলে নাকি? জানালে ভাল হবে। এখানে art Council-এ চাকুরিও করতে পার। এ ব্যপারে লিখবে নিশ্চয়ই। শীলা আর আমার ভালোবাসা নিও। তুলুকে আমার কথা বলো। হয়ত শীগগীরই দেখা হবে।
সাঈদ
['আমার বন্ধু সাঈদ' শীর্ষক রচনায় মুর্তজা বশীর চিঠিটির অংশ বিশেষ উল্লেখ করেছেন। এখানে পূর্ণাঙ্গ চিঠি তুলে ধরা হলো। পত্রগ্রহিতার ভাষ্যমতে, চিঠিটির রচনাকাল ১৯৬০-৬১]
Room No. 17
CHILTAN HOTEL
Quetta
প্রিয় বশির,
জানি আমার ওপর হয়ত কিছুটা রাগও থাকতে পারে। কিন্তু আমরা সবাই এত ঘৃন্য যে আর ঘৃনার মাত্রা বাড়িয়ে লাভ নেই। তোমার চিঠি অনেকদিন আগেই পেয়েছিলাম এবং ঘটা করে দু'চার লাইন সবাইকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। তার মধ্যে আবেদিন আর আমিনুলেরও মতামত সামিল করতে পারো। কিন্তু কোন বিশেষ কারণে নয় (হয়ত বা অনেক কারণও থাকতে পারে) জবাব দিতে পারিনি।
গত, মাস দেড়েক থেকে মানসিক অবস্থার অদ্ভুৎ বিকার দেখা দিয়েছে। তার মানে একটা নাটক লিখে দাঁড় করেছি। এটা পূর্ব বাংলার সাইক্লোনের ওপর ভিত্তি করে লেখা। সমসাময়িক সমস্যার প্রতিচ্ছবি হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যদিও ইংরেজিতে লিখেছি আমার মতে নিতান্ত মন্দ হয়নি। কতগুলো জায়গা আমার নিজের কাছেই ধরাছোঁয়ার বাইরে হয়ে যায়। তোমার ছবির মধ্যে অনেক সময় হয়তো এই অবস্থার ঈঙ্গিত পেয়ে থাকবে। তার মানে এই না যে না বুঝেই রং চাপানো বা লাইন আঁকা হয়েছে। তার মানে এই না যে কেবল শব্দের মারপ্যাঁচ ভাবের কুয়াশাচ্ছন্ন জাল বোনা হয়েছে। অনেক সময় মানুষের বুদ্ধি নাবালক মনে হয়। কেবল প্রজ্ঞা দিয়ে অনুভব করা চলে। প্রজ্ঞা শব্দটা বৌদ্ধ ধর্মের ভাবানুযায়ী ব্যবহার করেছি। বুদ্ধি (Intellect) দিয়ে সবকিছু বিচার করা চলে না। পাশ্চাত্ত Existenialist-রা Reason এবং Intellect-এর টানাহ্যাচড়ায় অনেক সময় কাটিয়েছে। যেমন Kant বলছেন 'Ineluctable limit of reason, বা Kierkegaard, Chestor, Husserl, এমনকি Camus, Sabtre, Malraux এরাও Reason এর গণ্ডি থেকে বেড়িয়ে পড়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
আমারও মনে হয় কেবল Reason দিয়ে বিচার করলে, যে কোন জিনিষের সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে যায়। তবে একদিক থেকে দেখতে গেলে Reason-এর জয়জয়গান অস্বীকার করা ধোঁকাবাজি হবে। কেবল এই ধোঁকাবাজিতেই বাঁচার সম্ভাবনা আছে। Camus তার কোন এক নায়ক সম্বন্ধে বলছে 'Tomorrow, he was longing for tomorrow, whereas everything in him ought to reject it.' নায়ক কালকে তার প্রেয়সীর সংগে শেষ বোঝাপড়া করার জন্যে তৈরী হচ্ছে। হৃদয়ের সবকিছু ওর পায়ে অঞ্জলি দেবে। কিন্তু কালকে ওর এই জীবন শেষও ত হয়ে যেতে পারে। যেখানে এত বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে, যে শক্তি ওর সব আশা, চিন্তাকে বিলুপ্ত করে দেবে, সেইখানে কালকের কথা ভাবাই পাপ। এই মতামত কেবল Reason থেকে আসতে পারে তাই হয়তবা খুবই Logical. কিন্তু তবুও আমরা বেঁচে থাকি, বেঁচে আছি, আশা করি, ঘর বাধি। সব খেলাই চলছে। মানববুদ্ধি নিজের পূর্ণতা খোঁজে। বুদ্ধির পূর্ণতা বুদ্ধিতে। কিন্তু তাতে মানবাত্মার বিকাশ হয় না।
"To an absurd mind reason is useless and there is nothing beyond reason." এই লাইনটা Camus তার Myths of Sisyphus-এ লিখেছে। Absurd mind-টা মোটামুটি বলতে গেলে বলতে হয় যে পৃথিবীকে জানার অদম্য ইচ্ছা আর প্রতি মুহুর্তে পৃথিবী গাছের আড়ালে লুকিয়ে যায়। দুই পাঞ্জা দিয়ে এঁটে ধরেছি আর সেই সময়েই আঙুলের ভেতর দিয়ে গলিয়ে যাচ্ছে। মানে বুদ্ধির আওতায় আসতে চায় না। মামুলিভাবে ধরো, একজন লোক সোমবার থেকে শনিবার পর্যন্ত রোজ ভোরবেলায় ওঠে, মুখ-হাত ধোয়, বাসে চড়ে, অফিসে যায়, ফাইল নাড়ে, একটু হাসে, একটু গল্প শোনে, একটু খাওয়া খায়, বেড়িয়ে পড়ে, বাস ধরে, ঘরে আসে, হাত মুখ ধোয়, খবরের কাগজ নিয়ে বসে, খাওয়া খায়, ঘুমিয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ একদিন বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে আর মাথায় চিন্তার বিপ্লব আরম্ভ হয়েছে। এটা কি জীবন? এই কি চেয়েছিল? এই কি সবকিছু? যখনই এই সব প্রশ্ন জাগছে তখনই সেই মানব সন্তান Absurd Condition-এর সম্মুখীন হচ্ছে। সব চিন্তা করার পর দেখতে পাচ্ছে 'মৃত্যু' এক চাপড়ে সব লীলাখেলা শেষ করে দেবে। তাহলে আর এত চিন্তার ফল কি? দাম কি? দাম অবশ্যি অনেক বড়, এ মানিক অমূল্য। Revolt! সবকিছুর বিরুদ্ধে তার প্রশ্ন। 'Rejection', ময়ুর সিংহাসনে লাথ মেরে হাসতে পারে। ওর চাইনে। পৃথিবী যত কিছুই প্রলোভন দিক ওর কিছু চাইনে। এখানে Rejection আর Renunciation-এর পার্থক্যটা খেয়াল করার মতন জিনিস।
