অনুবাদকদের গরিব আত্মীয় ভাবার দিন শেষ হয়ে এসেছে: এডিথ গ্রসম্যান
গ্রেগরি রাবাসার পর লাতিন আমেরিকান ও স্প্যানিশ সাহিত্যের সুদক্ষ অনুবাদক হিসেবে প্রথমেই যাঁর নাম মনে আসে, সেই ড. এডিথ গ্রসম্যান (২২ মার্চ ১৯৩৬-৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩) প্রয়াত হলেন সম্প্রতি। গ্রসম্যান দুহাতে অনুবাদ করতেন এবং তা করতেন সাহিত্যের প্রতি গভীর ভালোবাসা, দরদ ও দায় থেকে। কত লেখা, কতজনের লেখাই না তিনি অনুবাদ করেছেন তাঁর এই দীর্ঘ জীবনে। Gabriel García Marquez, Mario Vargas Llosa, Álvaro Mutis, Carlos Rojas, Mayra Montero, Sor Juana Inés de la Cruz, Carmen Laforet, Julián Rios এবং আরও কত বিখ্যাত লেখকদের নাম রয়েছে এই তালিকায়। তাঁর করা Miguel de Cervantes-এর কালজয়ী উপন্যাস 'Don Quixote'-এর অনুবাদ গোটা বিশ্বের অনুবাদ-সাহিত্যের একটি মাইলফলক কাজ হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত।
তাঁর অনন্য সব অনুবাদকর্মের জন্য পুরস্কার, স্বীকৃতি ও সম্মাননাও কম পাননি তিনি জীবদ্দশায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: পেন/রালফ মানহাইম মেডাল ফর ট্রান্সলেশন; অফিসার্স ক্রস অফ দি অর্ডার অফ সিভিল মেরিট বাই দি কিং অফ স্পেন, কুইন সোফিয়া স্প্যানিশ ইন্সিটিউট ট্রান্সলেশন প্রাইজ, গগেনহাইম ফেলোশিপ।
এডিথ গ্রসম্যানের অনুবাদবিষয়ক রচনার সংকলন 'Why Translation Matters' বিশ্বজুড়ে অনুবাদের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অপরিহার্য ও দিকনির্দেশনামূলক গ্রন্থ।
এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা, লেখক ও অনুবাদক সারা টিমার হার্ভে, যা প্রথম প্রকাশিত হয় Asymptote পত্রিকার অক্টোবর, ২০১৯ সংখ্যায়।
প্রশ্ন: আপনি প্রথম থেকেই ঠিক সাহিত্যের অনুবাদক হতে চাননি। আপনি নিজেই লিখেছেন, নেরুদার 'রেসিডেন্স অন আর্থ' পড়াটা 'একটা আবিষ্কারের মতো ছিল, যা আপনার পেশাজীবনের অভিমুখটিকে বৈপ্লবিকভাবে পাল্টে দেয়' এবং আপনার 'জীবনের অর্থই বদলে দেয়।'
এডিথ: হ্যাঁ এটা ঠিক, নেরুদাই আমাকে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন, আমার কাছে 'রেসিডেন্স অন আর্থ'-এর কবিতাগুলোকে অসামান্য ও বিস্ময়কর লেগেছিল; আমি এর আগে এ রকম কবিতা পড়িনি কখনো, আর তাই তখনই সিদ্ধান্ত নিই আমি এর অনুবাদ করব। আমি অনুবাদকই হব। এর আগে সব সময় ভেবেছি, আমি একজন শিক্ষক, সমালোচক হব, হয়তো মাঝেমধ্যে গ্রন্থালোচনা লিখব। অনুবাদ এমন একটা কাজ, যেটা আমি ঘরে বসেই করতে পারি এবং এর মধ্যে একধরনের সুরক্ষার ব্যাপারও জড়িত ছিল। আমাকে আমার মস্তিষ্কের একটা অংশ ব্যবহার করে কোনো নতুন বিষয়কে আবিষ্কার করতে হবে না, কেননা ইতোমধ্যেই বিষয়টার অস্তিত্ব রয়েছে।
প্রশ্ন: এই অনুবাদের প্রকল্পটা কি তাৎক্ষণিকভাবেই সফল হয়েছিল? এর শুরুটা কি বেশ মসৃণ ছিল?
