সাইদা খানমের ক্যামেরা-জীবন
সাইদা খানম যখন ক্যামেরা হাতে নেন, তখন এ দেশে কোনো মেয়ের পক্ষে আলোকচিত্রী হওয়ার কথা চিন্তা করাও ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। ঢাকা তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হলেও এর চেহারা ছিল মফস্বল শহরের মতো। মেয়েরা তখন পথেঘাটে প্রকাশ্যে বের হতেন না। ঘোড়ার গাড়ির বন্ধ ঘেরাটোপে তাদের স্কুল-কলেজে যেতে হতো। সেই রকম একটি রুদ্ধ সময়ে ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে ঢাকা শহরের অলিগলি ঘুরে ছবি তুলতেন সাইদা খানম। তাকে ছবি তুলতে দেখে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করত, ঢিল ছুড়ে মারত। এসব তিনি কখনো গায়ে মাখতেন না। তবে দুঃশ্চিন্তা করবেন ভেবে এসব কথা বাড়ির কাউকে বলতেন না। যদিও বাড়িতে প্রগতিশীল আবহ ছিল। কাজেই বাড়ি থেকে বাধা আসেনি। খালা কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা নিজের ছবি তুলতে ও পরিবারের সদস্যদের ছবি তোলাতে পছন্দ করতেন। তিনি বাড়িতে ক্যামেরাম্যান ডেকে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিতেন। কালো কাপড়ে ঢাকা বিরাট ক্যামেরা; তার সামনে চকচকে লেন্স। সেই ক্যামেরা দেখে ভয় পেতেন সাইদা খানম। ক্যামেরা ভয় পাওয়া সেই শিশুটিই একদিন এ দেশের আলোকচিত্রের অগ্রপথিক হয়ে উঠলেন!
সাইদা খানমের আগেও এ দেশের কোনো কোনো নারী ছবি তুলতেন বলে জানা যায়। তবে সাইদা খানম তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম, তিনি পেশাদারি মনোভাব কিংবা গভীর অভিনিবেশ নিয়ে ছবি তুলে গেছেন। ফলে সাইদা খানমই পরিচিতি পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে। তার সময়ে দুই পাকিস্তানে তিনিই একমাত্র আন্তর্জাতিক নারী আলোকচিত্রী। বাংলাদেশের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী সাইদা খানমের ক্যামেরা।
পাবনা শহরে যে কয়েকটি শিক্ষিত পরিবার ছিল, সাইদা খানমের নানার পরিবার তাদের একটি। তার নানা খান বাহাদুর মুহম্মদ সোলায়মান সিদ্দিক [১৮৭৩-১৯৫৩] ছিলেন ডিভিশনাল স্কুল ইন্সপেক্টর। ব্রিটিশ আমলে তিনি মেয়েদের জন্য পাবনাতে স্কুল স্থাপন করেছিলেন। নারী সমাজের অগ্রগতির জন্য তিনি খান বাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন। তৎকালীন নদীয়া জেলায় তিনিই প্রথম মুসলমান গ্রাজুয়েট। সাইদা খানমের নানি সৈয়দা রাহাতুন্নেসা খাতুনের [সম্ভাব্য ১৮৮৩-১৯১৩] হারমোনিয়াম ছিল। নানির এই সংগীত অনুরাগ সম্ভবত সাইদা খানমের রক্তের ভেতর প্রবাহিত হয়েছে। তার নানির মায়ের মা বাংলা, আরবি, উর্দু, ফারসি ও নাগরি–এই পাঁচটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। মা হাসিনা খাতুনই [১৮৯৯-১৯৭৪] প্রগতিশীল ছিলেন। তিনি স্বদেশিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হিন্দু বান্ধবীরা তার মায়ের কাছে অস্ত্র রেখে যেতেন। সেই অস্ত্র ব্যাগে ভরে বন্ধু যোগমায়া ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়ে থানার সামনে দিয়ে নিরাপদে পাড় করে দিতেন।
সাইদা খানমের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর, নানাবাড়ি পাবনায়। তার পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ফুকুরহাটি গ্রামে। বাবা আবদুস সামাদ খাঁ ছিলেন সরকারি স্কুল পরিদর্শক। সাইদা খানমের শৈশব কাটে নানাবাড়িতে। সাইদা খানমের মায়ের বিয়ে হয় ১৩ বছর বয়সে। খালাদেরও বিয়ে হয়ে যায় অল্প বয়সে। স্বামীর বদলির চাকরির কারণে সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকতেন সাইদা খানমের মা। খালা কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকাও বাবার বাড়িতে থাকতেন বিয়ের পর। বড় মেয়ে হিসেবে সাইদা খানমের মাকে সংসারের সবকিছু দেখতে হতো। ফলে সাইদা খানমকে দেখাশোনা করতেন তার কবি খালা। কবি খালাই তার ডাকনাম রাখেন 'বাদল'। তাদের বাড়িতে কলকাতার প্রায় সব পত্র-পত্রিকাই আসত। এসব পত্রিকায় তার কবি খালার লেখাও থাকত।
