কুন্ডেরাকথা
লেখকের একমাত্র নৈতিকতা হলো জ্ঞান—হার্মান ব্রক
মিলান কুন্ডেরা চেয়েছিলেন, তার বইয়ের পরিচিতিতে তার সম্পর্কে লেখা থাকবে শুধু দুটি বাক্য: চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্ম। ১৯৭৫ সাল থেকে ফ্রান্সে বসবাস। আর কিছু লেখার দরকার নাই, লেখক সম্পর্কে বা তার জীবন ও চিন্তা সম্পর্কে কিছু না। তার কাজই সবটা বলে দেয়। বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের বিশ্বসাহিত্যের ক্ল্যাসিক দু-তিনটি উপন্যাস ও প্রবন্ধের বই কুন্ডেরার লেখা: 'দ্য জোক' (ঠাট্টা, ১৯৮৬) এবং 'টেস্টামেন্টস ব্রিট্রেড' নামের প্রবন্ধগ্রন্থ। স্বদেশ চেকোস্লোভাকিয়া যখন স্তালিনের রাশিয়ার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়, সেই সময়কালের উদ্দীপ্ত কমিউনিস্ট মিলান কুন্ডেরা পরবর্তীকালে যাবতীয় আদর্শবাদকে নিকুচি করেছেন এবং জীবনভর নিজেকে আড়ালে রেখেছেন প্রেস, মিডিয়া ইত্যাদি থেকে। তার চাওয়া দুটি বাক্যের সাথে এখন তার নামের পাশে আর একটি অন্তিম বাক্য জুড়ে গেল: চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্ম। ১৯৭৫ সাল থেকে ফ্রান্সে বসবাস করেছেন। ২০২৩ সালে প্যারিসে মারা যান।
২.
১৯৬৮ সালে তাহা বসন্ত নামে যে গণ-আন্দোলন সংঘটিত হয়, তার অংশ ছিলেন কুন্ডেরা। সমাজতন্ত্রের মানবিক চেহারাটা দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল দখলদার রুশ বাহিনীর ট্যাঙ্কের তলায়। কমিউনিস্ট অপশাসনের শিকার চরম হতাশাব্যঞ্জক উদ্ভট জীবনের কাছ থেকে শেখা পাঠকে সমূল করে হার্মান ব্রক, রাবলে, সের্বান্তেস, কাফকা, মুসিল এবং সারোশ্লাভ হাসেক প্রভৃতি ঔপন্যাসিকদের অনুপ্রেরণায় লিখলেন একটি উপন্যাস, যার নাম 'দ্য জোক'। পাণ্ডুলিপিটি প্যারিসের বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গালিমার্ডের কাছে গিয়ে পৌঁছলে তারা সেটি ছাপায়। বাকিটা ইতিহাস। তর্জমার কল্যাণে এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে কুন্ডেরা পরিচিতি পান সারা দুনিয়ায়। গালিমার্ড প্রকাশনা সংস্থার অসামান্য ক্ল্যাসিক সিরিজ লা প্লেইয়াদের (সপ্তর্ষি) লেখক তালিকায় জীবিত অবস্থাতেই কুন্ডেরার নাম যুক্ত হয়েছে, যা বিরল এক ঘটনা।
কুন্ডেরা লিখতে শুরু করেন চেক ভাষায়। আটের দশকের শেষ থেকে লেখা শুরু করেন ফরাসিতে। সেন্ট্রাল ইউরোপের দিকপাল লেখকদের একজন কুন্ডেরা, যে তালিকায় আছেন কাফকা, রবার্ট মুসিল, হার্মান ব্রক, যারোশ্লাভ হাসেক, বহুমিল হাবাল প্রভৃতি। জন্মেছিলেন ১৯২৯ সালে, চেকোস্লোভাকিয়ার বর্নোতে। ফ্রান্সে নির্বাসনে চলে যাওয়ার পর সাতের দশকের শেষে চেক কমিউনিস্ট সরকার তার চেক জাতীয়তা কেড়ে নেয়, ২০১৮ সালে আবার তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালে চেক জাতীয় পুরস্কারে এবং ২০২১ সালে কাফকা পুরস্কারে তাকে সম্মানিত করে স্বদেশ। তার বইপত্র জন্মস্থান বর্নোর গণগ্রন্থাগারে দান করে গেছেন।
