পাসপোর্ট আছে পাসপোর্ট নেই
এয়ারপোর্টে পাসপোর্টহীন ১৮ বছর
মেহরান করিমি নাসিরির জন্ম ১৯৪৫ সালে ইরানের মাসজেদ সোলায়মান নামক স্থানে। তার বাবা আবদেল করিম তেল কোম্পানির ডাক্তার ছিলেন। নাসিরির ভাষ্য, তার বাবা এবং ইরানে কর্মরত একজন স্কটিশ নার্সের বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে তার জন্ম। এই নার্স পরবর্তী সময় গ্লাসগো ফিরে যান। অবশ্য নাসিরির দাবি প্রমাণিত নয়। ১৯৭৩ সালে নাসিরি ব্রিটেনে আসেন, ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে যান। ইরানে শাহবিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৭৭ সালে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বেলজিয়ামে পৌঁছালে সেখানকার জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন তাকে শরণার্থীর মর্যাদা দেয়। কিন্তু পরে তদন্তে জানা যায়, নাসিরিকে কখনো ইরান থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। সেখান থেকে তিনি ব্রিটেন ও ফ্রান্সে আসা-যাওয়া করেছেন। ১৯৮৮ সালে ফ্রান্স থেকে ব্রিটেনে পৌঁছালে নাসিরি পাসপোর্ট বা অন্য কোনো ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট দেখাতে না পারায় তাকে প্যারিসে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্টে নেমে নাসিরি ঘোষণা করেন, তার পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র সফরকালে চুরি হয়ে গেছে। তার ব্যক্তিপরিচিতি ও শরণার্থী পরিচিতি প্রমাণসহ দাখিলে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে এয়ারপোর্টে অবৈধ যাত্রীদের ওয়েটিং এরিয়াতে আটকে রাখা হয়।
এয়ারপোর্টে নাসিরি
বহুদিন এভাবে শার্ল বুরগে নামের একজন মানবাধিকার আইনজীবী তার জন্য লড়াই করতে থাকেন এবং বেলজিয়াম থেকে শরণার্থী মর্যাদার কাগজপত্র ফিরে পাবার আশ্বাস পান; সে ক্ষেত্রে নাসিরিকে ব্যক্তিগতভাবে সেখানে একবার হাজিরা দিতে হবে। কিন্তু নাসিরি তা প্রত্যাখ্যান করেন বরং তার মায়ের খোঁজে ব্রিটেনে প্রবেশ করতে চান। তিনি তার নাম বদলে স্যার আলফ্রেড মেহরান রাখেন এবং পূর্ব নামে কাগজপত্র সই করতে অস্বীকৃতি জানান। তার আইনজীবী শার্ল বুরগে হতাশ হয়ে পড়েন। শুরু হয় নাসিরি কিংবা স্যার আলফ্রেডের এয়ারপোর্টে বসবাস।
অন্যান্য কৌতূহলী যাত্রীরা এগিয়ে এসে তাকে দেখতেন এবং এয়ারপোর্টের কর্মচারীদের কেউ কেউ তাকে ফুড ভাওচার দিতেন। তাতে তার খাওয়াদাওয়া চলে যেত। ২০০৩ সালে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ তার কাহিনির ওপর ভিত্তি করে 'দ্য টার্মিনাল' চিত্রায়িত করেন। কথিত আছে, এ সময় নাসিরিকে ২ লাখ ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়া হয়েছিল।
২০০৬ সালের জুলাই মাসে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং তার এয়ারপোর্ট আবাসন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপরও পুনরায় এয়ারপোর্টে ফিরে আসেন এবং ১২ নভেম্বর ২০২২ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন।
ব্রিটিশ লেখক অ্যান্ড্রু ডলকিনের সহায়তা নিয়ে নাসিরি 'দ্য টার্মিনাল ম্যান' নামে একটি আত্মজীবনীও প্রকাশ করেন। পাসপোর্টহীন এয়ারপোর্ট বাসের মেয়াদ ১৮ বছর।
১৯৯২ সালে ফ্রান্সের একটি আদালত রায় দেন, নাসিরি শরণার্থী হিসেবে বৈধভাবেই শার্ল দ্যা গল এয়ারপোর্টে প্রবেশ করেছিলেন।
ব্রাজিলের ডেনিস লুই দ্য সুজা ২০০০ সাল থেকে এখন (২০২৩) পর্যন্ত ব্রাজিলের সাও পাওলো আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে অবস্থান করলেও তার পাসপোর্ট নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। পাসপোর্ট হারিয়ে কিংবা পাসপোর্ট নিজেই নষ্ট করে এয়ারপোর্টে আটকে পড়া যাত্রীর কথা হামেশাই শোনা যায়।