কিন্তু এবস্থায় উত্তীর্ণ হবার পরও আমরা একে অন্যকে ভালবাসি, সাহিত্য, কলা, স্থাপত্য সবারই চর্চা করি। কিন্তু এগুলো সব ধোঁকাবাজি। সদরঘাটে 'জোয়ান টেবলেট' (বা দাঁতের মাজন) বেচার আগে যে তারস্বরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায় আর তাসের খেলা দেখায়। ভেল্কিবাজি, কিছুক্ষণের জন্যে শ্রোতা এবং দর্শকদের Engage রাখা ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা সবাই শ্রোতা এবং তর্কবাচস্পতি। এক অন্যকে স্বীকার করে নিয়েছি। আশ্বাস দিয়েছি, আশা নিয়েছি। বাচার জন্যে 'আশাই' আমাদের একমাত্র সর্বস্ব। মরার জন্যে সবচেয়ে সোজা পথ 'আত্মহত্যা'। যে আত্মহত্যা করে তার বোঝারও শক্তি নেই, বোঝা বইবারও ক্ষমতা নেই। আমরা আত্মহত্যা করিনি মানে আমাদের Logically বাঁচার অদম্য ইচ্ছা এবং বোঝা বইবার সীমানা খুঁজে বেড়ানোর অঙ্গীকার। আর এই দুই প্রবল ইচ্ছার মাঝখানে যে মুহুর্তের ফাঁক পড়ছে তাতেই 'ম্যাজিক' দেখানো হচ্ছে। Picasso বলেছেন museum-এ যে paintings আছে তা greatest lie', মনে পড়ছে। এখন বোধহয় উপলব্ধি করতে পারবে। এ সংজ্ঞার সূত্র এবং অর্থ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
নাটকটা বোধ হয় করাচিতে December মাসে হ'বে। Yunus পরিচালনা করবে। সেখ এর করার ছিল কিন্তু ও লাহোরে চলে যাওয়ায় অন্য ব্যবস্থা করতে হলো। সেখকে জিজ্ঞেস করলে বুঝতে পারবে কি ধরণের লেখা হয়েছে। তবে আমার যতদূর পড়াশুনা আছে মনে হয় বাংলায় বা উর্দুতে এ পর্য্যায়ের নাটক আজ পর্য্যন্ত লেখা হয়নি। নেহাৎ অহমিকার গন্ধ পাচ্ছি। আমি লজ্জিত। সেখ লাহোরে করতে চাইছে। বোধহয় ফায়েজ সাহেবের সংগে কথাবার্তাও বলেছে। সেট ডিজাইন যদি তুমি করো তা'হলে খুশি হ'বো। সেখ এর সাথে কথা বল্লেই বুঝতে পারবে।
করাচির show টা হয়ত বা President Ayub Khan উদ্বোধন করতে পারে। Arts Councli থেকে লেখাপড়ি হচ্ছে। কিছুটা শান্তি বোধ করছি। এই জন্যে নয় যে President আসবে। লেখাটা শেষ হয়েছে। প্রসব ব্যথা থেকে নিস্তার পেয়েছি। কিছুদিন আগে Beckett-র ওপরে article লিখেছিলাম। যদিও printing ভূল হাজারো ছিল তবুও মোটামুটি উতরে গেছে। Beckett-কে এক কপি পাঠিয়েছি Paris-এ। ওর Waiting For Godot দেখেছ নিশ্চয়ই। বর্তমানে CAMUS ওপরে একটা article লিখছি। আমার কতগুলি ছোটগল্প আমেরিকান ম্যাগাজিন চেয়ে পাঠিয়েছে। শীগগীরই ওদের পাঠাচ্ছি।
হ্যাঁ, মেয়ে ঘঠিত ব্যপারে জড়িয়ে গেছি। আর পারভীন কোরেশীর বড় বোন ছোট বোনের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। হাসতেও ইচ্ছে হয় কাঁনতেও ইচ্ছে হয়। অনেক দিন পর নিজেকে কিছুটা গুছাতে পেরেছি। এই Sensation এত শীগগীর হারাতে চাই না। এইত কয়েক বছর লিখতে বা চিন্তা করতে পারবো। এর পর ত সর্দিজ্বর, আমাশা, কোমরে ব্যথা ইত্যাদি।
আমি তোমাকে চিঠিটা Quetta থেকে লিখছি। গতকাল পারস্যদেশ থেকে ফিরে এসেছি। এখানে কয়েকদিন অফিসের কাজ করতে হবে। আমার প্রমোশন হয়েছে শুনেছ বোধ হয়। তাই বড় সাহেবের সরকারী কাজে এই সব দেশ ঘোরা হচ্ছে। এখানে এসে C&M. Gezette কিনেছিলাম সেখের Editorial পড়তে। Arts Councli-এ নাটকের খবরও দেখলাম। তুমি set design করছো। আশাকরি ভাল করেছো। নাটকটা কেমন। Peerzada-র ছেলে কেমন direction দেয়? ইশরাৎ গনি মেয়েটির সংগে করাচিতে দেখা হয়েছিল। ঘনশ্যামের বাড়িতে এক সংগে গেছিলাম। দেখতে ভালো। কি বলো! তোমার প্রেমের দিক কেমন চলছে? আকিলার পর আর কেউ এলো! তুমি ত Don Juan. আমার মানে involvement-এ। Don Juan এই জন্যে বড়ো নয় যে হাজারো মেয়ের শারিরীক সম্পর্ক লাভ করতে পেরেছিল। হাজারো অভিজ্ঞতার মালিক হতে পেরেছিল। মেয়ে বলছে 'At last, I have given you ove'. Don Juan হেসে উত্তর দিলো 'At last? No, but once more',
