বাগানবিলাস: বাগানে যাই বাগানে বড় সুখ
'বাগানে যাই বাগানে বড় সুখ'
–হুমায়ুন কবির
অতিমারির সময় বাগান করাটা বাঁচিয়ে দিয়েছিল অনেক মানুষকে, মানসিক স্বাস্থ্য-উদ্ধারে নাকি বাগানের জুড়ি নেই। এমনকি যার বাগান করবার জায়গা নেই–তারও ঘরের দেয়াল, সিলিং, জানালার তাক ভরে উঠেছে সবুজ উদ্ভিদে। ছায়াসহিষ্ণু ফার্ন-স্পাইডার আইভি কিংবা মানিপ্ল্যান্ট/ডেভিলস আইভি। সহজে সুফলা জেড প্ল্যান্ট। ক্যাকটাস। রোদসোহাগী সাক্যুলেন্ট একিভেরিয়া। প্রায় অমর ড্রাসিনা যার আরেক নাম 'শাশুড়ির জিভ'। সারা দুনিয়া যখন কোভিডের লকলকে জিভের সামনে নিরুপায় হয়ে কাঁপছে, আত্মীয়হীন একা ঘরে হাতের মুঠোয় আয়ু নিয়ে অপেক্ষা করছে কবে এই দুর্দিন কেটে যাবে, তখন বাগানের দিকে আবার ফিরেছিল অনেক মানুষ, সবুজের শপথ নিয়েছিল। যদিও শপথ রাখে না সব লোকে, তবুও প্যান্ডেমিকের দুঃসময়ে বাগানের মহিমা পুনরায় আবিষ্কৃত হয়েছে বলা চলে। পুনরায় বলছি, কারণ মানুষের বাগান করবার প্রবৃত্তি একটি আদিম প্রবৃত্তি।
ইতিহাস যখন কথা কয়
আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মতে, স্বর্গের বাগান থেকে বিতাড়িত হবার পরই তো মানুষের পার্থিব জীবনের যাবতীয় ঝক্কির শুরু। বেহেশতের বিবরণ মূলত উদ্যানের বিবরণ। আদি প্রমোদ-উদ্যানগুলোর কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের কথা,আদি পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যের একটি (যার নাম শুনলেই আমার মনে হতো ফুলের ঝাড় আকাশ থেকে ঝুলছে–মানে পুষ্পবৃষ্টির একটি পারস্য সংস্করণ)। জানা যায়, মিডিয়ার কন্যা আমেতিসকে বিয়ে করে এনেছিলেন রাজা নেবুকাদনেজার, তখনকার ব্যাবিলনের সমতল প্রান্তরে পরান হাঁপিয়ে উঠেছিল পাহাড়ি কন্যা আমেতিসের। ব্যাবিলনে পাথর কোথায়? অতএব এক মিটার ব্যাসের রৌদ্রদগ্ধ ইটের ফাঁকা স্তম্ভ সারি দিয়ে রাজা নির্মাণ করেছিলেন ৪০০ X ৪০০ বর্গফুট ক্ষেত্রফলের একটি স্টেপ পিরামিড, ৩২০ ফুট উঁচু বাগান। গ্রিক ইতিহাসবিদ ডায়োডোরাস সিসেলাস এর বর্ণনা লিখেছিলেন। স্তম্ভগুলোর ভেতর মাটি ভরাট করে বড় বড় গাছ পুঁতে দেয়া হয়। একের পর এক তলা উঠে গেল, তাতে সবুজ গাছের সারি। সেচ দেয়া হতো সম্ভবত ইউফ্রেটিস নদীর জল দিয়ে।
প্রাচীন মিসরের বাগানে ছিল তিনটি উপাদান, ঘেরা দেওয়াল, জলের পুকুর বা ইঁদারা আর শ্যামলিমা (ফলের বড় গাছ-ফুলগাছ-সবজি); আদি মিসরীয় প্রেমপত্র থেকে পিরামিডের দেয়াল হয়ে মমির সঙ্গে দিয়ে দেয়া ফসলের বীজ–সর্বত্রই মিসরীয় বাগানের চিহ্ন উপস্থিত। বাগান মানে ফসলের সম্ভাবনা, উর্বরতা, বাগান মানে ঐশ্বর্য আর সচ্ছলতা।
জরাথুস্ত্রীয় আদি গ্রন্থ আভেস্তাতে ইডেন বা স্বর্গোদ্যানের যে চারটি উপাদানের কথা রয়েছে- আকাশ, মাটি, জল আর উদ্ভিদ; সেই চারটিকে নিয়েই পারস্যের বাগানের ভূমিকা রচিত হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের সেসব বাগানেই আমরা দেখতে পাই হার্ড ল্যান্ডস্কেপিংয়ের আইডিয়ার স্ফুরণ, দেয়াল-প্যাভিলিয়ন-বাগানঘর। সেই বাগানচিন্তা ছড়িয়ে পড়েছে এদিকের ভারতবর্ষে, ওদিকের স্পেন অবধি। মুঘলদের চাহারবাগ বা চারবাগ, দেয়ালঘেরা বাগানের চারটি ভাগ, মাঝখানে জলের ফোয়ারা- সেচও হবে, সৌন্দর্যও রক্ষা হবে। বলা হয়, এ বাগান বেহেশতের বাগানের প্রতিফলন। প্রাচীন মিসরীয়দের মতো করে মুঘলরাও এনেছিল প্রাসাদ-উদ্যান এবং সমাধি-উদ্যানের আলাদা কনসেপ্ট।