স্পিলবার্গের দ্য টার্মিনাল
পৃথিবীতে স্টেটলেস মানুষের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ। রাষ্ট্র না থাকাতে তারা নাগরিক নন। নাগরিক না হবার কারণে তাদের পাসপোর্ট নেই। পৃথিবীতে তারাই সবচেয়ে কোণঠাসা।
একটা সময় ছিল গলাকাটা পাসপোর্টেও লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্ট ডিঙিয়ে শহরে প্রবেশ করে বছরের পর বছর বিলেতবাস করা যেত, নাগরিকত্বও মিলত। গলাকাটা পাসপোর্টের দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
ভারতবর্ষে পাসপোর্ট
খ্রিষ্টজন্মের তিন শতক আগে ভারতবর্ষে পাসপোর্ট চরিত্রের একটি দলিলের উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য। তার অর্থশাস্ত্রের দ্বিতীয় গ্রন্থে লিখেছেন, দেশে আগমন বা প্রত্যাগমনের জন্য এক মাশা মূল্যমানের একটি পাস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুকূলে জারি করা হয় এবং সেই পাস বা অনুমতিপত্রে মুদ্রাধ্যক্ষের সিলমোহর প্রদান করা হয়।
প্রথম মহাযুদ্ধ পৃথিবীর নাগরিক ব্যবস্থাপনার চিত্রটি পালটে দিল। তার আগে কার্যত যেকোনো মানুষ যেকোনো দেশে সফর করতে পারতেন, ইচ্ছেমতো অবস্থান করতে পারতেন। আর স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়া মানেই নাগরিকত্ব লাভ। তারপরও সীমান্ত সুরক্ষিত হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হবার পর ১৯৪৫ থেকে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাসপোর্ট
১৯২০ সালের আগে ব্রিটিশ ভারতীয় পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে কি না, সন্দেহ রয়েছে রাজা রামমোহন রায় কিংবা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে কালাপানি পাড়ি দিয়ে ম্লেচ্ছদের দেশ ব্রিটেনে কেউ যেতে পারে, এটা ছিল রীতিমতো দুঃস্বপ্নের মতো। যখন সফর কিছুটা সহজ হয়ে এল, তখনো মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে কোন দুঃখে বসত করব, সেটা ছিল বড় প্রশ্ন।
১৯২০ দশকে ১ রুপি ফি দিয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা যেত এবং পাসপোর্ট অফিস বিধি মেনে ৫ বছরের জন্য পাসপোর্ট ইস্যু করত। ১৯৩৩ সালে পাসপোর্টের জন্য ফি বাড়িয়ে ৩ রুপি করা হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলেও পরবর্তী ২০ বছর পাসপোর্টের অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। ভিসা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল বেপরোয়া স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা। তারা অবাঞ্চিত নাগরিক আখ্যা দিয়ে পাসপোর্টে আবেদন খারিজ করে দিতে পারতেন। বর্ণপ্রথাও বহুলাংশে বিদ্যমান ছিল। নিম্নবর্ণের হিন্দু কিংবা পেশাগতভাবে কুলি শ্রেণিভুক্ত নাগরিকও কর্মকর্তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতায় পাসপোর্ট পাবার অযোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। এটাও সত্য, পাসপোর্ট একটি রাজনৈতিক দলিল। পাসপোর্টধারী রাষ্ট্রের প্রত্যয়ন গ্রহণ করেই ভিন্ন দেশে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে প্রবাসে পাসপোর্টধারীর আচরণ ও কর্মকা-ের দায় রাষ্ট্রকেও কমবেশি বহন করতে হয়। সে ক্ষেত্রে নাগরিকদের আকাক্সিক্ষত গতিশীলতা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দেওয়া হয়।
১৯৬৭ সালের ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় (৫ সদস্যের বিচারকের দুজন যদিও বিরোধিতা করেছেন) স্পষ্ট ঘোষণা করল যে পাসপোর্টপ্রাপ্তি এবং বিদেশগমনের অধিকার জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এখানে ভারতীয় সংবিধানের ডকট্রিন অব ইকুয়ালিটি প্রযোজ্য হবে।
আলবার্ট আইনস্টাইনের পাসপোর্ট
