তিলা নাগ ইগল—দুর্দান্ত এক সাপশিকারি
বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দক্ষিণেই ছিল ধোপাপুর বিল। শুনেছি ধোপা সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়মিত এই জলাশয় থেকে কাপড় ধুয়ে নিয়ে যেত। সেই থেকেই এই নামকরণ। আমার কৈশোরে ধোপাপুর বিল ছিল নানা প্রজাতির মাছের এক স্বর্গরাজ্য। রুই, কাতল, কালিবাউশ, বোয়াল, চিতল, শোল, গজার, শিং, মাগুর, কই, পুঁটি, পাবদা, মলা, ঢেলা, গুলশা, টেংরা—কী ছিল না ওখানে!
ধোপাপুরের কই মাছ ছিল খুবই বিখ্যাত, লোকে বলত 'বুকলাল কই'। কই মাছ ধরার ভীষণ বাতিক ছিল আমার। রোজ বিকেলে ছিপ নিয়ে বসে থাকতাম বিলের ধারে। ময়দার সঙ্গে পুঁটি মাছের শুঁটকি মিশিয়ে বানানো বিশেষ আধার ছিল কই মাছের প্রিয় খাদ্য। বড়শিতে সেই আধার গেঁথে কই মাছের আশায় ছিপ হাতে চুপচাপ বসে থাকতাম। বিলে তখন কচুরিপানা, মালেমচা, কুচিপানা, কলমিসহ নানা জাতের জলজ উদ্ভিদ ছিল। এই জলবনের বুকে ঘুরে বেড়াত ডাহুক, কোড়া, কালিম, জল পিপি, জলময়ূরসহ নানা জাতের পাখি। বালিহাঁস, সরালি আর পানকৌড়িও ছিল। বিকেলটা মুখরিত হয়ে উঠত সরালির গলার বাঁশির মতো সুরেলা আওয়াজে। ছোট-বড় মাছরাঙা শিকারের আশায় বসে থাকত কাঠির মাথায় কিংবা গাছের ডালে।
বিলের চারপাশজুড়ে শিমুল, কড়ই, চুড়ুলসহ ননা জাতের প্রাচীন বৃক্ষ। এসব গাছের মাথায় বসে বিলের দিকে সুতীক্ষ্ণ নজর রেখে চলত কোড়া, মাছ মুড়াল আর শঙ্খচিল। কোথাও মাছের অস্তিত্ব চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা দ্রুত বেগে নেমে আসত বিলের জল লক্ষ্য করে। তারপর শক্ত নখরে শিকারকে আঁকড়ে ধরে আকাশে উড়ে যেত। কুড়া আর মাছ মুড়াল শোল আর গজারের মতো বড় বড় মাছ ধরে নিয়ে যেত। শঙ্খচিলের শিকার ছিল টেংরা, টাকি কিংবা পুঁটি মাছ। যে যে রকম আকৃতির, তার শিকারও সেই মাপের। মাছ ধরার পাশাপাশি আমি ওদের শিকার ধরার কৌশল পর্যবেক্ষণ করতাম।
তবে ওখানে একটা বিশেষ পাখি ছিল যে দিনের পর দিন আমাকে অবাক করে যাচ্ছিল। মাছের প্রতি তার তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। পছন্দ ছিল সাপ। কোড়ার চাইতে আকৃতিতে কিছুটা ছোট সেই শিকারি পাখিটি প্রায় সময় প্রাচীন বৃক্ষের মাথা ছেড়ে দ্রুত নেমে আসত বিলের বুকে। পরক্ষণেই ঢোঁড়া কিংবা মেটে সাপ ধরে নিয়ে আকাশে উড়ে যেত। একবার বিলের পাশের ধানখেত থেকে বড় সাইজের একটা সাপকে নিয়ে আকাশে উড়ে যেতে দেখেছি তাকে। সেই দাঁড়াশ কিংবা গোখরা বাঁচার জন্য রীতিমতো লড়াই শুরু করে দিয়েছিল পাখিটার সঙ্গে। দৃশ্যটা আজও যেন চোখে লেগে আছে। সেই থেকেই মনে প্রশ্ন জেগেছিল, একটা পাখির কেন এত আকর্ষণ বিশেষ এক প্রাণীর প্রতি?
