মানুষ যেভাবে নিজেকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছে
১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের সামরিক ঘাঁটি ক্যাম্প ডেভেন্সে এক ফ্লু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল। সপ্তাহাখানেকের ব্যবধানে প্রতিদিন ওই ক্যাম্পে গড়ে শখানেক মানুষ টপাটপ মারা পড়তে লাগলেন। এ বিপদের পর নতুন বিপদ- আরও ভয়ানক মহামারি স্প্যানিশ ফ্লু ছড়াতে শুরু করল। এবার কেবল যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সারা বিশ্বে মহামারি শুরু হলো।
পরের বছর যুক্তরাষ্ট্রে মোট মৃত্যুর অর্ধেকেরই কারণ ছিল এই স্প্যানিশ ফ্লু। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, তার সঙ্গে 'মরার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দেখা দিল গ্রেট ইনফ্লুয়েঞ্জা। রণক্ষেত্রে আর ইউরোপের হাসপাতালগুলোতে কয়েক লাখ মানুষ মারা গেলেন এতে আক্রান্ত হয়ে। সব মিলিয়ে সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন এ মহামারিতে। যদি কোভিডের সঙ্গে তুলনা করা হয়- সে সময়ের তুলনায় চার গুণ বেশি জনসংখ্যার বর্তমান পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন এক মিলিয়নের কম মানুষ।
১৯১৬ থেকে ১৯২০ সালের মাঝে বৈশ্বিক প্রত্যাশিত গড় আয়ু হু হু করে কমে যায়। যেমন ওই সময় ইংল্যান্ড বা ওয়েলশের কোনো বাসিন্দার গড় আয়ু ছিল কেবল ৪১ বছর, এ সময়ে এসে যা দাঁড়িয়েছে ৮০-এর কোঠায়। তবে গত শতকের প্রথম ভাগে পশ্চিমা দেশগুলোতে মানুষের আয়ুষ্কাল বাড়লেও ভারত ও চীনের মতো অন্যান্য দেশগুলোতে গড় আয়ু বেড়েছে ওই শতকের শেষ দিকে এসে। শতবছর আগে বোম্বে বা দিল্লিতে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ তার বয়সের বিশের ঘর পেরোতে পারলে তবেই মোটামুটি ভালো একটি গড় আয়ুষ্কাল পেতেন। এখন ভারতে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭০ বছর।
মোদ্দা কথা, স্প্যানিশ ফ্লু শেষ হওয়ার পর থেকে গত শতকে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে দ্বিগুণ। মানুষের কত কী আবিষ্কার, তা ঘিরে কত গল্প! কিন্তু এই যে মানুষ এক শ বছরের ব্যবধানে নিজের গড় আয়ু দ্বিগুণ করে ফেলল- যাকে দিব্যি দ্বিতীয় জীবন বলা যায়- তা নিয়ে কিন্তু অত আলোচনা হয়নি কোথাও, খবরের কাগজগুলো বড় করে প্রথম পাতায় এ নিয়ে খবর ছাপায়নি। কারণ, এ সাফল্য আমাদের চোখে কোনো শারীরিক রূপ নিয়ে ধরা দেয়নি- সাধারণের আগ্রহ আর পাদপ্রদীপের আলো হতে অনেক দূরে থেকে অসংখ্য মহান মননের সামগ্রিক প্রচেষ্টার ফসল এ সাফল্য- মানুষের জন্য মানুষের এক অবিস্মরণীয় উপহার।
মানবজীবনের দৈর্ঘ্যের এ বৃদ্ধি কীভাবে সম্ভব হলো? ইতিহাসের বইগুলো এ নিয়ে তিনটে বিষয়ের কথা বারবার উল্লেখ করে: টিকা, জীবাণু তত্ত্ব, ও অ্যান্টিবায়োটিক। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরও জটিল। বৈজ্ঞানিক এ আবিষ্কারগুলো বিজ্ঞানীরা করেছেন বটে, কিন্তু সবাই যেন এসব আবিষ্কারের সহায়তা পায়, তা নিশ্চিত করতে বিশ্বজুড়ে কাজ করেছেন অ্যাক্টিভিস্ট, বুদ্ধিজীবী ও আইন সংস্কারকেরা। আর তার জন্য প্রয়োজন হয়েছে বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রার এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের- যার কয়েকটি উদাহরণ হলো হাত ধোয়া, ধূমপান বন্ধ করা, টিকা নেওয়া, যেকোনো সংক্রামক মহামারির সময় মাস্ক পরা ইত্যাদি।
আয়ু বাড়ানোর প্রথম ধাপ