সাইদা খানমের নানাবাড়ির একই পাড়ায় ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনদের বাড়ি। সুচিত্রা তখন 'রমা' নামের আড়ালে এক স্কুলপড়ুয়া তরুণী। সুচিত্রা বয়সে সাইদা খানমের ছয় বছরের বড়। তাই রমাকে তিনি দিদি বলে ডাকতেন।
একটি শিক্ষিত, সংস্কারমুক্ত ও সাংস্কৃতিক পরিবারে বড় হওয়ায় সাইদা খানমের মানস গঠনে পূর্ণতা পেয়েছিল। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বড় ভাই আবদুল আহাদ [১৯ জানুয়ারি ১৯১৮-১৫ মে ১৯৯৪] ছিলেন একজন কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ ছাত্র। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শমতো তিনি ঢাকায় এসে বেতারকেন্দ্রে সংগীত প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা' গানটির স্বররিপি বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ড থেকে অনুমোদন করে আনেন। বড় বোন মোহসেনা আলী লিলি [১৯২১-২১ জুন ২০১৯] ছিলেন সেই সময়ের নারী চিত্রশিল্পীদের একজন। মেজ বোন হামিদা খানম [২ জানুয়ারি ১৯২৩-১৮ মার্চ ২০১১] প্রথম মুসলমান নারী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এমএ পাস করেন। তিনি ঢাকার হোম ইকোনমিকস কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ছিলেন। বিবাহসূত্রে তিনি বরেণ্য ইতিহাসবিদ ড. এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদের স্ত্রী। আরেক ভাই আবদুল ওয়াহেদ খান [১৯২৯-২০০৪] দ্বিতীয় মুসলমান ছাত্র, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় ফার্স্ট ক্লাস পান। পেশাগতভাবে তিনি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি চিফ কনজারভেটর ছিলেন। সেজো বোন মমতাজ খানম [২৬ জানুয়ারি ১৯৩২] ঢাকা বিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করে শিক্ষকতায় যোগ দেন। তার পরিবারে তিনসহ পাঁচজন রাষ্ট্রীয় পদকে সম্মানিত। তার খালা ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৭৭ সালে একুশে পদক পান। বড় ভাই সাংস্কৃতিক অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে 'তমঘা-ই-ইমতিয়াজ', ১৯৬৯ সালে 'সিতারা-ই-ইমতিয়াজ' এবং ১৯৭৮ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য মেজ বোন ১৯৬৯ সালে 'প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড' পান। আলোকচিত্রের অগ্রপথিক হিসেবে ২০১৮ সালে সাইদা খানমও একুশে পদক পান।
প্রথম ক্যামেরা
সাইদা খানম প্রথম ক্যামেরা হাতে পান ১৯৪৯ সালে ১২ বছর বয়সে, কামরুন্নেসা স্কুলের প্রধান শিক্ষক লুৎফুন্নেসা চৌধুরীর কাছ থেকে। লুৎফুন্নেসা ছিলেন সাইদা খানমের মেজ বোন হামিদা খানমের বন্ধু। তিনি ছবি তুলতেন। কিন্তু বান্ধুবীর ছোট বোনের ছবি তোলার আগ্রহ দেখে লুৎফনন্নেসা তার কোডাকের বক্স ক্যামেরাটা সাইদা খানমকে উপহার দেন। সেই ক্যামেরা দিয়ে কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে সাইদা খানম প্রথম ছবি তোলেন দুইজন কাবুলিওয়ালার।
কিন্তু বক্স ক্যামেরায় ছবি তুলে তার মন ভরত না। চেনাজানা বা পরিচিতজনের কাছ থেকে ভালো ক্যামেরা চেয়ে এনে ছবি তুলতেন, এতে সবাই যে খুশিমনে দিতেন, তা-ও না। এ নিয়ে প্রায় তার মন খারাপ হতো। বিষয়টি তার মেজ বোন লক্ষ করলেন। তিনি পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় ছোট বোনের জন্য একটা রোলিকর্ড ক্যামেরা নিয়ে আসেন। সেই ক্যামেরাটাই ১৬ বছরের কিশোরী মেয়েকে ফটোগ্রাফির দিকে আরও বেশি আগ্রহী করে দেয়।
সাইদা খানম একবার কলকাতায় গেছেন, সেখানে তখন 'লাইফ' শিরোনামে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী হচ্ছিল। দেওয়ালে টাঙানো বিশাল ফ্রেমে মানুষের সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো যেন বাস্তব–আমেরিকান ফটোগ্রাফারদের তোলা ছবিগুলো দেখে অভিভূত হয়ে যান সাইদা খানম। প্রদর্শনী দেখতে দেখতে তার মনে হলো আলোকচিত্র শুধু নেহায়েত ছবি নয়, জীবনের ছবিও।