পরবর্তী সময়ে কৈশোরে বিস্ময়জাগানিয়া সেই পাখির পরিচয় জানতে পারি। আসলে সে হচ্ছে আমাদের দেশের ইগল পরিবারের এক অন্যতম সদস্য। বেশ বড় আকৃতির এই পাখিকে একসময় বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামেই দেখা যেত। এর নানা ধরনের আঞ্চলিক নাম রয়েছে। কোথাও এরা সাপ ইগল নামে পরিচিত, কেউ বলে সাপমারা চিল, অনেকে ডাকে নাগ ইগল বলে, কারও কাছে পরিচিত তিলাবাজ নামে।
এদের ইংরেজি নাম হচ্ছে Crested Serpent Eagle এবং বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Spilornees Cheela. এই পাখিদের গায়ের রং গাঢ় বাদামি, পেটের রং পিঠের চেয়ে হালকা। ডানা ও পেটজুড়ে রয়েছে সাদা ফোটা দাগ। এদের লেজ কালো। তবে লেজের নিচের অংশের মাঝখানের কিছু জায়গার রং সাদা। এদের দেহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ হচ্ছে এদের মাথার খোপা। এই খোপা বা শিখর সব সময় কিন্তু দেখা যায় না। এটা তাদের ঘাড়ের উপর বিছিয়ে থাকে। কোনো কারণে এরা রেগে গেলে বা উত্তেজিত হলে ঘাড়ের উপর বিছিয়ে থাকা খোপাটা তাদের মাথার উপরে মুকুটের মতো ফুটে ওঠে। তখন দূর থেকেও তাদের সেই আকর্ষণীয় খোপা স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। এই সুন্দর খোপার জন্য অনেকে এদের ডাকে খোঁপা বাজ বলে। অন্যান্য ইগলের মতো এদের রয়েছে শক্ত বাঁকানো ঠোঁট, সূতীক্ষè নগর। এদের পায়ের বেশির ভাগ অংশই পালকহীন।
এই শিকারি পাখিটির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এদের প্রধান খাদ্য সাপ। বিষাক্ত কিংবা নির্বিশ সব ধরনের সাপই এরা ভক্ষণ করে থাকে। বিল হাওরের জলজ সাপ থেকে শুরু করে গোখরা, দাঁড়াশ কিংবা দুধরাজ, কারও এর থাবা থেকে নিস্তার নেই। নাগ-নাগিনী, অর্থাৎ সাপের দুশমন হওয়ার কারণে ওরা খ্যাতি পেয়েছে তিলা নাগ ইগল নামে। তবে এসব ছাড়া এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে মাছ, পাখি, ব্যাঙ, ইঁদুর ইত্যাদি।
তিলা নাগ ইগল একা থাকতে পছন্দ করে। তবে বাসা বাঁধার আগে সঙ্গী খুঁজে নেয়। এদের প্রজননের সময় হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি। বড় গাছের মগডালে বাসা তৈরি করতে পছন্দ করে ওরা। গাছের চিকন শুকনা ডাল সংগ্রহ করে বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। কয়েক দিনের মধ্যে বিশাল আকারের বাসা তৈরি করে ফেলে। তিলা নাগ এত বড় পাখি কিন্তু ডিম পাড়ে মাত্র একটি। ডিমের আকার অনেকটা রাজহাঁসের ডিমের মতো। এদের বাসাটি যদি নিরাপদ স্থানে হয়, তবে এরা বছরের পর বছর ডিম পাড়ার জন্য একই বাসা ব্যবহার করে থাকে।
তিলানাগ ইগলেরা বাসা তৈরির সময় স্ত্রী-পুরুষ দুজন মিলেই কাজ করে থাকে। তবে ডিমে তা দেওয়ার কাজটি একান্ত স্ত্রী পাখিটি করে থাকে। স্ত্রী পাখিটি খাবারের সন্ধানে গেলে পুরুষ বাসার প্রহরায় থাকে। কোন কারণে এদের ডিম নষ্ট হয়ে গেলে, স্ত্রী পাখিটি দুই থেকে সাত সপ্তাহের মধ্যে আরও একটি নতুন ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসার পর বাবা-মা দুজনে মিলে বাচ্চার যত্ন নিয়ে থাকে।