১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আগে সারা বিশ্বেই মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৩৫ বছরের ঘর কখনো অতিক্রম করতে পারেনি। আর এত কম গড় আয়ুর পেছনে একটা বড় কারণ ছিল শিশুমৃত্যু ও বালক বয়সে মৃত্যুর উচ্চ হার। প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে দুটিই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে মারা যেত। তবে ১৭৫০ সালের দিকে অভিজাত ব্রিটিশদের গড় আয়ু হঠাৎ করে বেড়ে যেতে শুরু করে। বছরের পর বছর ধরে ব্রিটিশ সমাজের বনেদি ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশিত গড় আয়ুর মধ্যে ফারাক তৈরি হয়। রানি ভিক্টোরিয়ার সময়ে অভিজাত ব্রিটিশদের জন্মকালীন গড় আয়ু বেড়ে ৬০ বছরে দাঁড়ায়।
১৭৫০-এর আগে গড় আয়ুর ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। ওই বছরের আগে ব্রিটেন এবং ইউরোপের অনেক অভিজাত ও রাজন্যবর্গই গুটিবসন্তের মতো রোগের মুখে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু আঠার শতকের মধ্যভাগের পর থেকে হুট করে অভিজাতদের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?
এর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন এডওয়ার্ড জেনার। ভদ্রলোক গুটিবসন্তের টিকা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তখন। তিনি লক্ষ্য করলেন, কেউ একবার গো-বসন্তে আক্রান্ত হওয়ার পর আর গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন না। জেনার তখন গো-বসন্তের গুঁটি থেকে কিছু পুঁজ নিয়ে তা আট বছর বয়সী এক ছেলের হাতে প্রবেশ করালেন। ছেলেটার প্রথমে হালকা জ্বর এল, কিন্তু পরে দেখা গেল গুটিবসন্তের ভাইরাস প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে তার শরীর। এভাবেই জেনারের হাত ধরেই প্রথমবারের মতো মানবদেহে টিকা প্রদানের ঘটনা ঘটে।
তবে ব্রিটিশ অভিজাতদের আয়ুবৃদ্ধির পেছনে আরেকটি প্রাথমিক উদ্ভাবনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আর সেটি ছিল ভেরিওলেশন তথা খোদ আক্রমণকারী ভাইরাসের সংস্পর্শের মাধ্যমে চিকিৎসা নেওয়া। আর এ পদ্ধতি পশ্চিমের কেউ তৈরি করেননি। কিছু তথ্য অনুযায়ী, ভেরিওলেশন খুব সম্ভবত ভারতবর্ষে প্রথম চর্চা করা হয়েছিল। ১৬০০ শতকের মধ্যেই চীন, ভারত ও পারসিয়ায় (অধুনা ইরান) ছড়িয়ে পড়ে সংক্রামক রোগের চিকিৎসার এ পদ্ধতি। এরপর আফ্রিকান দাসেরা বিভিন্ন আফ্রিকান কলোনিতে এ পদ্ধতিটি পরিচিত করান।
ব্রিটেনের এক ডিউকের কন্যা ছিলেন লেডি ম্যারি উর্টলি মন্ট্যাগ। ভদ্রমহিলা বেশ বিদ্বান ছিলেন। ১৭১৮ সালের মার্চে তিনি তার ছোট ছেলেকে ভেরিওলেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করান। নিজেও এ পদ্ধতির বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। তার ছেলে প্রথম কদিন জ্বরে ভুগলেও পরে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে। এই ছেলে শেষে ৬০ বছরের বেশি বেঁচে ছিল। তাকেই টিকা গ্রহণকারী প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার বোনকেও সফলভাবে টিকা দেওয়া হয় ১৭২১ সালে। এ পরিবারের সাফল্য দেখেই প্রিন্সেস অব ওয়েলস তার তিন সন্তানকে টিকা দেন।
লেডি ম্যারির প্রচার-প্রসারেই ভেরিওলেশন ব্রিটেনের ওপরতলার মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। খোদ এডওয়ার্ড জেনারই ১৭৫৭ সালে এ টিকা নিয়েছিলেন। পরে নিজের চিকিৎসকজীবনেও নিয়মিত অনেক রোগীর ওপর ভেরিওলেশনের প্রয়োগ করেছিলেন। তাই বলা যায়, ভেরিওলেশন নিয়ে আজীবন ধারণা না থাকলে জেনার সম্ভবত কখনোই এক ধাঁচের বসন্তের পুঁজ নিয়ে অন্য ধরনের বসন্তের চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করতেন না।