এডিথ: আমি প্রথম যেটা অনুবাদ করি, সেটি ছিল আর্হেন্তিনার লেখক মাসেদোনিও ফের্নান্দেসের একটি রচনা, যিনি বোর্হেসের গুরুর মতো ছিলেন অনেকটা। তিনি মস্তিষ্কের অংশবিশেষ একেবারে মুছে দেওয়ার বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন The Surgery of Psychic Removal নামে। এর সঠিক মেজাজটিকে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে আমার দারুণ আনন্দ হয়েছিল, তাঁর শব্দভান্ডারের কথা না হয় নাই-বা বললাম। আমি ভাবলাম, লাইব্রেরিতে বসে 'গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে' গবেষণা করার চাইতে বরং এই কাজটাই করব।
প্রশ্ন: আপনি লিখেছেন যে, অনুবাদ্য পাঠবস্তুর মূল রূপটিকে 'যতটা গভীরভাবে সম্ভব' আপনি 'শুনতে' চান। তা এই এতগুলো বছরে একটা অনুবাদ শুরু করার আগে পালনীয় কোনো বিশেষ কৃত্য কি উদ্ভাবন করতে পেরেছেন আপনি? আপনি কি প্রতিটা অনুবাদের মুখোমুখি ঠিক একইভাবে হন?
এডিথ: আমি খুব একটা নিয়মতান্ত্রিক মানুষ নই এবং আমি কোনো কাজই সব সময় একইভাবে করি না। কিন্তু যখন আমি পড়ি, তখন আমার মনের একটা অংশও আমার সঙ্গে পড়ে চলে, ফলত লেখাটাকে আমি একই সঙ্গে দেখি ও শুনি। এটাই আমি বুঝিয়েছিলাম যখন ওই কথাটা লিখেছিলাম, কেননা আমি সব সময় সেই বিশেষ কণ্ঠটাকে শুনতে পাই।
প্রশ্ন: সেটা কি আপনার নিজের কণ্ঠ?
এডিথ: হ্যাঁ, এটা আমার নিজের কণ্ঠ। এটা আমি যখন কবিতা কিংবা খুব শিল্পিত কোনো গদ্য পড়ি, তখন ঘটে। আমার একটি কণ্ঠ রয়েছে, যেটি কবিতাটাকে 'বলে' আর একই সঙ্গে আমি সেটিকে 'দেখতে' পারি।
প্রশ্ন: আপনি কতগুলো বেশ পুরোনো লেখা অনুবাদ করেছেন, যেমন লুইস দে গঙ্গোরার 'সোলেদাদেস', যা লেখা হয়েছিল ১৬১৩ সালে। এখানেও কি সেই কণ্ঠটি সহজেই ধরা দেয়? লেখক যে জীবিত নেই, এই সত্যটি কি আপনাকে আরও বেশি জায়গা ও স্বাধীনতা দেয়, তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন, সেটাকে কল্পনা করে নিতে; অনেকটা বোর্হেসেরই ঢঙে, যিনি নাকি তাঁর অনুবাদককে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি যা লিখেছেন, সেটার অনুবাদ না করে-তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন, তার অনুবাদ করতে?