অষ্টম শতকে বৌদ্ধ সাধকদের সাধনাস্থল হিসেবে জেন বাগানের উদ্ভব, এটি চীনা সুং রাজবংশীয়দের আদলে তৈরি ড্রাই গার্ডেন–নুড়িতে গাঁথা তরঙ্গমালা, মসে ঢাকা পাথর, সামান্য কিছু গাছপালা। ফুলের রঙের চপলতা নেই, পাতাবাহারের চপলতা নেই, শুধু শমে ফিরে আসা শান্ত সুধীর হৃদয়ের মিহি সংগীত।
বাগানের ইতিহাস নিয়ে কথা কইতে গেলে থিওফ্রাস্টাস নামের এক গ্রিককে অবশ্যই স্মরণ করতে হবে, এই অতিপ্রজ মনিষী তিনটি বিষয়ের পিতা — বাস্তুবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা এবং উদ্যানশাস্ত্র (প্রথম বইটি তাঁরই লেখা)। তাঁর উদ্ভিদবিদ্যাবিষয়ক কিছু নিরীক্ষা সত্য, কিছু ভুল অথচ পরবর্তী ১৫০০ বছর ধরে সেসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেনি, খানিকটা আমাদের খনার মতো। থিওফ্রাস্টাস শেখালেন গোবর সার দিলে গাছ স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেগে বাড়ে, গোলাপ কলম করতে আর ছাঁটতে শেখালেন। লিখলেন–গাছ তার আপন রসে গর্ভবতী হয় শীতকালে, বসন্তে তাই ফুল ফোটে আর ফল ধরে।
মালঞ্চের আদি মালাকার
বাগানের ইতিহাস অগাধ বিত্তের অধিকারী পৃষ্ঠপোষকের ইতিহাসই শুধু নয়, দুর্বিনীত দস্যুর ইতিহাস, নীলকর-চা-বাগানের মালিক এবং মসলা-জাহাজের ইতিহাস, তুরস্ক থেকে তুলিপ চুরি করে আনা চোর কিংবা আজীবন মুখ বুজে কাজ করে যাওয়া প্ল্যান্ট ব্রিডারের ইতিহাস। আঠারো-উনিশ শতকে গাছ সংগ্রহের জোয়ার এল ইউরোপে। কলম্বাসের নতুন ভূখণ্ড থেকে বীজ চালান দিলেন জন বারট্রাম, দ্য টার্নফোর্ট আহরণ করলেন আরব-বলকান ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলো থেকে, ম্যাসন আনলেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে, ভন হাম্বল্ট গেলেন দক্ষিণ আমেরিকার গাছপালা সংগ্রহে, ড্রামন্ড গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়, কানিংহাম ও ফরচুন খুলে দিলেন চীনের উদ্ভিদ-সংগ্রহের দুয়ার, চীনা উইলসন আর জর্জ ফরেস্ট আনলেন ফার ইস্টের সম্ভার।
ইউরোপের প্রথম রাজকীয় বাগানের ডিজাইনার ব্রামান্তের কাছে বাগানের অর্থ ছিল–পাথর, সিঁড়ি, ভাস্কর্য আর জল। ভার্সাই প্যালেসের রচয়িতা লা নোতরার কাছেও বাগান মানে কিন্তু ফুলবাগান নয় বরং নুড়ি ফেলা পথ, ঝোপ, কাঁচিতে ছাঁটা বক্সউডের টোপিয়ারি, পুল, পাথরের বেঞ্চি আর ফোয়ারা। ভিক্টোরিয়ান আমলে জন লাউডন আর শার্লি হিবার্ডের হাত ধরে ফুল ঢুকল ইউরোপীয় বাগান-চিন্তায়। ১৮৭০-এ আইরিশ হর্টিকালচারিস্ট উইলিয়াম রবিনসন এসে বাগানচিন্তা থেকে ফরাসি ফর্মাল গার্ডেনের বাঁধা-ছাঁদা-ছাঁটা রীতিকে ছুড়ে ফেলে দিলেন। শিল্পবিপ্লব প্রকৃতির ওপর যে প্রবল নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে রবিনসন উদ্বিগ্ন ছিলেন। উইলিয়াম মরিস এবং জন রাস্কিনের নেতৃত্বে কারখানা-নির্মিত ছাঁচে-ঢালাই ডিজাইনের বিরুদ্ধে যে আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস মুভমেন্ট শুরু হয়েছিল, তা রবিনসনকে স্পর্শ করেছিল। তিনি চাইলেন বাগান হবে একেবারে আটপৌরে, ইনফর্মাল। বাগানে মৌসুমি গাছের বদলে স্থায়ী বহুবর্ষজীবী গাছ থাকবে, রকমারি বিদেশি গাছপালার পাশাপাশি দেশি গাছও থাকতে হবে, ঘাসে ফুলের কন্দ বুনতে হবে, বাগানের রঙের বৈচিত্র্য হবে মোলায়েম, দৃষ্টিনন্দন। রবিনসনের বাগান গ্রেভটাই ম্যানর এখনো বিলেতের ঐতিহাসিক বাগানগুলোর অন্যতম।