আশা করি ভালো আছো। করাচির ঠিকানায় চিঠি দিলে খুশি হবো। কাজ কেমন চলছে, ছবি আঁকা হচ্ছে ত। জানিও নিশ্চয়ই।
সাঈদ
[পত্রগ্রহীতার ভাষ্যমতে সাঈদ আহমদ ১৯৬০ সালের নভেম্বরে করাচি থেকে চিঠিটি লিখেছেন (পৃষ্ঠা ২৫৭, আমার জীবন ও অন্যান্য, মুর্তজা বশীর, ২০১৪)। গ্রন্থটিতে চিঠির অংশবিশেষ মুদ্রিত হয়েছিল। এখানে পূর্ণাঙ্গ চিঠি তুলে ধরা হলো।]
বশির,
তোমার চিঠি কয়েকদিন আগে পেয়েছি। আমার অনুপস্থিতিতে চিঠি পত্র সব এদিক ওদিক হয়ে গেছিল। তোমার টাকা পাঠাবার জন্যে বেশ চেষ্টা করছি। বারকির মুখে শুনলাম কয়েকটি ছবি নাকি বিক্রি হয়েছে এবং খাওয়া, মদ আর বেশ কিছু রোপ্য মুদ্রা খরচও করছ। যাক ছবি কেমন হচ্ছে? তোমার কোন exhibition-র plan করছ নাকি? করাচিতে ইচ্ছে ছিল। এখন মতামত কি? জালাল ত বোধহয় লাহোরে গেছিল। ওর সংগে কথা বার্তা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। কাইয়ুম সাহেব নাকি পিণ্ডিতে exhibition করার আমন্ত্রন জানিয়েছেন। যাবে নাকি? সাদেকায়েন এর সংগে কেমন কাটছে। মুইন ভাল আছে? খুব নাকি মদ চলছে। সত্যি লাহোর খুব আসতে ইচ্ছে করে কিন্তু বোধ হয় December-এর আগে হয়ে উঠবে না। তবে তুমিত করাচি আসতে চেয়েছিলে। কবে নাগাদ ! খালেদ, শাকের ওদের আমার কথা বলো। সাফদার (দুই জন) আর রিজভি ইত্যাদিকে সালাম দিও। সেজদা কেমন কাজ করছে? আমার কথা বলো (যদিও হয়ত আগামিতে দেখা হ'তে পারে) কারণ আমার সংগে আলাপ নেই। আব্বাসিকে আমার সালাম দিও।
হামিদ হয়ত কয়েকদিনের মধ্যেই করাচি আসবে। যদিও জাহাঙ্গীরের মুখে ওর সম্বন্ধে সবই শুনেছ। ওর জন্যে একটা ভাল জায়গা (মানে ওর show room করার জন্যে) খুঁজছি। পেলেই কাজ পুরোদমে আরম্ভ করবে। ওর বউও হয়ত সংগে আসবে। এরশাদ এখনও Continent এ আছে। আমিন, মোহসিন, ডাক্তার, মিরজা, বেগ (যার ওখানে মদ খেয়েছিলাম) সবাই তোমার কথা বলে।
আমার দিনকাল মোটামুটি কেটে যাচ্ছে। গতবারের Scintilla-র সংগে একটু ঝগড়ার মতন হয়ে গেছে যদিও আমার কাছে এখনও দৌড়াদৌড়ি করছে। Van Gogh- এর article-টা তোমার নামে উৎসর্গ করেছিলাম। ওদের Editorial Board শেষ মুহুর্তে আপত্তি জানায়। কারুর নামে কোন জিনিষ উৎসর্গ করতে ওদের ছাপাতে আপত্তি আছে। আমি একটু এড়ে বসেছিলাম। এমনকি ছাপাতে অমত জানিয়েছিলাম। ওরা যদিও পরে তৈরী ছিল, আমার সময়ের স্বল্পতার জন্যে telephone-এও কথা বলতে পারেনি । তার মানে আমার মতের বিরুদ্ধে ছাপাবার সাহস করেনি। হয়ত আগামি সংখ্যায় বেরুবে। গত মাসের Vision-এ একটা ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। এ মাসেরটাতেও হয়ত আর একটা প্রকাশিত হ'বে। Italy-র ওপরে যে গল্পটা বলেছিলাম তার খসড়া লেখা হয়ে গেছে। একটু ঠিক ঠাক করে তোমাদের জন্যে পাঠাব। Contemporary Arts আর একটা প্রবন্ধ বের হচ্ছে।
তুমি কিছু লিখলে নাকি? জানি ছবি একে সময় করা মুষ্কিল। শরীরের দিকে নজর রেখো। পেটে ব্যথা হচ্ছে নাকি? অত্যাচার কম করলেই ভাল। তোমার জন্যে ২৫, মানি অর্ডার করলাম। আমার কাছে এখন টাকা একটু কম আছে। কয়েকদিনে ঠিক হয়ে যাবে। নাজির ভাই এর বিয়ে, আর ঢাকা আসা যাওয়ায় অনেক খর্চ হয়ে গেছে। তবুও যদি টাকার বিশেষ প্রয়োজন হয় তাহ'লে জানিও। মানসিক ও দৈহিক দু দিক দিয়েই ভাল আছত। আমিনুল তোমার কথা বলছিল কিন্তু আর কেউ না। দুষ্টামিও হতে পারে। সময় করে চিঠি দিও। শুভাশিষ যেনো।
সাঈদ
[ভ্যান গঘকে নিয়ে 'আর্টিক্যাল'-এর কথা সাঈদ আহমদ উল্লেখ করেছিলেন তাঁর করাচি থেকে লেখা ১৯৬০ সালের নভেম্বরে চিঠিতে। সেই হিসাবে এই চিঠির সম্ভাব্য রচনাকাল ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর।]
বশির,
তোমার চিঠি কয়েকদিন আগে পেয়েছি। সময়াভাবে চিঠি দিতে পারিনি। নানা কাজে অনেক ব্যস্ত আছি। খোলাখোলি চিঠি দোব পরে। হামিদ আর জাহাঙ্গীর, আগামি মাসের প্রথম সপ্তাহে ওরা আসবে।