এডিথ: না, আমি তা করি না। আমার একটা দায় আছে, লেখক যা স্প্যানিশ ভাষায় বলেছেন, সেটাকে ঠিকঠাক ইংরেজিতে বলার, তা সেটা অনেক পুরোনো কিংবা একেবারে একুশ শতকের লেখাই হোক না কেন। তবে আপনাকে কিছু কিছু শূন্যস্থান নিজের মতো করে পূরণ করে নিতেই হয়, কেননা কোনো দুটো ভাষাই একে অন্যের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি নয়।
প্রশ্ন: আপনি কি কবি ও অনুবাদক ক্রিস্টিয়ান হকির কাজের সঙ্গে পরিচিত? তাঁর করা গিয়র্গ ত্রাকলের কবিতার নিরীক্ষামূলক অনুবাদের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, 'প্রয়াতদের লেখা পড়া মানে তাঁদের শব্দকে নতুন করে জীবন্ত করে তোলা, আর এই মাঝখানের কণ্ঠটি হচ্ছে একটি মাধ্যম বা অনেকটা ভূতের মতো।' প্রাচীন লেখকদের আপনার পড়া ও অনুবাদ করার অভিজ্ঞতার সঙ্গে কি এর কোনো প্রতিধ্বনি খুঁজে পান আপনি?
এডিথ: এটি আমাকে অনুবাদ করার সময় মূল পাঠ্যের ছায়ার মধ্যে আটকে যাবার কথা মনে করায়। সেই অর্থে আপনিই আসলে সেই ভূত। আর মাধ্যমও বলা যেতে পারে কোনো অনুষ্ঠানের আমন্ত্রক অর্থে, কেননা আপনিই তো পাঠকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন সেই লেখাটি পড়ার জন্য, যা হয়তো তাঁরা কোনো দিনই পড়তেন না। (হাসি)
প্রশ্ন: আপনি ঠিকই বলেছেন। অনুবাদ অনেকটা ইতিপূর্বে অপ্রবেশ্য একটি পরিসরে পাঠকদের প্রবেশের আমন্ত্রণ জানানোর মতোই। তবে আমি এটা বলেছিলাম, সেই প্রয়াত লেখকের সঙ্গে, যিনি এখন তাঁর পাঠবস্তুর সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছেন, একধরনের যোগাযোগ গড়ে তোলার অর্থে, যাঁকে খোঁজা ও খুঁজে পাওয়াটা হয়তো আপনার অনুবাদের কাজটাকে আরেকটু সহজ করে তুলতে পারে।
এডিথ: হয়তো নয়। সেই ধরনের যোগাযোগ অনুবাদ্য পাঠবস্তু বিষয়ে আপনার বোঝাপড়াকে বিঘিœত করতে পারে। আপনি যদি লেখকের মুখ দেখেন, তাঁর কণ্ঠ শুনতে থাকেন, তাহলে হয়তো তাঁর লেখাটিকেই আর দেখবেন না আপনি।
প্রশ্ন: আপনার করা 'সোলেদাদেস' এর অনুবাদ প্রকাশ করেছিল পেঙ্গুইন ২০১০ সালে। সেই সময় আপনি বলেছিলেন, অন্য যেকোনো প্রকাশনার চেয়ে এই প্রকল্পটি নিয়ে আপনি বেশি উত্তেজিত, কেননা এটি আপনি সেই স্নাতকোত্তর পড়াশোনার সময় থেকেই অনুবাদ করার কথা ভাবছিলেন। তা সেই অনুবাদের অভিজ্ঞতাটি কি আপনার প্রত্যাশামাফিক ছিল?