বনেদি ব্রিটিশদের আয়ুষ্কাল বাড়ার পর আরও এক শ বছর লেগেছিল সাধারণ মানুষদের একই সৌভাগ্য পেতে। ওই সময় ভেরিওলেশন ও টিকাদান ধীরে ধীরে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং শহরের শ্রমিকশ্রেণির মাঝে ছড়িয়ে পড়েতে শুরু করেছিল। কিন্তু তখন নতুন এক বিপদ টের পেলে মানুষ- সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচার পর নতুন ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিলো শিল্পায়ন। ব্রিটেনের শিল্পনগরী লিভারপুলে তখন মানুষের আয়ুষ্কাল ছিল গড়ে কেবল ২৫ বছর। ১৯ শতকের প্রথমভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মৃত্যুহার অবিশ্বাস্য রকম বেশি ছিল। দেশটিতে তত দিনে টিকার প্রসার অনেক ঘটেছে, কিন্তু মানুষের গড় আয়ুতে সে ছাপ নেই। আর এসবের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল দুধ! নষ্ট হয়ে গিয়ে শরীর খারাপ করানো থেকে শুরু করে দুধের মাধ্যমে সরাসরি প্রাণী থেকে সংক্রামক রোগ তৈরি হওয়া- দুধপান সব সময়ই স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ ছিল। তখন রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করার কোনো উপায় ছিল না, ফলে একটু গরম পড়লে সহজেই নষ্ট হয়ে যেত দুধ। নারীরা শিল্পকারখানায় কাজ করতেন বলে তাদের সন্তানেরা গরুর দুধের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ ছাড়া ডিপথেরিয়া, টাইফয়েড, স্কারলেট জ্বরের মতো অন্যান্য রোগের কারণও ছিল গোদুগ্ধ।
এবার দৃশ্যপটে লুই পাস্তুর। ১৮৫৪ সালে তরুণ লুই পাস্তুর ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অব লাইল-এ চাকরি শুরু করেন। বিভিন্ন খাবার ও পানীয় কেন নষ্ট হয়ে যায়, তা নিয়ে চিন্তা শুরু করেন তিনি। গবেষণার একপর্যায়ে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে তিনি অ্যাসিটোব্যাকটর অ্যাসিটি খুঁজে পান- এ ব্যাকটেরিয়া ইথানলকে অ্যাসিটিক অ্যাসিডে পরিণত করে। তার এ আবিষ্কারই জীবাণু তত্ত্বের ভিত্তি তৈরি করে। ১৮৬৫ সালে পাস্তুর পাস্তুরায়ন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এ পদ্ধতিতে তিনি ওয়াইনের স্বাদ নষ্ট না করেও অনেক জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম হন। এরপর সারা বিশ্বে দুধের জন্য এ পাস্তুরায়ন পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়, আর প্রাণ বাঁচে অসংখ্য মানুষের। তবে এক রসায়নবিদ এ প্রাণ বাঁচানো টোটকা উদ্ভাবন করলেও তা সবার মধ্যে পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল সাংবাদিকতা, অ্যাক্টিভিজম ও রাজনীতি।
দ্য গ্রেট এস্কেপ
২০ শতকের প্রথম দশকে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু গণহারে সবার জন্য বৃদ্ধি পায়। ওই সময়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের গড় আয়ু ৫০ বছর পার করে। শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোতে লাখো মানুষের জীবনে সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ দেখা যায় প্রথমবারের মতো। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অ্যাঙ্গাস ডিটন এ ঘটনাকে বলেছেন 'দ্য গ্রেট এস্কেপ'। আর এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল বিশ্বব্যাপী অবকাঠামোর উন্নয়ন।