সাদেকায়েন এর প্রদর্শনী হয়ে গেলো। আমার সংগে একটু গোলমাল হয়েছে। আমি ওর ক্যাটালগে লিখতে অসম্মতি জানিয়েছিলাম। রেডিওতে ওর ওপরে কথিকা পড়েছি। হয়ত জালালের ম্যাগাজিনে লিখব।
আমার বিশিষ্ট বন্ধু ফুলভিও কাত্তারকিক রোমের ছাত্র এ দেশে এসেছে লেখাপড়া করার জন্যে। অত্যন্ত ভদ্রলোক তবুও জাতে ইটালিয়ান। ওর সংগে কথা বলে খুশি হ'বে এবং হয়ত পুরোনো দিনের ছোঁয়াচ পাবে। তোমাদের লাইনের প্রতি যথেষ্ট ঝোঁক আছে আর ইংরাজি না বলার দরুণ হয়ত একটু বোকা মনে হ'বে। আস্তে আস্তে ভাল লাগবে। যদি সম্ভব হয় তবে তোমাদের গোষ্ঠিতে সামিল করে নিও।
তোমার টাকা ৫০, আগামি মাসে পাঠাবো। তবে বিশেষ দরকার থাকলে আমাকে টেলিগ্রাম ক'রো। বেশ মদ্যপানের মধ্যে দিন কাটাচ্ছো। কাজ বেশ করেছ জেনে খুশি হ'লাম। সেই রকম Structural কাজ হচ্ছে বুঝি, যেমন এখানে কতগুলো drawing আছে। পুরো উদ্দমে কাজ আর মদ খেয়ে যাও। ফল নিশ্চয়ই পাবে । তোমার ওপরে অনেকে আশা করে।
আমার লাহোর যাবার এখনও কিছু ঠিক করে উঠতে পারিনি। ছুটি পাওয়া হয়ত একটু মুষ্কিল হ'বে । দেখি কতদূর কি হয়।
মুইন, খালেদ, শাকের, সাফদার (দুই জনকেই), রাহিল, রিজভি ওদেরকে আমার সালাম দেবে। এবারের "সিন্টিলাতে Van Gogh-এর article টা বের হবে। তোমার নামে উৎসর্গ করেছি। সময় পেলে পড়বে। মনের খোরাক অনেক আছে।
বারফি, মিরজা, আমিন ওরা সবাই ভাল আছে। এরশাদ বিলেতে। শারিরিক ও মানসিক অবস্থা ভালই বলতে হবে। শুভাশিষ নিও
সাঈদ
২৬/৬/৬২
করাচি
বশির,
তোমাকে এতদিন চিঠি দিতে পারিনি বলে দুঃখিত। প্রথমে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। তোমার বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র পেয়েছিলাম এবং অন্যান্য বন্ধুদেরকে দেখিয়েছিলাম। আশাকরি দিন ভালো কেটে যাচ্ছে।
গিন্নিকে নিয়ে খুব ঘটা করে খাওয়া দাওয়া করছ বুঝি। এতদিন না খেয়ে খেয়ে শরীর নষ্ট করেছ। এখন দেখাশুনা করার জন্যেও ত লোক পাওয়া গেছে। আর ঝামেলা কি? কেমন লাগছে দাম্পত্য জীবন? আমার ত অভিজ্ঞতা নেই তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।
তোমার পিণ্ডির একজিবিশন খুব ভাল হয়েছে শুনেছি। জাহাঙ্গীর এ সম্পর্কে লিখেছিল। এখন ছবি আকা আরম্ভ করবে নাকি? কিছুদিনের জন্যে অবশ্য অবসর নিতে পারো। মধুর সম্পর্কের প্রথম দিনগুলোকে ভাল করে অনুভব করা উচিৎ। কিন্তু আমার মনে হয় creative artist- এর জন্যে কাজ নেহায়েৎ দরকারি। কাজ করার পর এক অদ্ভুত শান্তি আসে। আমার দিনকাল মোটামুটি কেটে যাচ্ছে। নাটক হয়ে গেলো। মন্দ হয়নি যদিও খবরের কাগজে বেশ লেখালেখি হয়েছিল । তবু মন যেন ভরেনি । বাহাবা বা খোশামদের পংক্তি ঢের ছিল। কিন্তু মন অন্য কিছু চায়। আর সবচেয়ে মুষ্কিল এই যে কি যে মন চায় তাই জানি না। আর এই confusion থেকে বাঁচার জন্যে নানা রকম খেলা তামাশা করতে হচ্ছে। যেমন পারভিনের সংগে বিয়ের প্রায় পাকাপাকি করে ফেলেছি। আরও নতুন নাটক লেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। সময় করে উঠতে পারি না। নানা ঝামেলায় বেশ ব্যস্ত থাকি। American Troup যেটা পাকিস্তানে এসেছিল আমার নাটক বেশ পছন্দ করেছিল। ওদের Producer কপি নিয়ে গেছে এবং জুলাই মাসে আমাকে নাটকটির America-য় মঞ্চস্থ্য করার সম্ভাবনা সম্বন্ধে লিখবে। ঢাকায়ও Drama Circle নাটকটি করবে। জানি না তারিখ কবে ঠিক করেছে।
গত চার/পাচ মাস এক লাইনও মনের মত লিখতে পারিনি। ছোট ছোট প্রবন্ধ অনেক লিখেছি কিন্তু এগুলো কিছুই না। তাই হয়ত মানসিক অবস্থা ভাল না।
তোমার গিন্নি এবং ছবি সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখো। আমার সালাম পৌছে দেবে। তোমার শরীর কেমন আছে জানাবে। ঢাকার খবরা খবর কি? ফিরোজ, এরশাদ, আমিন সবাই তোমার কথা বলে।
সাঈদ
২২. ১০. ৬২
করাচি
বশির,
তোমার চিঠি ক'দিন আগে পেয়েছি। কিন্তু সময়ের অভাবে জবাব দিতে পারিনি। এখনও অফিসে বসে নানা ফাইলের কাঁধ এড়িয়ে লিখছি। Exhibition-এর দিন ধার্য্য করেছ শুনে খুশি হলাম। এরফানের সংগে আমার কোন কথা এ পর্য্যন্ত হয়নি, তাই জানি না ওরা কি বন্দোবস্ত করবে। আজকে ইচ্ছে আছে কথা বলার। তুমি লিখেছ ১৮ তারিখে হ'বে। সময়ও আর বেশী নেই। কবে নাগাদ আসবে ঠিক করছো?