এডিথ: আমার মনে হয়, এটা তারও অধিক ছিল। পাঠবস্তুটি এত অসাধারণ ছিল, আর তিনি এমন দারুণ এক কবি যে তাঁকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার অভিজ্ঞতাটা আমার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর ভাষা অনবদ্য। প্রতিটি শব্দের অভিঘাতের ঊর্ধ্বে তাঁর প্রতিটি পঙ্ক্তিই ছিল আলাদা একেকটি সত্তাবিশেষ, যা কিনা অনুবাদের কাজটিকে প্রচণ্ড কঠিনও করে তুলেছিল।
প্রশ্ন: ঠিক, এ ছাড়া ইংরেজিতে লুইস দে গঙ্গোরার কাজ তেমন অনূদিতও হয়নি যে আপনি সেসবের সঙ্গে একটু মিলিয়ে দেখবেন।
এডিথ: আমার সেগুলো সম্পর্কে জানারও কথা নয়। সত্যি কথা হলো, আমি নিজে অনুবাদ করার সময় অন্য কারও অনুবাদের দিকে তাকিয়ে দেখিনি। কখনোই না। আমার শ্রুতিকে আমি কলুষিত করে তুলতে চাই না। আমি সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে মূল স্বরটিকে শুনতে চাই এবং সেটি নিয়েই কাজ করতে চাই। আমি মাঝেসাঝে অন্যদের অনুবাদ দেখি বটে, তবে অনুবাদ করার আগে কিংবা করার সময় কখনোই নয়।
প্রশ্ন: আপনি কি কখনো আপনার নিজের অনুবাদ শেষ করে অন্য কারও অনুবাদের সঙ্গে সেটা মিলিয়ে দেখতে গিয়ে সেখানে বড় ধরনের কোনো পার্থক্য আবিষ্কার করেছেন?
এডিথ: আমাকে আপনি ঠিক কতটা আত্মগর্বী হতে বলেন?
প্রশ্ন: কেন নয়, আপনি তার চেয়েও বেশি অর্জন করেছেন এত দিনে।
এডিথ: আমি কখনো কখনো অন্যদের অনুবাদের দিকে তাকিয়ে ভাবি: 'মহাশয়, আপনি আসলে কী সব চিন্তা করছিলেন তখন, শুনি?' আমি সাধারণভাবে আমার অনুবাদকেই ভালো মনে করি। এইরে, বলেই তো দিলাম!
প্রশ্ন: আপনি কি সমালোচনা নিতে পারেন?
এডিথ: আমার ভেতর থেকে আমি সমালোচনাকে প্রশান্তভাবে মেনে নিতে পারি না। বাহ্যিকভাবে ঠিক আছে, তবে আমি সমালোচিত হতেই পছন্দ করি না একেবারে।
প্রশ্ন: আপনি কি কখনো সম্পাদকের চাওয়ামতো কোনো কিছু পাল্টানোর প্রবল বিরোধী ছিলেন
এডিথ: আমার সব সম্পাদকই দারুণ ছিলেন। আমি জানি না, তাঁরা আমাকে ভয় পান কি না...
প্রশ্ন: নিশ্চয়ই না; আপনি তাঁদের মুগ্ধ করতে পারেন, ভয় পাইয়ে দেবার ব্যাপারটা আমি বলতে পারি না!
এডিথ: দুটোই হতে পারে, তারা আমার সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো কিছু পাল্টানোর কথা ভাববেই না! (হাসি)
প্রশ্ন: আমি আপনার অনুবাদের যে একটা বিষয় খুব পছন্দ করি, সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই। সেটি হচ্ছে ব্যঙ্গ ও কৌতুকের অনুষঙ্গগুলো অনুবাদে আপনার দক্ষতা। একধরনের ক্রীড়াময়তা আপনার অনুবাদে বরাবর স্পন্দ্যমান। এটি কি আপনি দীর্ঘদিনের চর্চার মধ্য দিয়ে সচেতনভাবে রপ্ত করেছেন? যেমন আপনি বলেছিলেন, তরুণ বয়সে যখন প্রথমবারের মতো 'দন কিহোতে' পড়েছিলেন, তখন সেটাকে একটা বিয়োগাত্মক লেখা ভেবেছিলেন। পরে বড় হয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জনের পর যখন আবার পড়লেন, তখনই কেবল তার কৌতুকময়তার বিষয়টিকে উপভোগ করতে পেরেছিলেন।