তোপখানা রোডে 'জায়েদী ফটোগ্রাফার্স' বলে একটা বিখ্যাত স্টুডিও ছিল। সাইদা খানম সেই স্টুডিওতে নিয়মিত ছবি প্রিন্ট করতে যেতেন। স্টুডিওর মালিক ছিলেন ক্যাপ্টেন এ এইচ এম জায়েদী। তিনি অবাঙালি ছিলেন। জায়েদী সাহেব একদিন সাইদা খানমের কম্পোজিশন দেখে মুগ্ধ হন। যাতে আরও ভালো ছবি তুলতে পারেন, সে জন্য জায়েদী সাহেব তাকে কিছু বিদেশি ম্যাগাজিন দেন। ছবির কম্পোজিশন দেখতে বললেন। ছবির নিচে যে সার্টার স্পিড, অ্যাপারচার আর আইএসও লেখা আছে; তা ভালোভাবে খেয়াল করতে বললেন। ফটোগ্রাফিবিষয়ক প্রবন্ধগুলো ভালোভাবে পড়ার পরামর্শ দেন। বিদেশি ম্যাগাজিনের ছবিগুলো দেখে সাইদা খানমের মধ্যে ছবি তোলার নানা কৌশল নিয়ে চিন্তা শুরু হয়: রোদ কখন আসবে, কখন চলে যাবে; গাছের ছায়াটা কোথায় পড়বে। অপেক্ষা করতেন ম্রিয়মাণ আলোর জন্য। ছবি তুলে ফিল্ম নিয়ে ছুটতেন জায়েদীর স্টুডিওতে। জায়েদী সাহেব সাইদা খানমের একটা ছবি এনলার্জ করে ১৯৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম নিখিল পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে পাঠান। ছবিটি প্রথম পুরস্কার জেতে। দুই বছর পর ১৯৫৬ সালে জায়েদী সাহেব আরেকটি ছবি প্রিন্ট করে জার্মানির কোলনে পাঠান। ছবিটি কোলন আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র ও সিনেমা প্রদর্শনীতে পুরস্কার পায়। জায়েদী সাহেবের এই ঋণের কথা সারা জীবন স্বীকার করে গেছেন সাইদা খানম। পাকিস্তানের ঝিলাম নদীতে পাহাড়ি ঢলে জায়েদী সাহেবের আকস্মিক ও অকাল মৃত্যু হয়।
বেগমের যুগে
দেশভাগের পর স্বনামধন্য ও জনপ্রিয় বেগম পত্রিকাটি কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসে। বেগমের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে তার কবি খালার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনিই একদিন সাইদা খানমকে বেগম পত্রিকা অফিসে নিয়ে গিয়ে নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আলোকচিত্রী শুনে তো নাসিরউদ্দীন মহাখুশি। ছবি দেখে বললেন, 'তুমি বেগমের প্রচ্ছদের জন্য আর মেয়েদের বিভিন্ন সভা, খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ছবি তুলে দেবে।' সেদিন নাসিরউদ্দীনের কথা শুনে তার মনে হলো, তিনি নিজেকে প্রকাশ করার একটা জায়গা পেলেন এতোদিনে।
বেগমের প্রচ্ছদে ও ভেতরের পাতায় ছাপা হতে লাগল তার তোলা পোর্ট্রেট আর প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। বেগম পত্রিকা তখন বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে যেতে শুরু করেছে। বেগমের জন্য ছবি তুললেও সাইদা খানমের মনে হতো, এটা তার সোশ্যাল ওয়ার্ক হচ্ছে। এই যে ছবি তুলে নারীদের মধ্যে একটা জাগরণ সৃষ্টি করতে পারছেন; এতে তার একটা অন্য রকম আনন্দ হতো।
১৯৫৬ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে বেগমের সঙ্গে যুক্ত হন সাইদা খানম। তিনি যখন বেগমের জন্য ছবি তুলতে শুরু করেন, তখন পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশে পেশাদার ফটোসাংবাদিকতাই শুরু হয়নি। কোনো দৈনিক পত্রিকারও তখন নিজস্ব ফটোসাংবাদিক ছিল না। সাইদা খানম আমৃত্যু বেগমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত এমন কোনো পত্রিকা নাই, যেখানে সাইদা খানমের ছবি ছাপা হতো না।
বাস্তবের রানি
ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ প্রথমবার ঢাকায় আসেন ১৯৬১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। এক মাস আগে রানির ঢাকা আগমনে সংবাদ সাইদা খানমের চোখে ঘুম কেড়ে নিল। প্রেস ফটোগ্রাফার ছাড়া তো রানির ধারেকাছেও যাওয়া সম্ভব না। সাইদা খানম 'বেগম'-এর সম্পাদক নূরজাহান বেগম ও সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে বললেন, একটা নিরাপত্তা পাসের ব্যবস্থা করে দিতে। তারা তার যোগ্যতা সম্পর্কে একটা সার্টিফিকেট লিখে দিলেন। সেই সার্টিফিকেট নিয়ে সাইদা খানম গেলেন সচিবালয়ের ইনফরমেশন বিভাগে। অনেক ঘোরাঘুরির পর প্রেস কার্ড হাতে পেলেন। কার্ড পেয়ে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য গেলেন দেশের আরেক বিখ্যাত আলোকচিত্রী গোলাম কাসেম ড্যাডির বাড়িতে। ড্যাডি তাকে সাহস দিলেন।