আমার সময় এত জটিল হয়ে পড়েছে যে কোনদিকই ভাল করে সামলাতে পারছি না। কোয়েটা যাবার তিন তিন বার দিন তারিখ ঠিক করে নাচক করতে হয়েছে। অফিসের বড় কর্তারা পিণ্ডি থেকে একের পর এক আসতে আরম্ভ করেছেন। আর তার ওপর হৃদয় ঘঠিত ব্যপারও গুরুতর। ঝগড়া ঝামেলা কান্নাকাটি দু পক্ষের বেশ কমজোর করে দিয়েছে। মানসিক অবস্থাও ভাল না। বুঝতে পারো তুমি যাবার পর থেকে বোধ হয় খুব বেশী হলে চার পাতা নাটকটা এগিয়েছে। একত লিখবার সময় পাই না আর সময় পেলেও লিখবার মন পাই না। বেশ কষ্ট হচ্ছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে আর আমার কাজ যেখানকার সেখানেই রয়েছে।
গিন্নি নিয়ে আসবে লিখেছ। জানি না কতখানি যুক্তি সঙ্গত হ'বে। কারণ হয়ত আর একটি কামরার বন্দোবস্ত করা মুষ্কিল হয়ে পড়বে। গত দশ/পনের দিন হয় এক সরকারি আদেশ অনুযায়ী আর কামরা allot করা হবে না। বিশেষ করে যাদের কাছে ডবল কামরা আছে। তাই অসুবিধাটা বুঝতে পারছো! তোমার থাকার কোন কষ্ট হ'বে না কিন্তু গিন্নি নিয়ে এলে একটু ঝামেলা হতে পারে। তোমার সেই বন্ধুকে (কুতুব) লিখলে ভাল হয়। হয়ত ও কোন বন্দোবস্ত করতে পারে। কষ্ট করে হলেও ক'টা দিন কাটিয়ে নিতে হ'বে।
আশা করি তুমি আমার অসুবিধা বুঝতে পারবে। এখানে এসে দেখলে আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। বুদ্ধিমত যা ভালো মনে করো তাই করো।
তোমার একটি ছোট ছবি মায়া জামিল নিয়ে গেছে। বোধ হয় কিনবে। তুমি এলে পয়সা সংগ্রহ করা যাবে। শীলা তার ছাত্রকে অন্য ছবিটি পাঠায়নি। তবে কথাবার্তা ত পাকাপাকি হয়েই আছে। তাই হয়ত আগামী কদিনেই ছবি ওকে পাঠিয়ে দোব। ৩৫০, ছবি চাইছে। নাকি তোমার আসা অবধি অপেক্ষা করব। Mrs. Gilbert নাম্মী এক American ভদ্রমহিলা কয়েকজন অসবৎরপধহ-কে নিয়ে শীলার কাছে এসেছিলেন। তোমার ছবিও দেখান হয়েছে। ওদের কাছে তোমার আগের কাজও আছে। কোন ছবিটা নেবে ঠিক করতে পারেনি। তাই ওরা বলেছে যে আগামী কয়েকদিনেই জানাবে। হয়ত ওদের কাছে দু'একটা কাজ বিক্রি হয়ে যেতে পারে।
তোমার introduction সম্বন্ধে চিন্তা করো না। তুমি এলে পরে দু'একদিনেই লিখে ফেলবো। কেন এতদিন ধরে লিখতে পারিনি তার আর বলা প্রয়োজন হবে কি? তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমার আসার সংগে সংগেই কাজ আরম্ভ করবো। কামার জামানি কাজটা খুব পছন্দ করেনি। তবে এ ব্যপারে ও পারভিনের মতামতের অপেক্ষা করছে। পারভিনকে আমি বলে দিয়েছি। আশা করি কাজটা ওরা নেবে এবং ব্যবহার করবে। আমিও দেখেছি। বেশ ভাল কাজ কভারের জন্যে। ওদের কাছ থেকে যে পয়সা পাবার তা প্রায় নিশ্চিত। পারভিন ঠিক করে নেবে।
আমাকে হয়ত আগামী মাসে কোয়েটা যেতে হতে পারে। তারিখ এখনও ঠিক করিনি। তোমার Exhibition এর ওপর নির্ভর করছে। সেই সময় করাচিতে থাকতে চাই।
চিঠির তাড়াতাড়ি উত্তর দিও। শীলার শরীর খুব ভাল না। তোমার কথা প্রায়ই বলে। আমার মোটামুটি চলে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীরের চিঠি পেয়েছি। ও করাচি আসার কথা ভাবছে। আবেদিন, আমিনুল ওদের আসার কথা বলো। হামিদ কেমন আছে? তোমার গিন্নির শরীর কেমন? এখানে ঠাণ্ডা পড়েনি তবে লাহোর, পিণ্ডিতে বেশ হচ্ছে শুনেছি।
শুভেচ্ছা রইল
সাঈদ
২. ১. ৬৩.