পাকিস্তান স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দিনই, ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ প্রথম পাসপোর্ট ইস্যু করে। শুরুতে পাসপোর্টের ওপর লেখা ইন্ডিয়া কেটে পাকিস্তান বসানো হতো। ১৯৪৯ সালে প্রথম পাকিস্তান মুদ্রিত পাসপোর্ট ইস্যু হতে শুরু করে পাকিস্তান পাসপোর্ট উর্দু, বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় লেখা থাকত। ১৯৫০ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুই সরকারের সম্মতিতে কেবল ভারতে বা পাকিস্তানে ভ্রমণের জন্য 'ইন্ডিয়া-পাকিস্তান' স্পেশাল পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়, তা ১৯৬০ দশকের শুরুতেও বিদ্যমান ছিল। ১৯৫৪-তে পাসপোর্টের রং করা হয় গাঢ় সবুজ। ১৯৫৬-তে পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষিত হলে পাসপোর্ট পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু ১৯৫৮-তে সেনানায়ক আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে ইসলামিক বর্জন করে করলেন রিপাবলিক অব পাকিস্তান। ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে যাবার পর পাসপোর্ট থেকে সকল বাংলা লেখা অপসারণ করা হয়। ২০০০ সালে পাসপোর্ট ইসলামিক যোগ করে ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরপর পুরোনো পাকিস্তানি পাসপোর্টের ওপর বাংলাদেশ ছাপ মেরে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৯ নং আদেশ বাংলাদেশ পাসপোর্ট অর্ডার, ১৯৭৩ জারি হবার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মুদ্রিত পাসপোর্টের ব্যবহার শুরু হয়। কেবল ভারত সফরের জন্য সে সময় মেরুন রঙের পাসপোর্ট চালু হয়। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজশনের চাহিদা পূরণের জন্য বিশেষ পাসপোর্ট রহিত হয় এবং আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট সকলের জন্য প্রযোজ্য হয়। এখন তিন ধরনের পাসপোর্ট প্রচলিত: সাধারণ, দাপ্তরিক ও কূটনৈতিক। কূটনৈতিক পাসপোর্টের রং লাল বলে এটা লাল পাসপোর্ট নামেও পরিচিত। ২০১৫-এর মধ্যে হস্তলিখিত সকল পাসপোর্ট প্রত্যাহার করে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট চালু করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ২০২০-এর জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ই-পাসপোর্টও ইস্যু করতে শুরু করেছে।
পাসপোর্টহীন খালাসি ও লস্কর প্রজন্ম
১৬৬০ থেকে কার্যকর ন্যাভিগেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী এশিয়ার কোনো দেশে ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ গেলে তার ৭৫ ভাগ কর্মী ব্রিটিশ হতে হবে। বিশেষ করে ভারতে আগত জাহাজের ব্রিটিশ খালাসি ও লস্করদের একাংশ ভারতেই থেকে যেত। সামুদ্রিক অসুস্থতা ও কষ্টকর কাজের জন্য অনেকেই ফিরে গিয়ে দ্বিতীয়বার জাহাজে উঠত না। বেতন স্বাভাবিকের অর্ধেক দিলেও ভারতীয়রা আগ্রহী হয়েছে। বিশেষ করে বাংলা, আসাম ও গুজরাটের খালাসিরা ১৯৬০ দশক পর্যন্ত ব্রিটিশ জাহাজে চাকরি অব্যাহত রেখেছে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ জাহাজে লস্করের সংখ্যা ছিল ৫১৬১৬ এবং তাদের অধিকাংশই বাঙালি। তাদের প্রায় ৮০০০ স্থায়ীভাবে ব্রিটেনে রয়ে যায়। ষাটের দশকেও ট্র্যাভেল পাস নিয়ে বহুসংখ্যক বাঙালি ব্রিটেনে পৌঁছান। তত দিনে পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদির কড়াকড়ি শুরু হলে বন্দরের কাছে জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়েও অনেকে ব্রিটেনে ঢুকেন। ব্রিটেনে স্থায়ী বসতি স্থাপন যারা করেছেন, তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান, তাদের কেউই পাসপোর্টধারী ছিলেন না। বিভিন্ন সুযোগে তারা স্থায়ী ব্রিটিশ নাগরিক হয়েছেন এবং সেখানকার অর্থনীতিতে অবদানও রেখে চলেছেন।