সময়মতো তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে গিয়ে দেখেন ৯০ জন প্রেস ফটোগ্রাফারের মধ্যে তিনিই একমাত্র শাড়ি পরা বাঙালি মেয়ে। তার কাঁধে দুটি ক্যামেরা ও একটি ব্যাগ। বিমান যখন এসে নামল, দিনের আলো তখন ম্লান হয়ে এসেছে। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে রানি লাল গালিচার ওপর নেমে আসতেই ঝাঁকে ঝাঁকে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলকে উঠল। কিন্তু সাইদা খানমের ফ্ল্যাশ জ্বলল না। কান্না পেয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তখনই বুদ্ধিটা মাথায় এল। দ্রুতগতিতে অন্য ক্যামেরায় হাইস্পিড ফিল্ম ভরে দুরু দুরু বুকে ছবি তুলে গেলেন। পরে দেখলেন, বিনা ফ্ল্যাশে তোলা তার সব কটি ছবিই ভালো হয়েছে।
'রমনা গ্রীন'-এ অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে বাজি পোড়ানো হচ্ছে। আকাশে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ আলোর ফুলঝুরি ঝলসে উঠে শত খণ্ড হয়ে ঝরে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে রানি মুগ্ধ দৃষ্টিতে হাসলেন। আতশবাজির রঙিন আভা রানির চোখে-মুখে। অপূর্ব দেখাচ্ছিল তাকে। এ রকম একটি অবিস্মরণীয় মুহূর্তের ছবি তুললেন সাইদা খানম।
পরের দিন রানি বের হলেন নৌভ্রমণে। রানি যে স্টিমারে যাচ্ছিলেন, তার পাশের লঞ্চে ছিলেন সাইদা খানম। নদীর দুই তীরে অগণিত মানুষ হাত নেড়ে, ঢোল বাজিয়ে রানিকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। রানিও হাত নাড়ছেন মাঝেমধ্যে। ভ্রমণ শেষে রানি যান আদমজী জুট মিলে। সেখানে একটা বিশেষ জায়গা বেছে নেন; যেখান থেকে রানিকে ক্লোজে ধরা যাবে। রানি তার সামনে দিয়েই হেঁটে গেলেন। এত কাছ থেকে ছবি তুলতে পারবেন, ভাবতেও পারেননি সাইদা খানম। বিদায়ের আগের দিন রানিকে অন্য মাধুর্যে ক্যামেরাবন্দী করলেন সাইদা খানম। রাতে গভর্নর হাউসে রানির ডিনার পার্টি। রানির হুডখোলা গাড়ি ধীরে ধীরে সামনের দিকে আসছে। রানি মাথায় হীরা বসানো সরু রাজকীয় মুকুট আর গলায় হীরার নেকলেস। ছবি তুললেন সাইদা খানম।
সত্যজিৎ রায়ের দেখা
চিত্রালীর প্রতিনিধি হয়ে ১৯৬২ সালে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম সাক্ষাৎকার নেন সাইদা খানম। সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে সাইদা খানম চিত্রালীর সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজকে বললেন, 'কলকাতায় যাব। সত্যজিৎ রায়ের একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই।' এস এম পারভেজ এতে খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। শুধু মিটমিট করে হাসলেন। সাইদা খানম কলকাতায় গিয়ে বন্ধুদের কাছে শুনলেন, সত্যজিৎ খুবই দাম্ভিক আর রাশভারী মানুষ। বেশি কথা বলেন না; ছবিও তুলতে দেন না। শুনে মনটা দমে গেল। তারপরও আশা-নিরাশার মাঝে দুরু দুরু বুকে ফোনের ডায়াল ঘোরাতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে গম্ভীর এক কণ্ঠস্বর। পরিচয় দিতেই সত্যজিৎ দুই দিন পর সময় দিলেন।
হেমন্তের শেষ বেলায় সত্যজিৎ রায়ের লেক টেম্পল রোডের তিনতলা বাড়িতে হাজির হলেন সাইদা খানম তিনদিন পর। দেখলেন, ঘরের দরজাটা একটুখানি ফাঁকা। সাদা শাল জড়িয়ে সত্যজিৎ লিখছেন। সত্যজিৎকে দেখে ঘাবড়ে গেলেন তিনি। ভাবলেন, বিশ্ববিখ্যাত এই পরিচালকের সাক্ষাৎকার নিতে আসেন দেশ-বিদেশের নামীদামি সাংবাদিকেরা। সেই তুলনায় তিনি অতি নগণ্য। সত্যজিৎ তার উপস্থিতি টের পেয়ে তাকে ঘরে আসতে বললেন। একনজর দেখে 'বসুন' বলেই আবার লেখায় ডুবে গেলেন। কয়েক মিনিট পর মুখ তুলে তাকালেন। মেয়েটি যে নার্ভাস, বুঝে গেছেন সত্যজিৎ। জিজ্ঞাসা করলেন, 'আমার সম্পর্কে কী জানতে চান আপনি?'