১৯০০-এর দশকের শুরু থেকেই বিশ্বের শহরগুলোতে মানুষেরা তাদের পানীয় জলে আণুবীক্ষণিক পরিমাণে ক্লোরিন খেতে শুরু করলেন। ক্লোরিন বেশি করে পেটে গেলে তা বিষ হিসেবেই কাজ করে, কিন্তু অতি ক্ষুদ্র পরিমাণে ক্লোরিন শরীরে গেলে মানুষের কোনো ক্ষতি হয় না বরং কলেরার মতো রোগসৃষ্টিকারী অনেক ব্যাকটেরিয়া নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা উন্নত অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সহায়তায় ক্লোরিনসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের জীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা পরীক্ষা করতে সক্ষম হলেন। এ ধরনের অনেকগুলো পরীক্ষার পর, জন লিল নামক একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ জার্সি সিটির একটি জলাধারে সবার অগোচরে ক্লোরিন ঢেলে দেন। তার এ কাজের সাফল্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরে জলাধারগুলোতে ক্লোরিন মেশানো শুরু হয়।
একই সময়ে টিকার বিকাশ নিয়েও বিস্তর গবেষণা করা হয়। ১৯১৪ সালে হুপিং কাশির টিকা তৈরি হয়। এরপর ১৯২১ সালে যক্ষ্মা এবং দুবছর পরে ডিপথেরিয়ার টিকা তৈরি করতে শেখে মানুষ। এরপর ১৯৫০-এর দশকে পোলিওর টিকা আবিষ্কার করে বিখ্যাত হয়ে যান জোনাস সল্ক। 'গ্রেট এস্কেপ'-এর ক্ষেত্রে টিকা ভূমিকা রাখলেও গতানুগতিক ওষুধপত্র খুব বেশি কাজে লাগেনি। তখনো এখনকার মতো রাজ্যের ওষুধ ছিল, কিন্তু অনেক ওষুধই কাজ করত না। সেই সময় ওষুধ নির্মাণ, বিপণন ইত্যাদি দেখার জন্য আমেরিকাতেও কোনও সংস্থা ছিল না। বর্তমানে দেশটির সুপরিচিত ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) ১৯০১ সালে জন্মের পর থেকে দীর্ঘ সময় নখদন্তহীন বাঘ ছিলÑসেটা অবশ্য কোনো বাহ্যিক চাপে পড়ে নয়, বরং তখনকার ওষুধ খাতের পরিস্থিতির কারণে।
২০ শতকের মাঝামাঝি এসে অবশেষে ওষুধপত্র মানুষের আয়ু বাড়াতে ভূমিকা রাখতে শুরু করল। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বরে স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। এর ১৭ বছর পরে যুগান্তকারী এ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চাহিদার চাপে প্রচুর পরিমাণ পেনিসিলিন তৈরির জন্য মিত্রপক্ষ ম্যানহাটন প্রজেক্টের মতোই একটি কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছিল। তবে ফ্লেমিং নয়, পেনিসিলিনের জীবন রক্ষাকারী ভূমিকার কথা টের পেয়েছিলেন দুই অক্সফোর্ড বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরি ও আর্নস্ট বরিস চেইন।
পেনিসিলিনের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিয়ে সীমাবদ্ধতার মুখে পড়তে হয় তাদের। ফ্লোরি এ সমস্যা সমাধানে মার্কিনদের সাহায্য চান। রকফেলার ফাউন্ডেশন-এর প্রধান ওয়ারেন ওইভার তাকে এ গবেষণার তহবিল দিতে রাজি হন। ১৯৪১ সালের ১ জুলাই ফ্লোরি ও তার অক্সফোর্ড দল বিশ্বের মোট পেনিসিলিনের বড় একটি অংশ সঙ্গে নিয়ে আমেরিকার বিমানে চড়ে বসেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের পেরিয়া শহরের এক গবেষণাগারে তারা কাজ শুরু করার পর মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীও তাদের গবেষণায় সহায়তা করতে শুরু করে। কারণ, আমেরিকার তখন এমন এক ওষুধের প্রয়োজন, যা ইউরোপে তার সেনাদের প্রাণঘাতী সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করবে।