ভারতীয় লস্কর বাবা এবং ইংরেজ মায়ের সন্তান আলবার্ট মেহমেত মোহাম্মদের জন্ম ১৮৬৮ সালে। মিশ্র জন্মের আলবার্ট একজন ফটোগ্রাফার, শিক্ষক এবং মেথোডিস্ট ধর্মযাজক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পূর্ব লন্ডনের পপলারে দরিদ্রজীবন ও জীবন সংগ্রাম নিয়ে একটি বইও লিখেন: 'ফ্রম স্ট্রিট আরব টু প্যাস্টর'। লস্কর পেশার তার ভারতীয় বাবা ব্রিটিশ জাহাজে ভারত ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করেন এবং মা অ্যালকোহল আসক্ত হয়ে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ার অপরাধে গ্রেপ্তার হলে আলবার্ট বাস্তবিকই পরিত্যক্ত হন। পরে তিনি ওয়েলসে একজন চিকিৎসকের গৃহভৃত্য হন, কিন্তু অসদুপায়ে কামাই করার অপরাধে চাকরিচ্যুত হন। পরে স্যামুয়েল গুচ নামের একজন চাষি ও শিক্ষকের আশ্রয়ে তার জীবন পাল্টে যায়। তিনি একটি ফটোগ্রাফিক স্টুডিও স্থাপন করেন এবং স্ত্রী পলিনাকে নিয়ে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে মনোযোগ দেন।
ম্যারিলিন মনরোর পাসপোর্ট
আমার বছর চারেকের বিলেত জীবনে জাহাজ থেকে পোর্টসমাউথ বন্দরে সঙ্গোপনে নেমে যাওয়া একজনের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। ব্রিটিশ পুলিশের ও সমাজসেবা দপ্তরের দোভাষী হয়ে কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকজনকে পেয়েছি, যারা বৈধ কিংবা অবৈধ পথে ব্রিটেনে ঢুকেই সবার আগে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ছুড়ে ফেলেছেন, যাতে তাদের শনাক্ত করে ডিপোর্ট করা না যায়। তারা ধরা পড়ার পর শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চেয়েছেন।
ভিসা ছাড়া পাসপোর্ট আলোচনা অর্থহীন। পাসপোর্টধারী যে দেশে যেতে চান, যে দেশের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দূতাবাস আবেদন পরীক্ষা করে সে দেশে যাবার ও অবস্থানের শর্তাবলিসহ পাসপোর্টের পাতায় যে সিলমোহর প্রদান করে, তাই ভিসা। ভিন্ন কোনো দেশে ঢোকার জন্য যে ভিসা লাগে, তা এন্ট্রি ভিসা। সে দেশ ত্যাগের সময় ভিন্ন কোনো ভিসা না লাগারই কথা। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে বিদেশি শিক্ষার্থীরা যখন আসতেন, তারা এন্ট্রি ভিসা দেখিয়ে ঢুকতেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়ার সময় তাদের এক্সিট ভিসা নিতে হতো। ভিসার রকমফের:
ট্র্যানজিট ভিসা: সাধারণত ৩ দিনের, তৃতীয় কোনো গন্তব্যে যাবার সময় মধ্যবর্তী কোনো দেশে অবস্তান।
বিজনেস ভিসা: এর সাথে স্থায়ী চাকরি সম্পর্কিত, বাণিজ্যিক লেনদেন জড়িত।
টেম্পরারি এমপ্লয়মেন্ট ভিসা: অস্থায়ী স্বল্পকালীন চাকরির অনুমোদন।
ভিসা অন অ্যারাইভাল: আগে ভিসা না নিলেও সমস্যা নেই, এয়ারপোর্ট কিংবা বর্ডার কন্ট্রোল পোস্টে ভিসা গ্রহণ করা যায়।
স্পাউজাল ভিসা: স্বামী বা স্ত্রীকে আনার অনুমতি।
ওয়ার্কিং হলিডে ভিসা: ভ্রমণকারীদের কাজ করে কিছু উপার্জনের সুযোগ প্রদান।
ডিপ্লোম্যাটিক ভিসা: কূটনীতিবিদরা পেয়ে থাকেন।
কার্টেসি ভিসা: কূটনৈতিক ভিসা পাচ্ছেন না, কিন্তু মর্যাদাসম্পন্ন হওয়ায় সৌজন্য ভিসা।
জার্নালিস্ট ভিসা: সাংবাদিকদের জন্য, তবে কিউবা, ইরান, উত্তর কোরিয়া দেয় না।
ফিয়াসে ভিসা: প্রমাণিত সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে বিয়ের সুযোগ দিতে প্রদত্ত ভিসা।
ইমিগ্রেন্টস ভিসা: অভিবাসনে অনুমতি প্রদান।
ভিসা প্রত্যাখাত হতে পারে, প্রত্যাখানের অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
পাসপোর্টে এক সিলেই ২৫ দেশ