৩
সেন্ট্রাল ইউরোপের আধুনিক কালের ইতিহাসটা (সাম্রাজ্যের পতন, ছোট ছোট জাতিরাষ্ট্রের জন্ম, গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, জার্মান রুশ ভোগদখল, সমাজতন্ত্রের আকাক্সক্ষা, স্তালিন যুগের ত্রাস, দেশান্তর) কিছুটা জেনে নিয়ে কুন্ডেরার ফিকশনের জগতে প্রবেশ করলে বরং লাভই হবে। সেন্ট্রাল ইউরোপের একটি দেশে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠে তারুণ্যে যে কদর্য বাস্তবতা অবলোকন করেন কুন্ডেরা, তারই প্রতিফলনে ব্যক্তিমানুষকে নিয়ে দার্শনিক ও অস্তিত্ববাদী প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন একদিন। কর্তৃত্ববাদী বা টোটালাইটারিয়াল রাষ্ট্রে ব্যক্তির জীবনের যে সংকট, তা তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। অন্যের চোখের আড়ালে কেউ আর যেতে পারছে না, তার সবটাই উন্মুক্ত। গোপন বলে কিছু আর নেই। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, চিন্তাভাবনা, শিল্পকলার চর্চা গেছে কমে; ব্যক্তির একান্ত জীবন নিয়ে শ্রদ্ধা গেছে চলে, সবাই নজরদারির শিকার। এ রকম বাস্তবতায় কুন্ডেরা সামাজিক জীবন যাপন করেও দশকের পর দশক ধরে নিজেকে ও নিজের ব্যক্তিজীবনকে আড়াল করে রাখতে পেরেছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত, যে জীবনে তার সর্বক্ষণের সঙ্গিনী ছিলেন স্ত্রী ভেরা। আর নিরালায় থেকে মানব অস্তিত্বের অজানা খণ্ডাংশগুলো প্রকাশ করার চেষ্টা করে গেছেন একটার পর একটা সাহিত্যকর্মে। তার কাছে বেঁচে থাকার অর্থই ছিল তাই।
৪
কুন্ডেরার উপন্যাসের ভাষাটি ঠিক কঠিন নয় (মূল চেক না জেনে, তর্জমার ভিত্তিতে কথাটি বলছি)। কিন্তু তার চিন্তার স্তরটি বোধগম্যতার দাবি রাখে। উপন্যাসগুলোতে তিনি খণ্ড খণ্ড করে কাহিনিটি বয়ান করেন, কিন্তু তার মধ্যে থেকেই থাকে দার্শনিক প্রজ্ঞা ও নানা চিন্তা। কাহিনি বলছেন কিন্তু তার মধ্যেই ঢুকিয়ে দিচ্ছেন প্রবন্ধ আর গল্পটি সরলরৈখিকভাবে এগোয়ও না। সময়ের এফোঁড়-ওফোঁড় করেন, মানে কখনো বলা হয় ফরমৎবংংরড়হ, এর চমৎকার নৈপুণ্য দেখি আমরা তার কথাসাহিত্যে। অ্যাকশনের বা নাটকীয় পরিস্থিতির ঐক্যের কোনো বিধান মেনে তিনি উপন্যাস লেখেন না; গুরুলেখক রাবলে, সের্বান্তেস কিংবা স্টার্নের সাথে যেখানে তার বেশ মিল। মানুষের অস্তিত্বের সংকটের কথা বলতে গিয়ে তিনি খুঁজে ফেরেন সত্যকে। কাফকার সার্থক উত্তরসূরি হিসেবে উদ্ভটতার সাথে মিলেমিশে থাকে সমাজবাস্তবতা। দুঃস্বপ্নতাড়িত মানুষের জীবনের কথা ফিকশনে গাঁথতে গিয়ে অনুষঙ্গ হিসেবে বেশি ব্যবহার করেন সংগীত। কোথাও যেন পড়েছিলাম যে তার চেক গদ্যে সংগীতের মূর্ছনার উপস্থিতি। কুন্ডেরার বাবা এবং শ্বশুর দুজনই সংগীতজ্ঞ ছিলেন। এবং প্রাহায় থাকতে তিনি সংগীত তালিমও নিয়েছিলেন। তার ফিকশনের আরেকটি প্রবল উপাদান হলো যৌনতা। যেখানে তার অনন্যতা হলো শ্লেষের ব্যবহার। হাস্যরস সৃষ্টিতে তিনি মাস্টার।