মোল্ড ছত্রাক থেকে পেনিসিলিন তৈরির কাজ শুরু করেন তারা। পরে তারা আরও দ্রুতহারে পেনিসিলিন তৈরির জন্য অন্য উপাদান খুঁজতে শুরু করলেন। মার্কিন সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাটি সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও এ অভিযান চলতে থাকে। তবে ১৯৪২ সালে পেরিয়াতেই এক জাতের খরমুজের মধ্যে একধরনের ছত্রাক পাওয়া গেল, যা থেকে আরও দ্রুত পেনিসিলিন তৈরি করা সম্ভব। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির অগ্রসর উৎপাদনপ্রক্রিয়া ব্যবহার করে পর্যাপ্ত পরিমাণে পেনিসিলিন উৎপাদন করা হয়। ১৯৪৪ সালের ৬ জুন নরম্যান্ডিতে অবতরণের সময় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র-রসদের পাশাপাশি পেনিসিলিনও ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে পেনিসিলিনসহ অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হয়। বিশ্বব্যাপী মানবস্বাস্থ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে এসব আবিষ্কার। যক্ষ্মার মতো রোগ থেকে মানুষ প্রায় পুরোপুরি মুক্তি পায়। ছোটখাটো কাটাছেঁড়া মারাত্মক সংক্রমণে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি বন্ধ হয়। বড় বড় অস্ত্রোপচারের দ্বারও উন্মুক্ত করে দেয় এ অ্যান্টিবায়োটিকগুলো। চিকিৎসকেরা এরপর থেকে কার্যকর ওষুধ রোগীর ওপর ব্যবহার শুরু করতে পারলেন। ছোটখাটো অস্ত্রোপচারের সময় কোনো প্রাণঘাতী সংক্রমণের কারণ হয়ে ওঠাও বন্ধ করে এসব অ্যান্টিবায়োটিক।
বাংলাদেশের সাফল্য
অ্যান্টিবায়োটিকের গণহারে উৎপাদন শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে বৈশ্বিক গড় আয়ুর হিসেবে বিপুল বৈষম্য দেখা দেয়। ১৯৫০ সালে ভারতে ও আফ্রিকার বেশির ভাগ অঞ্চলে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৩৫ বছরের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু একই সময়ে গড়পরতা একজন মার্কিন ৬৮ বছর পর্যন্ত বাঁচার আশা করতে পারতেন- স্ক্যান্ডিনেভীয়দের তত দিনে গড় আয়ু ৭০ বছর পার হয়ে গিয়েছে। তবে উপনিবেশ-পরবর্তী সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গড় আয়ু ক্রমে বাড়তে থাকে। এর পেছনে যেমন কৃত্রিম সার, 'সবুজ বিপ্লবের' ভূমিকা ছিল, তেমনিভাবে ছিল অন্য দেশ থেকে আমদানি করা ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদির অবদানও। কিন্তু এসবের মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে জ্বলজ্বল করবে গ্লোবাল সাউথের একান্ত নিজস্ব আবিষ্কার ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি (ওআরটি)।
দরিদ্র দেশগুলোতে প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল কম থাকার অন্যতম কারণ ছিল কলেরা। কলেরা হলে রোগীর শরীরে পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) তৈরি হতো, ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য ঠিক থাকত না। অনেক সময় কলেরা মারাত্মক রূপ নিলে রোগীর শরীরের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ওজন নাই হয়ে যেত। ১৯২০-এর দশকের মাথায় হাসপাতালগুলোতে আইভি (ইন্ট্রাভেনাস) ফ্লুইড দিয়ে কলেরা রোগীর চিকিৎসা করাটা সাধারণ পদ্ধতি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ বা লাগোসে গ্রামের পর গ্রাম কলেরায় উজাড় হয়ে যাওয়ার সময় আইভি ফ্লুইড দিয়ে রোগী বাঁচিয়ে রাখার উপায় ছিল না। আর তা ছাড়া এসব অঞ্চলে দক্ষ চিকিৎসকের অভাব তো ছিলই। ২০ শতকের প্রথম ছয় দশকে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশের কয়েক লাখ মানুষÑযার মধ্যে বেশির ভাগ শিশু মারা গিয়েছিলেন।