সত্যজিতের সহজ প্রশ্নে সাইদা খানমের আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। সাইদা খানম পথের পাঁচালী বা অন্য কোনো প্রসঙ্গ তুললেন না। সত্যজিৎ রায় কয়েক দিন আগে কাঞ্চনজঙ্ঘার শুটিং শেষ করে দার্জিলিং থেকে ফিরে এসেছেন। সাইদা খানম বুদ্ধি করে বললেন, 'আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির কাহিনি শুনতে চাই। সত্যজিৎ ধীরে ধীরে কাহিনি বলতে শুরু করলেন। সেই কাহিনির ভেতর থেকে প্রশ্ন বের করে আবার প্রশ্ন করেন। এভাবে আলোচনা এগোতে থাকে। সাক্ষাৎকার নেওয়া শেষে ছবি তোলার অনুমতি চাইলেন। তিনি কোনো আপত্তি তো করলেন না, বরং খুশি হয়ে বললেন, 'এ লাইনে আমাদের দেশের মেয়েরা একেবারেই আসে না।'
ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ছবি তুলতেই একটা ঘটনা ঘটে যায়। ফ্লাশের আলো ঝলকে উঠতেই অঘটন ভেবে ঘরের ভেতর ছুটে আসেন সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়। সাইদা খানমকে ছবি তুলতে দেখে তিনি হেসে ফেলেন। সত্যজিৎ তার স্ত্রীর সঙ্গে সাইদা খানমের পরিচয় করিয়ে দেন। কিছুক্ষণ আলাপেই সাইদা খানমের কাছে বিজয়া রায় হয়ে ওঠেন মঙ্কুদি। চা খাওয়ার পর সত্যজিতের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। বিজয়া রায় এলেন সিঁড়ি পর্যন্ত। বললেন, 'এখন থেকে আর অ্যাপয়নমেন্ট করে আসার দরকার নাই। যখন কলকাতায় আসবে, সময় করে চলে আসবে।' সেই থেকে সত্যজিতের বাড়ির দরজা সাইদা খানমের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।
সাইদা খানম সত্যজিৎ রায়ের 'চারুলতা', 'মহানগর' ও 'কাপুরুষ মহাপুরুষ'--এই তিনটি ছবির শুটিং দেখেন। চারুলতা শুটিংয়ের সময় বেশ কড়াকড়ি ছিল। সত্যজিৎ তখন শুটিং ফ্লোরে কোনো সাংবাদিককে ঢোকার অনুমতি দিতেন না। শুধু সাইদা খানম ও ব্রিটিশ এক চিত্রশিল্পীকে ফ্লোরে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন। সাইদা খানম সত্যজিৎকে ডাকতেন 'মানিকদা' বলে। আর সত্যজিৎ তাকে ডাকতেন 'বাদল' নামে। সত্যজিৎ এরপর সাইদা খানম কোনো ছবি তুলতে চাইলে কখনোই না করেননি। সাইদা খানম যখন যেভাবে চেয়েছেন, ছবি তুলতে দিয়েছেন।
সত্যজিৎ যখন অস্কার জেতেন, তখন কলকাতায় তার সঙ্গে দেখা করতে যান সাইদা খানম। কলকাতা পৌঁছার পরদিন তিনি সত্যজিতের বাড়িতে যান। নিশ্চুপ বাড়ি। বিজয়া রায় সবে বেলভিউ নার্সিং হোম থেকে ফিরেছেন। ক্লান্ত, বিষণ্ন; নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছেন। দু-এক দিন পরপর সাইদা খানম তার মঙ্কুদির কাছে যেতেন। ক্লান্ত মঙ্কুদি যখন ঘুমিয়ে পড়তেন, তখন সাইদা খানম তার মানিকদার ঘরে গিয়ে একবার ঘুরে আসতেন। ঘরে ঢুকলেই তার মনে হতো, এখনই আসবেন মানিকদা। একদিন দেখলেন, জানালার ফাঁক গলে শূন্য সোফার উপর সূর্যের আলো এসে পড়ছে। ক্যামেরায় হাত দিতেই তার মনে হলো–'মানিকদা বলছেন, আর কত ছবি তুলবে, বাদল?'