১৮৮০ সালে রবিনসনের বন্ধু হলেন গারট্রুড জেকিল, বাগানরচনার ঈশ্বরী, তিনি রবিনসনের বাগানচিন্তাকে ধারণ করলেন বটে, একটু বদলে দিলেন। ল্যান্ডস্কেপের ইতিহাসে একটি অলিখিত কানুন রয়েছে, আর যার সমালোচনা করা হোক, গারট্রুড জেকিলের নামে কিছু বলা যাবে না। ৪৫ বছর বয়সে গারট্রুড ঠিক করলেন, ছবি তো তিনি আঁকেন, চমৎকার সেলাইও করেন, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি ক্ষয়ে আসছে, অতএব এবার তিনি বাগান রচনা করবেন। পরবর্তী ৩০ বছর ধরে তিনি গড়ে তুললেন ৪০০ মতন বাগান, ২০ বছরের স্থপতি নেড লাচন্সকে নিয়ে গড়লেন এর ১০০টি; বাগানরচনার ইতিহাসে এ এক অনবদ্য মেধার মিথস্ক্রিয়া। লাচন্স (পরবর্তীতে স্যার এডউইন লাচন্স, নয়াদিল্লির মুখ্য স্থপতি) গারট্রুডকে অত্যন্ত ফরমাল বাগানের মূল কাঠামো তৈরি করে দিতেন, গারট্রুড তাতে পরাতেন ফুল-লতা-পাতার প্রসন্ন পোষাক। আজ গারট্রুডের তৈরি বাগানগুলোর গুটিকয় টিকে রয়েছে, রয়েছে তার বাগান-ভাবনার বইগুলো।
শহর আর বাগানকে একই ধারণার আওতায় নিয়ে এসেছিলেন নগর পরিকল্পনাবিদ হাওয়ার্ড। তার গার্ডেন সিটির কনসেপ্ট স্থাপত্যবিদ্যায় আমাদের পাঠ্য ছিল। আজ যখন নগর পরিকল্পনায় আবার ডাক উঠছে–'ফিরে চল মাটির টানে', শহরকে টিকে থাকতে হলে গ্রামায়ণ কত জরুরি, খাদ্যোৎপাদনে শহর কতটা স্বাবলম্বী হতে পারে তার নিরীক্ষা চলছে, তখন এবেনিজার হাওয়ার্ড আবারও প্রাসঙ্গিক; তিনি পিছু ফিরে দেখতে চেয়েছিলেন, প্রগতির নতুন অর্থ খুঁজতে চেয়েছিলেন বলে।
প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন
প্রাচীন রোমে বাগান ছিল ইন্দ্রিয়ের মহাভোজসভা, চোখ জুড়াত, কান ভরাত, মন পুরাত। আর বাগান ছিল মর্যাদা-প্রতিপত্তি-সুবিধাভোগিতা-বিত্তের প্রতিযোগিতা আর প্রদর্শনী। চিনিয়ে দিত রোমান সমাজে বিত্তভেদ। চতুর্থ সিজার ক্যালিগুলার ছিল মাত্র চার বছরের রাজত্ব। হর্টি লামিয়ানি ছিল তার প্রিয় প্রমোদ-উদ্যান, প্রথম যুগের ওয়াইল্ডলাইফ পার্ক। প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপের ভেতরই ভিলা-সৌধ-মন্দির-ভোজসভা-ফোয়ারা-চিড়িয়াখানা-ফলবাগান, প্যাভিলিয়ন আর টেরাস। বাগানে ময়ূর নাচত, হরিণ চরত। সিংহ আর ভালুকের খাঁচাও ছিল, গোমাংসের দর বেড়ে গেলে সম্রাট যাদের পাতি অপরাধীদের মাংস খাইয়েছিলেন। হত্যা করার পর ক্যালিগুলাকে এ বাগানেই দাহ করা হয়, ক্যালিগুলার অতৃপ্ত আত্মা চরে বেড়াত ভুতুড়ে বাগানে। এতকাল পর খনন করে তুলে আনা হয়েছে সেই বাগানের মার্বেলের সিঁড়ি আর স্তম্ভ, রঙিন টালি দেয়া স্নানাগার, স্বচ্ছ পাথরখচিত জানালা, অ্যালাবাস্টারের মেঝে, মোজেইক আর ফ্রেস্কো।
ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতে সমাধিস্থ হয়ে রয়ে গেছে পম্পেই শহরের প্রায় পাঁচ শ বাগান, বিশ্বযুদ্ধের বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেসব বাগান এখন খুঁড়ে বের করা হচ্ছে। সেকালের পম্পেইতে কয়েক রকম বাগান হতো। যেমন:
অ্যাট্রিয়াম বা সদরের বাগান: এখান দিয়ে বাড়িগুলোয় আলো আসত, মাঝখানে ছোট্ট পুকুর বা ফোয়ারা, চারদিকে ফুলগাছ, এটা পাবলিক স্পেস। বিত্তবিভেদে কখনো একাধিক অ্যাট্রিয়াম থাকত।
পেরিস্টাইল কোর্ট বা পেরিস্টাইল গার্ডেন: বাঁধানো চত্বর বা বাগান, এর চারদিকে ছাদঘেরা কলোনেড বা স্তম্ভের সারি (মধ্যবিত্ত পরিবারের বাগান), উচ্চবিত্তদের ভিলা গার্ডেনও থাকত।
জাইস্টাস-ঢাকা কলোনেড: যাতে শরীরচর্চা করা যায়
হর্টাস গার্ডেন: সবজি বাগান বা খিড়কি বাগান, বাগান শেষে জলপাই-চেরি-আপেল-ডুমুর-লেবু-তুঁত-কমলালেবু ইত্যাদি ফলের গাছ এবং বাদামগাছ রোপিত হতো।
একরকমের বাগান নেহায়েত প্রমোদ-উদ্যান, ব্যক্তিগত বিনোদন ছাড়া যার গন্তব্য নেই। রেনেসাঁর উদ্যানের মতোই, চিরহরিৎ ঝোপ ছেঁটে তৈরি করা টোপিয়ারি, জ্যামিতিক রেখাবিন্যাস, জলের ফোয়ারা। দেয়ালে ফ্রেস্কোর (মিসরের নীল নদের দৃশ্যও থাকত, রোমের কাছে অর্থনৈতিকভাবে তখন মিসর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) পারস্পেক্টিভের মাধ্যমে ছোট বাগানকেই বড় দেখাবার ব্যবস্থা, বাগান আর ফ্রেস্কোর মাঝে লতাবিতান বা ট্রেলিসের আড়াল। বিত্তহীন দাসানুদাসরা থাকত ঠাসাঠাসি করে জানালাহীন চিলেকোঠায়, মালিকের বাড়ির উজ্জ্বল উত্তাল বাগানগুলোয় ঘুরে বেড়ানোর অধিকার ছিল না তাদের। কলেরা কি ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপের সময় সে কোথায় যাবে? কোথায় তার সবুজের অধিকার? শহরের বাইরে বিশাল কৃষিবাগানে যেগুলো দাসদের হাতে তৈরি, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নিবেদিত। পরিখা, সেচব্যবস্থা, আঙুর চাষ, পালাক্রমে ফসল ফলানোর প্রক্রিয়া, ক্রসব্রিডিং- সবকিছু নিয়েই মাথা ঘামানো হতো সেখানে।
ভার্সাইয়ের পেছনে যেমন সম্রাট চতুর্দশ লুই, চীনা সামার প্যালেসের পেছনে তেমনি সম্রাট চিয়ানলঙ, শালিমার বাগের পেছনে সম্রাট শাহজাহান, মাদ্রিদেও বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনে সম্রাট ষষ্ঠ ফার্দিনান্দ, হ্যাম্পটন কোর্ট প্যালেসের পেছনে সম্রাট অষ্টম হেনরি, এমনকি ভ্যাটিকান গার্ডেনের নয়ন জুড়ানো শোভার পেছনে রয়েছে ভ্যাটিকানের অগাধ অর্থ-বিত্ত। বিত্তের সঙ্গে বাগানের যোগ রয়েছে, স্থাপত্যের যেমন। জার-লুই-শাহ-পাশা-লঙদের দখলে প্রকৃতির অধিকার; যার দুই বিঘা জমিন নেই, তার অন্নপূর্ণা প্রকৃতি কই, গাছপালার অধিকারই বা কই? বাগানের ইতিহাস আমাদের এদিকেও বৈভবের ইতিহাসলগ্না। আমাদের শহরের শেষ ঐতিহাসিক বাগান বলধা গার্ডেন, তার পেছনেও আছেন নারিন্দার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। পুরোনো গানে আছে — 'আমার সঙ্গে দেখা হবে বাবুর বাগানে'। ভেবে দেখুন রাজা-জমিদারের বাগানবাড়ি, সরোবরের জলটুঙ্গি- কামটুঙ্গি ইত্যাদি প্যাভিলিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাবু-কালচারের বিচিত্র ইতিহাস, বাগানে বেশ্যাদের সঙ্গে নগ্ন বাবুদের লুকোচুরি খেলার গল্পের কথা কে যেন লিখেছিলেন? হুতোম, টেকচাঁদ ঠাকুর, না বিমল মিত্র, নাকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়?