৩০ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। সদ্য ফোটা বাচ্চার গায়ের রং সাদাটে। দেড় মাস বয়সে বাচ্চা উঠতে শিখে। ডিম ফুটে বের হওয়া থেকে পূর্ণ বয়স পর্যন্ত এদের দেহের পালকে বেশ কয়েক ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে।
তিলা নাগের বাসার আশপাশে ছোট আকৃতির নানা জাতের পাখি এসে বাসা তৈরি করে থাকে। এ কাজটি তারা করে থাকে নিজেদের ডিম আর বাচ্চার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। পাখির ছানা এবং ডিমের প্রধান শত্রু হচ্ছে সাপ। কিন্তু তিলা নাগ ইগলের বাসার কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে সাপ নিজেই শিকারে পরিণত হবে; অন্যান্য পাখির এ কথা ভালো করেই জানা আছে।
বর্তমান সময়ে দেশে তিলা নাগ ইগলদের অবস্থা খুবই করুণ। আমার কৈশোরের সেই প্রিয় ধোপাপুর বিলকে পরিণত করা হয়েছে মাছের খামারে। একটাও জলজ উদ্ভিদ আর সেখানে অবশিষ্ট নেই। রোটেনন নামের বিষ ব্যবহার করে মেরে ফেলা হয়েছে দেশীয় মাছসহ সমস্ত জলজ প্রাণী। সারা দেশেই চলছে এই অবস্থা। প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো ইজারা নিয়ে শুরু হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ চাষ। এর ফলে তিলা নাগ ইগলেরা পড়েছে প্রবল খাদ্যসংকটে। খামারমালিকেরা তাদের মাছ রক্ষায় সদা তৎপর। বিগত সময়ে বন্দুক আর এয়ারগানের গুলিতে বহু তিলা নাগের মৃত্যু হয়েছে। তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে বড় বড় গাছ কমে যাওয়া। মানুষ তাদের নিজের প্রয়োজনে একের পর এক প্রাচীন বৃক্ষ নিধন করেছে। এতে করে তিলা নাগ ইগলদের বাসা তৈরির মতো নিরাপদ স্থানের অভাব দেখা দিয়েছে।
একসময় দেশের প্রতিটি বিল হাওরের পাশে তিলা নাগ ইগলের সরব উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এখন আর এদের চেহারা তেমন একটা চোখেই পড়ে না। দ্রুত কমে আসছে এদের সংখ্যা। এ অবস্থা সমান্তরালভাবে চলতে থাকতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এরা দেশের প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সুন্দর, বিশাল, সাহসী এই পাখিটি প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। একে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে সকল সচেতন নাগরিককে। পৃথিবী শুধুই আমাদের একার নয়, আমরা যেমন এখানকার বাসিন্দা, ওরাও তাই। ওদেরও আছে বাঁচার অধিকার। তাই নতুন আন্দোলনের ডাক দেওয়ার সময় এসেছে, প্রাকৃতিক জলাশয় এগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে আগের রূপে। বিল হাওরগুলো আবার যেন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে জলজ উদ্ভিদ, নানা জাতের মাছ, জলচর প্রাণী আর পাখির সমারোহে। আর তা না হলে সাজানো প্রকৃতি নষ্ট করার দায় বহন করতে হবে আমাদের সকলকে।