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ভারত, ইরাক ও ফিলিপাইনের কিছু চিকিৎসক ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপির পক্ষে পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়েও কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি, কারণ তখনো এ চিকিৎসাকে 'অগ্রসর চিকিৎসাপদ্ধতি' হিসেবে দেখা হতো না। দীর্ঘ সময় ধরে লবণ, পানি ও চিনির ওআরটি চিকিৎসাব্যবস্থা হালে পায়নি দুর্ভাগ্যজনকভাবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় অবশেষে দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটে। যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শরণার্থী ভারতের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী ক্যাম্পে অবস্থান নেন। বনগাঁর বিভিন্ন শিবিরে ভয়ানক কলেরার মুখে পড়েন শরণার্থীরা।
দিলীপ মহলানবিশ ছিলেন জনস হপকিন্স থেকে পাস করা ডাক্তার ও গবেষক। কলকাতায় গবেষণার কাজ স্থগিত রেখে তিনি চলে গেলেন কলেরাক্রান্ত শিবিরগুলোতে। দেখলেন, রোগীরা একে অপরের গায়ে গা লাগিয়ে হাসপাতালের মেঝেতে অবস্থান নিয়েছেন, সেই মেঝে আবার তাদেরই তরল বিষ্ঠা ও বমিতে পরিপূর্ণ। মহলানবিশ বুঝলেন, আইভি পদ্ধতি ব্যবহার করে এখানে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। 'তাদের বমি আর বিষ্ঠার ওপর হাঁটু গেড়ে বসে তাদের আইভি স্যালাইন দিতে হতো,' পরে বলেছিলেন মহলানবিশ। তাই তিনি তথাকথিত 'অনগ্রসর ও নিম্ন প্রযুক্তির' ওআরটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলেন। মহলানবিশের অধীনে শরণার্থী শিবিরের প্রায় ৩,০০০-এর বেশি রোগী ওআরটি গ্রহণ করেন। এ পদ্ধতি দারুণ সফল হলো: রোগীর মৃত্যুহার ৩০ শতাংশ থেকে কমে মাত্র ৩ শতাংশে নেমে এল।
এ ঘটনার সাফল্যে মহলানবিশ ও তার দল ওআরটি নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে একটি শিক্ষামূলক ক্যাম্পেইন শুরু করেন। তারা লবণ ও গ্লুকোজ পানিতে মেশানোর প্রক্রিয়া লিখে প্যাম্পলেট ছাপিয়ে সীমান্তের শরণার্থীদের মধ্যে দিতে শুরু করলেন। বাংলাদেশের একটি গেরিলা রেডিও স্টেশনেও তা প্রচার করা হলো। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় এক দশক পরে স্থানীয় একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক সারা দেশের ছোট ছোট গ্রামগুলোতে ওআরটি ছড়িয়ে দিতে চমৎকার একটি পরিকল্পনা হাতে নেয়। একজন রাঁধুনি, ও একজন পুরুষ তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ১৪ জন নারীর বিভিন্ন দল গ্রামে গ্রামে গিয়ে লবণ, পানি ও চিনি মিশিয়ে কীভাবে খাবার স্যালাইন তৈরি করতে হয়, তা দেখাতে শুরু করলেন। এ পাইলট প্রকল্পে উৎসাহব্যঞ্জক সাফল্যের পর তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার দেশের কয়েক শ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওরাল হাইড্রেশন সল্যুশন সরবরাহ করতে শুরু করে।
বাংলাদেশের এ সাফল্য বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও অনুসরণ করা হয়। গ্লোবাল সাউথে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে ইউনিসেফ-এর প্রকল্পে ওআরটি এখন একটি মৌলিক অংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায়ও স্থান পেয়েছে এটি। ল্যানসেট এটিকে '২০ শতকের সম্ভাব্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল অগ্রসরতা' হিসেবে অভিহিত করেছে। ১৯ শতকে কলেরায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মারা যাওয়ার কথা জানা যায়। কিন্তু ২১ শতকের প্রথম দশকে আট গুণ বেশি জনসংখ্যার এ পৃথিবীতে ৬৬ হাজারের কম মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