সত্যজিতের অন্তিম সময়ে সাইদা খানম বিজয়া রায়কে বললেন, 'আমি কী একবার মানিকদাকে দেখার সুযোগ পেতে পারি?' বিজয়া রায় বললেন, 'কাল সকালে তোমাকে নিয়ে যাব। তবে তোমাকে যদি চিনতে না পারে দুঃখ পেও না। কারণ, মানিক তার এক ঘনিষ্ট বন্ধুকেও চিনতে পারেনি।' ইনটেনসিভ কেয়ারে কান্নাভরা মন নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন সাইদা খানম। বিজয়া রায় বললেন, 'দেখো, বাদল এসেছে।' সত্যজিৎ রায় বড় করুণ আর ক্ষীণ স্বরে বললেন, 'কেমন আছো বাদল?' সাইদা খানম তার মানিকদার হাতটা স্পর্শ করলেন। ঠান্ডা হাত।
চাঁদের দেশের নভোচারী
পৃথিবীর সব মানুষকে স্তম্ভিত করে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই তিন নভোচার–নিল আর্মস্টং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স চাঁদে অবতরণ করেন। সবাইকে চমকে দিয়ে আচমকা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক ঝটিকা সফরে হাজির হলেন এই তিন নভোচারী। তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ফুল নিয়ে রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। পুরান ঢাকার সরু রাস্তার ভেতর দিয়ে তাদের হুডখোলা গাড়ি চলল ধীরগতিতে। ফুলের বৃষ্টি ঝরে পড়ে তাদের ওপর। বিকেলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাদের সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়। বেগমের প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে সাইদা খানম ঢোকেন সেই অনুষ্ঠানে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ছবি তোলেন। ছবি তোলা শেষে বাইরে এসে দেখেন, মাইকেল কলিন্স গাড়িতে একা বসে আছেন। হাতে একটা গোলাপ ফুল। বিষয়টি তার কাছে অবাক লাগে। সাইদা খানম একমুহূর্তও দেরি না করে ছবিটা তুললেন। দুর্লভ এক ছবি হলো।
ছবি নিয়ে হইচই
একবার বেগমের প্রচ্ছদে ব্লাউজ ছাড়া এক মেয়ের ছবি ছেপে সাইদা খানম চারদিকে হইচই বাধিয়ে দেন। স্নান-পোশাকে মেয়েটির একটি পোর্ট্রেট তুলেছিলেন তিনি। সাইদা খানম তখন পুরান ঢাকার ১০ নম্বর জয়নাগ রোডে একটি বাড়িতে থাকতেন। মেয়েটি সাইদা খানমদের বাসার গৃহকর্মী ছিল। পাশেই একটি বস্তিতে থাকত। বেগমে ছবিটি ছাপা হওয়ার পর বিষয়টি এ-বাড়ি, ও-বাড়ি হয়ে পুরো মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে। বস্তির লোকজন তার বাড়ি ঘেরাও করে বসে। বিক্ষোভকারীদের কথা–'কত বড় সাহস, নারীকে বে-আব্রু করে ছবি তুলে আবার পত্রিকায় ছাপায়!' পরে সাইদা খানমের বোনজামাই অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ অনেক কষ্টে পরিস্থিতি সামাল দেন। তিনি উত্তেজিত লোকজনকে বোঝাতে সক্ষম হন, 'যার ছবি ছাপা হয়েছে, সে আমাদেরই গৃহকর্মী মেয়ে এবং তার অনুমতি নিয়েই ছবিটি তোলা হয়েছে।'
বাকরুদ্ধ কবি
কলকাতার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাড়িতে ছবি তুলতে যান। পাইকপাড়ায় ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে বড় ছেলে সব্যসাচী কাজীর কাছে থাকতেন কবি। কবির স্ত্রী প্রমীলা দেবীও থাকতেন কবির সঙ্গে। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই মনটা ভারাক্রান্ত হলো সাইদা খানমের। কবির মুখে ভাষা নেই, বিষণ্ন চেহারা; আপন মনে কাগজ ছিঁড়ছেন। জানালার এক পাশের বিছানায় কবি বসে আছেন, আরেকটা বিছানায় অর্ধশায়িত প্রমীলা দেবী। পাশে একটা ঝুড়িতে তরকারি, ছুরি আর গামলা। প্রমীলা দেবীর বিছানার কাছের মোড়াতে বসেন সাইদা খানম। আলাপ-পরিচয়ের পর ছোটখাটো কয়েকটা প্রশ্ন করেন। এরপর ছবি তোলেন। এমন জায়গা থেকে ক্যামেরাটা ধরেন যেন দুজনকে একই ফ্রেমে পাওয়া যায়। চলে আসার সময় সাইদা খানম প্রমীলাকে প্রশ্ন করেন, 'কবির সঙ্গে এক ঘরে থাকতে আপনার কি অস্বস্তি লাগে?' প্রমীলা দেবী একটু হেসে বললেন, 'না। ওর অন্তরের একটা জায়গায় এখনো আমার অস্তিত্ব আছে। ওর যখন খিদে পায়, তখন আমার কাছে এসে বসে। আমি নিজ হাতে ওকে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিই।'
জয়নুলের ভিন্ন রূপ
সাইদা খানম ক্যামেরা নিয়ে প্রায়ই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বাসায় যেতেন যদি সৌভাগ্যক্রমে কোনো দুর্লভ ছবি তুলতে পারেন, এই আশায়। শুধু ছবি তুলতেই নয়, জয়নুলের কথা শুনতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন সাইদা খানম। তিনি সাইদা খানমকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখতেন। সাইদা খানম ছবি তুলতে গিয়ে প্রায়ই দেখতেন শিল্পাচার্য নিবিষ্ট মনে ছবি এঁকে চলেছেন। শিল্পীর ঘোর না ভেঙে, কোনো রকম বিরক্ত না করে নিজের মতো করে ছবি তুলতেন সাইদা খানম। একদিন বিকেলে শিল্পাচার্যের বাসায় গিয়ে দেখেন, তিনি তার পোষা গরুকে নিজ হাতে ঘাস খাওয়াচ্ছেন। সাইদা খানমও পেলেন এমন মুহূর্ত ধারণের সুযোগ।
মুক্তিযুদ্ধের দলিলচিত্র