করাচী
বশীর,
তোমার চিঠি কোয়েটায় পাঠানো হয়েছিল। তবে ডাক সেখানে গরবড় হয়ে যাওয়ায় সময়ে পাইনি। যা হোক দু দিন হয় করাচি ফিরে এসেছি। তোমার Exhibition-এর সমালোচনা Pakistan Times-এ পড়লাম । মোটামুটি ভাল লিখেছে। মানে লেখাটার ঢং সম্বন্ধে বলছি। আজে বাজে কথা বলে article-টাকে অযথা বড় করেছে। তোমার কাজ নিশ্চয়ই লাহোরওয়ালাদের পছন্দ হয়েছে।
তোমার brochure-এর কোন কপি পাইনি। ছাপানো হয়েছিল কি? যদি হয়ে থাকে তবে আশাকরি পাঠাবে। করাচির Exhibition-এর ব্যপারে নাকি না করে দিয়েছ। ট্রাঙ্ককলে কথা হয়েছিল। এখন ৪ তারিখে আমিনের Exhibition হচ্ছে। খুব ভাল কাজ করেছে। ওর catalogue -এ আমি লিখেছি আর এ নিয়ে অনেক ঝগড়া ঝামেলা হয়েছে। ইউনুস প্রথম লিখেছিল। কিন্তু জালাল ওরা সবাই নাকচ করে দিল । আমি কোয়েটা থেকে ফিরে আসার পর আমাকে ধরল । লিখতে বসলাম। এ ব্যপারে একটু ইউনুস, আমিন, জালাল ইত্যাদিদের একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। যাহোক আমরা এসব ঝগড়ায় নাই পড়লাম।
ছবি কি রকম বিক্রি হয়েছে? আলতাফ গওহার আর অন্যান্য বন্ধুরা নিশ্চয়ই সাহায্য করেছে। এখন কি প্ল্যান করেছ জানাবে।
৩১ তারিখে শীলার ঘরে পার্টি করেছিলাম। প্রচুর মদ আর খাওয়া। ওখানে মায়া জামিল ওরাও এসেছিল। উনি বল্লেন যে তুলুর নাকি শরীর খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল। তাই তোমরা পিঙি চলে গেছ। কি হয়েছিল এবং এখন কি রকম আছে জানাবে। অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। কিন্তু কি করা যায়। জীবনটা ঘুর্ণিপাক ছাড়া আর কিছুই নয়। সাহস রাখা উচিৎ। কারণ তোমার ওপরে ওকে নির্ভর করতে হচ্ছে।
আমার দিনকাল একটু গোলমালে কাটছে। পারভিনের সংগে মনকষাকষি হয়ে গেছে। তাই আর বেশী যাওয়া আসা করি না। দু'জনের মন যোগানো একটু কষ্টসাধ্য ব্যপার। শীলার দিকে পাল্লা ভারী মনে হচ্ছে। তাই আমরা দুজন বেশ আনন্দে আছি। জানি না কতদিন এরকম চলবে।
জাহাঙ্গীরের কোন খোঁজ পেলে কি? আমার এক বন্ধু বলছিল যে ও নাকি ফেরৎ এসেছে। পিণ্ডিতে কেমন কাটছে? আমিন, এরশাদ, ডাক্তার, শীলা সবাই তোমাদের কথা বলে। তুলুকে আমার শুভেচ্ছা দিও। সময় করে চিঠি লিখো।
সাঈদ
[সাঈদ আহমদ এই চিঠিতে তারিখ উল্লেখ করেননি। তবে চিঠির এক অংশে তিনি লিখেছেন, 'ঢাকায় শহীদ মিনারের উদ্বোধন হয়েছে'। শহীদ মিনারের উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। সেই হিসাবে চিঠির সম্ভাব্য রচনাকাল ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ।]
বশীর,
তোমার চিঠি পেয়েছি। করাচি ছাড়ছি ছাড়ছি করে একটু অস্থির ছিলাম। যা হোক এখন কয়েকদিনের অবসর পেয়েছি। যে ভদ্রলোক আমার জায়গায় আসছেন ওনার আর কিছু দেরী হবে তাই ওর অপেক্ষায় আছি। আশা করি ১৫/১৬ তারিখে জয়েন করবে। তারপর হয়ত লাহোরের দিকে রওয়ানা হব।
বুঝতেই পারো মানসিক আর দৈহিক অবস্থার কত অবনতি ঘটতে পারে এই টানা হ্যাচড়ায়। লেখা পড়া মোটেই হচ্ছে না কেবল ছেলেখেলা করে বেড়াচ্ছি। তোমার ওপরে লিখব নিশ্চয়ই কিন্তু আরও একটু সময় লাগবে। কারণ হাশেম বলল এই সংখ্যায় তোমার ওপর লেখা দেওয়া ঠিক হবে না। সব জিনিস প্রেসে প্রায় ছাপা হয়ে গেছে। কোরেশীর লেখাও আগামী সংখ্যায় বেরুবে। চিন্তা করো না দু'জনের লেখাই এক সংখ্যায় ছাপবে।