এডিথ: সেটা সত্যি। 'দন কিহোতে' আমি যে কতবার পড়েছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যখন এটা প্রথম পড়তে শুরু করি, তখন আমি কলেজের ছাত্রী। কিহোতের কষ্ট এবং সারা দুনিয়া যেভাবে তার পিছু লেগেছিল, সেটা আমার কাছে খুব ট্র্যাজিক ও ভয়ংকর মনে হয়েছিল। আমার যখন আরও বয়স বাড়ল, দীর্ঘদিন বাঁচার অভিঘাতে অনুভূতিগুলোও কিছুটা ভোঁতা হয়ে এল, তখন এটাকে আমার কাছে অবিশ্বাস্যরকম মজার লেগেছিল। আমার মনে হয় সেটা একটা কারণ, কেন বহু লোক এটিকে একটি অসাধারণ গ্রন্থ বিবেচনা করেন। এর মধ্যে সবই আছে, অনিঃশেষ কৌতুক এবং সত্যিকার গভীর বিষাদ।
প্রশ্ন: একদম, তবু আমি মনে করি ব্যঙ্গ, কৌতুক ইত্যাদির ব্যাখ্যা ও অনুবাদ বহু অনুবাদকের জন্যই বেশ কঠিন কাজ। বেলজিয়ান পণ্ডিত জেরোন ভান্ডেলের মতে, এর কারণ-একটা ব্যঙ্গাত্মক লেখার মধ্যে এমন অনেকগুলো উপভাষা, শ্রেণিভাষা, ব্যক্তিভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের সহাবস্থান (ও সংঘাত) এবং লক্ষ্যভাষায় তাদের কোনো সরাসরি সমতুল্য প্রতিশব্দ না থাকা।' তা প্রকারান্তরে অনুবাদককে এমন এক অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়, যখন তিনি মূলের প্রতি 'বিশ্বস্ত' থাকার পথ থেকে বিচ্যুত হতে বাধ্য হন। সেটি ভান্ডেল দাবি করেন, 'অনুবাদকের ওপর এমনই চাপ সৃষ্টি করে যে তিনি একপর্যায়ে হতাশায় নিমজ্জিত হন।' আপনি কি এই জাতীয় হতাশার শিকার হয়েছেন কখনো?
এডিথ: না। এটাই তো অনুবাদের চ্যালেঞ্জ। আপনি একই সঙ্গে একাধিক বাক্ভঙ্গি ও একাধিক স্বরধ্বনি নিয়ে কাজ করছেন, যাকে আপনি ইংরেজিতে রূপান্তরিত করতে চাইছেন। এটাই তো আমাদের কাজ, আর ইংরেজি এমন কোনো আদিম কিংবা অবিকশিত ভাষাও নয়। যা কিছু অন্য ভাষায় অর্জন করা সম্ভব, তা সাধারণত ইংরেজিতেও করা যেতে পারে বইকি।
প্রশ্ন: তবে আপনি আসলেই কৌতুকের অনুবাদে ভীষণ দক্ষ। আমি যদি আওগুস্তো মর্ন্তেরোসোর গল্পগুলোর কথা ভাবি, যেগুলো আপনি অনুবাদ করেছেন, সেগুলো তো রীতিমতো দমফাটানো মজাদার। আপনি মর্ন্তেরোসোর রসবোধের এক চিলতেও হারিয়ে যেতে দেননি... বরং আপনার অনুবাদে মনে হয়েছে, সেগুলো আরও আনন্দময় হয়ে উঠেছে। ব্যঙ্গ ও কৌতুক নিয়ে এ রকম অভ্রান্তভাবে খেলার ক্ষমতা আপনি কীভাবে অর্জন করলেন?