কিন্তু সত্যিই কি সুন্দরের অধিকার এত অন্যায্য? বিভূতিবাবুর 'আরণ্যক'-এর যুগলপ্রসাদকে মনে আছে? এক পয়সা আয় নেই, নিতান্ত গরিব, সরস্বতী কুন্ডিতে গ্রামের পদ্মফুল এনে ফোটাবে বলে তার কি পরিশ্রম, জঙ্গলের শোভা বাড়াতে তার কি উদ্বেগ! বাস্তবে হয় না এমন? আমাজন বনের ঠিক পাশটিতেই জলে ভাসমান কিছু মানুষের বসতি, ডুবজলে নৌকা রেখে সেই নৌকায় তারা ফসল ফলায়, ফলবাগান করে। কিউবাতে শহরের পতিত জমিতে-পোড়ো বাড়ির চৌহদ্দিতে নাগরিকেরা ভারি ভালোবেসে বাগান করে খাদ্যঘাটতি পূরণ করে চলেছে। আমাদের দেশেও তো আছেন আনমনা মানুষ, নিজ খরচে বছরের পর বছর ধরে সড়কের ঢালে তালগাছ লাগিয়ে চলেছেন। এই যে আমাদের ঢাকা শহরে ধোঁয়াভরা আকাশের দিকে উদ্ধত শিখর মেলে কত ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ছাদবাগান, ভাড়াটে কিংবা বাড়ির মালিকের বিপুল বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও ফুল-ফসল ফলিয়ে চলেছে মানুষ, কে বলে রাজারাই কেবল সবুজের পৃষ্ঠপোষক? আমরা সবাই রাজা।
ভেষজ সমাধান
আদি বাগানের কথায় আসবে মধ্যযুগের ইউরোপজুড়ে সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের কবিরাজি-বাগানের কথা, মনাস্টিক গার্ডেন, অ্যাপোথেকারিজ গার্ডেন, যেগুলো রোগীর আরোগ্যনিকেতন হিসেবেই শুধু কাজে লাগেনি–পরবর্তীতে কাজে লেগেছে জীববৈচিত্র্য রক্ষার একান্ত ল্যাবরেটরি হিসেবেও। ভেবে দেখুন, ইউনিভার্সিটি অভ পাদুয়ার সেই ষোড়শ শতকীয় বাগানের কথা, ভেনিস তার বাণিজ্যপথগুলো কাজে লাগিয়ে জোগাড় করেছে সারা পৃথিবীর যত বিচিত্র বনাজি উদ্ভিদ। এ বাগানের সংগ্রহে আজ প্রায় পাঁচ লাখ উদ্ভিদের স্যাম্পল রয়েছে, কোনো কোনোটি আঠারো শতকে বিলুপ্ত হয়েছে এমনও আছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুলনাচের ইতিকথা'র সেই যামিনী কবিরাজের ঘরটা মনে পড়ে, পাঁচন সেদ্ধ দেবার গন্ধভরা, কবিরাজি গাছপালা ঘেরা, চেলারা সেখানে শুকনো গুল্ম গুঁড়ো করছে। আমাদের কবিরাজি গাছপালা কত ওষুধ তৈরির কাজে লাগছে বহির্বিশ্বে, আয়ুর্বেদের বাত-পিত্ত-কফ দোষ, ইউনানি বলগম-দাম-সাফ্রা-সাউদা কিংবা চরক সংহিতা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন পণ্ডিতেরা। শুনেছি শক্তি ও সাধনা ঔষধালয়ের ওষুধ পৃথিবীর বহু দেশে রপ্তানি হতো। কবিরাজি গাছপালা চেনা সেই কবিরাজরাও নেই, ফলে কবিরাজি গাছ সংরক্ষণেরও দায় নেই কারও।
বাগানচিন্তা
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সাউথ আটলান্টিকের সেন্ট হেলেনা দ্বীপ থেকে সুবিশাল ভারতবর্ষ হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছুঁয়ে নিউজিল্যান্ড অবধি প্রকৃতিতে গ্লোবায়নের প্রথম প্রভাবকে রেকর্ড করেছিল — বিচিত্র গাছপালা-পশুপাখি আমদানি-রপ্তানি করেছিল, বন কেটে সাফ করেছিল, নদীর গতিধারা পালটে দিয়েছিল, দুর্ভিক্ষ আর মড়কের দোহাই দিয়ে চাষাবাদ প্রক্রিয়া এবং কবিরাজি উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা চালিয়েছিল। শেখ জয়েনউদ্দিন, রাম দাশ কিংবা ভবানী দাশের মতো শিল্পীকে দিয়ে ইংলিশ ওয়াটম্যান পেপারের ওপর আঁকিয়েছিল ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রেসিডেন্সির ফুল-ফল-পশু-পাখির ছবি। কচুগাছ-কলমিলতা-কলাবাদুড়–সবই নথিবদ্ধ করেছিল, নথিবদ্ধ করতে ব্রিটিশ জাতের জুড়ি নেই, জুড়ি নেই তাদের প্রকৃতি-দোহন করে অর্থ উপার্জনের চিন্তায়। উপনিবেশ ছাড়া এত জায়গার জল, মাটি, গাছপালা কিংবা প্রাণীকে বিশ্ব জানতে পারত না। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই ইন্ডিয়ান ফ্লোরা অ্যান্ড ফনার বিপুল সচিত্র সংগ্রহের পর আমরা আমাদের নিজেদের গাছপালা, ভেষজ ওষুধ-রং ইত্যাদি নিয়ে কতটা এগোলাম? মনে পড়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গলিতে ঢুকবার মুখে একটা ইংলিশ গার্ডেন ছিল, সেটা কই গেল? কেমন আছে বলধা গার্ডেন? বোটানিক্যাল গার্ডেন? চন্দ্রার ন্যাশনাল গার্ডেন? কোথাও আশা আছে নিশ্চয়ই, ভেজ-ডাইয়ের চমৎকার কাপড়চোপড় কিংবা মসলিনের পুনরুত্থান, শতরঞ্চের ব্যবহার, পাটজাত পণ্য, কারখানা এবং অফিসে দেশি গাছ আর ল্যান্ডস্কেপিং ভাবনার সমন্বয়, এসব আশাপ্রদ।
বাগানের পেছনের মানুষ
নেপোলিয়নের স্ত্রী জোসেফিন বোনাপার্টের নাম আমরা পড়েছি জগজ্জয়ী বীরের অবিশ্বস্ত স্ত্রী হিসেবে। যা পড়িনি তা হলো, শ্যাতু দ্য মালমেসোঁতে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বোটানিস্ট এবং হর্টিকালচারালিস্টদের নিয়ে প্রথম সর্ববৃহৎ গোলাপবাগান গড়েছিলেন জোসেফিন। তখন নেপোলিয়নের সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপে, তাদের অন্যতম কাজ ছিল গোলাপ সংগ্রহ। শামসুর রাহমানের সেই লাইন মনে পড়ে যায়–'ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি গোলাপ নেব।' মারি আঁতোয়ানেতের ড্রয়িংমাস্টারকে রাখা হলো এই বাগানের গোলাপ আঁকবার জন্যে। গোলাপসংগ্রহ বাগানে রাখবার রীতি শুরু হলো, যুদ্ধ শেষে ব্রিটেন আর উত্তর আমেরিকার বড় বড় বাগানে গোলাপবাগান তৈরি হলো। জোসেফিনের মৃত্যুর পর অবশ্য তার এই ২৫০ জাতের গোলাপসংবলিত বাগান ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেল, প্রুশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সময় এ বাগান একেবারে ধ্বংস করে দেয়া হলো। পরে অবশ্য ভাল দ্যে মানের গোলাপবাগানে জোসেফিনের সংগ্রহকে অনেকটাই ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
শুধু কি আর রাজারাজড়ারাই রানিদের জন্য বাগান করে দিয়েছিলেন? বিলেতে ডরোথি ক্লাইভ গার্ডেনে রডোডেনড্রনের অপূর্ব এক বাগান গড়েছিলেন কর্নেল হ্যারি ক্লাইভ (এই ক্লাইভ সেই ক্লাইভ নয়)। স্ত্রী ডরোথি ছিলেন পারকিনসন্সের রোগিনী, ডরোথি বনপথে হেঁটে বেড়াতে খুব ভালোবাসতেন। স্ত্রীর জন্য ক্লাইভ ১২ একর এলাকায় এই বাগান নির্মাণ করেছিলেন, প্রতিটি বাঁকে এমন ধীর-নিবিড় বদল, যা চমক সৃষ্টি করে না, কিন্তু মন ভোলায়। নির্বাসিত কবি, শিল্পী, সুররিয়ালিস্ট এডওয়ার্ড জেমস মেক্সিকোর অরণ্যে গড়েছিলেন স্কাল্পচার গার্ডেন, লোকে সেই বাগান দেখলে স্বপ্নদৃশ্যে আগন্তুকের মতো বোধ করে। বাগানরচনার কোনো ব্যাকরণকেই সেখানে মানা হয়নি। বাগান করেছিলেন ভার্জিনিয়া উলফের প্রেমিকা ভিটা স্যাকভিল ওয়েস্ট। এককালের শুয়োরের খামারের ওপর তাঁর রচিত বাগান–সিসিংহার্স্ট ক্যাসেল গার্ডেন বিংশ শতাব্দীর এক অপরূপ শিল্পসৌধ। উইলিয়াম কেন্ট ডিজাইন করেছিলেন রোশাম গার্ডেন, আঠারো শতকের সবুজ কবিতা, যেন একুশ শতকে এসেও পরান মুচড়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। ক্রিস্টোফার লয়েডের গ্রেট ডিক্সটার গার্ডেন বাগানভাবনার কেন্দ্র হিসেবে এখনো সপ্রাণ-সরব।
বাগানের রকমফের
স্থাপত্যে আমাদের সবচেয়ে বিশুষ্ক শিক্ষক পড়িয়েছিলেন ল্যান্ডস্কেপের মতো সরস বিষয়, পড়িয়েছিলেন বাগানের রকমফের — ইতালীয়, ফ্রেঞ্চ, ইংলিশ; ডাচ ওয়েভ স্টাইল শেখানো হয়েছিল কি না, মনে নেই।
কত রকমের বাগান করবার স্টাইল রয়েছে এখন!