পিণ্ডিতে বেশ কাটছে মনে হচ্ছে। ছবি বিক্রি কেমন হচ্ছে? ঢাকায় শহীদ মিনারের উদ্বোধন হয়েছে। জানি না হামিদ কাজ করেছে কিনা। ছবিতে যা দেখলাম তাতে মনে হলো ওর কাজ। সাদেকায়েন কিছুদিনের জন্য আছে। আমেরিকা যাচ্ছে। বেশ ভাল কাজ করছে। আমিন কতগুলো colour woodcut করেছে। ভারী সুন্দর! শীলা ভাল আছে। তুলুর কি খবর? আবহাওয়া ভাল লাগছে নিশ্চয়ই। খবরা খবর দিয়ে চিঠি লিখো। আমার আর খবর ভাল।
সাঈদ
১৩/৯/৬৩
2 MAIN GULBERG
Gulbers Road, LHR
প্রিয় বশির,
তোমার চিঠি ক'দিন হয় পেয়েছি। কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত আছো জেনে খুশি হলাম। ফিল্মে কাজ করছ বেশ জোরে শোরে। আবেদিন সাহেব সব খবরা খবর দিলেন। তুমি গ্যালারীর প্রর্শনীর কথা লিখেছ। চিঠি থেকে মনে হলো যে কেবল graphic art-এর প্রদর্শনী করবে অথচ অনেক শিল্পীকে নিমন্ত্রন করেছ ওদের কাজ পাঠানোর জন্যে। ওদের কাছে graphic নেই যেমন জাহাঙ্গীর, রাহিল, খালেদ, আব্বাসী ইত্যাদি। শাকের দেশে নেই তাই ওর কাজ পাঠানো সম্ভব হ'বে না।
আমার কাছে পাঠাবার মতন কেবল সেজদার কাজ আছে। কারণ কিবরিয়ার কাজও ঢাকা থেকেই নিতে পারো। শাকেরের প্রিন্টটা খুব ভাল না। তাই হয়ত এগুলো পাঠালে বিশেষ কাজ হ'বে না। আমার মনে হয় প্রদর্শনীতে অংশ ঢাকার শিল্পীরাই নেবে কারণ এখান থেকে কারুর কাজ প্রদর্শনীর লায়েক নেই। আমি এ ব্যপারে প্রায় সব শিল্পীর সংগেই কথা বলেছি।
তুমি আমার ওপর রাগ করে তোমার দেওয়া পেন্টিংটাও (Self-portrait) নিয়ে গেছ। কিন্তু ভাই এত রাগ কি ঠিক। আমার অবস্থা ত তোমার জানা আছে। মানসিক দিক দিয়ে খুব শান্তি নেই। এখানে লাহোরে আর সব ভাল চলছে কিন্তু অফিসের ঝামেলা এমন লেগে আছে যে কোন দিকে দু' মিনিটের জন্যেও যেতে পারি না বা গুছিয়ে বসতে পারি না। বাসায় সন্ধ্যাবেলা বসে অফিসের কাজ করতে হয়। তাই বুঝতে পারবে বন্ধুবান্ধবের সংগে দেখা করা মুশকিল, কলম দিয়ে প্রবন্ধ লেখা ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে। নাটকটা গত ছ' মাস থেকে পড়ে আছে। দু' কলমও এগুইনি। জাহাঙ্গীর লাহোরে আসে। ৫/৬ দিন থাকে তার মাঝখানে হয়ত একদিন দেখা হয় কারণ সন্ধ্যাবেলায় অফিসের কাজ নিয়ে বসতে হয় আর রাত দশটা বাজলেই শোবার তাড়া। ভোর বেলা ঠিক ৭টার সময় অফিসের দরজায় থাকতে হয়।
বুঝতে পারছি না এভাবে কতদিন কাটাতে পারবো। তবে হয়ত শীগগীরই পিণ্ডি বদলি হয়ে যাচ্ছি। ওখানে গেলে পরে হয়ত আরাম করে বসতে পারবো। গিন্নির কি খবর? এখন শরীর আশাকরি ভাল আছে। বেশ কিছুদিন কষ্ট করেছে। এখন ত তোমার চাকরিও হয়ে গেছে। ভাল করে খাওয়া দাওয়া করো শরীরের জোর হবে।
পারভীন ভাল আছে। পাকিস্তান টাইমসে কাজ করছে। আর রান্নাবান্নায় বেশ ব্যস্ত। আমি এক কলমও লিখতে পারিনি এমনকি একটি ভাল বইও পড়তে পারিনি। এতে মানসিক অশান্তি বেশ ঘটছে। নেপাল কবে যাচ্ছ? ক'দিন থাকবে? প্রদর্শনীতে ছবি কেন পাঠালে না। পাঠালে পুরষ্কার নিশ্চয়ই পেতে। এত বাজে কাজ ছিল যা বলতে পারি না। আবেদিন সাহেব পিণ্ডি গেছেন। আমিনুল, শফিউদ্দিন, কিবরিয়া, হামিদ সবাইকে আমার সালাম দিও। তুমি ভালবাসা যেনো। আমিন মারা যাবার খবর শুনেছ হয়ত।
সাঈদ
12/12/67
1845/c-4.
Elgin Road.