এডিথ: আমার মনে হয়, এই উপাদানগুলো আমার চরিত্রেরই অংশ। তুমি তো আমার ক্লাসে ছিলে। আমি খুব একটা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ নই। আমার স্বভাবের মধ্যেই একটা ব্যঙ্গাত্মক ঝোঁক রয়েছে। আমি অনেক কিছুর মধ্যেই একটা হাসির উপাদানকে দেখতে পাই।
প্রশ্ন: আপনার এই রসবোধটুকু যথেষ্ট স্বীকৃত ও প্রশংসিত। আপনার আশিতম জন্মদিনে পেন-এর অনুবাদ বিভাগ আপনার জন্য বিশাল এক উৎসবের আয়োজন করেছিল এবং আপনার অনেক বন্ধু ও সহকর্মীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আপনার জীবন ও কর্ম নিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য। তাঁদের অনেকেই আপনার অনুবাদের ঔজ্জ্বল্য, কাজের প্রতি আপনার নিষ্ঠা, আপনার ব্যক্তিত্বের উষ্ণতা নিয়ে কথা বলেছেন, পাশাপাশি আপনার কুখ্যাত কৌতুকবোধের কথাও উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ।
এডিথ: তাঁরা সবাই ভীষণ উদার ছিলেন। আসলেই। অনেকগুলো শ্রদ্ধাবাক্যই আমার মুখে হাসি ফুটিয়েছে এবং যা লেখা হয়েছে, তার সঙ্গে সম্মতিসূচক মাথা দোলাতে বাধ্য করেছে, তবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে পেন-এর তখনকার সভাপতি এবং ফারার, স্ট্রস অ্যান্ড জিঁরুও এর প্রকাশক জনাথন গালাসি যা বলেছেন, সেটি আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন: অনুবাদের ব্যাপারে এডিথ গ্রসম্যানের সাহিত্যিক অবস্থানের একেবারে কেন্দ্রভূমিতে যে শক্তিমত্তা ও সাহিত্যের প্রতি দরদ রয়েছে, আমি সব সময়ই তার প্রশংসা করি। আপনারা এটা তাঁর প্রাণশক্তি ও কাজের প্রতি বিশ্বস্ততার মধ্যে দেখতে পাবেন। এডি কোনো পেশাদার নন, যদিও তিনি যা করেন, তার ব্যাপারে সর্বোচ্চ দায়বদ্ধ থাকেন, তিনি শব্দটির আদি অর্থেই একজন অ্যামেচার: তিনি যা করেন, সেটাকে ভালোবাসেন এবং আমরা সবাই তাঁর ভালোবাসার কাজের প্রতি এই সীমাহীন, বাধাহীন দায়বদ্ধতার উপকারভোগী।
প্রশ্ন: আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই গালাসি এই 'অ্যামেচার ইন দি অরিজন্যিাল সেন্স' বাক্যবন্ধটির মাধ্যমে আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
এডিথ: আমি যখন সেটা প্রথম পড়ি, বাক্যের প্রথম কয়েকটা শব্দ, আমি বলে উঠি: 'কী?' এবং আমি খুব রাগান্বিত বোধ করি, কিন্তু যখন আমি আরও পড়তে থাকি, তখন ভাবি তিনি হয়তো এই 'অ্যামেচার' শব্দটার আদি অর্থটাই অর্থাৎ 'কোনো কিছুর অনুরাগী' বুঝিয়েছেন, যেটি আদতেই এই শব্দটার আক্ষরিক অর্থ। তিনি যেটা বলেছেন, সেটা দীর্ঘ মেয়াদে আমার জন্য অবশ্যই প্রশস্তিবাচক, কিন্তু এই 'অ্যামেচার' খুবই অর্থঠাসা একটি শব্দ।
প্রশ্ন: এই শব্দের ব্যবহারটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক, যখন আপনার বয়স আশি, আপনি লেখালেখির জীবনের শুরুর পর্যায়ে নয়, রীতিমতো শিখরে এবং পেন-এর অনুবাদ বিভাগ আপনার জীবন ও কর্মকে সম্মান জানাতে এসেছে। আমি নিদেনপক্ষে আপনাকে একজন পেশাজীবী বলব! তবে সবচেয়ে জরুরি আপনার নিজের সম্পর্কে নিজের ধারণাটি। আপনি কীভাবে দেখতে চান নিজেকে?