৫
কুন্ডেরা নিজের সৃষ্টিকর্মের ব্যাপারে খুবই সজাগ, সতর্ক এবং খুঁতখুঁতে ছিলেন। অনুবাদ বিষয়ে তার অসামান্য মৌলিক চিন্তার প্রতিফলন আমরা দেখি টেস্টামেন্টস ব্রিট্রেড নামের প্রবন্ধের বইটিতে। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের উপন্যাসগুলো পড়েছেন এবং শুধরে নতুন করে চেক থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করিয়েছিলেন, যা বের হয় ২০২০ সালে। পুরোনো অনুবাদগুলোকে তিনি ভুলে ভরা বলে বাতিল করেন। দিকপাল মার্কিন ঔপন্যাসিক বন্ধু ফিলিপ রথের সাথে প্যারিসে এক আলাপচারিতায় রুশ সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে আলাদা করে তলস্তয়ের কথা বলেন। উল্লেখ করেন যে অন্তর্গত মনোলোগের স্রষ্টা জয়েস নন, বরং তলস্তয়। আন্না কারেনিনা উপন্যাসে আন্না কারেনিনার মৃত্যুর ঠিক আগের অবস্থাটা বর্ণনা করতে গিয়ে তলস্তয় আন্নার স্ট্রিম অব কনশাসনেসের ছবি আঁকেন, যেখানে দেখা যায় যে সে ঘোড়ার গাড়িতে বসা আর তার মনে অযৌক্তিক, খণ্ডিত চিন্তারা ভিড় করছে রাস্তার দৃশ্যের সাথে। কিন্তু এটিকে পাঠ করে বোঝা যায় না; কারণ, তলস্তয়কে ঠিকমতো তর্জমা করে হাজির করা হয়নি—এমনটাই মত দেন কুন্ডেরা। তিনি বলেন যে একবার ফরাসি তর্জমায় তলস্তয়ের এ উপন্যাসের এই অংশটি পড়ে তিনি অবাক হয়েছিলেন। মূল টেক্সটে যা অযৌক্তিক ও খণ্ডিত একটি চিত্র, ফরাসি ওই তর্জমায় তা হয়ে ওঠে যৌক্তিক ও সম্পূর্ণ একটি চিত্র। কুন্ডেরা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের অনুবাদকেরা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তারা আমাদের টেক্সটের অস্বাভাবিক, অদ্ভুত, মৌলিক কিছু থাকলে তা অনুবাদ করেন না ওভাবে, উল্টোটা করেন। তারা ভয় পান, সমালোচকেরা বাজে অনুবাদের জন্য তাদের দোষারোপ করবে। নিজেদের বাঁচাতে গিয়ে তারা আমাদের বারোটা বাজান।
৬
'দ্য আর্ট অব দ্য নভেল' বইয়ে এক কাল্পনিক সংলাপে নিজের সঙ্গে নিজেই মাতেন কুন্ডেরা :
—আপনি কি কমিউনিস্ট, জনাব কুন্ডেরা?
—না, আমি একজন ঔপন্যাসিক।
—আপনি কি বিরোধী মতাবলম্বী?
—না, আমি একজন ঔপন্যাসিক।
—আপনি কি বামপন্থী না ডানপন্থী?
—এটাও না, ওটাও না। আমি একজন ঔপন্যাসিক।
যা ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে, সে অপশক্তির বিরুদ্ধে মানুষের নিরন্তর লড়াইয়ের কথা বলা কুন্ডেরাকে পাঠ করার মধ্য দিয়ে নিজেদেরই আমরা খুঁজে পাই।