বশীর,
তোমার খবরা খবর লোক মুখে শুনতে পাই। আশাকরি সপরিবারে ভাল আছ। 'চিত্রালী'তে দেখলাম সেট ডিজাইন করেছ 'সখিনা'র। কেমন হয়েছে? এখানে আমাদের বেশ কেটে যাচ্ছে। মার্চ মাসে 'Survival'-এর সূচনা হ'বে। মজলিস শাহ হোসায়েন-এর উদ্যোগে 'মেলা চেরাগাঁর' সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে আর তার বিশেষ অংক হবে এই নাটক। এখানকার ছেলেপুলেরা খুব উৎসাহী। পাঞ্জাবী বই ছাপাচ্ছে ওরা নাটকের। দোয়া করো যেন ইজ্জত বহাল থাকে। নাজমের অনুবাদ খুবই ভাল হয়েছে। হ্যাঁ ভাল কথা, নাজমের নতুন কবিতার বই শীঘ্রই বেরুচ্ছে। ও নাম রেখেছে 'চান্দান রুখ তে বেড়া' অর্থ্যাৎ 'চন্দন বৃক্ষ আর উঠোন'। এটি ওয়ারিশ শাহের একটি কবিতার লাইন থেকে নেওয়া হয়েছে। আদি অর্থ হলো যে নিজের উঠোনে একটা চন্দন বৃক্ষ রোপন করে তার সংগে হৃদ্যতা বাড়াও। চন্দন বৃক্ষ আলো (দৈবিক) আর সুগন্ধের প্রতীক। বৃক্ষ স্বয়ংসম্পূর্ণ, কারুর বন্ধুত্বের পিপাসু নয়। তাই আমাদেরকেই এগিয়ে যেতে হবে, অনুনয়, বিনয় আর নিষ্ঠা বোধহয় বৃক্ষের মনে সম্পর্কের উদ্রেক করতে পারে। আর সেই সম্পর্কের গভীরতায় বিলীন হয়ে যাওয়া সম্ভব। নাজমের নিজের মতামত আরও একটু আছে। প্রথমতঃ চন্দন বৃক্ষ রোপন করাও তোমার কাজ আর সম্পর্ক তৈরী করাও তোমার কাজ। বাইরের কোন দেবতা রোপন করবে না আর না তোমার দুরবস্থার সংগী হবে। তাই সামাজিক উন্নতির জন্যে নিজেকে সমাজ গড়তে হ'বে এবং তার সংগে ভাব সম্পর্ক করতে হ'বে। 'চন্দন' হয়ত উদাসীন কিন্তু জাগরণ তুলতে হ'বে। ওর খুবই ইচ্ছা তুমি 'জ্যাকেট ডিজাইন' কর। অন্যান্য আর কাউকে দিয়ে করাতে উৎসাহী নয়। কারণ তোমার সংগে ওর আলাপ হয়েছে, মতামতের আদান প্রদান হয়েছে এবং তোমাকে শ্রদ্ধা করে। বল দেখিনি কি করা যায়? আমার মনে হয় তোমার এ ভার নেওয়া উচিৎ। তাই আশা করি এ ব্যপারে একটু সময় দেবে। এখানে সাদেকায়েন, শাকের এদের কথা বলেছিলাম কিন্তু জানত ছেলে একটু ট্যেঁরা। সায় দেয় না। বলে যে বশীর করলে ভাল হয়। তুমি আমাকে লিখে পাঠিও যে কত তাড়াতাড়ি 'ডিজাইন' পাঠাতে পারবে। ওর বই ছাপা আরম্ভ হয়ে গেছে। প্রচ্ছদপট করতে হয়ত সময় লাগবে। বেশী রং এ গেলে খরচ বাড়বে তাই যেমন ভাল মনে কর করবে। পাঞ্জাবী হরফ এর লেটারিং আলাদা কাগজের টুকরায় লিখে পাঠালাম। তুমি এই লেটারিংটা নিজের ঢং এ আলাদা টুকরায় লিখে পাঠাবে। প্রচ্ছদের ওপরে ওটাকে আলাদা আঁঠা দিয়ে লাগিয়ে নিয়ে ব্লক তৈরী হবে। আর যদি লেটারিং এর বালাই না বাড়াতে চাও তবে প্রচ্ছদের কোন জায়গায়, কতটুকু সীমানার মধ্যে হবে তার নির্দেশ দিয়ে দিও। ওর এই বইটি খুব সম্ভব 'আদমজি' পাবে আর তোমার প্রচ্ছদপটও হয়ত বাজী মারবে। একজন বাঙালী শিল্পির কাজ পাঞ্জাবী বইয়ে হওয়া সুরুচির পরিচায়ক। আশা করি আমার বক্তব্য পরিষ্কার হয়েছে। আশাকরি বিনা দ্বিধায় উত্তর দেবে।
আমার বাংলা খসড়াটা ডা: হককে পাঠিয়ে দিয়েছি। উনি একটু দেখাশুনা করে আশকার ইবনে শেখকে দেবেন। আশকার ঢাকা থেকে চিঠি লিখেছিল তাড়া দিয়ে। ওরা বোধহয় মঞ্চস্থ করবে ইউনিভার্সিটিতে। তোমাকে হয়ত এর সংগেও জড়িত হ'তে হ'বে। এ ব্যপারে পরে বিস্তারিত লিখব। শাকের ভাল আছে। ওর বউ এর সংগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখন আবার 'ব্যাচেলার' জীবন কাটাচ্ছে। সাদেকায়েন আমার সংগে থাকতে চাইছে। এখানে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি, পাঞ্জাব লাইব্রেরী ইত্যাদির কাজ করবে। হয়ত মাস দু' মাস থাকতে হ'বে। খালেদ ভাল আছে। আনোয়ার সাজ্জাদ প্রদর্শনী করেছিল। মোটামুটি কাজ। শাকের কিছু কাজ আরম্ভ করেছে। পারভিন ভাল আছে। ও 'পার্সপেকটিভ' এ লিখছে। আমার একটা ছোট গল্প আগামী সংখ্যায় বেরুবে। তোমার মেয়ে কেমন আছে? বৌকে সালাম দেবে। এখানে ঠাণ্ডা বেদম পড়ছে। ৩৭ক্ক এর কোঠায় পৌছেছে। শারিরীক সুখবর জানিয়ে চিঠি লিখো। ভালোবাসা রইল
সাঈদ
তথ্যসূত্র:
*মুর্তজা বশীর, আমার বন্ধু সাঈদ, আমার জীবন ও অন্যান্য, বেঙ্গল পাবলিকেশন, ২০১৪।
*হাসনাত আব্দুল হাই, ভূমিকা, সাঈদ আহমদ রচানাবলী, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ২০১২।
*ART OF BANGLADESH, SERIES- 11, MURTAJA *BASEER, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ২০০৪।
*আশফাকুর রহমান কৃত জীবনী সংকলন আলোকে, মুর্তজা বশীরের একক প্রদর্শনী, ক্যাটালগ, ২০২০।