এডিথ: আমি একজন পেশাদার হিসেবেই দেখতে চাইব নিজেকে-যে তার কাজকে ভালোবাসে। শৌখিন আখ্যায়িত হবার চেয়ে সেটাই অনেক ভালো নয় কি!
প্রশ্ন: অনুবাদক জীবনে আপনার নারী পরিচয়টি কি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে বলে আপনার মনে হয়?
এডিথ: আমি নিশ্চিত করেছে। আমার স্নাতকোত্তর শিক্ষাজীবনে তো নিশ্চিতভাবেই করেছে। সেখানকার জীবন তখন ছাত্রীদের জন্য বেশ কঠিন ছিল। আমার এক অধ্যাপক একবার আমাকে বলেছিলেন: 'তুমি জানো, তুমি এমন একজনের জায়গা দখল করেছ, যে কি না এই ক্ষেত্রটিতে সত্যি সত্যি কাজ করত, অথচ তুমি তো বিয়ে করে স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করবে।' আমি বেশ রেগে যাই। বলি: 'আমি কী করব না করব, সেটা তো আপনার জানার কথা নয়।' আমার মনে হয়, সেগুলো কিছুটা কমেছে, কেননা সামাজিক চাপের মুখে তারা এইসব নারীবিদ্বেষী মন্তব্যগুলো ঢেকেঢুকে রাখে।
প্রশ্ন: আর লেখালেখির বেলায়?
এডিথ: সেখানেও তফাৎ আছে। অবশ্যই আগেকার কালের সাহিত্যের চাইতে এখনকার পরিস্থিতি আলাদা, যেটা খুবই ভালো। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে। তবে প্রায়ই পুরোনো আমলের সাহিত্যিকেরা সমাজের সংস্কারের মধ্যে আবদ্ধ থাকেন। তাঁদের সেসব লেখা অনুবাদ করাও ভীষণ ভীষণ কঠিন।
প্রশ্ন: আপনি লাতিন আমেরিকার অনেক লেখকের লেখা অনুবাদ করেছেন; তাঁদের কেউ কেউ বিদেশে নির্বাসিতের জীবন যাপন করছিলেন এবং সেখানে থেকে তাঁদের ফেলে আসা দেশ ও অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন। আমার জিজ্ঞাসা, তাদের এসব লেখা কি আপনার নিজের কোনো অবস্থানকে পাল্টে দিতে পেরেছিল?
এডিথ: আমার মনে হয় না। আমি একজন যাকে বলে ঝানু বামপন্থী এবং আমার পঠিত কিংবা অনূদিত কোনো কিছুই আমার সেই মতাদর্শ পাল্টাতে পারেনি।
প্রশ্ন: কিন্তু অনুবাদক হিসেবে আপনার দৃশ্যমানতা অনেক পাল্টেছে। আপনার সাম্প্রতিক প্রকাশনাগুলোতে আমি লক্ষ করেছি বইয়ের শেষে আপনার লেখা একটি অনুবাদকের ভাষ্য যুক্ত হচ্ছে, পাশাপাশি মূল লেখকের সমান দীর্ঘ অনুবাদক-পরিচিতিও। এটি আপনার প্রথমদিককার অনুবাদকজীবন থেকে এক বিশাল উল্লম্ফন। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, এমনকি স্রেফ প্রচ্ছদের ওপর আপনার নাম যোগ করাতেও অনেক দিন লেগেছে আপনার।
এডিথ: হ্যাঁ, এটা একটা লড়াই ছিল। আমার প্রয়াত আইনজীবী নিল গ্যাচার একজন জবরদস্ত মানুষ ছিলেন। আমি তাঁকে সাংঘাতিক ভালোবাসতাম। গোড়ার দিকেই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: 'তোমার নাম কেন প্রচ্ছদে নেই?' আমি তাঁকে বলি: 'কারণ, অনুবাদকের নাম বইয়ের প্রচ্ছদে থাকে না।' যার উত্তরে তিনি বলেছিলেন: 'ঠিক আছে, এখন থেকে তোমার নাম সেখানে থাকবে।' এবং তারপর থেকেই তিনি প্রকাশকদের চাপ দিতে থাকেন আমার নাম প্রচ্ছদে দেবার জন্য।
প্রশ্ন: তাতে আপনার কী অনুভূতি হয়েছিল? অস্বস্তিকর? উত্তেজনাকর?