এক ভিসায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের জন্য সেনজেন ভিসায় অন্তত ২৫টি দেশ সফর করা যায়। এ ধরনের ভিসাকে কমন ভিসাও বলা হয়। ১৯৮৫ সালের সেনজেন চুক্তিতে ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের দেশে সাময়িক সফরকারীদের জন্য একই নীতি অবলম্বন করতে সম্মত হয়। সেনজেন এরিয়া বা সেনজেনল্যান্ড-এ রয়েছে ২৭টি দেশ: অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, ইতালি, ল্যাটভিয়া, লিচেনস্টেইন, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড।
ক্যারিকম ভিসা: ক্যারিবীয় অঞ্চলের ১০টি দেশ ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়: অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারমুডা, বার্বাডোস, ডমিনিকা, গ্রেনাডা, গায়ানা, জ্যামাইকা, সেইন্ট লুসিয়া, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো।
সেন্ট্রাল আমেরিকান সিঙ্গেল ভিসায় চারটি দেশ: গুয়াতেমালা, এল সালভাদর, হন্ডুরাস ও নিকারাগুয়া।
ইস্ট আফ্রিকান সিঙ্গেল ভিসায় তিনটি দেশ: কেনিয়া, তাজানিয়া ও উগান্ডা।
হেনলি গ্লোবাল পাসপোর্ট ইনডেক্স
সোনার বাংলার যত গর্বই আমাদের থাকুক না কেন, বৈশ্বিক পাসপোর্ট সূচকে বাংলাদেশ সম্মানজনক কোনো অবস্থানে নেই। যুক্তরাজ্যের হেনলি গ্লোবাল পাসপোর্ট ইনডেস্কের সূচক মূলত মোবিলিটি স্কোর। এর সারকথা: অপর একটি দেশ বাংলাদেশের পাসপোর্টকে কতটা গুরুত্ব দেয়। ভিসা ছাড়া সে দেশে প্রবেশ করতে দেয় কি না, অন অ্যারাইভাল ভিসা ইস্যু করে কি না, তিন দিনের মধ্যে ই-ভিসা মঞ্জুর করে কি না- এসব সূচকের ওপর পাসপোর্টের মান নির্ভর করে। ২৮ মার্চ ২০২৩ প্রকাশিত হেনলি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ তলানির দশটির একটি। দুর্বলতম পাসপোর্টের দেশগুলো হচ্ছে: ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইরেত্রিয়া, ইরান, প্যালেস্টাইন, লিবিয়া, উত্তর কোরিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সোমালিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তান। তলার ১০টি অবস্থান দখল করে আছে ১৩টি দেশ।
আর পাসপোর্টের শক্তিমত্তার দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত; এ দেশের মোবিলিটি স্কোর ১৮১। দ্বিতীয় অবস্থানে ১১টি দেশের পাসপোটÑসুইডেন, ফিনল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া।
তৃতীয় অবস্থানে ৯টি দেশের পাসপোর্ট- ডেনমার্ক, নরওয়ে বেলজিয়াম, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়া। চতুর্থ অবস্থানে ৭টি- চেক রিপাবলিকান, গ্রিস, হাঙ্গেরি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান ও লিথুয়ানিয়া। পঞ্চম অবস্থানে: সিঙ্গাপুর, স্লোভানিয়া ও মাল্টা। ষষ্ঠ অবস্থানে: এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, স্লোভেনিয়া ও লিচেনস্টেইন। সপ্তম অবস্থানে: আইসল্যান্ড; অষ্টম অবস্থানে: সাইপ্রাস, ক্রোয়েশিয়া, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া এবং নবম ও দশম অবস্থানে যথাক্রমে মালয়েশিয়া ও মোনাকো।
পাদটীকা: হালে পাসপোর্ট ও ভিসা আলোচনার তুঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে কি দেবে না, পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথাই হচ্ছে। লন্ডারিং করা টাকায় যারা সে দেশে সুখের জীবনের ভিত্তি স্থাপন করেছেন, তারা বিচলিত, যারা এ ধরনের অর্থে পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাইছেন, তারাও বিচলিত। কেউ কেউ বলছেন, নাই-বা হলো ভিসা, তাতে কী এসে যায়।
এতেআমার যে কিছু এসে-যায় না, তা নিশ্চিত। ফাইভ ইয়ার্স মাল্টিপল ভিসা পেয়ে একযাত্রায় পাঁচ দিন চার রাত মহাম্লেচ্ছদের দেশ ইউনাইটেড স্টেটসে কাটিয়েছি, ভিন্ন কোনো যাত্রার দরকার হয়নি। যাওয়া যেত, কিন্তু বাপু, গেলেই তো হলো না, থাকব কোথায়? খাব কী?
বেগম পাড়ায় ঠিকানা নেই যে...