কটেজ গার্ডেন: ঘাসের সবুজ লন নেই, অল্প জায়গায় প্রচুর গাছপালা, নানান মৌসুমের প্রচুর ফুলের গাছ-লতা-ঝোপ, একটা অন্তত ফলের গাছ। বাগানে সরু পথ থাকবে, বসবার টেরাস থাকতে পারে।
ট্রেডিশনাল গার্ডেন: বাড়ির পাশেই ফরমাল এরিয়া, হারবেশাস বর্ডার বা বীরুৎ গোছের একবর্ষজীবী ও বহুবর্ষজীবী ফুলের ঝোপ এবং পাতাবাহার, ফটক দিয়ে ফরমাল সাংকেন গার্ডেনে যাওয়া যাবে। কিচেন গার্ডেন থাকবে, একই গাছপালার পুনরাবৃত্তি থাকবে, টোপিয়ারি বা ছাঁটাই করা ঝোপ থাকবে, কিছু জ্যামিতিক রেখা ও শেপের ব্যবহার থাকবে, এ বাগান সারা বছর দেখতে ভালো লাগে।
ইংলিশ কান্ট্রি গার্ডেন: বেশ খানিকটা জায়গা দরকার। চওড়া হারবেশাস বর্ডার থাকবে, লন এবং চওড়া বাঁধাই রাস্তা থাকবে, ঝোপ আর বড় গাছ, ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে ভাস্কর্য, টোপিয়ারি, গোলাপবাগান, সূর্যঘড়ি। এ বাগান ছোট-বড় বেশ কিছু রকমারি বাগানে বিভাজিত হবে।
আউটডোর রুম গার্ডেন: শহরের বাগান, এতে বৈঠকখানার কাজ চলে। কিচেন, বার, বসার জায়গা, ফায়ারপ্লেস, ফার্নিচার থাকতে পারে। গাছপালা লাগাবার জন্য রেইজড বেড বা মাটি উঁচু করে ভরাট করে বেড এবং ডেকিং থাকতে পারে।
কন্টেম্পরারি বা মডার্ন গার্ডেন: ছোট বাগানে নতুন রকমের চিন্তা, ডাবলডেকার গার্ডেন (নিচে ছায়াসহিষ্ণু গাছ, ছাদেও গাছ), ন্যাচারালিস্টিক/আগাছার বাগান। বক্ররেখার দেয়াল এবং ওয়াটারফিচারের ব্যবহার। পাতার রকমফের।
ড্রাই গার্ডেন: অস্ট্রেলিয়ান বা ভূমধ্যসাগরীয় স্টাইল। খরাসহিষ্ণু গাছ। নুড়ি আছে, লন নেই, বাগানপথ নেই। পুরোটাই ন্যাড়া বাদা জমিন, মাঝে মাঝে গাছ আর পাথর। বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের জন্য ভালো।
কোস্টাল গার্ডেন: বাতাস বেশি, লবণাক্ততা বেশি, ভূমিক্ষয় বেশি। রেইজড বেড থাকবে, লন টিকবে না। নুড়িপাথর থাকবে জমিনে, তাতে ভূমিক্ষয় রোধ হবে। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলোর আদি বাসিন্দারা সাধারণত নিম্নবিত্ত হয় বিধায়, এই স্টাইলে রিসাইক্লড বা আপসাইক্লড গার্ডেন ফার্নিচার, ভাঙা পুরোনো মরচে ধরা গ্যাজেট বা তৈজসপত্র ব্যবহৃত হবে।
ট্রপিকাল/এক্সোটিক গার্ডেন: ক্রান্তীয় জঙ্গলের মতো তৈরি বাগান, প্রচুর গাছ আর গাছতলায় ঝোপের স্তর, ফার্ন, কলাবতী, পাতার আকারে এবং রঙে বৈপরীত্য, উজ্জ্বল ফুলের সমাহার।
ওয়াইল্ড লাইফ গার্ডেন: কোনো কেমিক্যাল সার বা কীটনাশক ব্যবহৃত হবে না। পাখির জন্য বাদুড়ের জন্য মৌমাছি-ফড়িং-বোলতার জন্য খাবার, পানি, ছায়াঢাকা আশ্রয়। চিরসবুজ গাছ এবং ঝোপ, খড়ের গাদা, লাকড়ির স্তূপ এবং ইটের পাঁজা শীতকালীন আশ্রয় দেবে।
জাপানিজ গার্ডেন: ছাঁটা গাছ, রঙের ব্যবহার খুব কম। টেক্সচার বেশি। মস, শ্যাওলা লাইকেন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
শশী ডাক্তারের বাড়িতেও বাগান রয়েছে বলে মানিকবাবু জানিয়েছিলেন (পুতুলনাচের ইতিকথা), সেখানে আম-কাঁঠাল, কপি আর নটেশাক, তীব্রগন্ধী কাঁঠালিচাঁপা আর লাল বোঁটা শিউলি সব একত্রে ফোটে আর ফলে — অর্থাৎ হাল আমলে যাকে বলে পার্মাকালচার গার্ডেন, নেটিভ গাছপালায় তৈরি। আমাদের গ্রামের-মফস্বলের-শহরতলির বাড়িগুলোর আশপাশে আম-জাম-কাঁঠাল-পেয়ারা-বরই ইত্যাদি ফলের গাছ থাকত, সঙ্গে থাকত অনামা বনজ গাছ, সেসব গাছে গাছালু বা এমনি কোনো লতা, থাকত কলাঝোপ-এক সারি পেঁপেগাছ কিংবা মানকচু। বেড়ায় থাকত রাঙচিতা-পলাশ-কাঁটামেহেদি-ঢোলকলমি-নিশিন্দা। এই সামান্য শ্যামলিমা প্রায়ই থাকত অত্যন্ত পরিচর্যাহীন, আগাছা তুলবার বালাই নেই, মাটিতে খুরপি চালানোর দরকার নেই, সার নেই, কীটনাশক নেই। আজ পশ্চিম এর নাম দিয়েছে 'ফুড ফরেস্ট', শহরের ভূমিক্ষয়-ভূগর্ভস্থ জলের তল এসবের জন্য তো বটেই, খাদ্যঘাটতি মেটাতেও এর জুড়ি নেই। ক্রান্তীয় অঞ্চলের ফরেস্ট গার্ডেনিং (বিভূতিবাবুর যুগলপ্রসাদ যা করত) দেখে রবার্ট হার্ট এই কনসেপ্টকে ইউরোপ-উত্তর আমেরিকায় জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। আমরা হয়তো অনেক কিছু শুরু করি, তারপর ভুলে যাই সারবস্তুটিকে, ভুলে যাই এর পেছনের আদর্শকে।