এডিথ: দুটোই। প্রথমে অস্বস্তি, আর তারপর আনন্দ। আমি ভেবেছিলাম: যথেষ্ট হয়েছে, অনুবাদকদের গরিব আত্মীয় ভাবার দিন শেষ হয়ে এসেছে, তাদের এখন ব্যবসার সমান অংশীদার ভাবা দরকার।
প্রশ্ন: আপনিই কি এই সমান অংশীদারদের মধ্যে একেবারে প্রথমদিকের একজন?
এডিথ: আমার মনে হয় আমিই প্রথম। এবং এটা ওঁর জন্যই সম্ভব হয়েছে। এরপর থেকে এটা একটা প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আমার ধারণা, অনুবাদকদের নাম এখন অধিকাংশ সময় মূল প্রচ্ছদেই যায়, নয় কি?
প্রশ্ন: অধিকাংশ সময়। এখন সাহিত্যজগতে ও পাঠকদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা প্রচ্ছদে অনুবাদকের নাম না থাকলে কিংবা বইয়ের আলোচনায় তাঁদের কথা উল্লেখ করা না হলে রীতিমতো খেপে যান।
এডিথ: হ্যাঁ! আসলেই তো, পুস্তক সমালোচকেরা এমনভাবে লিখতেন যেন অনুবাদটি কোনো অলৌকিক বস্তুর মতো স্বর্গ থেকে সরাসরি নাজেল হয়ে গেছে। মাতা মেরির সেই পুরুষ ব্যতিরেকে গর্ভধারণের মতো আর কী!
প্রশ্ন: যেন বা লেখক মহাশয় দুয়েকবার কাশি দিলেন আর কী আশ্চর্য আরেকটি ভিন্ন ভাষায় তাঁর উপন্যাসের একটি নিখুঁত অনুবাদ তৈরি হয়ে গেল।
এডিথ: এটা খুব মজার কথা বলেছ। (হাসি)
প্রশ্ন: আপনি কি কখনো স্রেফ বিশুদ্ধ আনন্দের জন্য অনুবাদ করেন?
এডিথ: না। আমার বাবা ট্রেড ইউনিয়নের নেতা ছিলেন, আমি তাই শ্রমের মূল্যের ব্যাপারে ভীষণ দায়বদ্ধ, তা সে যতই আপনি কাজটাকে উপভোগ করেন না কেন। আপনি যদি বিশেষ কোনো একটি মহৎ লক্ষ্যে দান করার সিদ্ধান্ত না নেন, তাহলে অবশ্যই আপনাকে কাজের পারিশ্রমিক পেতে হবে।
প্রশ্ন: আপনি যখন স্বাধীন, তখন কি প্রকাশকদের আপনার পছন্দের কিছু লেখা অনুবাদ ও প্রকাশের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়ার বিষয়টা অনুভব করেন?
এডিথ: আমার ধারণা, আমি এমন একটা বয়সে পৌঁছে গেছি, যেটাকে ইতালীয়রা বলে ইল দোলসে ফার নিয়েন্তে (কিছুই না করে থাকাটা কী আনন্দের)। উদাহরণস্বরূপ, এখানে বসে তোমার সঙ্গে গল্প করাটা কী যে মুক্তিদায়ক, যখন আমাকে তাড়াতাড়ি ফেরার কথা ভাবতে হচ্ছে না; কারণ, একটা অনুবাদের কাজ আমার জন্য অপেক্ষা করছে এবং দিন শেষ হবার আগে আমাকে অন্তত আরও ১০ পৃষ্ঠার অনুবাদ শেষ করতেই হবে।