১৯৭১ সালে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রস্তুতি। তখন নারীদের মধ্যে একটা প্রচণ্ড জাগরণ তৈরি হয়। মার্চ মাসে ঢাকার আজিমপুর গার্লস স্কুল মাঠে যখন মেয়েদের অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণ শুরু হয়, তখন সাইদা খানম তার প্রিয় ক্যামেরা নিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হন। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের প্রমাণ হিসেবে সেসব ছবি এখন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে আছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ৯ মাসের অভিজ্ঞতা ছিল অন্য রকম। ১৬ ডিসেম্বরের আগপর্যন্ত সমস্ত ঢাকা শহর পরিণত হয়েছিল একটা মৃত্যুপুরী উপত্যকায়। যাকে ইচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। গুলি করে লাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে বুড়িগঙ্গায়।
৯ মাসের বিভীষিকার পর ১৬ ডিসেম্বর খুব ভোরে লেপের তলায় ঢেকে রাখা রেডিওতে যখন শুনতে পেলেন 'আমরা স্বাধীন'; দুপুরের দিকে লোকমুখে শুনলেন, রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করবে পরাজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সাইদা খানম তখন থাকতেন ইস্কাটন গার্ডেন রোডে বড় ভাইয়ের বাসায়। উত্তেজনায় ক্যামেরা না নিয়েই বেড়িয়ে পড়েন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে এসে দেখেন রাস্তায় ইন্ডিয়ান ট্যাংক দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধারা ট্রাকের উপর অস্ত্র উঁচিয়ে বিজয়োল্লাস করছে। নারী, পুরুষ আর শিশুদের ভিড়। সবাই পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যদের স্বচক্ষে দেখতে চায়। চারদিকে একটা উৎসব উৎসব ভাব। সাইদা খানম আবার বাসায় গেলেন ক্যামেরা আনতে।
দ্বিতীয়বার যখন বের হয়ে ইন্টারকন্টিনেটালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন; এদিক-ওদিক ঘুরে রোলিকর্ড ক্যামেরায় তুললেন মুক্তিকামী মানুষের বেশ কিছু বিজয়োল্লাসের ছবি। অস্ত্র হাতে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধার ছবিও তুললেন।
যুদ্ধের পর
উদ্যমী সাইদা খানম কেবল আলোকচিত্রী হিসেবে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি; মানবতার সেবায়ও তিনি নিজেকে বিস্তৃত রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর নার্স-সংকট দেখা দিলে গাইড রেঞ্জারদের নিয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী নার্সিংয়ের কাজ করেন। হাসপাতালে ছিল আহত কিশোর-কিশোরী আর নারীরা। গুলি, গ্রেনেড আর মাইনের আঘাতে তারা আহত। কারও পা নেই, কারও হাত উড়ে গেছে। একদিন দেখলেন হুইলচেয়ারে বসে এক কিশোর ক্র্যাচ তৈরি করা দেখছেন। এই দৃশ্যের ছবি তুলতে গিয়ে তার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। ১৬ ডিসেম্বরের পর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে পিজি হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো ভরে যায়। এসব মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগই ছিল শিক্ষিত তরুণ। সে সময়ে পিজির পরিচালক ছিলেন ডা. নূরুল ইসলাম। তিনি সাইদা খানমের পরিচিত ছিলেন। সাইদা খানম তাকে বললেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কী ধরনের সাহায্য করতে পারি?' তিনি বললেন, 'খাবার পানির তীব্র সংকট। তখন তিনি আর আলেয়া ফেরদৌসী ভিকারুননিসা নূন স্কুলের কয়েকজন ছাত্রীকে নিয়ে একটা স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করেন। মাটির কলসিতে পানি ভরে রিকশায় করে তারা হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। আহত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছে বিপ্লবের বই চাইতেন। তাদের চোখে-মুখে ছিল স্বাধীনতার আনন্দ।
অশ্রুসিক্ত মাদার তেরেসা
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অবাঞ্ছিত শিশুদের দেখার জন্য মাদার তেরেসা ১৯৭৩ সালে ঢাকায় এসেছিলেন। এক সকালে ক্যামেরা নিয়ে সাইদা খানম ছুটলেন; পুরান ঢাকার খ্রিষ্টানদের আশ্রমকেন্দ্রে গিয়ে দেখেন মাদার তেরেসা তেজগাঁওয়ের বটমলী হোমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গাড়ি দাঁড়িয়ে। মাদার তেরেসাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে গভীর শ্রদ্ধায় মহীয়সীর পা ছুঁয়ে সালাম করে ছবি তুললেন সাইদা খানম। দু-একটা ছবি তোলার পর মাদার তেরেসা হঠাৎ সাইদা খানমকে তার গাড়িতে উঠতে বলেন। এ ঘটনায় সাইদা খানম শুধু বিস্মিতই হননি, আনন্দ আর ভালো লাগায় তাঁর মন ভরে ওঠে। আশ্রমে পৌঁছে মাদার তেরেসার সত্যিকার রূপটা দেখতে পান তিনি। অসহায় শিশুদের অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বুকের মধ্যে চেপে ধরেন। বিকলাঙ্গ এক বালককে আদর করেন গভীর মমতায়। খাটে শোয়া শিশুদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটান। বটমলী হোমে অসহায় শিশুদের দুরবস্থায় অশ্রুসিক্ত, বেদনাহত মাদার তেরেসার আবেগটা ক্যামেরায় ধারণ করলেন সাইদা খানম।