শেষের কথা
বিলেতে ন্যাশনাল ট্রাস্ট পুরোনো বাড়ি এবং তদসংলগ্ন বাগান সংরক্ষণ করে, ঐতিহাসিক ল্যান্ডস্কেপ সংরক্ষণ করে গার্ডেন ট্রাস্ট-কান্ট্রি গার্ডেন ট্রাস্ট, ব্রিটিশরা সংরক্ষণবাদী বলে। প্রচুর মানুষ সেই বাগানগুলোতে সাপ্তাহিকভাবে ভলান্টিয়ারের কাজ করেন, মাটি নিড়িয়ে দেন, আগাছা সাফ করেন, নাতি-নাতনিদের গাছপালা চেনাতে নিয়ে আসেন, সকলে মিলে হাঁটেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বাগানে কাজ করেন। বাগানবাড়ি বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাড়া দেয়া হয়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান হয়। আমাদের মতো দোআঁশ মাটি তো নয়, তাদের পাথুরে কিংবা কর্দম মাটির দেশ, সহজে ফসল ফলে না, শীতকালীন বর্ষণে-তুষারপাতে সব পচতে থাকে, তবু চেষ্টার ত্রুটি নেই। বাগানের জন্য মানুষ গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের জন্য যেমন বাগান। মানুষের পদচারণ, তার মানুষিক আবেগ-প্রেষণা-সহমর্মিতা-যত্ন ছাড়া বাগান টিকে থাকে না।
ঢাকার মতো জনবহুল শহরে ছাদবাগান একটি অত্যন্ত পজিটিভ ঘটনা, আমাদের হৃত বাস্তুসংস্থানকে এটি খানিকটা হলেও ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। স্থপতিরা উদ্যোগ নিলে ছাদে রীতিমতো সবজিখেতের বেড বসানো সম্ভব। মহল্লাকেন্দ্রিক পরিচয়কে আমরা বাড়িয়ে তুলতে পারি এলাকাভিত্তিক বাগান এবং খামারের কনসেপ্টকে চালু করে, বীজ-চারা-শৌখিন কৃষিপণ্য বিক্রির ছোট্ট পরিসর তৈরি করে। এতে রাষ্ট্র আর সমাজের দুর্বৃত্তায়ন কমবে। রিও ডি জেনেরিওর ফাভেলা এবং কিউবান পারসেলাগুলোর কমিউনিটি গার্ডেন থেকে আমাদের অনেক কিছু শিখবার আছে, দারিদ্র্য সেখানেও আছে, সন্ত্রাস সেখানেও উত্তুঙ্গ। আমাদের শহরে কত মানুষ আছেন, কায়িক পরিশ্রম করতে পারেন কিন্তু কাজ নেই। কত উদ্ভিদবিদ্যায় পারদর্শী মানুষ আছেন, কাউকে জানিয়ে যাবার নেই। কত শিশু-কিশোর আছে, জীবজগৎ সম্পর্কে সংবেদনশীল নয়, তারা জানেই না ব্যাঙ কিংবা বাদুড় কি সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ, কোনো কীটখোর পতঙ্গ তুচ্ছ নয়। এদের জন্য আমাদের নগর-পরিকল্পনায় উত্তর থাকতে হবে।
পাড়ার পুকুর ময়লা-আবর্জনায় ভরাট করে, নদী ভরাট করে আর দখল নিয়ে, বনভূমি-জলাভূমি ধ্বংস করে আমরা যে অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক অপচয় ঘটিয়ে চলেছি, তার বিপরীতে কিছু হওয়া দরকার। ভূগোলকীয় উষ্ণায়ন একটি অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের দিকে চলেছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো সমুদ্রতল থেকে সামান্যই উপরে, সেসব দ্বীপের যুবক-যুবতীরা পরম যত্নে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ রোপণ করছে সৈকতে। উষ্ণায়নের বিপর্যয় থেকে আমাদের এই বদ্বীপকে বাঁচাতে আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে–যে যেখানে দাঁড়িয়ে।
সুন্দরের অধিকার মানবিক অধিকার। বাগানঘেরা সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে যেতে মানুষ বরাবরই উদ্গ্রীব, নিজের দেশের সেসব পর্যটকের জন্য আমাদের কিছু তো করা চাই। সপ্তদশ শতকের কবি আব্রাহাম কাউলি লিখেছিলেন, 'হু দ্যাট হ্যাজ রিজন অ্যান্ড হিজ স্মেল, উড নট অ্যামং রোজেস অ্যান্ড জেসমিন ডোয়েল?' শহরের ধোঁয়ায় আকণ্ঠ নিমগ্ন মানুষকে কোনো বিকল্প কি আমরা দিতে পারি না? লাভায় ভাজা-ভাজা হয়েও বেঁচে রয়েছে পম্পেইয়ের বাগানকাঠামো, পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরেও চেরনোবিলে জেগে উঠেছে অন্ধ-উচ্ছল-নিবিড় বাগান। আর আমরা? নিম-শজনে-তুলসী-চিরতা-আকন্দ-বাসক-ভাঁট-ভৃঙ্গরাজ-নয়নতারা-থানকুনিতে জড়াজড়ি একটা কবিরাজি বাগানও কি আমরা করতে পারতাম না? এখনো কি পারি না?