বিশ্বজুড়ে যেসব অর্জনের দরুন দ্য গ্রেট এস্কেপ সম্ভব হয়েছিল, তার মধ্যে একটি গুটিবসন্ত নির্মূল করা। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের ভোলা দ্বীপে বাস করা শিশু রহিমা বানুর শরীরে সর্বশেষ বারের মতো গুটিবসন্তের ভাইরাস ভ্যারিওলা মেজর আক্রমণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা এ খবর পেয়ে রহিমার চিকিৎসার জন্য ভোলায় একটি দল পাঠান। স্থানীয় মাঠকর্মীদের সহায়তায় ওই দলটি রহিমা বানুর বাড়ির চারপাশের দেড় মাইলের মধ্যে থাকা ১৮,১৫০ জনকে টিকা দেন। রহিমা বানু গুটিবসন্ত থেকে বেঁচে যায়, এবং দ্বীপের মধ্যে টিকাদানের কারণে ভাইরাস আর কোথাও ছড়াতে পারেনি। এর চার বছর পর ১৯৭৯ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে গুটিবসন্ত পুরোপুরি নির্মূল করার ঘোষণা দেয়। এটি ছিল মানবসভ্যতার একটি প্রকৃত মহান অর্জন। ১৯৭৯ সালের ৯ ডিসেম্বরকে চাঁদে পা রাখার দিনের মতো করে আমাদের মনে রাখা উচিত।
এডওয়ার্ড জেনারের সময় টিকাদানের পৃষ্ঠপোষকেরা সারা পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন 'শয়তানের ক্যাটালগ' থেকে গুটিবসন্ত দূর করার কথা লিখেছিলেন। কিন্তু ১৮০০-এর দশকে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে লড়াইটা ছিল রোগী থেকে রোগী পদ্ধতিতে। তখন সারা বিশ্ব থেকে এ রোগ দূর করা কার্যত অসম্ভব ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হলো কী করে? তার একটি মূল প্রভাবক ছিল গুটিবসন্তের ভাইরাসকে বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝতে পারা।
জীবাণুবিদেরা বুঝতে পেরেছিলেন, ভ্যারিওলা মানবদেহের বাইরে টিকে থাকতে পারে না। এ জ্ঞানের কারণে ভাইরাসটি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তারা আরও এগিয়ে গেলেন। একবার মানুষ থেকে এ ভাইরাস পুরোপুরি দূর করতে পারলেই এটি নিয়ে আর কোনো আশঙ্কা থাকবে না। তবে এ নির্মূল অভিযানে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) পরামর্শক উইলিয়াম ফেগি 'রিং ভ্যাক্সিনেশন' পদ্ধতি চালু করেছিলেন। এ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে গুটিবসন্তের সংক্রমণ এলাকায় সবাইকে গণটিকা না দিয়েও বসন্ত নির্মূল করা যেত।
আগে গণটিকা দেওয়ার জন্য ব্যয়বহুল 'জেট ইনফেকটর' ব্যবহার করা হতো। তার স্থলে পরবর্তী সময়ে কম জটিল প্রযুক্তির 'বাইফারকেটেড' সুচ ব্যবহার শুরু হলে টিকা দেওয়া আরও সহজ হয়। এটিতে যেমন টিকার পরিমাণ কম লাগত, তেমনি টিকাদানে বিশেষজ্ঞ নয় এমন কেউও এ সুচ ব্যবহার করে টিকা দিতে পারতেন। এ ছাড়া ১৯৫০ সালে এমন টিকা তৈরি করা হয়, যেগুলো রেফ্রিজারেটর ছাড়াই ৩০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেত। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে টিকা সরবরাহে বিরাট সুবিধা তৈরি হলো।
এর পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা সিডিসির মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সৃষ্টিও বিশ্বব্যাপী এ ধরনের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। রোগ নির্মূলের ক্ষেত্রে যতটা বাইফারকেটেড সুচ বা অন্য যেকোনো আধুনিক প্রযুক্তি অবদান রেখেছিল, তেমনিভাবে এটি বৈশ্বিকভাবে বিস্তৃত এসব প্রাতিষ্ঠানিক নেটওয়ার্কের ওপরও বড় অংশে নির্ভরশীল ছিল। হয়তো জনস্বাস্থ্যের এসব প্রতিষ্ঠানের আটলান্টা বা জেনেভার বড় বড় সদর দপ্তরে গুটিবসন্ত নির্মূলের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, কিন্তু সে স্বপ্নকে বাস্তবরূপ দিতে দরকার হয়েছিল অসংখ্য গ্রামবাসীকে, মাঠকর্মীকে।