টুকরো টুকরো
স্মৃতি শান্তিনিকেতনে গিয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুর ছবিও তুলেছেন সাইদা খানম। এ ছাড়া তিনি ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ব্রিটিশ অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন, লেডি ব্যাডেন পাওয়েল, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বিপ্লবী সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি মৈত্রেয়ী দেবী, অভিনেত্রী অরুন্ধতী মুখার্জি, অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, অভিনেত্রী চন্দ্রবতী দেবী, অভিনেত্রী ছায়াদেবী, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়, অভিনেত্রী নমিতা সিনহা, অভিনেতা হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়, কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কবি শামসুর রাহমান, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, শিক্ষাবিদ ড. নীলিমা ইব্রাহিমসহ অসংখ্য খ্যাতিমানের মুখছবি ক্যামেরায় ধরে রেখেছেন।
দেরি করে শুরু
সাইদা খানমের শিক্ষাজীবনটা বেশ অদ্ভুত। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় একটু দেরি করে। ছোটবেলায় অসুস্থ থাকতেন বলে বাড়ির কেউ তাকে পড়াশোনার জন্য চাপ দিতেন না। অসুস্থতার কারণে ক্লাসে বসে পাঠ গ্রহণ করা তার পক্ষে কঠিন ছিল। প্রাইভেট পরীক্ষা দিতে দিতেই তিনি মেট্রিক পাস করেন। ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ক্লাস করতে পারতেন না বলে সময়মতো ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে পারলেন না। পরের বছর প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করলেন। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর তার মেজ বোন হামিদা খানম বললেন, 'আইএ পাস করছ, এখন বিএ পাস না করলে কেউ সম্মান করবে না।' পরে তিনি আবার প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করলেন। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করলেন। পরবর্তী সময়ে তার শখ হলো গ্রন্থাগারবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার। ফলে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবারও লাইব্রেরি সায়েন্সে স্নাতকোত্তর করলেন।
১৯৭৪ সালে তিনি দুই শ টাকা বেতনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আবদুল হাই স্মৃতি পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন সাইদা খানম।
সামাজিক ধ্যান-ধারণাকে মূল্য না দিয়ে তিনি নিজের ইচ্ছা আর আকাক্সক্ষাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। জীবনের পুরো সময় তিনি ব্যয় করেছেন ফটোগ্রাফি, লেখালেখি আর ভ্রমণের পেছনে। বিয়ে করেননি, বিয়ে না করার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, 'এর কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। ফটোগ্রাফারদের মধ্যে অনেকেই বিয়ে করেনি। আমি করিনি। আমানুল [আলোকচিত্রী আমানুল হক] করেননি, নওয়াজেশও [আলোকচিত্রী ড. নওয়াজেশ আহমদ] করেনি।' মাঝে মাঝে রসিকতা করে বলতেন, 'ক্যামেরাকে খুব ভালোবাসলে কারও সংসার হয় না।'
৮২ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের ৭০ বছর তিনি ক্যামেরা নিয়ে মেতেছিলেন। হুইলচেয়ারে চলাফেরার সময়ও তার হাতে ক্যামেরা থাকত। অসুস্থ শরীরে প্রকৃতি কিংবা সুন্দর কোনো মুখের ছবি তুলতে পারলে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত।
সাইদা খানম প্রথম পুরস্কার পান ১৯৫৪ সালে। নিখিল পাকিস্তান আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তার 'শান্তির দূত' ছবিটি ১৯৮৫ সালে জাপানে ইউনেসকো পদক পায়। এর আগে আলোকচিত্রশিল্পে অনন্য অবদানের জন্য সাইদা খানম ২০১৯ সালে একুশে পদক পান। আগের বছর এশিয়ার সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র উৎসব–নবম ছবিমেলায় আজীবন সম্মাননা পান। এ ছাড়া তিনি দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে অসংখ্য সম্মাননা পান।
২০২০ সালের ১৮ আগস্ট এক শরতের রাতে মৃত্যু হয় এই দেশবরেণ্য আলোকচিত্রীর।
লেখক: আলোকচিত্রশিল্পী ও গবেষক।
তথ্যসূত্র
স্মৃতির পথ বেয়ে, সাইদা খানম, প্রকাশক: যুক্ত, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১০
আলোকচিত্রী সাইদা খানমের উপন্যাসত্রয়ী, প্রকাশক: যুক্ত, প্রথম সংস্করণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৫
ঝরা বকুলের গন্ধ: স্মৃতি-আলেখ্য, হামিদা খানম, প্রকাশক: সাহিত্য প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১
কথার ঘরবাড়ি [একটি সাক্ষাৎকার সংকলন], নিশাত জাহান রানা সম্পাদিত, প্রকাশক: যুক্ত, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃষ্ঠা: ১২১-১৫৬
আমাদের ছায়াতরুগণ, মতিন রায়হান, প্রকাশক: সময় প্রকাশন, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা: ১৭২-১৭৬